টুকরো কথা - ১
ভালই বাস, কি হত্যাই কর !
দ্বিতীয় পর্ব:-
ফতেমা একদিন ওই দিগন্ত পার হয়ে বানজারাদের কাফেলার সাথে চলে গেল। চলেই গেল। তাঁর মতন মানুষের সঙ্গে থাকা অনুচিত ফতেমার। খৈয়ামের বেগম আছে। ফতেমার ঠাঁই কই? তাছাড়া এসব নেশা মাত্র। কাল নেশা ছুটে গেলে তখন? ফতেমাকে পরে থাকতে হবে ছেঁড়া কাপড়ের মতন। কাবেলার ভাই-বেরাদর যত সকলেই একথা বলেছে। ফতেমা মেনে নিয়েছে। তাঁদের মিলন নেই। তাঁদের কুষ্ঠীতে নক্ষত্রের দোষ। ফতেমা কাফেলার সঙ্গে চলে গিয়েছে মরুভূমি পার।
তারপরের থেকে নক্ষত্র দেখেছেন তিনি। দীর্ঘ্যকাল রাতের আকাশে তাকিয়ে থেকেছেন। ঘুম আসতো না তাঁর। কষ্ট ভারী হয়ে ঝুলতো তাঁর পড়ার ঘরের কোণ-কুলুঙ্গিতে। ঢুকলেই ঝাঁপিয়ে পড়তো তাঁর উপরে যেন দামাল এক শিশু। তিনি তাকে কোলে নিয়ে আদর করতেন, খেলা করতেন। কাঁদাতেন, কাঁদতেন। একদিন যখন আর জল ছিল না কোনো তখন ওই অনন্ত আকাশের দিকে চাইলেন। যখন তিনি চাইলেন তখন মনে পড়লো তাঁকে ফতেমা বলেছিল,
- আমরা দুজন যেন দুটি সমান্তরাল রেখা। চলে যাচ্ছি আর চলে যাচ্ছি।
খৈয়াম, যে সুলতান মালিক শাহ-র পরামর্শদাতা, যে কিনা বলখ-এ শেখ মুহাম্মদ মনসৌরির ছাত্র, খোরাসান-এ যাকে শিক্ষা দিয়েছেন স্বয়ং ইমাম মোয়াফফক নিশাপুরি, সে যতই তাঁবু বানানেওয়ালা পরিবারের সন্তান হোক সে আর ফতেমা সমান না। তাঁবু বানানেওয়ালা পরিবারের অনেক অর্থ সঞ্চয় হয়েছিল। তাদের দরকার ছিল রাজ বংশের সান্নিধ্য। তারা ক্ষমতার কাছে থাকতে চেয়েছিল। তাই না আফঘানিস্তান থেকে খোরাসান সর্বত্র নিয়ে গিয়েছে ওমর-কে। এই ওমর বানজারা ফতেমার সঙ্গে সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে তা কি করে হয়? অনেক পড়াশোনা করে খৈয়াম সার বুঝেছেন যখন ফতেমা এক রাতের আঁধারে চলে গেল মরুভূমির অজানা কোনো প্রান্তে।
শিশুকালে যখন শিখেছি অনেক কিছু ইস্কুলে,
যখন পড়াতে এসেছি পরে তখনও কি আনন্দ!
অথচ জানার কথাটি ছিল কাকে শেষ বলে,
শেষটা আসলে ধুলো্, আর ডানা হবে নিষ্পন্দ!
রাতের আকাশ দেখেছে খৈয়াম। দেখেছে দিন গুণতে গুণতে। ফতেমা ঠিক কতদিন গেল? কতদিন হল? গুণতে গুণতে তিনি ঠিক করে ফেলেছেন জালালি দিনপঞ্জিকা। সূর্যের গমনাগমনের উপর নির্ভর করে ঠিক করেছেন। পারস্যের শাহ মেনে নিয়েছেন তাকে। এই এখন সমগ্র ইরানীয় অঞ্চলের দিনপঞ্জিকা। তিনি কি সূর্য? আদিদেবের মতন? কে জানে? কিন্তু তিনি নিজের কথা জানেন। জানেন না ফতেমার কথা। ফতেমা এখন কোথায়? যাকে তিনি নিবিড় হয়ে ডাকতেম 'মাহ' বলে। 'মাহ' মানে চাঁদ। যাকে তিনি রোজ রাতে দেখেন। যাকে তিনি কখনো হারান না। যে চাঁদ সুরের লাবণ্য হয়ে ঝরে পড়তো তাঁর বুকে বালির চূড়ায়। বালির সমুদ্রে তাঁরা ভাসতেন। কখনো কখনো তিনি তার গভীরে ডুব দিয়ে ডেকে উঠতেন,
-'ওহ মাহি'!
'মাহি' তখন মাছ। 'মাহি' মানে মাছ। সেই মাছ যে ধারণ করে আছে পৃথিবীকে। জন্ম হবে, মৃত্যু হবে। চেতনা থাকবে। সৃষ্টির গভীরে থাকবে চেতনা। যে নানান চেহারা নেবে। যেমন তাঁর গবেষণাগারে ধাতুগুলো নেয় তেমন।
"Whose secret Presence, through Creation's veins
Running, Quicksilver-like eludes your pains:
Taking all shapes from Mah to Mahi; and
They change and perish all - but He remains;"
--- Rubaiyat of Omar Khayyam, Edward Fitzgerald's translation, stanza 52
যার গূঢ় উপস্থিতি সৃষ্টির শিরায়
দৌড়োয়, রূপোলি সৃষ্টিছাড়া ধাতু
তোমার বেদনাকে অতিক্রম করে যাবে
মাহ থেকে মাহি সব, সমস্ত রূপকেও
সব বদলাবে এমনকি উবে যাবে
যবে, সেদিনও শুধু সে থেকে যাবে।
তিনি ধাতুতত্ত্ব জানেন। ওই রূপোলি মতন ধাতুটি একমাত্র যে সাধারণ তাপমাত্রাতে তরল থাকে। যে এখন ঠান্ডা-কঠিন, মুহুর্তে আবার গলে যেতেও পারে। কোনো ঠিক নেই তার। কিচ্ছু ঠিক নেই। প্রেমের মতন অনিশ্চিত ওই ধাতু। তিনি জানেন। তাঁর চুল্লীতে কতবার খেলেছেন এই ধাতুর সঙ্গে। যেন খেলছিলেন ফতেমার সঙ্গে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন