শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ৫ম সংখ্যা



কবিতা লোকে কেনই বা লেখেন, কেনই বা পড়েন! যিনি লিখছেন, কেনই বা লিখছেন? আর যিনি বা যারা কবিতা পড়ছেন, অতি জরুরী একটি কাজ ভুলে গিয়ে, তিনি বা তাঁরা? তাদেরই বা প্রত্যাশা কী? আমার কাছে, এ সত্যিই খুব বিষ্ময়কর। একজন যখন কলম ধরলেন, লিখে গেলেন কিছু শব্দ ভাষার আশ্রয়ে, সে আসলে কবিতার আড়ালে নিজেকে মুক্তি দিলেন। আর বিদগ্ধ পাঠক, কবিতাতে জীবন যুদ্ধে অবিরত থাকার বর্ম খুঁজে পেলেন। কবি মুক্তি দিলেন বোধের ছেঁড়া অংশ, আর পাঠক তাতে নিজেকে আবদ্ধ কোরে জুড়ে নিলেন তার বোধিতে। পুরো হলো বর্তনী। এর মাঝে সময়পোযোগী সমালোচকেরা তাদের আবিষ্কার অথবা তিরষ্কার অব্যাহত রাখুন কী না-রাখুন কবি বা পাঠকের আসলে সত্যিই দায় নেই কিছু। ব্যাপারটি হয়তো এমন, একদল পরিব্রাজক পথে যেতে যেতে কথার ছলে বিনা প্রয়োজনে গাছের পাতাটি ছিঁড়ে নিল; আঙ্গুলের পেষণে, নিজের পর্যবেক্ষণে পাতাটিকে একটি বর্ণনায় সীমা দিয়ে দিল। এতেই তাঁর মুক্তি, তাঁর জ্ঞানের, তাঁর অনুবীক্ষণের, পাতাটির করুণ পরিণতিতে। কিন্তু কবি ও পাঠকের বর্তনীর মাঝে ‘কবিতা’-কে এসব জ্ঞানী-গুণীজন সেভাবে হনন করতে পারেন না। তাদের প্রয়োজনে তারা তাদের মুক্তির আশ্রয় হিসেবে কবিতাকেই আঁকড়ে আছেন, আর কিছু নয়। সুতরাং, ‘কবি-কবিতা-পাঠক’, এই ত্রিভুজ প্রেমে আর সব কিছুই খলনায়কের ভূমিকায়। আমরা তাঁদের নিপুণ পারফরমেন্স দেখব, শুনব যার যার ভূমিকায়, তারপর ভুলে যাব সব।

‘ক্ষেপচুরিয়াস কবিতার পাগলামি গ্রুপম্যাগ’ - বলতে গেলে, ফেসবুকে সর্বাধিক স্বার্থক একটি কবিতার গ্রুপ, এখন পর্যন্ত। দুই বাংলার সীমাকে অতিক্রম করে একটি সার্বজনীন চেহারা দেবার এমন দুর্লভ প্রচেষ্টা যেসব তরুণ কবিরা করেছিলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় আনত হই। তাদের তরুণ প্রাণ-প্রাচূর্যেই আপাত সম্ভব হয়েছে, ফেসবুকের মতো একটি জায়গায় একই সাথে কবি ও পাঠকের দুই রকম চাহিদা মেটানোর একটি ধারক ও বাহক হিসেবে ‘ক্ষেপচুরিয়াস’-কে প্রতিষ্ঠিত করা। গ্রুপটিতে নতুন কবিদের যেভাবে উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে নেবার চেষ্টা দেখেছি, সেটি সত্যিই প্রশংসনীয়। দেখেছি জুবিনকে, যার ভেতরেই বিন্দু পরিমাণ সম্ভাবনা দেখেছে, ঝাঁপিয়ে পড়েছে কিভাবে, তাকে আরও একটু উৎসাহ দিয়ে পরিস্ফুরণে। দলীয় মতভেদ থাকেই সর্বত্র। তবুও গ্রুপটির সঞ্চালনে যারা দিনের দিনের পর দিন শ্রম আর মেধা দিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে তাদের আন্তরিকতা ছাড়া ক্ষেপচুরিয়াসের এই অগ্রযাত্রা সম্ভব ছিল না কোনোভাবেই। গ্রুপের সব সদস্যকে অভিনন্দন জানাই।

বেরুচ্ছে ব্লগজিনের ৫ম সংখ্যা। সুমিত একাই সামলাচ্ছে মোটামুটি, জুবিন আছে ক্ষেপু সর্দার। অলংকরণে পাশে আছে, কৌশিক বিশ্বাস, মেঘ অদিতি। আর আছে সদস্যদের অংশগ্রহণ। গ্রুপের মতোই ‘ক্ষেপচুরিয়ান ব্লগজিন’-এও সদস্যরা প্রমাণ রেখেছে তাদের সুসংগঠিত ‘টিম ওয়ার্ক’। প্রত্যেককে আন্তরিক শুভেচ্ছা। আর পাশে থাকুন আপনারা ক্ষেপচুরিয়ান হয়ে। ধন্যবাদ।।


ক্ষেপচুরিয়ানস্‌ সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে
অপরাজিতা ফেরদৌস




৫টি মন্তব্য:

  1. অস্থির!! অস্থির!! ম্যাডাম, এতো হুড়মুড় না করে একটু গুছিয়ে সময় নিয়ে লিখলে অনেক বেশী উপভোগ্য হোতো হয়তো! :) যাই হোক, শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। :))

    উত্তরমুছুন
  2. সম্পাদককে ধন্যবাদ। কিন্তু সম্পাদকীয়ের প্রথম অংশের সঙ্গে কঠোরভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। যারা ফলিত বিজ্ঞান, কারিগরী বা চিকিৎসাবিদ্যার সাথে জড়িত, বা এসব বিষয়ে সামান্য-ও জ্ঞান রাখেন - তারা জানেন - Sample Testing বা নমুনা পরীক্ষা প্রধানতঃ দুইরকমের হয়ে থাকে। এক, ধ্বংসাত্মক(Destructive) এবং দুই, অ-ধ্বংসাত্মক (Non-Destructive) পরীক্ষা। প্রথম ক্ষেত্রে, কোন বিশেষ উৎপাদিত দ্রব্যকে (product) পরীক্ষা করতে তার সম্পূর্ন পরিমাণের (Batch)এর সামান্য অংশকে নমুনা (Sample) হিসেবে নেওয়া হয় এবং তাকে পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে দ্রব্যটির একক হিসেবে প্রতিটি অংশকে পৃথক ক'রে নেওয়া হয় ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতিতে - সুতরাং দ্রব্যটির গুণাগুণ ও উপযোগীতা এর ফলে নষ্ট হয়। সরল উদাহরন, কৃষিবিদ্যায় একটি মাটির ঢেলা তুলে হাতে চটকে বলে দেওয়া (Thumb rule অনুযায়ী)ঐ কৃষিক্ষেত্রের মাটির আর্দ্রতা কত ! অথবা, সম্পাদকের বিবরন অনুযায়ী, গাছের একটি পাতা চটকে অথবা তার গবেষণা (Lab-analysis) ক'রে গুণাগুণ (Properties)সনাক্ত ক'রা। এ গেল Destructive Test এর বিবরণ। এছাড়াও রয়েছে Non-Destructive Test. এই পদ্ধতিতে প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা (representative sample)-টিকে ধ্বংস না ক'রেও তার গুণাগুণ ও উপযোগীতা নির্ণয় ক'রা সম্ভব। যেমন, কোন prototype machine এর Testing.
    সুতরাং, কবিতার বিশ্লেষণকে কোন বিভাগে ফেলা উচিৎ - তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। বিশ্লেষক (বা সমালোচক) যখন কবিতাকে খুব কড়া ভাষায় (?) আক্রমনপূর্বক বিশ্লেষণ করেন, তখন, নিহিতার্থে কেউ কেউ এঁকে ধ্বংসাত্মক নমুনা-পরীক্ষণের সঙ্গে তুলনা ক'রলেও করতে পারেন - কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে এতে কবিতার কোন ক্ষতি সাধিত হয় না। অনেকে বলবেন, এমন ভাবে তুলোধোনার জন্য যে বিতৃষ্ণা উদ্রেকের প্রয়োজন নিজের ভিতরে, তার ফলে, অন্ততঃ বিশ্লেষক স্বয়ং আর কবিতা থেকে রস উপভোগ করতে পারবেন না। বিতৃষ্ণা বাধা হয়ে দাড়াবে। কিন্তু এখানেই বোধ হয় ফিসিক্যাল প্রপার্টি আর ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি-র পার্থক্য। ফিজিক্যাল প্রপার্টি পরিবর্ত্তিত হয় ফিজিক্সের কঠোর নিয়মের সামান্যতম ব্যাত্যয় না ঘটিয়ে। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির সীমানা ফিজিক্সনিয়ন্ত্রিত বটে, তবে ফিজিক্সনির্ধারিত নয়। সুতরাং, সমালোচক কবিতার মৃত্যু ঘটান না। বরং পাঠক আকৃষ্ট না হ'লে কবিতার মৃত্যু ঘটে। কবিতার মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে পাঠক এবং কিছুটা কবি নিজে দায়ী। সমালোচক কোনমতেই নন - তিনি কবির থেকেও সংখ্যালঘু। আবার সমালোচক মানেই বিশ্লেষক নন। এত সহজে সবাইকে এক শ্রেণীতে ফেলা যায় না। অজস্র বৈচিত্র্য রয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. "কবি ও পাঠকের বর্তনীর মাঝে ‘কবিতা’-কে এসব জ্ঞানী-গুণীজন সেভাবে হনন করতে পারেন না। তাদের প্রয়োজনে তারা তাদের মুক্তির আশ্রয় হিসেবে কবিতাকেই আঁকড়ে আছেন, আর কিছু নয়। সুতরাং, ‘কবি-কবিতা-পাঠক’, এই ত্রিভুজ প্রেমে আর সব কিছুই খলনায়কের ভূমিকায়।"

    দ্বিতীয়তঃ - এই মন্তব্যদু'টি একান্তই একদেশদর্শী। "এসব জ্ঞানীগুনীজন" বলতে যদি ধরেও নিই যে সম্পাদক শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে তথাকথিত কবিতা-ধ্বংসকারী জ্ঞানী-গুনীজন-কে বোঝাচ্ছেন, তাহলেও জ্ঞান ও গুণের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। কবিতা রচনা একটি গুণ (Quality) আর তাকে রচনা করতে লাগে জ্ঞান। এই জ্ঞান সমকাল ও ইতিহাসকে ধ'রে, এর অপর অংশ বিশ্লেষণক্ষমতা - যা সাধারন মানুষ (পড়ুন পাঠক)-এর থেকে পৃথকভাবে সময়কে দেখে এবং যে কোন সভ্যতায়, ভাষার অগ্রবর্তীর ভূমিকা নিয়ে ভাষার সাহায্যে তার রূপদান ক'রে এবং এই পদ্ধতিতে ভাষাকে সমৃদ্ধ ক'রে। এভাবেই কবিতা একটি পৃথক সাহিত্যধারা হয়ে ওঠে, উঠেছে - যা, আরিস্টোক্রেসি বা অর্থডক্স ভাবনাকে পাশে সরিয়ে রেখেই এগিয়েছে - জ্ঞান ও গুণকে পাথেয় ক'রে। সুতরাং কবি নিজেও জ্ঞানী এবং গুনী। তিনিও কি কবিতাকে হনন করতেই তার জন্ম দ্যান? জানতে ইচ্ছা করছে।

    দ্বিতীয় মন্তব্যটি, এই সূত্রেই আরো মারাত্মক। কবি-কবিতা-পাঠক- এই চক্রের কথা অনাদিকালের কবিতা থেকে আজ-ও সমানরকম প্রাসঙ্গিক। কিন্তু তার মানে কি এই, যে বাদবাকী সব কিছু খলনায়ক? কি সব্বোনাশ ! কবিতা আসে কোথা থেকে? কবিতা থাকে কোথায়? কবি থাকেন বা আসেন কোথা থেকে? পাঠক-ও কি নিরালম্ব? সমাজবিচ্ছিন্ন? এই ত্রিভূজটি কি অপার্থিব কিছু? সবাই খলনায়ক হয়ে গেলে তো মুশকিল। আরো বড় প্রশ্ন - এখানে পাঠক সিঙ্গুলার না প্লুরাল? প্লুরাল হ'লে - এক পাঠক অন্য পাঠকের প্রতি খলনায়ক? এক কবি অন্য কবির প্রতি? রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুদের কবিতাকে আক্রমন করেছিলেন। তিনি কি খলনায়ক "বুদ্ধদেব বসু-বুদ্ধেদেব বসুর কবিতা-বুদ্ধেদেব বসুর কবিতার পাঠক" - এই ত্রিভূজের নিরিখে? নাহ - এই একদেশদর্শী মতামতের কঠোর বিরোধীতা করি।

    উত্তরমুছুন