শুক্রবার, ২ মার্চ, ২০১২

অনুপম চট্টোপাধ্যায়

ম্যানিফেস্টো - আধুনিক শিল্পকলাকে কিভাবে দেখবো?

দর্শকের প্রায়শঃ একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আমাদের দিকে "মডার্ন আর্ট-ফার্ট খুবই দুর্বোধ্য, আমরা বাপু এসবের কিছুই বুঝি না" আমরা যারা ছবি আঁকিয়ে বা মূর্তি গড়িয়ে বলে গর্ববোধ করি তারা প্রথমেই থতমত খাই, ভাবি তাহলে আমরা যা কিছু আঁকছি বা গড়ছি তার কি কিছুই হচ্ছে না? কিন্তু একথা তো সত্য নয়, কারণ ভুক্তভোগী  শিল্পী মাত্রেই জানেন যে একটি শিল্পকর্ম শেষ করার পিছনে কত রক্তজল-করা পরিশ্রম থাকেতাহলে কি শিল্পী যত পরিশ্রম করেন তার শিল্পটিকে পূর্ণরূপ দিতে সেই তুলনায় দর্শকেরা কি রস উপলব্ধিতে সামান্য পরিশ্রমে নারাজ?
না; তাও না, তাহলে ...
আসলে কোন সাহিত্যকর্মের রস উপলব্ধির জন্য যেমন সেই ভাষাটি জানা প্রয়োজন তেমনি শিল্পকলার প্রকৃতি রস উপলব্ধির জন্য তার ভাষাটিও জানা জরুরিএই ভাষাটিই শিল্পী ও  দর্শকের মধ্যে সেতুর কাজ করেশিল্প সমালোচকেরা অনেক সময় এই সেতুর কাজটি করে দেন, তবে সেটি হয়ে ওঠে অনেকটা পুরোহিতের মাধ্যমে ভগবানকে ডাকার মতো ব্যাপার
প্রাগৈতিহাসিক আদিম মানুষ যেদিন গুঁড়ো রঙের সঙ্গে পশু চর্বি মিশিয়ে পাথরের দেওয়ালে শিকারের ছবি এঁকেছিল, সেইদিনই শুরু চিত্রকলার জয়যাত্রাএই ঘটনাটির মধ্যেই আছে চিত্রশিল্পের মূল তত্ত্বপাথর গুঁড়ো করে চর্বি মিশিয়ে রঙ তৈরি করার মধ্যে আছে যেমন তার প্রকরণ (technique) রপ্ত তেমনি বিষয়বস্তু নির্বাচনের মধ্যে পাওয়া যায় তার মনস্তত্ত্ব, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটবিশ্বের প্রায় সব দেশের গুহাচিত্রে পাওয়া যায় শিকারের ছবিএকটি বড় পশুকে সবাই মিলে আক্রমণ করার দৃশ্য, পশুশক্তিকে জয় করবার কামনার প্রতিচ্ছবি
পরবর্তীকালে মানুষ যখন সমাজ গড়ল তখন প্রাকৃতিক শক্তিকে জয় করবার অথবা
তাকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য সৃষ্টি করেছিল ওই শক্তির প্রতিরূপ ঈশ্বরকে ততদিনে মানুষের মেধারও উন্নতি ঘটেছিল, মানুষ চাইছিল নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যকে কিভাবে আরও সুন্দর করা যায়।  রূপদানে এগিয়ে এলেন শিল্পী এরপর সভ্যতা ধীরে ধীরে শহরকেন্দ্রিক হতে লাগলো এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে চিত্রশিল্পও দুভাগে ভাগ হয়ে গেলএকটি রূপ হ'ল লৌকিক বিশুদ্ধ রূপ, যাকে আমরা বলি ফোক (folk) আর্টমানুষের সহজাত চাওয়া পাওয়ার প্রায় অবিকৃত রূপ যার আদিম গন্ধ এখনও উপলব্ধি করা যায়অপর রূপটি হ'ল ধ্রুপদী, যাকে আমরা বলি ক্লাসিক (classic) আর্ট; সেটির সর্বশেষ পরিমার্জিত রূপ হল আধুনিক শিল্পকলা (modern art)প্রসঙ্গত জানাই ভাস্কর্য নিয়ে পৃথক প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে এই রচনাকে একমুখী করবার স্বার্থে
বিশ্বের সব দেশের বা জাতির চিত্রকলার ইতিহাসে দেখা যায় প্রাচীন যুগে আঁকা হতো দেবতাদের ছবি (অনেক দেশে রাজাদেরই দেবতা বলে মানা হতো, যেমন মিশর, জাপান)অথবা আঁকা হয়েছে এমন মানুষের জীবনগাথা যিনি দেবত্ব লাভ করেছেন (বুদ্ধ, যীশু)মধ্যযুগে আঁকা হল রাজা,পুরোহিত এবং রাজপুরুষদের ছবিএকদিকে যেমন রইলো মানুষের দেবত্ব লাভের ছবি, অপরদিকে কিন্তু পাল্লা ভারি করলো রাজতন্ত্রঅর্থাৎ দেবতা, পুরোহিত এবং রাজাকে খুশি রাখলেই সমাজ ও শিল্পীর মঙ্গল, তখনকার আর্থসামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিরূপ
মানসিক দিক দিয়ে যেদিন চিত্রশিল্পীরা সম্পূর্ণতা অর্জন করলেন এবং ঘোষণা করলেন যে তারা শুধুমাত্র নিজেদের স্বতন্ত্র চিন্তাকেই রূপ দেবেন, সেইদিনই সূচনা হল চিত্রশিল্পের আধুনিক রূপশুরু হল নিত্যনতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা, উঠে আসলো জীবনের ভালোবাসা, যন্ত্রণা, জটিলতা, অন্ধকার দিক, মনস্তত্ত্ব, যৌনতা আরও কতকিছুআধুনিক চিত্রশালাগুলি ভরে উঠল কানায় কানায়দরকার পড়লো চিত্রশিল্পকে নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ
আধুনিক ছবি বিশ্লেষণের জন্য আমরা প্রথমে জানবো এই টেকনিক্যাল দিকটি অর্থাৎ মাধ্যমের (medium) আবেদন এবং ছবির কম্পোজিশনতারপরই আমরা প্রবেশ করবো শিল্পীর চিন্তার অন্দরমহলে এবং সেই সঙ্গে জানবো এর নান্দনিক রূপকে
সচারচর চিত্রশিল্পীরা যেসব মাধ্যম ব্যবহার করেন সেগুলি হল জলরং, তেলরঙ, অ্যাক্রিলিক, টেম্পোরা, ওয়াস, প্যাস্টেল, গুয়াশ(পোস্টার কালার), ছাপাই ছবি, কালিকলম, এবং মিশ্র মাধ্যমেযে মাধ্যমটি ব্যবহার করলে ঈপ্সিত রূপটি পাওয়া যারে, শিল্পী কাজের সময় সেই মাধ্যমটিকেই অগ্রাধিকার দেনআবার মাধ্যম নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে শিল্পীর মানসিক চরিত্রও ফুটে ওঠে( এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে শিল্পীর চিন্তার অন্দরমহল প্রসঙ্গে)এবার দেখা যাক এই মাধ্যমগুলি কিভাবে শিল্পী ব্যবহার করেনজলরঙকে শিল্পী দুভাবে ব্যবহার করেনযেমন - স্বচ্ছ, জোরালো রঙ এবং এথার প্রাধান্যযুক্ত ছবির জন্য প্রয়োজন চৈনিক জলরং, আবার রঙের আভা দেখানোর জন্যও এটিকে ব্যবহার করা হয়অপরদিকে ঝকঝকে দুপুরের আবেদন আনতে গেলে ব্রিটিশ জলরং অনবদ্য গাম্ভীর্যময় বিষয়, ভারীত্ব, জমকালো বিষয়ের প্রকাশ ঘটে তেলরঙের
মাধ্যমেফটো-রিয়ালিস্টিক কাজের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমটি অতুলনীয়তেলরঙ শুকোতে দেরি করে তাই অনেকেই অ্যাক্রিলিক মাধ্যমটি ব্যবহার করেনএর সুবিধা হল এটি দ্রুত শুকিয়ে যায়ক্যানভাসে অমসৃণ টেক্সচার দেখানোর জন্য বর্তমানে অ্যাক্রিলিক সবথেকে জনপ্রিয় মাধ্যমএটিও অপর সুবিধা হল এটিকে জলরঙের মতোও ব্যবহার করা সম্ভবছন্দময় ত্রিমাত্রিক গতিশীল ছবির জন্য প্যাস্টেলের ব্যবহার সুপরিচিতজমকালো এবং ছবিতে স্বর্গীয় মাত্রা বৃদ্ধি করে ওয়াসছবির নান্দনিক আবেদন বাড়ানোয় এর অবদান প্রশ্নাতীত আবার খুব অল্প সময়ে ছবি করা সম্ভব ওয়াসেসবচেয়ে শ্রমসাধ্য মাধ্যম হিসাবে টেম্পোরার নাম করা যায়তেলরঙ আবিষ্কারের আগে এটি ছিল চিত্রশিল্পের ইতিহাসে প্রধান মাধ্যমএর রঙের আবেদন এককথায় অনবদ্য রেখার টানাপোড়েনের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর বক্তব্য প্রকাশের জন্য কালি-কলমের জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছেপ্রাথমিক স্কেচ আর চটজলদি সাদাকালো ছবি করার জন্য চারকোল মাধ্যমটি ব্যবহার করা হয়আধুনিক বহু শিল্পী তাদের ভাব প্রকাশ করতে উপরোক্ত একাধিক মাধ্যম যখন একসঙ্গে ব্যবহার করেন তখন তাকে বলা হয় মিক্সড মিডিয়া বা মিশ্র মাধ্যমএকসাথে অনেকগুলো original print পাওয়া সম্ভব ছাপাই ছবিতেকমপিউটারকে ভৃত্য বানিয়ে
মাল্টিমিডিয়ায় যে সব কাজ এখন তরুণ শিল্পীরা করছেন সেটির এখনও নামকরণ করা সম্ভব না হলেও শিল্প হিসাবে উৎকৃষ্ট
কম্পোজিশানকে আমরা তুলনা করি বাড়ি তৈরির সঙ্গেনক্সা, ইট, বালি, রড, সিমেন্ট, পাথর, রং ইত্যাদির সাহায্যে যেমন আলাদা ডিজাইনের বাড়ি তৈরি সম্ভব তেমনি রং, রেখা, ছন্দ, ব্যালেন্স, স্পেস-ডিভিশন ইত্যাদির সাহায্যে আলাদা আলাদা নান্দনিক মাত্রায় ছবি তৈরি করেন শিল্পীছবি যেহেতু দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয় তাই দর্শকরা প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র রং ও রেখার মাধ্যমেই ছবিকে জানবেনঅপর বিষয়গুলি ছবি ভালোলাগা বৃদ্ধির সঙ্গে জানা বাঞ্ছনীয়... ততদিন ওগুলি শিল্পীদের জন্য তোলা থাক। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন