শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অমর মিত্র



অমর মিত্র

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে পড়ছি ৪০ বছরের উপর। পড়তে পড়তেই আমার বয়স বাড়িয়েছি। সেই কবে পড়েছিলাম তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণপোকা, তার আগে পরে উত্তরের ব্যালকনি, ঘরের পথ, ট্যাঙ্কি সাফ, গঞ্জের মানুষ, দেখা হবে... গল্পের পর গল্প। সব গল্পের নামও মনে নেই, কিন্তু গল্পটির নির্যাস ভুলিনি। এক রোববারে আনন্দবাজার পত্রিকায়... লম্বোদরের ঘাট খরচা (নামটি অসম্পূর্ণ, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব) গল্পটির কথা আচমকা এখন ভেসে এল। লোকের কাজ করে বেড়ায় যে যুবকটি সে বিয়ের ফুলশয্যার দিনে গাঁয়ের কোনো মৃতের ঘাট খরচা জোগাড়ে বেরিয়ে পড়ে। তাঁর লেখার মানবিক মুহূর্তগুলি আমাকে স্তম্ভিত করে। পারাপার, যাও পাখি, মানব জমিন, পার্থিব থেকে জাল,গয়নার বাক্স, একের পর এক উপন্যাস পড়তে পড়তে আমি শিখেছিও কম নয়। তাঁর আনন্দমেলার সেই সব উপন্যাস, মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, গোঁসাই বাগানের ভূত......নাম হারিয়ে ফেলেছি, কাহিনি মনে আছে, এ রকম কত। কিন্তু যে উপন্যাসটি এখনও আমাকে কখনো কখনো নিয়ে বসতে হয়, পাতা উল্টে দেখতে হয় বার বার, সেই উপন্যাস উজান। ১৯৭০ বা একাত্তরে বেরিয়েছিল দেশ বা আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায়। সেই পাঠের স্মৃতি এখনও হারায়নি। আমার প্রিয় উপন্যাসের ভিতর উজান রয়ে গেছে গত ৪০ বছর ধরে। সেই অল্প বয়সে পড়া আর এই পরিণত বয়সে পড়ার ভিতরে তফাৎ কিছু থেকে যায়। তখন যে উপন্যাস ভালো লেগেছিল, এখন দেখি তার ভিতরে কত অসম্পূর্ণতা। ফিরে উজান পড়তে গিয়ে সেই ভয় হয়েছিল আমার। এই উপন্যাসটির সঙ্গে আমার প্রথম বয়সের যে ভালো লাগা জড়িয়ে আছে, তাকে কি আমি ভেঙ্গে দেব এই বয়সে এসে ? আবার এও তো হতে পারে, নতুন পাঠে নানা মাত্রা খুলে যেতে পারে যা বহুদিন আগে আমি টের পাইনি। এরকম হয়েছে অনেকবার। উজান উপন্যাস নতুন পাঠে তেমন হয়ে উঠল। এই উপন্যাসের নতুন পাঠে আবার নতুন করে চেনা হল এ জীবন।

উপন্যাসটি শৈশবের কথা। শৈশব মানুষের সব চেয়ে অনুভূতিময় সময়। শৈশবহীন মানুষ তো হয় না, কিন্তু মগ্ন শৈশবকে উচ্চারণ করতে পারেন কে? আমাদের ভাষায় কেন, সব ভাষাতেই শৈশব উপজীব্য হয়েছে অনেক মহৎ উপন্যাসে। জাঁ ক্রিস্তফ থেকে পথের পাঁচালি, দৃষ্টি প্রদীপ(বিভূতিভূষণ), অচিন রাগিণী (সতীনাথ ভাদুড়ি), সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার ইত্যাদি। প্রতি লেখক তাঁর শৈশবের অনুভূতি মালাকে নিজের মতো করে শিল্পিত করে এঁকেছেন তাঁদের উপন্যাসে। ক্ষীণকায় উপন্যাস উজান যেন সেই শিল্পিত রূপের এক আশ্চর্য উপাখ্যান। আমার কাছে উপন্যাসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই উপন্যাসের গোত্র আলাদা। এর সুরের ভিতরে জাঁ ক্রিস্তফ বা দৃষ্টি প্রদীপের মায়া খুঁজে পাই আমি। যখন তিনি লিখেছিলেন এই উপন্যাস, তখন তিনি তরুণ। তরুণ লেখক জীবনের যে অতলে প্রবেশ করেছিলেন তা যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল বলার কথা না থাকলে কেন লেখা? যা পড়ি, তার অনেকখানিই শেষ অবধি মুছে যায়। উজান উপন্যাসে তিনি তাঁর জীবন বোধের কথা বলতে পেরেছিলেন, তাই এতকাল ধরে তাকে আমি আমার গোপন সিন্দুকে রেখে দিতে পেরেছি।

এই উপন্যাস স্বাধীনতার আগে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ শহরের এক যৌথ পরিবারের কাহিনি। যৌথ পরিবারটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে কী ভাবে ভেঙ্গে যায় সেই কাহিনি ধারণ করেছে উজান। তা এক বালকের চোখ দিয়ে দেখা। এবং উত্তম পুরুষে লেখা। যে বালকটি ম্যালেরিয়ায় ভোগে, জ্বর আসে, জ্বর ছাড়ে, ব্রহ্মপুত্র নদের কূলে তাদের বাড়ি, ঠাকুর্দা ঠাকুমা, জেঠা, জেঠি, কাকা, কাকি, দূরের আত্মীয়, লতায় পাতায় সম্পর্কের জোরে ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া পরিবার, ভাগ্যান্বেষী নিরালম্ব মানুষ......এই রকম চিত্রময় পরিবারে একা একা বড় হয় যে বালক, সকলের ভিতরে থেকেও যে কিনা নিজের গড়া অন্তর্জগতে একা তার কথা শুনিয়েছেন শীর্ষেন্দু একটু একটু করে। ধীরে ধীরে মোড়ক খুলেছেন শৈশবের। পড়তে পড়তে বুক ভার হয়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে হয় কিছু সময়, ফিরে পড়তে হয় ফেলে আসা পৃষ্ঠাগুলি। আর ওই বালক, কুকু, শ্রীমধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের বাল্যকালের ভিতর নিজের বাল্যকাল যেন খুঁজে পাই আমি। না, ময়মনসিংহ নয়, ব্রহ্মপুত্র নয়, এসব কিছুই ছিল না যার শৈশবে, সে উজান পড়তে পড়তে নিজেকে খুঁজে পায় যেন হারিয়ে যাওয়া সেই যৌথ পরিবারে।

ঠাকুর্দার চার ছেলে। বড় জেঠামশায় ক্ল্যারিওনেট বাজান, প্লুরিসি হওয়ায় তাঁকে ক্ল্যারিওনেট ছাড়তে হয়। তাঁর ছিল ওই একটিই গুণ। অসম্ভব স্ত্রৈণ বড় জেঠামশায় তাঁর চার ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে থাকতেন দক্ষিণের ঘরে। ঠাকুদ্দা কালীকুমার ছিলেন ময়মনসিংহ আদালতের মুহুরি। বড়ো ছেলের গতি হবে কোথায়, মেছোবাজারে খুলে দিলেন একটা কাটা কাপড়ের দোকান—অন্নপূর্ণা ভাণ্ডার। ......ধীরে ধীরে আজ থেকে সত্তর পঁচাত্তর বছর আগের মফস্বল শহর, যৌথ পরিবারের রূপটি উন্মোচিত হতে থাকে। সময় তার আলো অন্ধকার নিয়ে চোখের সামনে পরিস্ফূট হয়ে উঠতে থাকে। কত মানুষ এই কৃশকায় উপন্যাসে, একটি বালক কত মানুষের ভিতর বড় হয়ে উঠতে থাকে। তার ভিতরেও মগ্ন হয় নিজের অন্তর্জগতে। কী স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে যে পূর্ণ এই উপন্যাস তা পুনঃপাঠে টের পেয়েছি বার বার। আর সংসার কত নিষ্ঠুর, কত মানবিক সেই সত্যও এই উপন্যাসের পরতে পরতে লুকিয়ে। মনের ভিতরে কি ফিরে আসে না সেই যৌথ পরিবারে আশ্রয় নেওয়া যক্ষারোগী মাখন কাকার কথা। এই উপন্যাস লেখকের প্রথম জীবনের। মানুষের প্রতি মায়া, মমতা, মানবিক বোধ, মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি সমস্ত কিছুর চিহ্ন এর পরতে পরতে।

উজান-এ রয়েছেঃ “ শরতের শেষে শীতের গোড়ার দিকে আমাদের কাছারি ঘরের বারান্দায় হঠাৎ কামলা লাগিয়ে বেড়া বাঁধা হচ্ছিল। সারা দুপুর আমি আর গণনাথ সেই দৃশ্য দেখলাম। খোলা বারান্দাখানা দেখতে দেখতে কেমন একখানা ঘর হয়ে গেল।
গণনাথ বলল—এই ঘরে একজন যক্ষারুগী থাকবে—জানিস!
—সত্যি!
গণনাথ মাথা নাড়ে—সত্যি। তোদের জ্ঞাতিকাকা না কী যেন হয়। যক্ষারোগী বলে দিদিমা রাগারাগি করছিল। দাদু বলল—যক্ষা হয়েছে বলে কি আর মাখনকে ফেলে দিতে পারি!
—মাখন! আমি অবাক হই—যাঃ, মাখন নামে আমার আবার কে কাকা আছে!
ম—আছে কেউ। তোদের গ্রামের। কালু ভটচাজের ভাইপো। এখানে আসবে চিকিৎসা করাতে। আমি কখনো যক্ষারোগী দেখিনি। তুই দেখেছিস?”

এই অংশটি থেকে ধরা যায় সেই ৭০-৭৫ বছর আগের সমাজটি কেমন ছিল। গল্প কথক সেই বালক মধুসূদনের ঠাকুর্দা কালীকুমার ছিল বট বৃক্ষের মতো। বিলুপ্ত সেই যৌথ পরিবার, তার কর্তা, আশ্রিতরা, নানা রকম মানুষ সব মিলিয়ে যে মস্ত চালচিত্র তা উজান উপন্যাসের ছোট পরিসরেই কিন্তু ব্যপ্ত হয়ে এসেছে। বড় লেখককে বেশি কথা বলতে হয় না। আঁচড়ে আঁচড়ে তিনি বিন্দুকে সিন্ধু করে তোলেন। এমন পরিবার আমি ছেলেবেলায় দেখেছি, দেখেছি বলেই উজান আমাকে এত বছর ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে। কত রকমের চরিত্ররা। মনে করা যাক সেই তুলারানির কথা। অভাবী জ্ঞাতি নিবারণ জেঠার ফুটফুটে মেয়ে তুলারানি, তার খুব হাত টান, চুরি করে এটা ওটা, ক্ষেতের সব্জি, অন্ধকারে তার পায়ে লাঠি পড়ে, মনে করি রূপবান সেই সিতিকণ্ঠের কথা। তার রূপের খ্যাতি বহুদূর ছড়িয়েছিল, তার দিকে গোপনে তাকিয়ে থাকত, কোনো বাড়িতে এলে আলাদা ভাবে ভীড় কমলে আসত সিতিকণ্ঠ, যাতে ভিড়ের ভিতর তার রূপ হারিয়ে না যায়। মেয়ে মহলে ফিসফাস শুরু হয়ে যেত—সিতিকণ্ঠ...... সিতিকণ্ঠ......সেই যে সুন্দর মানুষটা। বিয়ের পর কী হল তার! মর্ম বেদনার কথা এমনভাবে লেখেন আমার এই প্রিয় লেখক। চল্লিশ বছর বাদেও সিতিকণ্ঠের দুঃখময় দাম্পত্যের বৃত্তান্তে আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকি। এতই যার রূপ, গাঁ গঞ্জের মেয়ে বউরা যাকে দেখতে পেলে ধন্য হত, তার সব রূপ তুচ্ছ হয়ে গেল বিয়ের পর। তার বউ-এর মন তার দিকে নেই। পাগলপারা সিতিকণ্ঠ বসে থাকে বুনো ঝোপঝাড় জঙ্গলে ভরা তার ভিটেয় বসে গান গাইছে, রাম গেল বনবাসে, বেহুলা হল রাঁড়ি... সিতিকণ্ঠের বউ, নতুন কাকিমার কোলে পুঁটুলির মতো রাঙা শিশু। সিতিকণ্ঠ বলত, ওটা তার বাচ্চা নয়, হয় মেছোবাজারের কিষ্টার, নয়ত চাটুজ্যেবাড়ির নগেনের। নগেন হল, কুকু, গল্প কথক বালক শ্রীমধুসূদন চট্টোপাধ্যায়ের কাকা। এ জীবনের ছোট ছোট ভালোমন্দ, সুখদঃখকে এমন নিবিড় ভাবে পড়েছি কম।

ব্রহ্মপুত্রে কোল ছেড়ে বালক যায় মা বাবার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের চা বাগানের দেশে। শ্বশুর চাকরি করে দিয়েছে ময়মনসিংহের ডাকসাইটে মুহুরি, কালীকুমার চাটুজ্যের ছেলে, কুকুর বাবাকে। যুদ্ধ আর মন্বন্তরের সময় তা। উজান উপন্যাসে এমন একটি অংশ এই অংশে রয়েছে যা আমি এতকাল ধরে স্মৃতির ভিতরে রেখে দিয়েছিলাম লুকিয়ে, আমার ছেলেবেলার গোপন কুটরিতে তা আলাদা করে রেখে মাঝে মাঝে বের করে দেখতাম। এবারের নতুন পাঠে সেই আশ্চর্য কথনে আবার প্রবেশ করলাম।

কাটিহার রেল জংশনে বদলি হয়ে এসেছে বাবা। তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অন্নের অভাব, ভিখিরির সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। অন্নের অভাবের কথা শোনা যায়, কিন্তু তার আঁচ কুকুদের সংসারে নেই। আগের মতোই কাটারিভোগ চালের ভাত খায় তারা। পাতে ভাত ফেলে। সেই ভাত কাজের লোক হাজারী ঢেলে দিয়ে আসে টমি কুকুরকে।
কুকুরা থাকে সাহেবপাড়ায়। সাহেবপাড়ায় ভিখিরির আনাগোনা বাড়তে থাকে। অচেনা ভিখিরিরা আসে। সকাল থেকে রাত অবধি উলিঝুলি পোশাক পরা মানুষ আসছে তো আসছে। এরা সবাই কানা খোঁড়া আতুর নয়, কিন্তু রোগ, খুব রোগা। লোক দেখলেই তারা ডাকে। কাজের লোক হাজারী ভিখিরি তাড়ায়। বালক কুকুও একদিন হাজারীর সঙ্গে দুটো ভিখিরিকে তাড়িয়ে লাইন পার করে দিয়ে এসে খুব আনন্দ পায়। তার হাতে হান্টার। হান্টার ঘুরিয়ে ভিখিরি তাড়ানো তার খেলা। মাঝে মাঝে গুলতি টিপ করে কুকু ভিখিরিদের দিকে। তো এক দুপুরে, সেদিন হাজারী নেই, কুকুদের বাবুর্চিখানার বারান্দার সামনে গাছতলায় এসে দাঁড়াল দুই ভিখিরি, একজন কম বয়সী যুবা, আর একজন বুড়ি। মা ও ছেলে হবে হয়তো। হান্টার নিয়ে এসে কুকু বলল, যাও ভাগো।

ভিখিরি লোকটার চোখদুটি জ্বলজ্বলে, হাতে কলাইকরা বাটি, অতি শীর্ণ সে কুকুর কথায় স্থির চোখে তার দিকে তাকাল মাত্র। নড়ল না। কুকু তখন গর্জন করে ওঠে, যাও, ভাগো—আভি যাও—
লোকটা নড়ে না। কী ভয়ঙ্কর এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন লেখক। জেদি ভিখারি নড়ে না। বালকও তাকে তাড়াবে। সে তো এয়ার গান চালাতে পারে, গুলতি। বালির বস্তায় ঘুষি মারে। জেদী ভিখিরিকে সে তাড়াবেই। হান্টার খুলে সে ঘোরাতেই ভিখিরির হাতের বাটিতে লাগল, বাটি পড়ে গেল। ছিল আধমুঠো চালের খুদ। ছড়িয়ে যেতেই ভিখিরি বদলে গেল। লেখক বলছেন, “যেন বা ভিখিরির ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে এল রাজার মূর্তি। জ্বলজ্বল করে উঠল তার দুই চোখ। রোগা মুখের চোয়ালে ঢেউ খেলে গেল। পলকের মধ্যে সে তার রোগা দুই হাতে প্রকাণ্ড লাঠিটা মাথার ওপর তুলে ফেলল—থরথর করে সে কাঁপছে—খিদেয়, উত্তেজনায়। আকাশ-পাতাল ব্যপ্ত বিশাল গলায় চেঁচিয়ে বলল—তোলো। একটা একটা করে চাল কুড়িয়ে দাও, কুকুর—তোলো তোলো শীগগির—খুঁটে খুঁটে তুলে দাও—
আমি ভীষণ অবাক হয়ে সেই সুমহান দৃশ্য দেখি। রোগ এবং ক্ষুধায় জীর্ণ ভিখিরির হাতে উদ্যত আকাশ ছোঁয়া লাঠি, থরথর করে হাত কাঁপছে, টলছে পা......”

পাতার পর পাতা উদ্ধৃত করা যায়। এই আশ্চর্য ছবি উজানের লেখক ব্যতীত কে বোঝাতে পারবেন? বালক কুকু ভেঙ্গে পড়ে তার সামনে। হাতের হান্টার খসে পড়ে। সেই আধ ল্যাংটা, ক্ষুধার্ত, রাজাধিরাজ ভিখিরির সামনে ভেলভেটের প্যান্ট পরা বালক হাঁটু গেড়ে ধুলোয় বসে খুঁটে খুঁটে ভিখিরির চাল কুড়িয়ে দিতে থাকে তার বাটিতে। বাংলা উপন্যাসে এমন জীবনের কথা আর কোথাও পড়েছি বলে মনে হয় না। সেই অল্প বয়সে আমার চোখে জল এসেছিল, এখনও। কিন্তু এখন আমি আবিষ্কার করলাম যে অনন্ত সত্য তার কোনো তুলনা নেই। উজান উপন্যাসটিতে শুধু দুঃখী আর নিরালম্ব মানুষের কথা। মাখন কাকা, সিতিকণ্ঠ, তুলারানি, বড় জেঠামশায়, অনাদিনাথ, কত মানুষ ( অনুচ্চারিত রয়েও গেল কয়েকজন )! উজান নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা যায়। আলাদা করে প্রত্যেকটি মানুষের কথা। এই উপন্যাসটি আমার সঙ্গে থাকে। সঙ্গে থাকে সেই যৌথ পরিবার, ঠাকুদ্দা, ব্রহ্মপুত্র......। হারিয়ে যাওয়া সেই পৃথিবী। মস্ত আকাশতলে রাজাধিরাজ ভিখিরি আর তার দাসানুদাস বালক কুকু, শ্রীমধুসূদন চট্টোপাধ্যায়। 

অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস 


২টি মন্তব্য: