অমলেন্দু চন্দ
জীবনানন্দ প্রসঙ্গে টুকরো কথা
উত্তর রবীন্দ্র যুগে জীবনানন্দ কতটা বিরাট প্রতিভা ছিলেন কতটাশ্রেষ্ঠত্তের অধিকারী ছিলেন কতবড় কবি ছিলেন এসব বিচার অনুভূতির আভাষ এখনো প্রায়শই বিবেচিত – তবে তার কতটা জীবনানন্দের কাব্য চেতনার অনুভব থেকে আসা আর কতটা প্রয়োজনের হুজুগ – এসব প্রশ্ন এলেই মনে মনে তর্জনী তুলে শাষাই – এক পা যদি এগোস তবে আর, ওই চেয়ে দেখ ভীষণ তলোয়ার। ফলে প্রশ্নর দৌরাত্মি মাঠে মারা পড়ে আর মন খোঁজে সটীক উত্তর।
লোকে বলে বাঙালি কবির জাত। মিথ্যা কথা। জীবনানন্দের কবিতার পড়ে মনে হয় – কবি কই? কবিতা অনেক। কারুকে ছোটো করছি না, আসলে এটাই সম্ভবত জীবনানন্দময়তা আমাদের কাব্য চেতনায়। রবীন্দ্রনাথ কতো সহজে বহির্বিশ্ব কে মহা জগতকে বিশ্বচেতনাকে জড়িয়ে নিয়েছেননিজের চেতনার আঙিনায় সে রূপের সে বোধের প্রশান্তির অনায়াস স্বাচ্ছন্দে আমরা ভেসেছি । আর জীবনানন্দ প্রগাঢ় অন্তর্লীন স্পর্শাতুর মায়াতুলির আঁচড়ে ছবি এঁকেছেন অনবদ্য অনাময় সঞ্চরণশীলতায় – আমরা ডুবেছি।
জীবনানন্দের রুপচেতনা বিচ্ছিন্ন অনুভূতির মতো নয় , মনের ভীষণ গোপন নিভৃতিতে তাঁর শব্দের রূপকল্প এক অভিন্ন অচ্ছেদ্য সমান্তরাল জগত গড়ে তোলে - এই সমান্তরাল জগতের প্রতিভাস তাঁর কবিতার প্রতীতি - প্রতিটি শব্দের স্বরূপ নির্ধারণ হয় সেইজগতের অদ্ভুত অস্ফুট বাঙময় চৈতন্যের ঘরে - এই অন্তরের অন্তরঙ্গময়তাই জীবনানন্দের কবিতার অলঙ্কার - ক্রমাগত অন্তর্মুখী হয়েছেন কিন্তু সে অন্তর্মুখিতায় যে আলোর উদ্ভাস তা তাকে অদ্ভুত ব্যাপ্তি দিয়েছে - সে জগত , তাঁর আলো আমরা অনুভব করি আমাদের চেতনায় - মায়াবী নয় অদ্ভুত স্নিগ্ধতাই তাঁররুপালেখ্য।
তাঁর কবিতা ইন্দ্রিয়ানুভুতিকে উলটে পালটে ইন্দ্রিয়েরভেতরেই আশ্চর্য বৈভবের সৃষ্টি করেছে যখন তখন –“তোমাকে” কবিতায় বলছেন –“ মানবকে নয় নারী শুধু তোমাকে ভালবেসে বুঝেছি নিখিল বিষ কি রকম মধুর হতেপারে” ... ধুসর পাণ্ডুলিপির "মৃত্যুর আগে' কবিতায় বলছেন ...
“চালের ধুসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু বেলা
নির্জন মাছের চোখে। পুকুরের পারে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ - মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে...”
কি অসম্ভব ক্ষমতায় শব্দের সাথে শব্দকে এনে এক অদ্ভুত নিরালা রূপকল্পের সৃষ্টি - সাদা বাংলায় গল্পটা বলতে গেলে হয়ে যাবে পুকুরের পাড়ের কাছে ছিটোন চাল মাছেরা খেতে আসে আর সন্ধ্যায় বউমনি হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে যান সে পুকুরেরপার থেকে -যে কোন গাঁয়ের যে কোন পুকুর - অথচ কি আশ্চর্য মায়ায় শব্দ দিয়ে গড়েছেন মায়ার প্রাসাদ - ইন্দ্রিয়ানুভুতিকে উলটে পালটে ইন্দ্রিয়ের ভেতরেই সৃষ্টি করেছেন মায়া জগত - যে মায়াতে সমাহিত বাংলার রূপকল্প আলোর চেতনা ।
কবিতার জন্য পৃথক কোন পরিভাষা চাই নাকি চাই না এ আপ্ত আলোচনাও জীবনানন্দের কবিতাকে কেন্দ্র করে হয়। তাঁর কবিতার ঐশ্বর্যের আলোয় এ আলোচনাও সমিচীন । ধুসর পাণ্ডুলিপির কল্পনার ঐশ্বর্য, রূপসী বাংলার গ্রামীণ – গ্রাম্য নয় – সংস্কৃতিবোধ , বনলতা সেনে’র ইতিহাসনিষ্ঠ প্রেম, মহাপৃথিবীর অমেয়া নিরাকার ব্যাপ্তির বিশ্বাস, বা সাতটি তারার তিমিরের অন্তহীন প্রসারিত আত্মবীক্ষন – এই সব মিলিয়েই জীবনানন্দের কবিসত্তার পরিচয়।
পরিসর মাথায় রাখাভালো তাই থামতে হচ্ছে। শেষ পাতে অম্লরস – চাটনির মতো – আমাদের সাধারণ দৃঢ়বিশ্বাস কবিদের শরীর হয় না, শুধু নাকি সত্তাটাই আসল ব্যাপার। তাদের দেহাতীত বানীই সব, আকাশের গানের মতন দৈববাণী গোছের – তো এটা বোধহয় সেকালেও মানে জীবনানন্দের কালেও ছিল, কারন তা না হলে ভদ্রলোক ট্রাম লাইনে কেন গন্ধ শুঁকলেন – তাঁর ব্যাখ্যা তেও সেই অজর অমর বিশ্বাসী বাঙ্গালীচিত্তর দেখা মেলে । কবির অভাব দৈন্য দুঃখ কষ্ট আর তাঁর ভীষণ জাগতিক সত্য আজও হয়ত অনাদৃত – তাই আজও কবিতার বই পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয়। গুনীজনেদের মধ্যেও নিশ্চয়ই ব্যাতিক্রম আছে, তো বলে না ব্যাতিক্রম নিয়ম কে স্বতঃ সিদ্ধ করে। বাঙ্গালির সাধনা আর সিদ্ধি ওই ব্যাতিক্রমের মাধ্যমে নিয়মকে সিদ্ধ করেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন