মোহমুদগর
১.
স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। তার পায়ের শব্দ। ওই যে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নামছে সে। একটু কি থামল? কেশে ওঠল যেন একবার? চুপ করে বসে আছি চেয়ারে। এ ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার। না কি ছিল? কী করতে পারতাম? না কি বলতাম, যা করেছ, সব ঠিক। তোমার কোনো দোষ নেই, অপরেশ। ভুল যা কিছু হয়েছে, আমারই!
তা হলেই কি মিটে যেত সব ঝামেলা? ফাটল আর থাকত না এই সম্পর্কে? সত্যি? তা কী করে হয়? ফাটল ধরে যাচ্ছে, এটা টের পেয়েছিলাম আগেই। গত দুবছর ধরে। মিলিকে নিয়ে। প্রথমে স্বীকার করেনি মিলি। চাইছিলাম, নিজে থেকেই বলুক সবকিছু। বলেনি। আমি যে টের পাচ্ছি, তাও বলিনি তাকে। লোকের মুখে শুনি। পাড়া থেকে অফিসে, সর্বত্র, একটা ফিসফিস শব্দ। ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাড়াময়। আমাকে দেখলেই থমকে যাচ্ছে তা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পরিচিতজন। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল ক্রমশ। পাত্তা না দিতে গিয়ে, দেখি, পারছি না।
সেদিন, সকালে, পাড়ার সেলুনে, চুল কাটাতে গিয়ে, নিতাই, সেলুনের মালিক, বলে ওঠল, দাদা, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না তো?
আয়নার ভেতর দিয়ে নিতাইকে দেখলাম। চিত্রগুপ্তের মতো। নির্বিকার, ভাবলেশহীন তার মুখ। আমার চুলে কাঁচি চালাচ্ছে। বললাম, বল, নিতাই।
অপরেশবাবু আপনার কেমন বন্ধু?
কেন?
না। এমনিতেই জানতে চাইছিলাম।
অপরেশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। খুব ভালো লোক। কেন বল তো? আবার তাকে পোষণ করি।
তার ভাবগতিক ভালো নয়, স্যর।
আর কিছু বলেনি নিতাই। ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠেছিলাম আমি। তা হলে, পাড়াতেও খুব চর্চা হচ্ছে অপরেশকে নিয়ে? কী কী আলাপ হয়? লোকে কেচ্ছার গন্ধ পেলে উৎসাহিত হয় খুব। মাছি যেমন একটু দুর্গন্ধের সন্ধান পেলে ভন ভন করতে থাকে, এটাও তাই। নির্ভেজাল এক কেচ্ছা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মিলি।
ভেবেছিলাম, ঘরে ফিরে, জিগ্যেস করি। কী ভেবে, চুপ করে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, মিলি তো সেই আগের মতো আছে। দরোজা খুলে দিয়ে, বলল, জান, আজ তোমার জন্য চিংড়ির মালাইকারি করলাম। আর পোস্ত দিয়ে দেশি মুরগি। বাইরে বাইরে থাক, ঘরের খাবার মুখে দেবার সুযোগ আর কোথাও পাও? ভাবলাম—
মিলির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আমার কি পছন্দ, এখনও, মনে রেখেছে মিলি।
হাসছ যে?
তখনই মনে পড়ে গেল, অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। তিনদিনের। এইসব পরচর্চা থেকে অন্তত তিনদিন বেঁচে থাকতে পারব। পিএনপিসি ভালো লাগে না আমার। বললাম, রেডি হয়ে নাও। আমরা দুপুরে বেড়িয়ে পড়ব। জমপুই যাব।
সত্যি? খুশিতে নেচে ওঠল মিলি। বাচ্চা মেয়ের মতো। যেন সে পুজোর জামা পেয়েছে।
জমপুই হিল্স আমার ভালো লাগে খুব। লোকে গ্যাংটক যায়, শিলঙ যায়, আমার পছন্দ জমপুই। লুসাই অধ্যুষিত এই পাহাড়ে শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই। আগরতলা থেকে দুশ কিলোমিটার কি হবে না। একদিকে আইজল শহর, অপরদিকে, কাঞ্চনপুর। আগে কমলার জন্য বিখ্যাত ছিল এই জমপুই। ভুবনবিখ্যাত এই কমলার জন্য লোক আসত দেশবিদেশ থেকে। উৎসব হত কমলার। এখন তা নেই। কমলার বাগান নেই আর। যদিও, কিছু কিছু জায়গায়, পুনরায়, লাগানো হয়েছে কমলার গাছ। লোকের মন নেই সেদিকে। সবাই এখন রাবার চাষে উৎসাহী। সরকার ছাড় দিচ্ছে। ঐ ছাড়ের লোভে, যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে রাবার বাগান। পরিবেশ দুষিত হয়ে পড়ছে দ্রুত। কে রাখে সেদিকে খেয়াল?
তবু, জমপুই, এখনও, অনেকদিন দুষনমুক্ত। এই একটি কারণেই জমপুই আমার প্রিয়। তা ছাড়া প্রকৃতির ঐ চলচপলরূপ আর কোথায় দেখব? লুসাই কিশোরীর মতো তন্বী, শ্যামা এখন সে।
সরকারি লজ বুক করেছিলাম আগে থাকতেই। ভাঙমুনে এই লজ, সত্যিই, দু একদিন কাটানোর জন্য আদর্শ। কয়েকহাজার ফুট উঁচু এই ভাঙমুন। তবে, আর কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে, শিবলিঙ্গ। জমপুইয়ের শিখরদেশ। লজের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে, মেঘ এসে খেলা করে পায়ের নীচে। কোনো কোনো সময়, ভিজিয়ে দেয় শরীর। ঐ শীতল স্পর্শে, জুড়িয়ে যায় মন। লজ থেকে সামান্য এগিয়ে গেলে, বাজার, ব্লক অফিস। প্রতিটি দোকানে লুসাই মেয়েরা হাসি মুখে অভ্যর্থনা করছে খদ্দেরকে। বাংলা বোঝে না তারা। আধা হিন্দী, আধা ইংরাজিতে কথা বলে ভিনদেশী লোকের সঙ্গে। আর প্রতিটি কথায় হেসে ওঠে তাদের উচ্ছ্বল শরীর।
সন্ধ্যের একটু আগে, নতুন গড়ে ওঠা ইকো পার্কে, মিলিকে নিয়ে বসি। সূর্্য ডুবে যাচ্ছে শাখান পাহাড়ের পিঠে। মনে হচ্ছে, মোষের পিঠে চড়ে, সূর্্য যাচ্ছে বেড়াতে। অস্তাচলে। নিচে কাঞ্চনপুর শহর সেজে উঠছে আলোয়। ব্যাগ থেকে বের করি, মনপুই থেকে আনা লুসাই পানীয়। মগজকে মুহূর্তে চাঙ্গা করে তোলে এই পানীয়। মূলত ভাত থেকে তৈরি। তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। প্রথমে সামান্য ঝাঁঝ থাকলেও, দু’তিন গ্লাস নেবার পর, এর স্বাদ অনুভব করা যায়। একটা ওয়ান টাইম গ্লাস মিলিকে দিই। আমিও নিই আর একটা গ্লাস।
দু-গ্লাস নেবার পর, মিলি, উঠে গেল। একটু এগিয়ে গেল পশ্চিমে। সেখান থেকে, কাঞ্চনপুর শহর দেখা যায় ভালো। দূর নিচে জনপদ ক্রমে শহর হয়ে উঠেছে বেশিদিন নয়। মূলত চাকমা ও রিয়াংদের আধিপত্য ছিল সেখানে। উদ্বাস্তু বাঙালীরা এসে, এলাকার অধিকাংশ স্থান নিয়েছে তাদের করে। ব্লক থেকে এখন মহকুমা শহর।
একটা সিগারেট ধরালাম আমি। সাধারণত সিগারেট কম খাই। পানীয় গ্রহণের সময়, একটা সিগারেট হলে জমে ভালো। মিলিকে বললাম, নেবে?
সরে এল মিলি। আমার ধরানো সিগারেট নিয়ে, টান দিল। ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে, হঠাৎ বলে ওঠল, তোমাকে একটা কথা বলব, ভাবছিলাম।
তার দিকে তাকালাম। নেশা হবার কথা নয়। লুসাই পানীয় ধরে ধীরে ধীরে। ঘন্টা খানেক পর থেকে এর মজা পাওয়া যায়। তার আগে নয়। কি বলতে চায় মিলি?
কয়েকদিন ধরে, বলব বলব করেও বলতে পারিনি। অথচ না বললেই নয়।
আরেক রাউন্ড গ্লাসে ঢালি। তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, বলে ফেল। অনেক সময়, বলে ফেললে হালকা হয়ে যায় সমস্ত ভাত। হাতে গ্লাস নিয়ে, দেরি করল না মিলি। এক ঢোকে শেষ করল সবটা। তারপর পুনরায়, বাঁ-হাতে রাখা সিগারেট ঠোঁটে চেপে, টান দিল। লম্বা টান। আবার ছেড়ে দিল। তারপর বলে ওঠল, জান, পেটে যে আসছে, সে তোমার নয়। অপরেশের।
আমি কি ভুল শুনলাম? মিলি যেন কী বলল? কী বলল মিলি? ঠিক শুনতে পেয়েছি তো আমি? হাতের গ্লাস, মুহূর্তে, শূন্য করে দিয়ে, বললাম, তুমি ঠিক বলছ তো, মিলি?
পাথরের মতো মিলি। নাড়ির স্পন্দন যেন নেই। চোখ কি বন্ধ করে রেখেছে সে? ভাবলেশহীন তার মুখ। না কি তার উলটোটাই? ভেতরে ভেতরে একটা ঝড়ের মোকাবিলা করছে সে? আশ্চর্্য এক ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, তোমাকে ঠকাতে চাই না আমি। এই সন্তান তোমার নয়।
এতক্ষণ চাঁদ ছিল আকাশে। চাঁদের আলোয়, জমপুই হয়ে উঠেছিল অপার্থিব। মনে হচ্ছিল, এখনই, নেমে আসবে পরীর দল। তারা এসে নাচবে লুসাই যুবতীদের মতো। গীটার হাতে কেউ হয় তো বাজাবে তাদের সঙ্গে। সেই সুর ছড়িয়ে পড়বে জমপুইয়ের সর্বত্র। আর নাচের তালে তালে সমগ্র বন দুলতে থাকবে জ্যোৎস্নায়। মুহূর্তে, একটা মেঘ এসে, ঢেকে ফেলল চাঁদ। ম্লান ও আবছা হয়ে এল এই ইকো পার্ক।
এই গ্রীষ্মেও, বেশ ঠান্ডা জমপুইয়ে। এই পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যই এটা। সব সময় মিহি বসন্ত। হালকা একটা সোয়েটার পরে এসেছিলাম। মিলির এই কথা শুনে, মাথা শুধু নয়, গা হয়ে ওঠল গরম। ঘামতে শুরু করেছি। এমনই যে, খুলতে হল সোয়েটার। মাথা দিয়ে সোয়েটার গলিয়ে নিতে গিয়ে, টের পেলাম, গা গুলিয়ে উঠছে আমার। বমি কি হবে? এটা মদ্যপানের ফল, না, মিলির ওই কথার প্রেক্ষিতে?
চুপ করে বসে আছে মিলি। মাথা নিচু তার। এতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছিল উলটোদিকে। সেদিকে, দূর আইজল শহরের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত জুড়ে। কেউ কোন কথা বলছি না আর। দু একটা বনচারী প্রাণীর চলাফেরা শব্দ, বয়ে যাওয়া হাওয়ার পাতার খসে পড়া ছাড়া, মনে হল, স্তব্ধতা এসে, ঘিরে ধরেছে আমাদের দুজনকে।
মিলি খুব সুন্দর এক সবুজ শিফনের শাড়ি পরেছিল আজ। আমিই গতবছর আমাদের বিবাহবার্ষিকিতে উপহার দিয়েছিলাম তাকে। ভালোবেসে। এই আমার বিবাহিত পত্নী? আগ্নিসাক্ষী রেখে যাকে পাঁচ বছর আগে, জীবনসঙ্গী করেছিলাম, এই তো সে-ই? না কি আর কেউ?
ক’দিন ধরে, কাজের চাপ ছিল প্রচণ্ড। চারদিন আগে, ডিজিএম বললেন, কয়েকটা দিন কোথাও ঘুরে এস হে! একটু রেস্ট নাও। তারপর তোমাকে যেতে হবে চেন্নাই। পুরো একমাসের জন্য।
আমার কাজের ধরণটাই এরকম। বেশিরভাগ সময় ঘুরে বেড়াতে হয় বাইরে বাইরে। ঘরে থাকি মাসে সাত-আটদিন। মিলির অসুবিধে হয় জানি। কিন্তু পেটের দায় বলে একটা কথা যে আছে। বড় দায় সেটা। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছিল মিলি। এখন বুঝতে পারছি, মিলি আসলে মেনে নেয়নি। না হলে, অপরেশের সঙ্গে এই অবৈধ সম্পর্ক রচিত হয় কী করে? অপরেশ আমার বাল্যবন্ধু। মুহূর্তে, আমার ক্রোধ আছড়ে পড়ল অপরেশের উপর। সেই অপরেশ, যে আমার আপদে-বিপদে থাকে! বিবাহিত, দুটি সন্তানের জনক। পার্টির বিভাগীয় কমিটির কী একটা পদে আছে। জনগণকে নীতিশিক্ষা দেয়, স্বপ্ন দেখায়। মিলিকেও কি স্বপ্ন দেখিয়েছিল অপরেশ? কী স্বপ্ন?
আচ্ছা! জয়তী কি এটা জানে? জয়তী, মানে, অপরেশের বউ? জানে? অপরেশের এই সব কীর্তি? না কি, তাকেও আড়ালে রেখে এই কান্ড করেছে? জয়তী জানতে পারলে কি হবে? কি হতে পারে?
তুমি কিছু বলবে না? অদ্ভূত ঠান্ডা এক গলায় বলে ওঠল মিলি।
চমকে ওঠলাম। এরপরও, আমার মতামতো জানতে চাইছে মিলি? কি বলব তাকে? গালি দেব? তার টুটি চেপে ধরব? না কি৮, বলব, এসব কথা আর কাউকে বলতে যেও না। যা হবার হয়েছে, অ্যাবোর্শন করিয়ে ফেল। অথবা, ঠিক আছে, বাচ্চাটাকে মানুষ করব আমরা। কি বলব?
জান, এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাইছে না অপরেশ। আর আমি ঠিক করেছি, অ্যাবোর্শন করাব না। অ্যাবসার্ড। এই প্রথম, হ্যাঁ, এই প্রথম, মা হবার সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নই আমি। মিলির গলায় কি সামান্য কান্না লেগে আছে? না কি এটা তার দৃঢ় মানসিকতার স্পর্শ? কোনো অপরাধবোধ নেই তার? অনুশোচনা?
২.
জমপুই থেকে ফিরে এসে, আর কথা হয়নি মিলির সঙ্গে। চলে যেতে হল চেন্নাই। একমাসের জন্য বলা হলেও, যে এসাইনমেন্ট নিয়ে আমার যাওয়া, তা শেষ করে ফেলি আঠারো দিনের মাথায়। আমিও ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। আসলে, সেখানে আমার রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল লাইফের একজন ক্লাশমেটকে পেয়ে যাই। অভাবিতভাবে। রেড্ডি। রেড্ডিই এই এসাইনমেন্টের বিষয়ে সাহায্য করে বেশি।
ডিজিএম, ফোনে, জানালেন, ওয়েল ডান, মিস্টার চৌধুরী। গুড নিউজ। কোম্পানী আপনাকে একটা গিফ্ট দেবার কথা ভাবছে। তিনচার দিন ছুটি কাটাতে কোথাও চলে যেতে পারেন। ইচ্ছে করলে, সিঙ্গাপুরও চলে যেতে পারেন। আপনার অপরেশ এই এলাকায় মিলনচক্রের দিকে থাকে।
অপরেশের কথা মনে পড়তেই মনে পড়ল মিলির কথা। চেন্নাই, কাজের ফাঁকে, দু একবার মিলির কথা মনে পড়েনি, তা নয়। আগে রোজ দুতিনবার ফোন করতাম। খোঁজ নিতাম তার। এবার তা করলাম না। কেন? রাগে? মিলির ঐ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এই ক্রোধ? জমপুইয়ে, সেদিন আর তেমন কোনো কথা হয়নি। একবার, বিছানায় যাবার আগে, মিলি বলেছিল, তুমি, তাহলে, কিছুই বললে না?
লাইট অফ্ করতে গিয়ে, গলা নিচু করেই বললাম, দেখ, বিষয়টা, সন্দেহ নেই, গুরুতর। সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাকেই। কেন না, তুমি চাইছ, বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে আনতে—
হ্যাঁ। আমি ওকে নিয়ে আসতে চাই। অপরেশ দায়িত্ব না নিক, তাতে কি, আমি একাই ওকে বড় করব।
তবে কি?
বাচ্চার একটা পরিচয় দরকার।
আমার পরিচয়ে সে বড় হবে। সে তার মায়ের সন্তান।
আমি নিঃশব্দে হেসে উঠলাম। সে হাসি বড় ম্লান। লুসাই মেয়েরা বিবাহের আগেও সন্তানের মা হয়ে যায়। পিতৃত্বের দায় যদি কেউ না নেয়, সমাজ নেয়। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজ কতখানি মেনে নেবে মিলিকে?
অফিসের গাড়ি ছিল এয়ারপোর্টে। প্রথমে ভাবলাম, ঘরে যাই আগে। তারপর, ভাবলাম, না, অফিস হয়ে ঘরে যাব। ডিজিএম-এর সঙ্গে দেখা করে, কয়েকটা দিন ছুটি নেব। যদিও তিনি ঘুরে আসতে বলেছিলেন আমাকে।
দুর্গা চৌমুহনীতে এসে দেখলাম, জনসভা চলছে রাস্তা আটকে দিয়ে। এফডি আইয়ের বিরুদ্ধে জনসভা। এফডিআই কতখানি বিপজ্জনক, এখনও বোঝা যাচ্ছে না এটা। প্রতিবাদ করা আর রাস্তা আটকে জনসভা করা যে এক নয়, কে বোঝাবে? এই শহর রাজনীতির দাদাদের দ্বারা পীড়িত। মুখ বুজে সইতে হয় সবাইকে। কেউ কিছু বলে না। মানুষ, এখনও, এইসব নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়! অবাক হতে হয়, এসব দেখলে। শিক্ষাদীক্ষায় যারা এগিয়ে আছেন, তারাও, সামান্য স্বার্থের জন্য দাদাদের অনুগামী হয়, সেই সব দাদা, যারা তাদের চেয়েও অশিক্ষিত, বোধহীন। কবে যে মানুষ মুক্তি পাবে এই যাঁতাকল থেকে?
অফিসে বেশিক্ষণ থাকতে হল না। ডিজিএম, আমাকে দেখে, বললেন, কয়েকটা দিন বিশ্রাম কর। তারপর তোমাকে হয় তো, দেশের বাইরে যেতে হতে পারে।
ঘরে এসে, দেখি, তালা দেওয়া। অর্থাৎ মিলি নেই ঘরে। দ্বিতীয় চাবি থাকে আমার সঙ্গে। ফলে, অসুবিধে হল না কোনো। ঘরে ঢুকে, প্রথমেই চান করে নিলাম। ফ্রেশ হওয়ার দরকার ছিল খুব। তারপর, নিজেই বানিয়ে নিলাম কফি। টিভি চালিয়ে দিয়ে, ড্রয়িং রুমে বসেছি, তখনই বেজে ওঠল কলিংবেল।
এই সময় কে আসতে পারে? মিলি? ওর কাছে তো চাবি রয়েছেই। তা হলে?
দরজা খুলে, দেখি, অপরেশ।
মুহূর্তে, পায়ের রক্ত চড়ে গেল মাথায়। এক নিমেষ। না কি, তারও কম? প্ল-বিপলের চেয়েও কম? ক্রোধ গিলে ফেললাম পরক্ষণেই। থুথু গেলার মতো। দতজা ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকতে দিলাম তাকে।
কখন এলে? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, অপরেশ বলে ওঠল।
তার কথার জবাব না দিয়ে, পালটা জিগ্যেস করলাম, তুমি কি মিলির কাছে এসেছিলে?
হ্যাঁ! সকালে ফোন করেছিল। খুব জরুরি দরকার বলল। আসতে পারিনি। পার্টির একটা গোপন মিটিং ছিল। আটকে গেছি। মিটিং থেকে বেরিয়ে, ফোন করলাম, স্যুইচ অফ। ভাবলাম ঘরে আছে।
মিলি তো ঘরে নেই। ঠান্ডা মাথায় বললাম আমি।
ঠিক আছে। পরে আসব।
চলে যাচ্ছিল অপরেশ। পেছন থেকে বললাম, দাঁড়াও, অপরেশ। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার।
ফিরে এসে, অপরেশ বসল সোফায়।
ড্রিংক্স নেবে?
দাও। খুব নির্লিপ্ত গলায় বলল অপরেশ।
অপরেশের হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে, একটা চেয়ার টেনে বসালাম আমি। প্রথম চুমুক গলা পর্যন্ত নিয়ে, তাকে বললাম, মিলি বলছিল, তার পেটে যে বাচ্চাটা আসছে, সেটা তোমার। এটা কি ঠিক? অপরেশ?
ঢোক গিলে উঠতে পারেনি অপরেশ। তার আগেই, আমার এই প্রশ্ন, বোধহয়, তাকে হতচকিত করে তুলল। হেঁচকি এল তার নাকে-মুখে দিয়ে। কাশতে লাগল সে।
বি কুল, অপরেশ! রেগে যাওয়ার কথা আমার। আর তুমি খাচ্ছ ভিড়মি?
আমার ভেতরে কি জেগে উঠছে শয়তান? আমি এখন ঠান্ডা মাথায় খুন পর্যন্ত করতে পারি। অপরেশ বুঝতে পারছে, ফাঁদে পড়ে গেছে সে। এখন আর পরিত্রাণ নেই তার।
নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল অপরেশ। ঘোড়ার মুখে পড়ে গেছে তার নৌকা আর গজ। কোনো রকমে গজ বলি দিয়ে সে এখন চেষ্টা করছে নৌকা বাঁচাবার। মিলি বলেছে? মিলি?
অবাক হচ্ছ? কী করে তোমাদের গোপন অ্যাফেয়ার্সের কথা প্রকাশ করল মিলি? এই ভাবছ?
আমি গ্লাস খালি করে নিলাম এক চুমুকে। দ্বিতীয়বার গ্লাস ভরে নিতে নিতে, বললাম, মিলিকে চিনতে সামান্য ভুল করেছ, অপরেশ! অন্য মহিলাদের থেকে একটু আলাদা সে। পার্সোনালিটি বলতে যা বোঝায়, সেটা তার আছে। অকপটে কনফেস করার ক্ষমতা তার আছে। তা, তোমার বাচ্চা যখন, তোমার জন্য ফেঁসে গেছে সে, এখন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছ কেন? না কি, দায়িত্ব নিতে গেলে, জয়তী, তোমার দুই বাচ্চা, পার্টির ইমেজ, সব হারাবে, এই ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছ?
কোনো জবাব দিল না অপরেশ। হাতের গ্লাস রয়ে গেছে হাতেই। মুখটা রক্তশূন্য রোগীর মতো।
অবশ্য, তোমাকে দোষ দিয়েই-বা কী করব? তোমাদের তো গাছেরও খাবো, তলারও কুড়োব নীতি। ক্ষমতায়ও থাকবে, বিপ্লবও করবে। ইমেজ তো রাখতেই হয়। না হলে চলবে কেন?
টিভিতে, দিল্লীর নিউজ। পার্লামেন্ট-এ বিজেপির সুষমা স্বরাজ কী যেন বলছে। হৈচৈ হচ্ছে খুব। টিভি বন্ধ করে দিলাম। পার্লামেন্ট মূলত শুয়োরের খামার, কে যেন বলেছিল! এমপিদের কান্ড কীর্তি দেখলে, ওই কথাটিই মনে পড়ে আমার।
বিশ্বাস কর, জহর, যা ভাবছ, ঘটনাটা সেরকম না। অপরেশ হঠাৎ বলে ওঠল। আসলে—
আত্মপক্ষ সমর্থণ করার চেষ্টা করছ কেন, অপরেশ? তুমি আমার বাল্যবন্ধু। অবশ্য এখন থেকে আর কখনও বন্ধু ভাবতে পারব না তোমাকে। অ্যাবসার্ড। মধ্যযুগীয় ক্রোধ আমার ভেতরে থাকলে খুন করে ফেলতাম তোমাকে। একটু আগেও ইচ্ছে হয়েছিল। খুন চেপেছিল মাথায়। তা, আমি তো আর তুমি না!
ঘরে এখন ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া কিছু নেই। ভয়ংকর এক স্তব্ধতা ঘরটাকে গুমোট করে তুলছে। আর এক গ্লাস ভরে নিলাম আমার জন্য। অপরেশ, দেখলাম, আর নিল না। সেই গ্লাস এখনও অর্ধেক হয়ে আছে। বললাম, মিলি অ্যাবোর্শন করবে না। ও যে বলে, তাই করে। কিন্তু তুমি সেই বাচ্চার বাবা হয়েও, দায়িত্ব নিতে মানছ না কেন?
এটা অ্যাবসার্ড জহর। পার্টি আমাকে সাসপেন্ড করবে। জয়তী—
আমার কি হল হঠাৎ। চিৎকার করে ওঠলাম। স্কাউন্ডেল! বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। গেট আউট। একটা মহিলার সর্বনাশ করে এখন সাধু সাজতে চাইছ? দায়িত্ব নেবার মুরোদ নেই যখন ভোগ করতে গেছিলে কেন? যাও। আর কখনও যেন তোমার মুখ না দেখি!
কোনো কথা না বলে, অপরেশ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার দিকে ফিরেও তাকালাম না আমি। এখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। খোঁড়াচ্ছে কেন সে? যখন এল, খোঁড়াতে দেখিনি তাকে। তা হলে?
৩.
সন্ধ্যেবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, মাথাটা ধরে আছে প্রচণ্ড। ঘড়ির দিকে তাকালাম। নটা বাজে। মাই গড! এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? টয়লেট থেকে, এসে, দেখলাম, মিলি এখনও আসেনি। এরকম তো করে না! ফোন করলাম, স্যুইচ অফ। অপরেশও বলছিল এই কথা। কোথায় গেল মিলি? চন্দ্রপুরে তার বাবা থাকেন। একা। সেখানে যায়নি তো? তাড়াতাড়ি, মিলির বাবাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। নট রিচেবল। তার মানে?
কার কাছে জানতে চাইব মিলির কথা? বৃষ্টির কথা মনে পড়ল। মিলির বন্ধু। দু-একবার এই ঘরে এসেছিল। কিন্তু তার ফোন নম্বর? হতাশ হয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
চন্দ্রপুর, বাসস্ট্যান্ডের পেছনে, মিলির বাবার বাড়ি। জামতোলা বলে লোকে। বারান্দায়, একটা চেয়ারে বসে রয়েছেন তিনি। অনেকদিন দেখিনি। আজ দেখলাম, দীর্ঘকায় লোকটা শীর্ণ হয়ে গেছে। মিলির মা নেই। আমাদের বিয়ের পরেই মারা গেলেন। লাংস-ক্যানসার। খুব কষ্ট পেয়েছেন ভদ্রমহিলা। বাবাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে বলেছিলাম। মিলিও চাইছিল খুব। তিনি থাকবেন না। মেয়ের বাড়িতে থাকলে না কি মান-সম্মান থাকে না। অথচ তিনি থাকলে অপরেশ এই কান্ড করার সুযোগ পেত না। সাহস হত না মিলিরও।
আমাকে দেখে, গ্রিলের দরজা খুলে দিলেন তিনি। এত রাতে? কিছু হয়েছে জহর? কোনো বিপদ? উৎকন্ঠিত গলা কেঁপে গেল যেন।
মিলি আসেনি, বাবা? কোনো ভনিতা না করে জিগ্যেস করলাম আমি।
মিলি? না তো! ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন আমার কথা শুনে।
আশ্চর্্য!
মিলি তা হলে গেল কোথায়? আমার চেন্নাই থেকে আসার খবর তার জানার কথা নয়। তা হলে কোনো বন্ধুর কাছে গেছে? অদিতিদের বাড়ি? অদিতিরা থাকে রামনগর আট-এ। সেখানেও যায়নি সে। সব কথা শুনে, অবাক হয়ে গেল অদিতি। বলল, মিলির দায়িত্বজ্ঞান খুব বেশি। ঘরে যান, গিয়ে দেখবেন, ফিরে এসেছে সে।
বৃষ্টিও তাই বলল। চারদিন আগে, এসবিআইর কাউন্টারে দেখা হয়েছিল। খুব বেশি কথা হয়নি তখন। টেনশনে ছিল কি এক কারণে। ভেবেছিল, দু-একদিন পর, মিলির সঙ্গে দেখা করবে, গিয়ে।
রাতে, এই প্রথম, একা থাকতে হল ঘরে। খেতে ইচ্ছে করছিল না। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মিলি আসেনি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। ঘুমের ভেতর, দেখলাম, একটা থানার লক-আপ। আলোয় সাজানো হয়েছে সেই লক-আপ। শুধু লক-আপ নয়, পুরো এলাকাতেই আলোর রোশনাই। সেখান থেকে, দুজন সান্ত্রী নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ভেতরে। আরও একটা ঘরে। ঘরটায় কেউ নেই। একটা বালভ ঝুলছে মাঝখানে। কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু মাঝখানে একটা হাতলহীন চেয়ার। পাশে কয়েক বোতল জল।
ঐ ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দিল সান্ত্রীরা। কিছুক্ষণ পরে, তিন-চারজন পুলিশ এলো। ওসি সহ একজন এস আইও এলেন সঙ্গে। ওসি বসলেন চেয়ারে। বাঁ-হাতে বেতের একটা পালিশ লাঠি। এস আই আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনিই তবে জহর চৌধুরী?
আমি মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ।
আপনি, শুনেছি, একটা ভালো কোম্পানির এগজিকিউটিভ। মান-সম্মানও আছে আপনার। টাকাকড়ির অভাব নেই সে অর্থে। তাহলে, কেন, আপনি আপনার স্ত্রী মিলি চৌধুরীকে খুন করলেন? কেন?
চুপ করে রইলাম আমি।
শুনুন, আপনি যদি কো-অপারেশন করেন, তাহলে, থার্ড ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন হবে না। আর যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন—
উলটো দিক থেকে, মানে, ওসি বলে ওঠলেন, মশাই, বলে ফেলুন। আপনার সকল গতিবিধি আমাদের জানা। আমরা শুধু আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই।
বলুন—
অ্যাই লিটন, ভদ্রলোকের প্যান্টের জিপটা নামিয়ে দে। বুঝতে পারছি, পেনিসে সিগারেটের ছ্যাঁকা না দিলে মুখ খুলবে না!
বলে কি! এই তাহলে থার্ড ডিগ্রি? আমার সারা শরীর কেঁপে ওঠল। মিলিকে আমি জমপুই থেকে ফেরার পথে, মনপুইয়ের কাছে একটা উঁচু জায়গা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। লজ থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম সকালেই। যাতে লজের কোনো লোক কিছু বুঝতে না পারে। কমলা বাগান দেখাবার নাম করে, মনপুইয়ের আগে, গাড়ি থেকে নেমে, একটা নির্জন স্থানে তার টুটি চেপে ধরি। শাঃলী! আমাকে ঠকাবে। আড়ালে আড়ালে আমার বন্ধুর সঙ্গে ফস্টিনস্টি? ছটফট করতে করতে, একসময়, নিথর হয়ে গেল মিলি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, না কোন শ্বাস পড়ছে না। তার মানে, মৃত সে। দেরি না করে, তার মৃতদেহ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। গড়াতে গড়াতে, দেখলাম, অনেক নিচে চলে গেল। সহসা আর কেউ দেখবে না উপর থেকে। তার আগেই শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলবে।
আমার মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। মিলির মুখে, ঐ কথা শোনার পর, আগ্নেয়গিরির লাভার মতো টগবগ করছিল আমার ক্রোধ। এখন শান্ত। শিস দিতে দিতে, গাড়ি চালিয়ে, চলে আসি কাঞ্চনপুর। সেখান থেকে সোজা আগরতলা। তারপর, অফিসের কাজে চেন্নাই।
এত নিখুঁত প্ল্যানিং করেও ধরা পড়ে গেলাম আমি?
এস আই, হঠাৎ, হ্যাঁ, হঠাৎই, বলা নেই কওয়া নেই, হো হো করে হাসতে লাগল। সেই হাসি, ঐ নির্জন সেল পার হয়ে, টুকরো টুকরো হয়ে, ছড়িয়ে পড়তে লাগল চরাচরে। আর আমি কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। মনে হল, আমার শরীর ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে, বিন্দু হয়ে যাচ্ছি না তো? মিলিয়ে যাচ্ছি না তো ঐ হাসির মতো?
ঐ সময়, ঐ আধো ঘুমের ভেতর মনে হল, কলিংবেল বাজছে। মুহূর্তে, থানার লক-আপ গেল মিলিয়ে। না, সত্যিই বাজছে কলিং বেল। আর আমি, লক-আপ নয়, বিছানায় আছি শুয়ে। তাড়াতাড়ি, উঠে গিয়ে, দরজা খুলে দিই। সামনে মিলি। সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই।
মিলিকে, মনে হল, অচেনা কোনো নারী। নারী নয়, এই মুহূর্তে, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কেউ। যুগ যুগ আগে, যে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছিল তার মনোজগতের স্বর্গ। বলল, চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ভেতরে ঢুকে, কাঁধের ব্যাগ রেখে দিল সোফায়। তারপর, বসতে বসতে বল, কবে এসেছ ফিরে?
কোনো কথা না বলে, মিলির দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক। আমার ভেতরে ক্রমশ জেগে ওঠছে এক শয়তান, প্রবল হয়ে ওঠছে সে। একটু আগে, স্বপ্নে, খুন করেছিলাম মিলিকে। স্বপ্ন সত্যি নয়, তা বলে, এখন কি খুন করতে পারি না? কেউ জানতে পারবে না। সবাই জানে, কাল রাতে খুঁজে বেড়িয়েছি মিলিকে। তার বাবাও সাক্ষ্য দেবেন নিশ্চয়।
চুপচাপ তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তখনই, মিলি বলে ওঠল, এ শহর ছেড়ে চলে যাব আমি। একটা চাকরিও জুটিয়ে নিলাম। যা পাব, তাতে চলে যাবে। বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে কোনো অসুবিধে হবে না আর।
আর এগিয়ে যেতে পারলাম না মিলির দিকে। উলটো দিকের সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লাম। চারদিক থেকে, সহসা, আশ্চর্্য এক শূন্যতা চেপে ধরল আমাকে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। দৃষ্টি হয়ে আসছে ঝাপসা। চশমার কাচ কি ঘোলাটে হয়ে গেল? কি করব এখন? ঠাহর করতে না পেরে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠলাম, চলে যাবে?
মিলি কি শুনতে পেল? আমি জানি না। শুধু লক্ষ্য করলাম, মিলির সামনে, আমি ক্রমশ, টুকরো টুকরো হয়ে, ভেঙে, আছড়ে পড়ছি। যেন কেউ আমার অস্থি-মাংস-মজ্জা আলাদা আলাদা করে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলছে মিলির পায়ের নিচে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মিলির। সে তখন গুন গুন করে গাইছে, তুমি আপনে কর পার... আমি চাহি না নিস্তার...
১.
স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। তার পায়ের শব্দ। ওই যে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নামছে সে। একটু কি থামল? কেশে ওঠল যেন একবার? চুপ করে বসে আছি চেয়ারে। এ ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার। না কি ছিল? কী করতে পারতাম? না কি বলতাম, যা করেছ, সব ঠিক। তোমার কোনো দোষ নেই, অপরেশ। ভুল যা কিছু হয়েছে, আমারই!
তা হলেই কি মিটে যেত সব ঝামেলা? ফাটল আর থাকত না এই সম্পর্কে? সত্যি? তা কী করে হয়? ফাটল ধরে যাচ্ছে, এটা টের পেয়েছিলাম আগেই। গত দুবছর ধরে। মিলিকে নিয়ে। প্রথমে স্বীকার করেনি মিলি। চাইছিলাম, নিজে থেকেই বলুক সবকিছু। বলেনি। আমি যে টের পাচ্ছি, তাও বলিনি তাকে। লোকের মুখে শুনি। পাড়া থেকে অফিসে, সর্বত্র, একটা ফিসফিস শব্দ। ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাড়াময়। আমাকে দেখলেই থমকে যাচ্ছে তা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পরিচিতজন। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল ক্রমশ। পাত্তা না দিতে গিয়ে, দেখি, পারছি না।
সেদিন, সকালে, পাড়ার সেলুনে, চুল কাটাতে গিয়ে, নিতাই, সেলুনের মালিক, বলে ওঠল, দাদা, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না তো?
আয়নার ভেতর দিয়ে নিতাইকে দেখলাম। চিত্রগুপ্তের মতো। নির্বিকার, ভাবলেশহীন তার মুখ। আমার চুলে কাঁচি চালাচ্ছে। বললাম, বল, নিতাই।
অপরেশবাবু আপনার কেমন বন্ধু?
কেন?
না। এমনিতেই জানতে চাইছিলাম।
অপরেশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। খুব ভালো লোক। কেন বল তো? আবার তাকে পোষণ করি।
তার ভাবগতিক ভালো নয়, স্যর।
আর কিছু বলেনি নিতাই। ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠেছিলাম আমি। তা হলে, পাড়াতেও খুব চর্চা হচ্ছে অপরেশকে নিয়ে? কী কী আলাপ হয়? লোকে কেচ্ছার গন্ধ পেলে উৎসাহিত হয় খুব। মাছি যেমন একটু দুর্গন্ধের সন্ধান পেলে ভন ভন করতে থাকে, এটাও তাই। নির্ভেজাল এক কেচ্ছা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মিলি।
ভেবেছিলাম, ঘরে ফিরে, জিগ্যেস করি। কী ভেবে, চুপ করে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, মিলি তো সেই আগের মতো আছে। দরোজা খুলে দিয়ে, বলল, জান, আজ তোমার জন্য চিংড়ির মালাইকারি করলাম। আর পোস্ত দিয়ে দেশি মুরগি। বাইরে বাইরে থাক, ঘরের খাবার মুখে দেবার সুযোগ আর কোথাও পাও? ভাবলাম—
মিলির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আমার কি পছন্দ, এখনও, মনে রেখেছে মিলি।
হাসছ যে?
তখনই মনে পড়ে গেল, অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। তিনদিনের। এইসব পরচর্চা থেকে অন্তত তিনদিন বেঁচে থাকতে পারব। পিএনপিসি ভালো লাগে না আমার। বললাম, রেডি হয়ে নাও। আমরা দুপুরে বেড়িয়ে পড়ব। জমপুই যাব।
সত্যি? খুশিতে নেচে ওঠল মিলি। বাচ্চা মেয়ের মতো। যেন সে পুজোর জামা পেয়েছে।
জমপুই হিল্স আমার ভালো লাগে খুব। লোকে গ্যাংটক যায়, শিলঙ যায়, আমার পছন্দ জমপুই। লুসাই অধ্যুষিত এই পাহাড়ে শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই। আগরতলা থেকে দুশ কিলোমিটার কি হবে না। একদিকে আইজল শহর, অপরদিকে, কাঞ্চনপুর। আগে কমলার জন্য বিখ্যাত ছিল এই জমপুই। ভুবনবিখ্যাত এই কমলার জন্য লোক আসত দেশবিদেশ থেকে। উৎসব হত কমলার। এখন তা নেই। কমলার বাগান নেই আর। যদিও, কিছু কিছু জায়গায়, পুনরায়, লাগানো হয়েছে কমলার গাছ। লোকের মন নেই সেদিকে। সবাই এখন রাবার চাষে উৎসাহী। সরকার ছাড় দিচ্ছে। ঐ ছাড়ের লোভে, যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে রাবার বাগান। পরিবেশ দুষিত হয়ে পড়ছে দ্রুত। কে রাখে সেদিকে খেয়াল?
তবু, জমপুই, এখনও, অনেকদিন দুষনমুক্ত। এই একটি কারণেই জমপুই আমার প্রিয়। তা ছাড়া প্রকৃতির ঐ চলচপলরূপ আর কোথায় দেখব? লুসাই কিশোরীর মতো তন্বী, শ্যামা এখন সে।
সরকারি লজ বুক করেছিলাম আগে থাকতেই। ভাঙমুনে এই লজ, সত্যিই, দু একদিন কাটানোর জন্য আদর্শ। কয়েকহাজার ফুট উঁচু এই ভাঙমুন। তবে, আর কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে, শিবলিঙ্গ। জমপুইয়ের শিখরদেশ। লজের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে, মেঘ এসে খেলা করে পায়ের নীচে। কোনো কোনো সময়, ভিজিয়ে দেয় শরীর। ঐ শীতল স্পর্শে, জুড়িয়ে যায় মন। লজ থেকে সামান্য এগিয়ে গেলে, বাজার, ব্লক অফিস। প্রতিটি দোকানে লুসাই মেয়েরা হাসি মুখে অভ্যর্থনা করছে খদ্দেরকে। বাংলা বোঝে না তারা। আধা হিন্দী, আধা ইংরাজিতে কথা বলে ভিনদেশী লোকের সঙ্গে। আর প্রতিটি কথায় হেসে ওঠে তাদের উচ্ছ্বল শরীর।
সন্ধ্যের একটু আগে, নতুন গড়ে ওঠা ইকো পার্কে, মিলিকে নিয়ে বসি। সূর্্য ডুবে যাচ্ছে শাখান পাহাড়ের পিঠে। মনে হচ্ছে, মোষের পিঠে চড়ে, সূর্্য যাচ্ছে বেড়াতে। অস্তাচলে। নিচে কাঞ্চনপুর শহর সেজে উঠছে আলোয়। ব্যাগ থেকে বের করি, মনপুই থেকে আনা লুসাই পানীয়। মগজকে মুহূর্তে চাঙ্গা করে তোলে এই পানীয়। মূলত ভাত থেকে তৈরি। তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। প্রথমে সামান্য ঝাঁঝ থাকলেও, দু’তিন গ্লাস নেবার পর, এর স্বাদ অনুভব করা যায়। একটা ওয়ান টাইম গ্লাস মিলিকে দিই। আমিও নিই আর একটা গ্লাস।
দু-গ্লাস নেবার পর, মিলি, উঠে গেল। একটু এগিয়ে গেল পশ্চিমে। সেখান থেকে, কাঞ্চনপুর শহর দেখা যায় ভালো। দূর নিচে জনপদ ক্রমে শহর হয়ে উঠেছে বেশিদিন নয়। মূলত চাকমা ও রিয়াংদের আধিপত্য ছিল সেখানে। উদ্বাস্তু বাঙালীরা এসে, এলাকার অধিকাংশ স্থান নিয়েছে তাদের করে। ব্লক থেকে এখন মহকুমা শহর।
একটা সিগারেট ধরালাম আমি। সাধারণত সিগারেট কম খাই। পানীয় গ্রহণের সময়, একটা সিগারেট হলে জমে ভালো। মিলিকে বললাম, নেবে?
সরে এল মিলি। আমার ধরানো সিগারেট নিয়ে, টান দিল। ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে, হঠাৎ বলে ওঠল, তোমাকে একটা কথা বলব, ভাবছিলাম।
তার দিকে তাকালাম। নেশা হবার কথা নয়। লুসাই পানীয় ধরে ধীরে ধীরে। ঘন্টা খানেক পর থেকে এর মজা পাওয়া যায়। তার আগে নয়। কি বলতে চায় মিলি?
কয়েকদিন ধরে, বলব বলব করেও বলতে পারিনি। অথচ না বললেই নয়।
আরেক রাউন্ড গ্লাসে ঢালি। তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, বলে ফেল। অনেক সময়, বলে ফেললে হালকা হয়ে যায় সমস্ত ভাত। হাতে গ্লাস নিয়ে, দেরি করল না মিলি। এক ঢোকে শেষ করল সবটা। তারপর পুনরায়, বাঁ-হাতে রাখা সিগারেট ঠোঁটে চেপে, টান দিল। লম্বা টান। আবার ছেড়ে দিল। তারপর বলে ওঠল, জান, পেটে যে আসছে, সে তোমার নয়। অপরেশের।
আমি কি ভুল শুনলাম? মিলি যেন কী বলল? কী বলল মিলি? ঠিক শুনতে পেয়েছি তো আমি? হাতের গ্লাস, মুহূর্তে, শূন্য করে দিয়ে, বললাম, তুমি ঠিক বলছ তো, মিলি?
পাথরের মতো মিলি। নাড়ির স্পন্দন যেন নেই। চোখ কি বন্ধ করে রেখেছে সে? ভাবলেশহীন তার মুখ। না কি তার উলটোটাই? ভেতরে ভেতরে একটা ঝড়ের মোকাবিলা করছে সে? আশ্চর্্য এক ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, তোমাকে ঠকাতে চাই না আমি। এই সন্তান তোমার নয়।
এতক্ষণ চাঁদ ছিল আকাশে। চাঁদের আলোয়, জমপুই হয়ে উঠেছিল অপার্থিব। মনে হচ্ছিল, এখনই, নেমে আসবে পরীর দল। তারা এসে নাচবে লুসাই যুবতীদের মতো। গীটার হাতে কেউ হয় তো বাজাবে তাদের সঙ্গে। সেই সুর ছড়িয়ে পড়বে জমপুইয়ের সর্বত্র। আর নাচের তালে তালে সমগ্র বন দুলতে থাকবে জ্যোৎস্নায়। মুহূর্তে, একটা মেঘ এসে, ঢেকে ফেলল চাঁদ। ম্লান ও আবছা হয়ে এল এই ইকো পার্ক।
এই গ্রীষ্মেও, বেশ ঠান্ডা জমপুইয়ে। এই পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যই এটা। সব সময় মিহি বসন্ত। হালকা একটা সোয়েটার পরে এসেছিলাম। মিলির এই কথা শুনে, মাথা শুধু নয়, গা হয়ে ওঠল গরম। ঘামতে শুরু করেছি। এমনই যে, খুলতে হল সোয়েটার। মাথা দিয়ে সোয়েটার গলিয়ে নিতে গিয়ে, টের পেলাম, গা গুলিয়ে উঠছে আমার। বমি কি হবে? এটা মদ্যপানের ফল, না, মিলির ওই কথার প্রেক্ষিতে?
চুপ করে বসে আছে মিলি। মাথা নিচু তার। এতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছিল উলটোদিকে। সেদিকে, দূর আইজল শহরের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত জুড়ে। কেউ কোন কথা বলছি না আর। দু একটা বনচারী প্রাণীর চলাফেরা শব্দ, বয়ে যাওয়া হাওয়ার পাতার খসে পড়া ছাড়া, মনে হল, স্তব্ধতা এসে, ঘিরে ধরেছে আমাদের দুজনকে।
মিলি খুব সুন্দর এক সবুজ শিফনের শাড়ি পরেছিল আজ। আমিই গতবছর আমাদের বিবাহবার্ষিকিতে উপহার দিয়েছিলাম তাকে। ভালোবেসে। এই আমার বিবাহিত পত্নী? আগ্নিসাক্ষী রেখে যাকে পাঁচ বছর আগে, জীবনসঙ্গী করেছিলাম, এই তো সে-ই? না কি আর কেউ?
ক’দিন ধরে, কাজের চাপ ছিল প্রচণ্ড। চারদিন আগে, ডিজিএম বললেন, কয়েকটা দিন কোথাও ঘুরে এস হে! একটু রেস্ট নাও। তারপর তোমাকে যেতে হবে চেন্নাই। পুরো একমাসের জন্য।
আমার কাজের ধরণটাই এরকম। বেশিরভাগ সময় ঘুরে বেড়াতে হয় বাইরে বাইরে। ঘরে থাকি মাসে সাত-আটদিন। মিলির অসুবিধে হয় জানি। কিন্তু পেটের দায় বলে একটা কথা যে আছে। বড় দায় সেটা। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছিল মিলি। এখন বুঝতে পারছি, মিলি আসলে মেনে নেয়নি। না হলে, অপরেশের সঙ্গে এই অবৈধ সম্পর্ক রচিত হয় কী করে? অপরেশ আমার বাল্যবন্ধু। মুহূর্তে, আমার ক্রোধ আছড়ে পড়ল অপরেশের উপর। সেই অপরেশ, যে আমার আপদে-বিপদে থাকে! বিবাহিত, দুটি সন্তানের জনক। পার্টির বিভাগীয় কমিটির কী একটা পদে আছে। জনগণকে নীতিশিক্ষা দেয়, স্বপ্ন দেখায়। মিলিকেও কি স্বপ্ন দেখিয়েছিল অপরেশ? কী স্বপ্ন?
আচ্ছা! জয়তী কি এটা জানে? জয়তী, মানে, অপরেশের বউ? জানে? অপরেশের এই সব কীর্তি? না কি, তাকেও আড়ালে রেখে এই কান্ড করেছে? জয়তী জানতে পারলে কি হবে? কি হতে পারে?
তুমি কিছু বলবে না? অদ্ভূত ঠান্ডা এক গলায় বলে ওঠল মিলি।
চমকে ওঠলাম। এরপরও, আমার মতামতো জানতে চাইছে মিলি? কি বলব তাকে? গালি দেব? তার টুটি চেপে ধরব? না কি৮, বলব, এসব কথা আর কাউকে বলতে যেও না। যা হবার হয়েছে, অ্যাবোর্শন করিয়ে ফেল। অথবা, ঠিক আছে, বাচ্চাটাকে মানুষ করব আমরা। কি বলব?
জান, এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাইছে না অপরেশ। আর আমি ঠিক করেছি, অ্যাবোর্শন করাব না। অ্যাবসার্ড। এই প্রথম, হ্যাঁ, এই প্রথম, মা হবার সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নই আমি। মিলির গলায় কি সামান্য কান্না লেগে আছে? না কি এটা তার দৃঢ় মানসিকতার স্পর্শ? কোনো অপরাধবোধ নেই তার? অনুশোচনা?
২.
জমপুই থেকে ফিরে এসে, আর কথা হয়নি মিলির সঙ্গে। চলে যেতে হল চেন্নাই। একমাসের জন্য বলা হলেও, যে এসাইনমেন্ট নিয়ে আমার যাওয়া, তা শেষ করে ফেলি আঠারো দিনের মাথায়। আমিও ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। আসলে, সেখানে আমার রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল লাইফের একজন ক্লাশমেটকে পেয়ে যাই। অভাবিতভাবে। রেড্ডি। রেড্ডিই এই এসাইনমেন্টের বিষয়ে সাহায্য করে বেশি।
ডিজিএম, ফোনে, জানালেন, ওয়েল ডান, মিস্টার চৌধুরী। গুড নিউজ। কোম্পানী আপনাকে একটা গিফ্ট দেবার কথা ভাবছে। তিনচার দিন ছুটি কাটাতে কোথাও চলে যেতে পারেন। ইচ্ছে করলে, সিঙ্গাপুরও চলে যেতে পারেন। আপনার অপরেশ এই এলাকায় মিলনচক্রের দিকে থাকে।
অপরেশের কথা মনে পড়তেই মনে পড়ল মিলির কথা। চেন্নাই, কাজের ফাঁকে, দু একবার মিলির কথা মনে পড়েনি, তা নয়। আগে রোজ দুতিনবার ফোন করতাম। খোঁজ নিতাম তার। এবার তা করলাম না। কেন? রাগে? মিলির ঐ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এই ক্রোধ? জমপুইয়ে, সেদিন আর তেমন কোনো কথা হয়নি। একবার, বিছানায় যাবার আগে, মিলি বলেছিল, তুমি, তাহলে, কিছুই বললে না?
লাইট অফ্ করতে গিয়ে, গলা নিচু করেই বললাম, দেখ, বিষয়টা, সন্দেহ নেই, গুরুতর। সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাকেই। কেন না, তুমি চাইছ, বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে আনতে—
হ্যাঁ। আমি ওকে নিয়ে আসতে চাই। অপরেশ দায়িত্ব না নিক, তাতে কি, আমি একাই ওকে বড় করব।
তবে কি?
বাচ্চার একটা পরিচয় দরকার।
আমার পরিচয়ে সে বড় হবে। সে তার মায়ের সন্তান।
আমি নিঃশব্দে হেসে উঠলাম। সে হাসি বড় ম্লান। লুসাই মেয়েরা বিবাহের আগেও সন্তানের মা হয়ে যায়। পিতৃত্বের দায় যদি কেউ না নেয়, সমাজ নেয়। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজ কতখানি মেনে নেবে মিলিকে?
অফিসের গাড়ি ছিল এয়ারপোর্টে। প্রথমে ভাবলাম, ঘরে যাই আগে। তারপর, ভাবলাম, না, অফিস হয়ে ঘরে যাব। ডিজিএম-এর সঙ্গে দেখা করে, কয়েকটা দিন ছুটি নেব। যদিও তিনি ঘুরে আসতে বলেছিলেন আমাকে।
দুর্গা চৌমুহনীতে এসে দেখলাম, জনসভা চলছে রাস্তা আটকে দিয়ে। এফডি আইয়ের বিরুদ্ধে জনসভা। এফডিআই কতখানি বিপজ্জনক, এখনও বোঝা যাচ্ছে না এটা। প্রতিবাদ করা আর রাস্তা আটকে জনসভা করা যে এক নয়, কে বোঝাবে? এই শহর রাজনীতির দাদাদের দ্বারা পীড়িত। মুখ বুজে সইতে হয় সবাইকে। কেউ কিছু বলে না। মানুষ, এখনও, এইসব নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়! অবাক হতে হয়, এসব দেখলে। শিক্ষাদীক্ষায় যারা এগিয়ে আছেন, তারাও, সামান্য স্বার্থের জন্য দাদাদের অনুগামী হয়, সেই সব দাদা, যারা তাদের চেয়েও অশিক্ষিত, বোধহীন। কবে যে মানুষ মুক্তি পাবে এই যাঁতাকল থেকে?
অফিসে বেশিক্ষণ থাকতে হল না। ডিজিএম, আমাকে দেখে, বললেন, কয়েকটা দিন বিশ্রাম কর। তারপর তোমাকে হয় তো, দেশের বাইরে যেতে হতে পারে।
ঘরে এসে, দেখি, তালা দেওয়া। অর্থাৎ মিলি নেই ঘরে। দ্বিতীয় চাবি থাকে আমার সঙ্গে। ফলে, অসুবিধে হল না কোনো। ঘরে ঢুকে, প্রথমেই চান করে নিলাম। ফ্রেশ হওয়ার দরকার ছিল খুব। তারপর, নিজেই বানিয়ে নিলাম কফি। টিভি চালিয়ে দিয়ে, ড্রয়িং রুমে বসেছি, তখনই বেজে ওঠল কলিংবেল।
এই সময় কে আসতে পারে? মিলি? ওর কাছে তো চাবি রয়েছেই। তা হলে?
দরজা খুলে, দেখি, অপরেশ।
মুহূর্তে, পায়ের রক্ত চড়ে গেল মাথায়। এক নিমেষ। না কি, তারও কম? প্ল-বিপলের চেয়েও কম? ক্রোধ গিলে ফেললাম পরক্ষণেই। থুথু গেলার মতো। দতজা ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকতে দিলাম তাকে।
কখন এলে? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, অপরেশ বলে ওঠল।
তার কথার জবাব না দিয়ে, পালটা জিগ্যেস করলাম, তুমি কি মিলির কাছে এসেছিলে?
হ্যাঁ! সকালে ফোন করেছিল। খুব জরুরি দরকার বলল। আসতে পারিনি। পার্টির একটা গোপন মিটিং ছিল। আটকে গেছি। মিটিং থেকে বেরিয়ে, ফোন করলাম, স্যুইচ অফ। ভাবলাম ঘরে আছে।
মিলি তো ঘরে নেই। ঠান্ডা মাথায় বললাম আমি।
ঠিক আছে। পরে আসব।
চলে যাচ্ছিল অপরেশ। পেছন থেকে বললাম, দাঁড়াও, অপরেশ। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার।
ফিরে এসে, অপরেশ বসল সোফায়।
ড্রিংক্স নেবে?
দাও। খুব নির্লিপ্ত গলায় বলল অপরেশ।
অপরেশের হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে, একটা চেয়ার টেনে বসালাম আমি। প্রথম চুমুক গলা পর্যন্ত নিয়ে, তাকে বললাম, মিলি বলছিল, তার পেটে যে বাচ্চাটা আসছে, সেটা তোমার। এটা কি ঠিক? অপরেশ?
ঢোক গিলে উঠতে পারেনি অপরেশ। তার আগেই, আমার এই প্রশ্ন, বোধহয়, তাকে হতচকিত করে তুলল। হেঁচকি এল তার নাকে-মুখে দিয়ে। কাশতে লাগল সে।
বি কুল, অপরেশ! রেগে যাওয়ার কথা আমার। আর তুমি খাচ্ছ ভিড়মি?
আমার ভেতরে কি জেগে উঠছে শয়তান? আমি এখন ঠান্ডা মাথায় খুন পর্যন্ত করতে পারি। অপরেশ বুঝতে পারছে, ফাঁদে পড়ে গেছে সে। এখন আর পরিত্রাণ নেই তার।
নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল অপরেশ। ঘোড়ার মুখে পড়ে গেছে তার নৌকা আর গজ। কোনো রকমে গজ বলি দিয়ে সে এখন চেষ্টা করছে নৌকা বাঁচাবার। মিলি বলেছে? মিলি?
অবাক হচ্ছ? কী করে তোমাদের গোপন অ্যাফেয়ার্সের কথা প্রকাশ করল মিলি? এই ভাবছ?
আমি গ্লাস খালি করে নিলাম এক চুমুকে। দ্বিতীয়বার গ্লাস ভরে নিতে নিতে, বললাম, মিলিকে চিনতে সামান্য ভুল করেছ, অপরেশ! অন্য মহিলাদের থেকে একটু আলাদা সে। পার্সোনালিটি বলতে যা বোঝায়, সেটা তার আছে। অকপটে কনফেস করার ক্ষমতা তার আছে। তা, তোমার বাচ্চা যখন, তোমার জন্য ফেঁসে গেছে সে, এখন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছ কেন? না কি, দায়িত্ব নিতে গেলে, জয়তী, তোমার দুই বাচ্চা, পার্টির ইমেজ, সব হারাবে, এই ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছ?
কোনো জবাব দিল না অপরেশ। হাতের গ্লাস রয়ে গেছে হাতেই। মুখটা রক্তশূন্য রোগীর মতো।
অবশ্য, তোমাকে দোষ দিয়েই-বা কী করব? তোমাদের তো গাছেরও খাবো, তলারও কুড়োব নীতি। ক্ষমতায়ও থাকবে, বিপ্লবও করবে। ইমেজ তো রাখতেই হয়। না হলে চলবে কেন?
টিভিতে, দিল্লীর নিউজ। পার্লামেন্ট-এ বিজেপির সুষমা স্বরাজ কী যেন বলছে। হৈচৈ হচ্ছে খুব। টিভি বন্ধ করে দিলাম। পার্লামেন্ট মূলত শুয়োরের খামার, কে যেন বলেছিল! এমপিদের কান্ড কীর্তি দেখলে, ওই কথাটিই মনে পড়ে আমার।
বিশ্বাস কর, জহর, যা ভাবছ, ঘটনাটা সেরকম না। অপরেশ হঠাৎ বলে ওঠল। আসলে—
আত্মপক্ষ সমর্থণ করার চেষ্টা করছ কেন, অপরেশ? তুমি আমার বাল্যবন্ধু। অবশ্য এখন থেকে আর কখনও বন্ধু ভাবতে পারব না তোমাকে। অ্যাবসার্ড। মধ্যযুগীয় ক্রোধ আমার ভেতরে থাকলে খুন করে ফেলতাম তোমাকে। একটু আগেও ইচ্ছে হয়েছিল। খুন চেপেছিল মাথায়। তা, আমি তো আর তুমি না!
ঘরে এখন ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া কিছু নেই। ভয়ংকর এক স্তব্ধতা ঘরটাকে গুমোট করে তুলছে। আর এক গ্লাস ভরে নিলাম আমার জন্য। অপরেশ, দেখলাম, আর নিল না। সেই গ্লাস এখনও অর্ধেক হয়ে আছে। বললাম, মিলি অ্যাবোর্শন করবে না। ও যে বলে, তাই করে। কিন্তু তুমি সেই বাচ্চার বাবা হয়েও, দায়িত্ব নিতে মানছ না কেন?
এটা অ্যাবসার্ড জহর। পার্টি আমাকে সাসপেন্ড করবে। জয়তী—
আমার কি হল হঠাৎ। চিৎকার করে ওঠলাম। স্কাউন্ডেল! বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। গেট আউট। একটা মহিলার সর্বনাশ করে এখন সাধু সাজতে চাইছ? দায়িত্ব নেবার মুরোদ নেই যখন ভোগ করতে গেছিলে কেন? যাও। আর কখনও যেন তোমার মুখ না দেখি!
কোনো কথা না বলে, অপরেশ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার দিকে ফিরেও তাকালাম না আমি। এখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। খোঁড়াচ্ছে কেন সে? যখন এল, খোঁড়াতে দেখিনি তাকে। তা হলে?
৩.
সন্ধ্যেবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, মাথাটা ধরে আছে প্রচণ্ড। ঘড়ির দিকে তাকালাম। নটা বাজে। মাই গড! এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? টয়লেট থেকে, এসে, দেখলাম, মিলি এখনও আসেনি। এরকম তো করে না! ফোন করলাম, স্যুইচ অফ। অপরেশও বলছিল এই কথা। কোথায় গেল মিলি? চন্দ্রপুরে তার বাবা থাকেন। একা। সেখানে যায়নি তো? তাড়াতাড়ি, মিলির বাবাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। নট রিচেবল। তার মানে?
কার কাছে জানতে চাইব মিলির কথা? বৃষ্টির কথা মনে পড়ল। মিলির বন্ধু। দু-একবার এই ঘরে এসেছিল। কিন্তু তার ফোন নম্বর? হতাশ হয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
চন্দ্রপুর, বাসস্ট্যান্ডের পেছনে, মিলির বাবার বাড়ি। জামতোলা বলে লোকে। বারান্দায়, একটা চেয়ারে বসে রয়েছেন তিনি। অনেকদিন দেখিনি। আজ দেখলাম, দীর্ঘকায় লোকটা শীর্ণ হয়ে গেছে। মিলির মা নেই। আমাদের বিয়ের পরেই মারা গেলেন। লাংস-ক্যানসার। খুব কষ্ট পেয়েছেন ভদ্রমহিলা। বাবাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে বলেছিলাম। মিলিও চাইছিল খুব। তিনি থাকবেন না। মেয়ের বাড়িতে থাকলে না কি মান-সম্মান থাকে না। অথচ তিনি থাকলে অপরেশ এই কান্ড করার সুযোগ পেত না। সাহস হত না মিলিরও।
আমাকে দেখে, গ্রিলের দরজা খুলে দিলেন তিনি। এত রাতে? কিছু হয়েছে জহর? কোনো বিপদ? উৎকন্ঠিত গলা কেঁপে গেল যেন।
মিলি আসেনি, বাবা? কোনো ভনিতা না করে জিগ্যেস করলাম আমি।
মিলি? না তো! ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন আমার কথা শুনে।
আশ্চর্্য!
মিলি তা হলে গেল কোথায়? আমার চেন্নাই থেকে আসার খবর তার জানার কথা নয়। তা হলে কোনো বন্ধুর কাছে গেছে? অদিতিদের বাড়ি? অদিতিরা থাকে রামনগর আট-এ। সেখানেও যায়নি সে। সব কথা শুনে, অবাক হয়ে গেল অদিতি। বলল, মিলির দায়িত্বজ্ঞান খুব বেশি। ঘরে যান, গিয়ে দেখবেন, ফিরে এসেছে সে।
বৃষ্টিও তাই বলল। চারদিন আগে, এসবিআইর কাউন্টারে দেখা হয়েছিল। খুব বেশি কথা হয়নি তখন। টেনশনে ছিল কি এক কারণে। ভেবেছিল, দু-একদিন পর, মিলির সঙ্গে দেখা করবে, গিয়ে।
রাতে, এই প্রথম, একা থাকতে হল ঘরে। খেতে ইচ্ছে করছিল না। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মিলি আসেনি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। ঘুমের ভেতর, দেখলাম, একটা থানার লক-আপ। আলোয় সাজানো হয়েছে সেই লক-আপ। শুধু লক-আপ নয়, পুরো এলাকাতেই আলোর রোশনাই। সেখান থেকে, দুজন সান্ত্রী নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ভেতরে। আরও একটা ঘরে। ঘরটায় কেউ নেই। একটা বালভ ঝুলছে মাঝখানে। কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু মাঝখানে একটা হাতলহীন চেয়ার। পাশে কয়েক বোতল জল।
ঐ ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দিল সান্ত্রীরা। কিছুক্ষণ পরে, তিন-চারজন পুলিশ এলো। ওসি সহ একজন এস আইও এলেন সঙ্গে। ওসি বসলেন চেয়ারে। বাঁ-হাতে বেতের একটা পালিশ লাঠি। এস আই আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনিই তবে জহর চৌধুরী?
আমি মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ।
আপনি, শুনেছি, একটা ভালো কোম্পানির এগজিকিউটিভ। মান-সম্মানও আছে আপনার। টাকাকড়ির অভাব নেই সে অর্থে। তাহলে, কেন, আপনি আপনার স্ত্রী মিলি চৌধুরীকে খুন করলেন? কেন?
চুপ করে রইলাম আমি।
শুনুন, আপনি যদি কো-অপারেশন করেন, তাহলে, থার্ড ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন হবে না। আর যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন—
উলটো দিক থেকে, মানে, ওসি বলে ওঠলেন, মশাই, বলে ফেলুন। আপনার সকল গতিবিধি আমাদের জানা। আমরা শুধু আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই।
বলুন—
অ্যাই লিটন, ভদ্রলোকের প্যান্টের জিপটা নামিয়ে দে। বুঝতে পারছি, পেনিসে সিগারেটের ছ্যাঁকা না দিলে মুখ খুলবে না!
বলে কি! এই তাহলে থার্ড ডিগ্রি? আমার সারা শরীর কেঁপে ওঠল। মিলিকে আমি জমপুই থেকে ফেরার পথে, মনপুইয়ের কাছে একটা উঁচু জায়গা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। লজ থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম সকালেই। যাতে লজের কোনো লোক কিছু বুঝতে না পারে। কমলা বাগান দেখাবার নাম করে, মনপুইয়ের আগে, গাড়ি থেকে নেমে, একটা নির্জন স্থানে তার টুটি চেপে ধরি। শাঃলী! আমাকে ঠকাবে। আড়ালে আড়ালে আমার বন্ধুর সঙ্গে ফস্টিনস্টি? ছটফট করতে করতে, একসময়, নিথর হয়ে গেল মিলি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, না কোন শ্বাস পড়ছে না। তার মানে, মৃত সে। দেরি না করে, তার মৃতদেহ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। গড়াতে গড়াতে, দেখলাম, অনেক নিচে চলে গেল। সহসা আর কেউ দেখবে না উপর থেকে। তার আগেই শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলবে।
আমার মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। মিলির মুখে, ঐ কথা শোনার পর, আগ্নেয়গিরির লাভার মতো টগবগ করছিল আমার ক্রোধ। এখন শান্ত। শিস দিতে দিতে, গাড়ি চালিয়ে, চলে আসি কাঞ্চনপুর। সেখান থেকে সোজা আগরতলা। তারপর, অফিসের কাজে চেন্নাই।
এত নিখুঁত প্ল্যানিং করেও ধরা পড়ে গেলাম আমি?
এস আই, হঠাৎ, হ্যাঁ, হঠাৎই, বলা নেই কওয়া নেই, হো হো করে হাসতে লাগল। সেই হাসি, ঐ নির্জন সেল পার হয়ে, টুকরো টুকরো হয়ে, ছড়িয়ে পড়তে লাগল চরাচরে। আর আমি কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। মনে হল, আমার শরীর ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে, বিন্দু হয়ে যাচ্ছি না তো? মিলিয়ে যাচ্ছি না তো ঐ হাসির মতো?
ঐ সময়, ঐ আধো ঘুমের ভেতর মনে হল, কলিংবেল বাজছে। মুহূর্তে, থানার লক-আপ গেল মিলিয়ে। না, সত্যিই বাজছে কলিং বেল। আর আমি, লক-আপ নয়, বিছানায় আছি শুয়ে। তাড়াতাড়ি, উঠে গিয়ে, দরজা খুলে দিই। সামনে মিলি। সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই।
মিলিকে, মনে হল, অচেনা কোনো নারী। নারী নয়, এই মুহূর্তে, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কেউ। যুগ যুগ আগে, যে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছিল তার মনোজগতের স্বর্গ। বলল, চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
ভেতরে ঢুকে, কাঁধের ব্যাগ রেখে দিল সোফায়। তারপর, বসতে বসতে বল, কবে এসেছ ফিরে?
কোনো কথা না বলে, মিলির দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক। আমার ভেতরে ক্রমশ জেগে ওঠছে এক শয়তান, প্রবল হয়ে ওঠছে সে। একটু আগে, স্বপ্নে, খুন করেছিলাম মিলিকে। স্বপ্ন সত্যি নয়, তা বলে, এখন কি খুন করতে পারি না? কেউ জানতে পারবে না। সবাই জানে, কাল রাতে খুঁজে বেড়িয়েছি মিলিকে। তার বাবাও সাক্ষ্য দেবেন নিশ্চয়।
চুপচাপ তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তখনই, মিলি বলে ওঠল, এ শহর ছেড়ে চলে যাব আমি। একটা চাকরিও জুটিয়ে নিলাম। যা পাব, তাতে চলে যাবে। বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে কোনো অসুবিধে হবে না আর।
আর এগিয়ে যেতে পারলাম না মিলির দিকে। উলটো দিকের সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লাম। চারদিক থেকে, সহসা, আশ্চর্্য এক শূন্যতা চেপে ধরল আমাকে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। দৃষ্টি হয়ে আসছে ঝাপসা। চশমার কাচ কি ঘোলাটে হয়ে গেল? কি করব এখন? ঠাহর করতে না পেরে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠলাম, চলে যাবে?
মিলি কি শুনতে পেল? আমি জানি না। শুধু লক্ষ্য করলাম, মিলির সামনে, আমি ক্রমশ, টুকরো টুকরো হয়ে, ভেঙে, আছড়ে পড়ছি। যেন কেউ আমার অস্থি-মাংস-মজ্জা আলাদা আলাদা করে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলছে মিলির পায়ের নিচে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মিলির। সে তখন গুন গুন করে গাইছে, তুমি আপনে কর পার... আমি চাহি না নিস্তার...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন