গানের ভুবনে কবিতা
পৃথিবীর সব কিছুই গতিশীল, পরিবর্তনশীল। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, মানুষের পোশাক আষাক, চালচলন। শিল্প সংস্কৃতি স-ব। এই পালটানো এত দ্রুত গতি সম্পন্ন যে অনেক মানুষ সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে। গানের ধারা শৈলী সেভাবে পালটে গেছে গতির সামঞ্জস্য বজায় রেখে।
সুধীন দাসগুপ্ত, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ----এঁদের মতোন গুণী মানুষ প্রায়এক সাথে চলে গেলেন। মনে হয়েছিল একটা বিরাট ফাঁক তৈরি হয়েছে। শূন্য স্থান!! সেটা কি পূরণ হবে? বাঙালী ভেবেছিল বাংলাগানের ভরাডুবি হয়েছে। হঠাৎ একদিন জোয়ার এলো বাংলা গানে -----সুমন / অঞ্জন দত্ত/ নচিকেতা আরও কিছু প্রতিভাবান শিল্পীর হাত ধরে । বলতেই হচ্ছে এঁরাই নিয়ে এলেন বাংলা গানের নতুন জোয়ার ।
প্রথমেই বলবো অসম্ভব প্রতিভাধর শিল্পী কবির সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়) আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী, তাঁর গানের ভাষায় আছে প্রতিবাদ , মানব প্রেম, দুর্গত বঞ্চিত ,অবহেলিত মানুষের জন্য সহানুভূতি। জানিনা কতবার শুনেছি এই গান----“ কতটা পথ পেরলে তবে পথিক বলা যায়/ কতটা পথ পেরলে তবে পাখী জিরোবে তার ডানা”, গানের কথা গুলো শিহরন জাগায় , মনে রেখে যায় একটা অদ্ভুত অনুভূতি। “কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শেকল পরে”..... আবার “কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে ,বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেষে”। পুর গানটাতে অনেক প্রশ্ন,এবং উত্তর সবার জানা। একটা বিষণ্ণতা রয়ে যায় । এই গান Bob Dylan-এর ‘Blowing in The Wind’ অবলম্বনে লেখা। সুমনের inspiration Bob Dylan. সুমনের আর একটা গান, খুব-ই মন খারাপ হয়ে যায় , একটা ছেলে রিকশা চালাচ্ছে, বয়স ১২ কি ১৩ । তার হাসি খুশি খেলাধুলা দৌরাত্ম্য সব কিছু ছেড়ে---“পেট কাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা, আকাশে ঘুরির ঝাঁক মাটিতে অবজ্ঞা/ যে ছেলেটা প্রাণপণে রিকশা চালাচ্ছে, মুক্তির ঘুরি তাকে খবর পাঠাচ্ছে” ।সে যে শিশু শ্রমিক একজন! কিন্তু হায় কোথায় তার মুক্তি?
অভিনেতা অঞ্জন দত্ত—একাধারে নাট্য পরিচালক,চিত্র পরিচালক আবার তাঁর গান গীটার হাতে নিয়ে। এক কথায় ভীষণ-ই ভালো লাগে তাঁর গান শুনতে, মন ভালোলাগা কিন্তু আবার মনখারাপ করা একটা গান, শৈশব মনে করিয়ে দেয় , ‘খাদের ধারের রেলিং টা’ ......দার্জিলং , অঞ্জনদা ফিরে যান শৈশবে, তাঁর সাথে সাথে আমিও চলে গেলাম সেই খুব সুন্দর জীবনটাতে।
“সেই ফেলে আসা/ মেঠো পথের বাঁকে দুপায়ে ধুলো,” নচিকেতা চক্রব্ররতী আর একজন সংগীত শিল্পী, তাঁর এই গানে বন্ধু অনির্বাণকে মনে করছেন, অনির্বাণ এখনও মানুষের জন্য কাজ করে যান। এই গান শুনতে শুনতে গভীরভাবে অনুভব করেছি, হৃদয় ছুঁয়ে যায়, “ফের যাব তোর সাথে, রোদ্দুর নিয়ে হাতে , তখনই মুক্ত হবে আমার গান,” আমার ভালো লাগা গানের গুচ্ছ গুচ্ছ এবং ভালোলাগার অনুভূতি আমাই সব বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
খালি গলায় ,বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে, তেমনি অনবদ্য সুরে গাইলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় , “কিসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের/ লাফিয়ে হব পার/ থাকনা হাজার অজুত বাধা”-----এখানে তরুণ তাজা যুবকের টগবগে রক্ত ছলকে ওঠে, ভয় বাধা তুচ্ছ করে এগিয়ে চলার গান। জীবনের গান। জীবন সংগ্রামের গান। প্রতুল দার কণ্ঠে আর একটা গানের কথা না বলে পারলাম না,----- ফরাসী কবি Jacques Waver –র কবিতা, তাতে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যবাদের কথা বলছেন একজন পুরুষ-ই----“ গিয়েছিলাম পাখির হাটে কিনেছিলাম পাখি/ বঁধু তোমারই জন্যে”...... আবার বলিষ্ঠ গলায় শুনি, “ গিয়েছিলাম লোহার হাটে, কিনেছিলাম শেকল , ভারী শেকল/ বঁধু তোমারই জন্যে”। এই সব গানের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শহর , সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ, রোমান্টিকতা। বাঙালী কোনদিন চিন্তা করতে পারেনি এরকম তীক্ষণ স্বপ্রতিভ, প্রখর লেখা নতুন প্রজন্মকে ফিরিয়ে আনবে গান সৃষ্টির মাধ্যমে । বাংলা গানের নতুন স্টাইল , গানের লিখন শৈলীর পরিবর্তন ঘটেছে।
চমকে উঠেছিলাম একটা গান শুনে,মৌসুমি ভৌমিকের কণ্ঠে “ শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ /আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনা বালির তীর ধরে বহুদূর বহুদূর হেঁটে এসেছ”......মৌসুমি তাঁর গানের মধ্যে নিজস্ব অনুভুতি, নিজের কথা ব্যক্ত করেছেন, অনেকবার শুনেছি গানটা। তখন মনে হয়েছে , নোনা বালির তীর ধরে আমি নিজে ব-হু-দূ-র হেঁটে চলেছি, আর “স্বপ্ন দেখব বলে আমি দুচোখ পেতেছি’’।
লোপামুদ্রা মিত্র-র একক অনুষ্ঠানে শ্রোতা হয়ে উপস্থিত থেকে মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনেছিলাম তাঁর কণ্ঠে অন্যের সুরারোপিত জয় গোস্বামীর কবিতা । এক নারীর জবানীতে ফুটে উঠেছে বেদনা, সে তার ভালোবাসার মানুষ বেনীমাধব দ্বারা প্রতারিত , তার ভালোবাসার পরাজয়। প্রবঞ্চিত সব নারী কণ্ঠ যেন গাইছে সেই গান, “ বেনীমাধব বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাব / তুমি কি আর আমার কথা ভাব”...... ‘বেণীমাধব’ ।
গান ব্যতিরেকে মানুষের জীবন বৃথা। আমাকে বিহ্বল করেছে এই শিল্পীদের গান। আমরা অনেকটা সময় এগিয়ে এসেছি, এক কথায় আধুনিক যুগের মানুষ আমরা। এখনকার আধুনিক বাংলা গান সময়, অভিজ্ঞতা, ভাবনা চিন্তা সব কিছুকেই জিবন্ত করে তুলেছে, বিভিন্ন শিল্পীদের রচনা কিংবা গায়কি তা বলে দেয়। বিদগ্ধ সমাজে এই পাওয়া আমাদের এক বিশাল পাওয়া ।
সুমন/ নচিকেতা / অঞ্জন দত্ত / শিলাজীৎ / মৌসুমি / রূপঙ্কর / প্রতুল মুখোপাধ্যায় / লোপামুদ্রা—এদের গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে অর্থাৎ লাইভ প্রোগ্রামও দেখেছি। শুনতে শুনতে সেই দৃশ্যই ফুটে ওঠে যা আমাকে কাদাঁয়, হাসায় , প্রতিবাদ করতে শেখায় , সর্বোপরি মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় এই জীবনের গান। জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাই।।
অলংকরণ – মেঘ অদিতি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন