সুবীর বোস
আমি অরুণাভ। দিল্লীতে এসেছি অফিসের কাজে। বেজায় ঠান্ডা। পাহাড়গঞ্জের হোটেল থেকে বেরিয়েই এত জমাট কুয়াশার মুখোমুখি হব, ভাবতে পারিনি। দু-ফুট দূরের কিছুও দেখতে পারছি না। মনে হল, পকেটে একটা আলপিন থাকলে বেশ হত। একটু একটু করে কুয়াশা ফুটো করে দেখা যেত, মাকড়সার জালের মতো দেখায় কিনা। সে যাক, একদিক থেকে ভালোই হল। নীচের দিকে যে পাতাগুলো জল পায় না, তারাও ভিজে নিচ্ছে আজ, নরম হচ্ছে দেদার। আমি সেতু ধরে এগিয়ে গেলাম নিউ দিল্লী মেট্রো স্টেশনের দিকে (‘সেতু’ শব্দটা একজন কবির থেকে ধার নিয়েছি)। অনামিকা বলত, কুয়াশার মধ্যেই নাকি লুকিয়ে থাকে প্রকৃত আশা।
একটু পিছিয়ে ভাবলেই আমি আর দিল্লীতে নয়, গাঁয়ের এক পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ঠোঁটে গুরু দত্তর মতো এক চিলতে বিষণ্ণ হাসি উঁকি দিচ্ছে। মেয়েটা, সেই যে গেল, আর এল না। ধীর পায়ে এরপর আমি ‘বৌদি’র চায়ের দোকানে। জুম ইন। আমি বিড়বিড় করছি, দ্যট গার্ল মেড অ্যান অগস্ত যাত্রা। গরম চায়ে চোবানো বিস্কুট নরম হয়ে গলে গলে পড়ছে। বৌদি আরেকজন খদ্দেরকে ফিসফিস করে বলছেন, ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভালো, মন খারাপ হলেই ইংরেজিতে বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দিল্লীর কথা, কুয়াশার কথা। আমার ঠিক সামনেই একটা মারুতি-৮০০, যার ওয়াইপারটা ‘ইয়েস-নো, ইয়েস-নো’ করে যাচ্ছে একটানা। সেবার কুয়াশায়, রিক্সায় আমি আর অনামিকা, গালে-গাল, নরম, ভিজে, ঘনিষ্ঠ। সেদিন অনামিকাও হঠাৎ এমন, ইয়েস-নো, ইয়েস-নো। ‘লার্ণিং টাইমে এসব করা ঠিক না’। কপট রাগ ও-প্রান্ত থেকে। সম্ভবত সেদিন থেকেই আমার প্রকৃত আর্ণিংয়ের ভাবনার শুরু।
“জিম্বাবোয়ের বোলারদের মধ্যে রসন একটু বেশি ভালো বল করছিল, ফলে ওকে একটু দেখেশুনে খেলছিলাম। এরপর যখন দেখলাম দলের রান ১৫০ পেরিয়ে গেছে, ভাবলাম, আরেকটু চালিয়ে খেলি। তো, রসনের একটা বলে পা বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে দেখি, বেশ শর্ট পিচ, চোখ বুজে চালালাম। ছয়। উত্তেজিত রসন একটা বিচ্ছিরি গালাগাল দিয়ে গেল। মাথায় রক্ত চড়ে গেল। পরের বলটা মিড উইকেটের মাথার উপর দিয়ে ছয়, তার পরের বলটা রসনের মাথার উপর দিয়ে ছয়।” বক্তা কপিলদেব নিখাঞ্জ, ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ১৭৫ (অপরাজিত) রানের পর। আচ্ছা, কুয়াশা তো ওখানেও ছিল। সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলোর ধর্মঘট। একটাও রান আমরা দেখতে পাইনি সেদিন।
হুম্ম্ম্, কুয়াশার মধ্যে প্রকৃত আশা। ১৭ রানে ৫ উইকেট। ভারত হারছে। নিশ্চিত। কিন্তু ওই যে বললাম, আশা। ঠিক সময়মতো হাজির। সেদিন থেকেই ভারতীয় ক্রিকেট রোজগেরে হবার টিকিটটা পেয়ে গেল। আর্ণিং...
আমি আবার পুকুরপাড়ে। আমাদের খেলার মাঠ ভর্তি কুয়াশা। অনামিকা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা করে, ‘লা-লা-লা-লালা, লা-লা-লা-লালা’ বসিয়ে দিলেই হল। ভিজে গেছে সব ঘাস, ভিজে গেছে আমাদের অনুভূতি। আর্ণিং টাইম। ১৭ রানে ৫ উইকেট থেকে জিততেই হবে। বিপক্ষে যে ভদ্রলোক বল করছেন, তিনি একটাও লুজ বল দেবেন না। তার বাড়ির ফিল্ডাররাও সব তৈরি।
স্টাফ সিলেকশন কমিশনের প্রথম পরীক্ষায় পাশ। এবার আঙুলের গতি পরখ হবে একমাস পরে। আঙুলের সংলাপ! অনামিকার ঘাড়ের উপর পড়া চুলগুলো আর কানের লতির পাশে নরম জায়গাটা জানে আঙুলের সংলাপ কী এবং
কেন। আচ্ছা, অনামিকাও কি জানে না!
- আচ্ছা অরু, তুমি টাইপ টেস্টের জন্যে ঠিকমতো তৈরি তো?
- আমার আঙুল জানে।
- তোমার হেঁয়ালি ছাড়ো।
- হেঁয়ালি নয়, অনামিকা। ওই নরম কী-গুলোতে যখন আমার আঙুল ডুবে যায়, মনে হয়, আমি ওদের
গায়ে হাত বুলিয়ে কথা বলছি। জোরে চাপ দিলে, পাছে ওদের ব্যথা লাগে, তাই কত শব্দ আমার অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। রান করতে হবে রান। ১৭৫ রান।
- আবার শুরু হল পাগলামী। আমি কিন্তু এবার চলে যাব।
(অনামিকা, আমি তোমাকে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইলাম পৃথিবীটা কত সুন্দর, আর তুমি কিনা আমার তর্জনীর ভুল
ধরে বসলে!)
অনামিকা চলে গেল, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে। পাশের অশত্থ গাছটা, যার শিকড় বয়ে গেছে যমুনার মতো, আমাকে ডেকে বলল, সব মাটি নিয়ে গেছে আমার পূর্বপুরুষ। তবু ভালো আছি এই কুয়াশায়। বলতে পারিস, বৃষ্টি আসবে কবে?
বৃষ্টি এল। অনামিকাকে নিয়ে বেরিয়েছি, হঠাৎ বৃষ্টি। দাঁড়িয়ে গেলাম পাড়ার ‘প্রণামী’ স্টুডিওর বারান্দায়। আমার
অভ্যেস ছিল, বাসের নাম্বার মনে রাখার। দূর থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে একটা করে বাস আসছে, আর আমি বলে
দিচ্ছি তার নাম্বার। একটা বাসের নম্বর ছিল, আজও স্পষ্ট মনে আছে, ১৭০৫।
ময়লা জামা-প্যান্ট পরে উদয় হলেন একজন।
- প্রবাবলি আই অ্যাম দ্য ওনলি পারসন, হু ডাজ নট হ্যাভ থাইরয়েড গ্ল্যান্ড...বাট স্টিল অ্যালাইভ। বজ্রপাতের মতো শব্দগুলো নেমে এল বারান্দায়।
- এক পাগলে রক্ষে নেই...(অনামিকা কি স্বগতোক্তি করল?)
আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সেই লোকটার পরবর্তী সংযোজন, এই যে দেখছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী খুন হলেন, এর কোনো কিনারা হবে না।
- কেন বলুন তো? আমি কৌতুহলী।
- লক্ষ্য করুন, ইন্দিরা গান্ধীর প্রতীক চিহ্ন হল হাত। আর যিনি বা যারা তাঁকে হত্যা করার দায়ে ধরা পড়েছেন, সব পঞ্জাবের মানুষ।
- তাতে কী হল?
- হাত মানে পাঁচটা আঙুল। পঞ্জাব মানে পাঁচটা নদী। ঠিক?
- হ্যাঁ, ঠিক।
- ফাইভ ইন্টু ফাইভ, ইজ ইকুয়্যাল টু টোয়েন্টিফাইভ, মানে টু অ্যান্ড ফাইভ। টু প্লাস ফাইভ মানে সেভেন, মানে ইউরেনাস, মানে রহস্য। ফলে ওই হত্যাটা রহস্যপূর্ণই থেকে যাবে। লোকটা একটানা অতগুলো কথা বলে তখন হাঁপাচ্ছে।
আমি চুপ, অনামিকা চুপ, আকাশও চুপ। বৃষ্টি থেমে গেছে। এবার পালাতে হবে। যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছি লোকটা বলছে, আমরা সবাই যদি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যেতাম, বলা যেত, বয়ম শনৈ শনৈ...
আমি শনৈ শনৈ হাত চালাচ্ছি। সামনে ফেলে রাখা অক্ষরগুলো মুখ চেপে হাসছে। ১৫ মিনিট সময় শেষ। এবার অপেক্ষা, কবে আসবে সেই প্রত্যাশিত চিঠি। ১৭৫ রান। আমি জানি, আমার জন্যে ১৭ রানে ৫ উইকেট অপেক্ষা করে আছে।
সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলের কোচ নিখিল নন্দী। পার্কসার্কাস ময়দানে জমিয়ে প্র্যাকটিস চলছে। অটোগ্রাফ নিচ্ছি, হাবিব, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, আকবর...। হঠাৎ থামিয়ে দিলেন হাবিব অনুজ, বাবু, জারা পিছে যাইয়ে। বাবু? প্রায় ভিরমি খাই আর কী। বিনয়। বিনয় মজুমদার। “ফিরে এসো চাকা” । সেবার বাংলা ফাইনালে ইন্দর, হরজিন্দরের পঞ্জাবের কাছে ৬-১ গোলে হেরে গেল। আমিও হারলাম। কোনো চিঠি এল না। আমি ১৭ রানে ৫ উইকেট জেনেও সামলে নেবার চেষ্টা করি।
আমি ভালোবেসেছিলাম অক্ষরগুলোকে, আর অক্ষরগুলো আমাকে। ফলে আঙুলের সংলাপ একদিন আমাকে এনে ফেলল একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে। মালিক ‘লায়ন্স ক্লাব’এর লায়ন। অফিসের পর আরও অনেক কাজ জমে থাকে। লায়নের ব্যক্তিগত কাজ। সে সব শেষ করতে করতে রাত বেড়ে যায়, খিদে পেয়ে যায়। মাস-মাইনে এতটাই কম যে, অফিস থেকে বেরিয়ে সামনের ফুটপাথের দোকান থেকে কম পয়সায় ইডলি কিনে খাই। আমার অবস্থা তখন আরব আমীরশাহী ক্রিকেট টীমের ক্যাপ্টেনের মতো। লোকে বলে, ওনার নাকি যতগুলো গাড়ি, তত রান নেই। আমারও ‘রান’ নেই, তবু পেট ভরতে হয়।
বালিশে নিঝুম মেঘ, কুয়াশার দাগ
ছাদে ঝিঁঝিঁদের শব
পেয়ালায় জমে থাকা ঘুমে
স্তব্ধ আমাদের বাড়িঘর
আমরা তবুও ভাবি
গরাদ ভিজিয়ে ঘরে জমা হবে ফোঁটা ফোঁটা চাঁদ।
কুয়াশা ভেদ করে একটা গাড়ি দাঁড়াল অনামিকাদের বাড়ির সামনে, নেমে এল প্রজাপতির আসবাবপত্র। আমি শুয়োপোকার রোঁয়া দেখতে পেলাম ফরসা সজনে ডালে। বুকে যন্ত্রণা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, “এ ব্যথা কী যে
ব্যথা” সেই প্রথম আমার কাছে পূর্ণ হয়ে ধরা দিল। ঘন্টা দুয়েক পর বনেদী সানাই তার সম্দেখিয়ে বিদায় নিল, আর আমি তখনও সঞ্চারীতে বসে খাদের গভীরতা মেপে যাচ্ছি।
‘লায়ন’ নিজের হাতে লিখে দিতেন, যা টাইপ করতে হবে। সে এক কঠিন কাজ। গম্ভীর গলা প্রায় প্রতিদিন আমার জন্যে একটা আপ্তবাক্য রেখে যেত, আই ডোন্ট লাইক এনিথিং ডার্টি। অথচ ওনার হাতের লেখা ছিল একদম বাগজোলা খালের কাদার মতো। জল আছে, তবু মুখ দেখা যায় না। রোজই মনে হত, ফরোয়ার্ড সর্ট লেগে ফিল্ডিং করছি, হেলমেট ছাড়া। কপালে লাগলেই...। একদিন লাগল। ‘অফন’কে হাতের লেখার সৌজন্যে ‘আফটার’ ধরে নিয়ে টাইপ করেছিলাম। ব্যস! ওভারহেড তারে কলাপাতা! তবে সেদিনটা (নাকি রাত?) ছিল অন্যরকম। ‘এমনকী একটা পোকাও ঘুরে দাঁড়ায়’। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। সেদিন ঠিক কী কী বলেছিলাম, আজ আর মনে নেই। এটুকু মনে আছে যে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ‘অদ্য শেষ রজনী’।
পরদিন সকালবেলা অফিসে গিয়েই, ‘আই হিয়ারবাই টেন্ডার মাই রেজিগনেশন...’। ম্যানেজার দিলীপবাবু, উনি আবার ‘লায়ন’-এর বন্ধু, অনেক বোঝালেন। আমি পয়সা-কড়ি বুঝে নিয়ে অফিসের পাশের গলির সেলুনে ঢুকে পড়লাম। দাড়ি কাটাতে হবে। দাড়ি কাটানো যে এত আরামের, আমি সেদিনই প্রথম বুঝলাম। দাড়ি আমাকে, না আমি দাড়িকে, কে কাকে মুক্তি দিল কে জানে!
যাক, কুয়াশা অনেকটাই কেটেছে। অনেকটা রাস্তা পার হয়ে এসেছি। আর কিছুটা গেলেই কাশ্মীরি গেট। নির্বাচন দপ্তরের পুরোনো বিল্ডিং আমার গন্তব্য। ভোটের কাজ। ছবিগুলো ঠিক উঠল কী না, নামের সঙ্গে ঠিকানা যথাযথ কী না...। সে অনেক হ্যাঁপা।
অনামিকা ওর ছবিগুলো ফেরৎ নিতে এসেছে। ওর তখন ঠিকানা বদলের সময় হয়ে এসেছে। আচ্ছা, আমার কষ্ট হচ্ছে না কেন? আমি এখনও নট আউট। এতক্ষণ নন-স্ট্রাইকার এন্ড থেকে যে আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছিল, সে কি আউট হয়ে গেল? সাদা পোশাকের আম্পায়ারদের জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। এঁদের কখনও কখনও আমার সিনেমার সেইসব সাদা পোশাকের ডাক্তারদের মতো মনে হয়, যাঁরা লালবাতি জ্বলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, স্যরি...। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, সৈয়দ কিরমানী অনেকক্ষণ সঙ্গত করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন। মিঃ কিরমানী, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
- অনামিকা, ওঁরা কারা? (আমার গলাটা কি দেবদাসের মতো শোনালো?)
- ঘরে বাইরে এত চাপ। আমি আর পারছি না। (আমি স্পষ্ট শুনলাম, ও বলছে, আমি আউট হয়ে গেছি।)
- তুমি চিন্তা কোরো না। হাতে এখনও চার উইকেট। আর তুমিও ‘ঘরে-বাইরে’, বাই রে’র বিমলা নও।
- একটু সিরিয়াস হও অরু। আমি চাই না, আমার জন্যে তোমার কোনো ক্ষতি হোক। (একদম বস্তাপচা ফিল্মি ডায়লগ।)
- আমাকে আরেকটু সময় দাও। একটা সরকারি অফিসের প্যানেলে আমার নাম উঠেছে। হয়তো মাস ছয়েকের মধ্যে...। ভুলে যেও না, হাতে এখনও চার উইকেট।
- আমার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। আর দু-মাস বাকি আছে। তুমি কি বুঝতে পারছ?
- অনামিকা, তুমি রক্তকরবী নাটক দেখেছ? রাজা, অন্ধকার...
- তুমি একটা কিছু কর। ওই অফিসটায় গিয়ে খোঁজ নাও।
- “দ্য রিচ লিভস অন টপ, গিভিং দ্য পুওর বিনিথ ড্রপ আফটার ড্রপ”। আমি খোঁজ নিয়েছি। অন্তত
তিন মাস লাগবেই। চলো, আমরা দুজনে পালাই। তারপর সিরাজ-উদ্-দৌলা যতই ‘পলাশী’, ‘পলাশী’ বলে চীৎকার করুক, সে একবারের জন্যেও মঞ্চে আসবে না।
- তুমি কি একটুও সিরিয়াস হতে জানো না?
- চলো সোনাই, ‘কিছু করে দেখাই।’
- ঠিক আছে, আমি কাল সকালে ফের আসব পুকুরপাড়ে। তুমি তৈরি থেকো।
- আমি তো সেই কবে থেকেই ক্রিজে বিছানা পেতে পড়ে আছি।
ভোটার লিস্ট মেলাতে গিয়ে দেখি প্রচুর ভুলের ছড়াছড়ি। নাম মহিলার, ছবিতে পুরুষ। অথবা পুরুষের ছবি, পুরুষের নাম, কিন্তু পাশে লেখা ‘ফিমেল’। ঠিকমতো স্ক্যানিং করতে হবে। এরপর মার্জিং।
অনামিকা, আমার কুয়াশা সুন্দরী, সকালবেলায় হাজির পুকুরপাড়ে। আকাশী রঙের শাড়ি, ট্যারেন্টুলার সুক্ষ্ণ জালের মতো কুয়াশা, পুকুরপাড়। একদম জীবনানন্দের কবিতা মাইরি!
- অনামিকা, তোমার ক্রিকেটের পোশাক কই?
- শোনো, ভেবে দেখলাম, তোমার জীবনটা নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই।
- তুমি তো আমাকে রান-আউট করোনি অনামিকা।
- হঠাৎ করে এসব করা ঠিক না। তুমি তোমার মতো থাক, আমি আমার মতো। ভুল বুঝো না আমায় সোনা। প্লীজ।
- অনামিকা, আমি আমার অনেক প্রিয় শট ছেঁটে ফেলেছি শুধু তোমার কথা ভেবে।
- তোমার যা বয়েস, ধীরে-সুস্থে তুমি আরও অনেক উপরে উঠতে পারবে। এরপর থানা-পুলিশ হলে তোমার সরকারি চাকরি পাওয়া সমস্যা হয়ে যাবে। আমার জন্যে নিজের ক্যারিয়ারের ক্ষতি কোরো না প্লীজ।
- অনামিকা, আজ হেরে গেলে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়। আমি লড়াই ভালোবাসি। শেষ পর্যন্ত লড়তে চাই।
- আমি আসছি বাড়ি থেকে ঘুরে।
- ওভারের কোটা শেষ হয়ে আসছে। এখন আর ধরে খেললে হবে না। বিগ হিট, ডার্লিং, বিগ হিট।
- তুমি অপেক্ষা কর, আমি ঠিক আসব।
অনামিকা আর আসেনি। আমিও কি বদলে গিয়েছিলাম? নিজেকে ঘরবন্দী করে অজস্র বই পড়া, আর সেগুলোর মধ্যে ডুব দিয়ে খুঁজে বেড়াতাম পাহাড়, সমুদ্র, কুয়াশা এবং অনামিকা। আসলে অভিমানের কোনো ইংরেজি হয় না। সে জন্যেই বোধহয়...
মাস ছয়েক পরে এসেছিল সেই সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র। সেদিনও, কী আশ্চর্য, কুয়াশায় ঘেরা ছিল আমাদের খেলার মাঠ, পুকুরপাড়। বাতাসে তখনও অনামিকা গন্ধ...
হঠাৎ শব্দ করে একটা এস.এম.এস. এল। একটা ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, উই হ্যাভ রিসিভড ইয়োর ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট ভাইড চেক...ফর...থ্যাঙ্ক য়্যু। পেমেন্ট সাবজেক্ট টু রিয়ালাইজেশন...। রিয়ালাইজেশন শব্দের দু-রকম অর্থ আজ এই পুরোনো দিল্লীর অফিসে কী-বোর্ডের নরমে ডুবে যাচ্ছে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিন্তে।
তখনই নিয়ম না মেনে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এল পুরোনো দিল্লীর গাছপালা ভিজিয়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দূরের করিডর দৌড়ে পার হয়ে যাচ্ছে একটা ভিজে বেড়াল।
একটু পিছিয়ে ভাবলেই আমি আর দিল্লীতে নয়, গাঁয়ের এক পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ঠোঁটে গুরু দত্তর মতো এক চিলতে বিষণ্ণ হাসি উঁকি দিচ্ছে। মেয়েটা, সেই যে গেল, আর এল না। ধীর পায়ে এরপর আমি ‘বৌদি’র চায়ের দোকানে। জুম ইন। আমি বিড়বিড় করছি, দ্যট গার্ল মেড অ্যান অগস্ত যাত্রা। গরম চায়ে চোবানো বিস্কুট নরম হয়ে গলে গলে পড়ছে। বৌদি আরেকজন খদ্দেরকে ফিসফিস করে বলছেন, ছেলেটা পড়াশোনায় খুব ভালো, মন খারাপ হলেই ইংরেজিতে বিড়বিড় করে কী যেন বলে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, দিল্লীর কথা, কুয়াশার কথা। আমার ঠিক সামনেই একটা মারুতি-৮০০, যার ওয়াইপারটা ‘ইয়েস-নো, ইয়েস-নো’ করে যাচ্ছে একটানা। সেবার কুয়াশায়, রিক্সায় আমি আর অনামিকা, গালে-গাল, নরম, ভিজে, ঘনিষ্ঠ। সেদিন অনামিকাও হঠাৎ এমন, ইয়েস-নো, ইয়েস-নো। ‘লার্ণিং টাইমে এসব করা ঠিক না’। কপট রাগ ও-প্রান্ত থেকে। সম্ভবত সেদিন থেকেই আমার প্রকৃত আর্ণিংয়ের ভাবনার শুরু।
“জিম্বাবোয়ের বোলারদের মধ্যে রসন একটু বেশি ভালো বল করছিল, ফলে ওকে একটু দেখেশুনে খেলছিলাম। এরপর যখন দেখলাম দলের রান ১৫০ পেরিয়ে গেছে, ভাবলাম, আরেকটু চালিয়ে খেলি। তো, রসনের একটা বলে পা বাড়িয়ে খেলতে গিয়ে দেখি, বেশ শর্ট পিচ, চোখ বুজে চালালাম। ছয়। উত্তেজিত রসন একটা বিচ্ছিরি গালাগাল দিয়ে গেল। মাথায় রক্ত চড়ে গেল। পরের বলটা মিড উইকেটের মাথার উপর দিয়ে ছয়, তার পরের বলটা রসনের মাথার উপর দিয়ে ছয়।” বক্তা কপিলদেব নিখাঞ্জ, ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ১৭৫ (অপরাজিত) রানের পর। আচ্ছা, কুয়াশা তো ওখানেও ছিল। সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলোর ধর্মঘট। একটাও রান আমরা দেখতে পাইনি সেদিন।
হুম্ম্ম্, কুয়াশার মধ্যে প্রকৃত আশা। ১৭ রানে ৫ উইকেট। ভারত হারছে। নিশ্চিত। কিন্তু ওই যে বললাম, আশা। ঠিক সময়মতো হাজির। সেদিন থেকেই ভারতীয় ক্রিকেট রোজগেরে হবার টিকিটটা পেয়ে গেল। আর্ণিং...
আমি আবার পুকুরপাড়ে। আমাদের খেলার মাঠ ভর্তি কুয়াশা। অনামিকা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হালকা করে, ‘লা-লা-লা-লালা, লা-লা-লা-লালা’ বসিয়ে দিলেই হল। ভিজে গেছে সব ঘাস, ভিজে গেছে আমাদের অনুভূতি। আর্ণিং টাইম। ১৭ রানে ৫ উইকেট থেকে জিততেই হবে। বিপক্ষে যে ভদ্রলোক বল করছেন, তিনি একটাও লুজ বল দেবেন না। তার বাড়ির ফিল্ডাররাও সব তৈরি।
স্টাফ সিলেকশন কমিশনের প্রথম পরীক্ষায় পাশ। এবার আঙুলের গতি পরখ হবে একমাস পরে। আঙুলের সংলাপ! অনামিকার ঘাড়ের উপর পড়া চুলগুলো আর কানের লতির পাশে নরম জায়গাটা জানে আঙুলের সংলাপ কী এবং
কেন। আচ্ছা, অনামিকাও কি জানে না!
- আচ্ছা অরু, তুমি টাইপ টেস্টের জন্যে ঠিকমতো তৈরি তো?
- আমার আঙুল জানে।
- তোমার হেঁয়ালি ছাড়ো।
- হেঁয়ালি নয়, অনামিকা। ওই নরম কী-গুলোতে যখন আমার আঙুল ডুবে যায়, মনে হয়, আমি ওদের
গায়ে হাত বুলিয়ে কথা বলছি। জোরে চাপ দিলে, পাছে ওদের ব্যথা লাগে, তাই কত শব্দ আমার অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। রান করতে হবে রান। ১৭৫ রান।
- আবার শুরু হল পাগলামী। আমি কিন্তু এবার চলে যাব।
(অনামিকা, আমি তোমাকে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইলাম পৃথিবীটা কত সুন্দর, আর তুমি কিনা আমার তর্জনীর ভুল
ধরে বসলে!)
অনামিকা চলে গেল, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে। পাশের অশত্থ গাছটা, যার শিকড় বয়ে গেছে যমুনার মতো, আমাকে ডেকে বলল, সব মাটি নিয়ে গেছে আমার পূর্বপুরুষ। তবু ভালো আছি এই কুয়াশায়। বলতে পারিস, বৃষ্টি আসবে কবে?
বৃষ্টি এল। অনামিকাকে নিয়ে বেরিয়েছি, হঠাৎ বৃষ্টি। দাঁড়িয়ে গেলাম পাড়ার ‘প্রণামী’ স্টুডিওর বারান্দায়। আমার
অভ্যেস ছিল, বাসের নাম্বার মনে রাখার। দূর থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে একটা করে বাস আসছে, আর আমি বলে
দিচ্ছি তার নাম্বার। একটা বাসের নম্বর ছিল, আজও স্পষ্ট মনে আছে, ১৭০৫।
ময়লা জামা-প্যান্ট পরে উদয় হলেন একজন।
- প্রবাবলি আই অ্যাম দ্য ওনলি পারসন, হু ডাজ নট হ্যাভ থাইরয়েড গ্ল্যান্ড...বাট স্টিল অ্যালাইভ। বজ্রপাতের মতো শব্দগুলো নেমে এল বারান্দায়।
- এক পাগলে রক্ষে নেই...(অনামিকা কি স্বগতোক্তি করল?)
আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে সেই লোকটার পরবর্তী সংযোজন, এই যে দেখছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী খুন হলেন, এর কোনো কিনারা হবে না।
- কেন বলুন তো? আমি কৌতুহলী।
- লক্ষ্য করুন, ইন্দিরা গান্ধীর প্রতীক চিহ্ন হল হাত। আর যিনি বা যারা তাঁকে হত্যা করার দায়ে ধরা পড়েছেন, সব পঞ্জাবের মানুষ।
- তাতে কী হল?
- হাত মানে পাঁচটা আঙুল। পঞ্জাব মানে পাঁচটা নদী। ঠিক?
- হ্যাঁ, ঠিক।
- ফাইভ ইন্টু ফাইভ, ইজ ইকুয়্যাল টু টোয়েন্টিফাইভ, মানে টু অ্যান্ড ফাইভ। টু প্লাস ফাইভ মানে সেভেন, মানে ইউরেনাস, মানে রহস্য। ফলে ওই হত্যাটা রহস্যপূর্ণই থেকে যাবে। লোকটা একটানা অতগুলো কথা বলে তখন হাঁপাচ্ছে।
আমি চুপ, অনামিকা চুপ, আকাশও চুপ। বৃষ্টি থেমে গেছে। এবার পালাতে হবে। যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছি লোকটা বলছে, আমরা সবাই যদি বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দৌড়ে যেতাম, বলা যেত, বয়ম শনৈ শনৈ...
আমি শনৈ শনৈ হাত চালাচ্ছি। সামনে ফেলে রাখা অক্ষরগুলো মুখ চেপে হাসছে। ১৫ মিনিট সময় শেষ। এবার অপেক্ষা, কবে আসবে সেই প্রত্যাশিত চিঠি। ১৭৫ রান। আমি জানি, আমার জন্যে ১৭ রানে ৫ উইকেট অপেক্ষা করে আছে।
সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলের কোচ নিখিল নন্দী। পার্কসার্কাস ময়দানে জমিয়ে প্র্যাকটিস চলছে। অটোগ্রাফ নিচ্ছি, হাবিব, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, আকবর...। হঠাৎ থামিয়ে দিলেন হাবিব অনুজ, বাবু, জারা পিছে যাইয়ে। বাবু? প্রায় ভিরমি খাই আর কী। বিনয়। বিনয় মজুমদার। “ফিরে এসো চাকা” । সেবার বাংলা ফাইনালে ইন্দর, হরজিন্দরের পঞ্জাবের কাছে ৬-১ গোলে হেরে গেল। আমিও হারলাম। কোনো চিঠি এল না। আমি ১৭ রানে ৫ উইকেট জেনেও সামলে নেবার চেষ্টা করি।
আমি ভালোবেসেছিলাম অক্ষরগুলোকে, আর অক্ষরগুলো আমাকে। ফলে আঙুলের সংলাপ একদিন আমাকে এনে ফেলল একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে। মালিক ‘লায়ন্স ক্লাব’এর লায়ন। অফিসের পর আরও অনেক কাজ জমে থাকে। লায়নের ব্যক্তিগত কাজ। সে সব শেষ করতে করতে রাত বেড়ে যায়, খিদে পেয়ে যায়। মাস-মাইনে এতটাই কম যে, অফিস থেকে বেরিয়ে সামনের ফুটপাথের দোকান থেকে কম পয়সায় ইডলি কিনে খাই। আমার অবস্থা তখন আরব আমীরশাহী ক্রিকেট টীমের ক্যাপ্টেনের মতো। লোকে বলে, ওনার নাকি যতগুলো গাড়ি, তত রান নেই। আমারও ‘রান’ নেই, তবু পেট ভরতে হয়।
বালিশে নিঝুম মেঘ, কুয়াশার দাগ
ছাদে ঝিঁঝিঁদের শব
পেয়ালায় জমে থাকা ঘুমে
স্তব্ধ আমাদের বাড়িঘর
আমরা তবুও ভাবি
গরাদ ভিজিয়ে ঘরে জমা হবে ফোঁটা ফোঁটা চাঁদ।
কুয়াশা ভেদ করে একটা গাড়ি দাঁড়াল অনামিকাদের বাড়ির সামনে, নেমে এল প্রজাপতির আসবাবপত্র। আমি শুয়োপোকার রোঁয়া দেখতে পেলাম ফরসা সজনে ডালে। বুকে যন্ত্রণা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, “এ ব্যথা কী যে
ব্যথা” সেই প্রথম আমার কাছে পূর্ণ হয়ে ধরা দিল। ঘন্টা দুয়েক পর বনেদী সানাই তার সম্দেখিয়ে বিদায় নিল, আর আমি তখনও সঞ্চারীতে বসে খাদের গভীরতা মেপে যাচ্ছি।
‘লায়ন’ নিজের হাতে লিখে দিতেন, যা টাইপ করতে হবে। সে এক কঠিন কাজ। গম্ভীর গলা প্রায় প্রতিদিন আমার জন্যে একটা আপ্তবাক্য রেখে যেত, আই ডোন্ট লাইক এনিথিং ডার্টি। অথচ ওনার হাতের লেখা ছিল একদম বাগজোলা খালের কাদার মতো। জল আছে, তবু মুখ দেখা যায় না। রোজই মনে হত, ফরোয়ার্ড সর্ট লেগে ফিল্ডিং করছি, হেলমেট ছাড়া। কপালে লাগলেই...। একদিন লাগল। ‘অফন’কে হাতের লেখার সৌজন্যে ‘আফটার’ ধরে নিয়ে টাইপ করেছিলাম। ব্যস! ওভারহেড তারে কলাপাতা! তবে সেদিনটা (নাকি রাত?) ছিল অন্যরকম। ‘এমনকী একটা পোকাও ঘুরে দাঁড়ায়’। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। সেদিন ঠিক কী কী বলেছিলাম, আজ আর মনে নেই। এটুকু মনে আছে যে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ‘অদ্য শেষ রজনী’।
পরদিন সকালবেলা অফিসে গিয়েই, ‘আই হিয়ারবাই টেন্ডার মাই রেজিগনেশন...’। ম্যানেজার দিলীপবাবু, উনি আবার ‘লায়ন’-এর বন্ধু, অনেক বোঝালেন। আমি পয়সা-কড়ি বুঝে নিয়ে অফিসের পাশের গলির সেলুনে ঢুকে পড়লাম। দাড়ি কাটাতে হবে। দাড়ি কাটানো যে এত আরামের, আমি সেদিনই প্রথম বুঝলাম। দাড়ি আমাকে, না আমি দাড়িকে, কে কাকে মুক্তি দিল কে জানে!
যাক, কুয়াশা অনেকটাই কেটেছে। অনেকটা রাস্তা পার হয়ে এসেছি। আর কিছুটা গেলেই কাশ্মীরি গেট। নির্বাচন দপ্তরের পুরোনো বিল্ডিং আমার গন্তব্য। ভোটের কাজ। ছবিগুলো ঠিক উঠল কী না, নামের সঙ্গে ঠিকানা যথাযথ কী না...। সে অনেক হ্যাঁপা।
অনামিকা ওর ছবিগুলো ফেরৎ নিতে এসেছে। ওর তখন ঠিকানা বদলের সময় হয়ে এসেছে। আচ্ছা, আমার কষ্ট হচ্ছে না কেন? আমি এখনও নট আউট। এতক্ষণ নন-স্ট্রাইকার এন্ড থেকে যে আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছিল, সে কি আউট হয়ে গেল? সাদা পোশাকের আম্পায়ারদের জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। এঁদের কখনও কখনও আমার সিনেমার সেইসব সাদা পোশাকের ডাক্তারদের মতো মনে হয়, যাঁরা লালবাতি জ্বলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, স্যরি...। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, সৈয়দ কিরমানী অনেকক্ষণ সঙ্গত করে আউট হয়ে গিয়েছিলেন। মিঃ কিরমানী, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
- অনামিকা, ওঁরা কারা? (আমার গলাটা কি দেবদাসের মতো শোনালো?)
- ঘরে বাইরে এত চাপ। আমি আর পারছি না। (আমি স্পষ্ট শুনলাম, ও বলছে, আমি আউট হয়ে গেছি।)
- তুমি চিন্তা কোরো না। হাতে এখনও চার উইকেট। আর তুমিও ‘ঘরে-বাইরে’, বাই রে’র বিমলা নও।
- একটু সিরিয়াস হও অরু। আমি চাই না, আমার জন্যে তোমার কোনো ক্ষতি হোক। (একদম বস্তাপচা ফিল্মি ডায়লগ।)
- আমাকে আরেকটু সময় দাও। একটা সরকারি অফিসের প্যানেলে আমার নাম উঠেছে। হয়তো মাস ছয়েকের মধ্যে...। ভুলে যেও না, হাতে এখনও চার উইকেট।
- আমার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছে। আর দু-মাস বাকি আছে। তুমি কি বুঝতে পারছ?
- অনামিকা, তুমি রক্তকরবী নাটক দেখেছ? রাজা, অন্ধকার...
- তুমি একটা কিছু কর। ওই অফিসটায় গিয়ে খোঁজ নাও।
- “দ্য রিচ লিভস অন টপ, গিভিং দ্য পুওর বিনিথ ড্রপ আফটার ড্রপ”। আমি খোঁজ নিয়েছি। অন্তত
তিন মাস লাগবেই। চলো, আমরা দুজনে পালাই। তারপর সিরাজ-উদ্-দৌলা যতই ‘পলাশী’, ‘পলাশী’ বলে চীৎকার করুক, সে একবারের জন্যেও মঞ্চে আসবে না।
- তুমি কি একটুও সিরিয়াস হতে জানো না?
- চলো সোনাই, ‘কিছু করে দেখাই।’
- ঠিক আছে, আমি কাল সকালে ফের আসব পুকুরপাড়ে। তুমি তৈরি থেকো।
- আমি তো সেই কবে থেকেই ক্রিজে বিছানা পেতে পড়ে আছি।
ভোটার লিস্ট মেলাতে গিয়ে দেখি প্রচুর ভুলের ছড়াছড়ি। নাম মহিলার, ছবিতে পুরুষ। অথবা পুরুষের ছবি, পুরুষের নাম, কিন্তু পাশে লেখা ‘ফিমেল’। ঠিকমতো স্ক্যানিং করতে হবে। এরপর মার্জিং।
অনামিকা, আমার কুয়াশা সুন্দরী, সকালবেলায় হাজির পুকুরপাড়ে। আকাশী রঙের শাড়ি, ট্যারেন্টুলার সুক্ষ্ণ জালের মতো কুয়াশা, পুকুরপাড়। একদম জীবনানন্দের কবিতা মাইরি!
- অনামিকা, তোমার ক্রিকেটের পোশাক কই?
- শোনো, ভেবে দেখলাম, তোমার জীবনটা নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই।
- তুমি তো আমাকে রান-আউট করোনি অনামিকা।
- হঠাৎ করে এসব করা ঠিক না। তুমি তোমার মতো থাক, আমি আমার মতো। ভুল বুঝো না আমায় সোনা। প্লীজ।
- অনামিকা, আমি আমার অনেক প্রিয় শট ছেঁটে ফেলেছি শুধু তোমার কথা ভেবে।
- তোমার যা বয়েস, ধীরে-সুস্থে তুমি আরও অনেক উপরে উঠতে পারবে। এরপর থানা-পুলিশ হলে তোমার সরকারি চাকরি পাওয়া সমস্যা হয়ে যাবে। আমার জন্যে নিজের ক্যারিয়ারের ক্ষতি কোরো না প্লীজ।
- অনামিকা, আজ হেরে গেলে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়। আমি লড়াই ভালোবাসি। শেষ পর্যন্ত লড়তে চাই।
- আমি আসছি বাড়ি থেকে ঘুরে।
- ওভারের কোটা শেষ হয়ে আসছে। এখন আর ধরে খেললে হবে না। বিগ হিট, ডার্লিং, বিগ হিট।
- তুমি অপেক্ষা কর, আমি ঠিক আসব।
অনামিকা আর আসেনি। আমিও কি বদলে গিয়েছিলাম? নিজেকে ঘরবন্দী করে অজস্র বই পড়া, আর সেগুলোর মধ্যে ডুব দিয়ে খুঁজে বেড়াতাম পাহাড়, সমুদ্র, কুয়াশা এবং অনামিকা। আসলে অভিমানের কোনো ইংরেজি হয় না। সে জন্যেই বোধহয়...
মাস ছয়েক পরে এসেছিল সেই সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র। সেদিনও, কী আশ্চর্য, কুয়াশায় ঘেরা ছিল আমাদের খেলার মাঠ, পুকুরপাড়। বাতাসে তখনও অনামিকা গন্ধ...
হঠাৎ শব্দ করে একটা এস.এম.এস. এল। একটা ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, উই হ্যাভ রিসিভড ইয়োর ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট ভাইড চেক...ফর...থ্যাঙ্ক য়্যু। পেমেন্ট সাবজেক্ট টু রিয়ালাইজেশন...। রিয়ালাইজেশন শব্দের দু-রকম অর্থ আজ এই পুরোনো দিল্লীর অফিসে কী-বোর্ডের নরমে ডুবে যাচ্ছে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিন্তে।
তখনই নিয়ম না মেনে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এল পুরোনো দিল্লীর গাছপালা ভিজিয়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম দূরের করিডর দৌড়ে পার হয়ে যাচ্ছে একটা ভিজে বেড়াল।
(অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস )
আজ শনিবার মোবাইলটা দেখে বুঝলাম।একটা গল্প যা বারের গণ্ডগোল পাকিয়ে দিতে পারে!অদ্ভুত ভাল লাগল সুবীর কাকু।দারুণ কম্পজিশান...
উত্তরমুছুনবলার ভঙ্গী ভালো লেগেছে -
উত্তরমুছুনkhub valo laglo...
উত্তরমুছুনঅসাধারণ।
উত্তরমুছুন