সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

মলয় রায়চৌধুরী


খামচানো কালপৃষ্ঠা
মাটিতে শাল বা শিশুকাঠের গুঁড়ি পুঁতে তাকে পাকিয়ে-পাকিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁশের রেলিঙ আর কঞ্চির ধাপ দেয়া কাঠের সরু সিঁড়ি , এতই সরু যে একজন যদি নামতে থাকে তাহলে তাকে জায়গা দেবার জন্য রেলিঙে হেলে দাঁড়াতে হবে । তা সত্ত্বেও স্পর্শ বাঁচানো কঠিন । স্হান সংকুলানের জন্য দুই পাক ওঠার পর একতলা, তার পর দুই পাক উঠে দু'তলা, এইভাবে পাক খেয়ে চারতলা পর্যন্ত টালির চালে তৈরি কাঠের বাড়ি । অর্থাৎ সিঁড়িটা কেবল সরু নয়, তা বেশ প্যাঁচালো । প্রতিটি তলায় সিঁড়ির মুখে বাঁ'দিকে একটা ঘর আর ডান দিকে খোলা , কাঠের সরু করিডরে যাবার জন্য ; করিডরের একদিকে কাঠের ঘরের সারি , আরেক দিকে খোলাবারান্দা । বারান্দা থেকে ভেতরের উঠোন দেখতে পাওয়া যায় । ঘরের মেঝেও কাঠের, দুটি জানালার শিকগুলোও কাঠের । জানালাগুলো বিশাল, দরজার মাপেই । ঘরগুলো বারো বাই আট হবে । গ্রাউন্ড ফ্লোর বা একতলা ছাড়া ওপরের তলাগুলোয় আসবাব কম ; প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আসবাব ওপরে ওঠানো কঠিন । বিছানা বলতে মাটিতে খড়ের আঁটি বিছিয়ে তার ওপর চাদর পাতা । ঘরভাড়া মাথা-প্রতি মাসে একটাকা ,যা সংগ্রহ করতে সামন্তের পেয়াদা আসে মাসের এক তারিখে । পাড়াটার নাম ঠমেল---তার রূপ সম্পূর্ণ বদলে গেছে গত কয়েক দশকে ।

অমন গুঁড়ি পুঁতে-পুঁতে , পঞ্চাশ মিটার বাই একশো মিটার জুড়ে একটা আয়তাকার উঠোন ঘিরে জনপ্রাসাদ । এই প্রাসাদের মূল দরজা একটিই এবং সেটি সদাসর্বদা খোলা ; দশ ফিট উঁচু চার ফিট চওড়া কাঠের ফ্রেমে কাঠের ক্ষয়াটে জনপ্রাসাদের সংদরজা । কতজন থাকতেন এই বাড়িটিতে অনুমান করা যেত সকালবেলায়, যখন উঠোনে জড়ো হতেন অনেকে প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য, স্নানের জন্য । এই জনপ্রাসাদের সবাই প্রত্যেকদিন স্নান করতেন না বলে সুবিধা , প্রাতঃকৃত্য বলা হলেও সবাই সকালেই যেতেন না , অ্ভ্যাসমতো যেতেন । প্রতিদিন স্নান করার ব্যাপারটা আমিও বাদ দিয়েছিলুম । এই কুটিরপ্রাসাদে গরিব নেপালি ও নেওয়ারি পরিবার যেমন থাকতেন তেমনই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হিপির দল, নেপালি কবি-লেখক-শিল্পী, আর ভারত থেকে আসা আমাদের মতোন উচ্ছন্নাকাঙ্খীরা । গ্রাউন্ডফ্লোরে, দু-তিন ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতেন মধ্যবিত্তরা । একজন নেপালি অভিনেত্রীও থাকতেন ।


আমি ষাটের দশকের কথা বলছি , যে সময়ে ফান, ফুড, ফ্রিডাম, ফ্রিকাউট এবং ফাকিঙের উদ্দেশ্যে দলে-দলে তরুণ-তরুণী আমেরিকা-ইউরোপে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন ; লন্ডন বা অ্যামস্টারডম হয়ে বাসে, ট্রেনে, আর হিচহাইক করে তুরস্ক, ইরান, আফগানিসতান, পাকিস্তান , ভারতবর্ষ হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । লন্ডন আর অ্যামস্টারডম ছিল স্বাধঃপতিতদের জড়ো হবার ঘাঁটি । ভারত-পাকিস্তানের যে গেট দিয়ে তাঁরা আসতেন তার নাম ছিল গন্দাসিং ওয়ালা, তখনও ওয়াগার গেট হয়নি , পাকিস্তানের সঙ্গে এখনকার মতোন বোমাবুমির সম্পর্কও হয়নি , চিনের যুদ্ধ সত্ত্বেও । এই যাত্রাপথের নাম ছিল শামুক-গতির হিপি ট্রেইল , যে যাত্রাপথ ছিল যথেচ্ছাচার ও মহানন্দে সময় কাটাবার সহজ উত্তরণ । সে-সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যুবক-যুবতীরা চাইলেই চাকরি পেতেন অথচ বাড়ি ছেড়ে দলে-দলে বেরিয়ে পড়তেন । এখন চাকরি পাওয়া কঠিন , তবুও কেউ বেরিয়ে পড়েন না , তার কারণ পৃথিবীটা হয়ে গেছে ঝগড়াটে , খেঁকুরে, লোভী , জোচ্চোর ও মতলববাজ । শান্তির কোনো ট্রেইল আর নেই, দেশগুলোও অশান্ত ! পৃথিবীর অত্যন্ত ধনী এলাকাগুলোই কেবল শান্তিতে রয়েছে ।

ফ্রিকিং আউট হবার জন্যই কাঠমান্ডুতে জড়ো হতেন হিপি-হিপিনীরা , নেপালে চরস গাঁজা ভাঙ ইত্যাদি পথেঘাটে পাওয়া যেত বলে । ১৯৮০ র পর আমেরিকার চাপে প্রতিটি দেশে আইন করে ভেষজ মাদকসহ সব মাদক নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে । আমেরিকার বিজ্ঞানীরাই ভেষজ থেকে রসায়ন বের করে মাদককে কড়া আর বাজারু করে দিয়েছেন । আর ওই রসায়নেই ড্রাগ অ্যাডিক্ট নামক জীবদের জন্ম । হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা এখনও ভেষজের ধোঁয়া ফুঁকে চলেছেন কিন্তু কেউই অ্যাডিক্ট হন না ।

হিপিরা বেরিয়ে পড়ার পথে আফগানিস্তান থেকে আনতেন উচ্চমানের চরস বা হ্যাশিশ আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাপাতার গুঁড়ো যাকে পাকিস্তানিরা বলতেন গরদা । নেপালি গাঁজার সঙ্গে হ্যাশিশ আর গরদা মিশিয়ে তৈরি হতো একরকমের ডেডলি মাদক । হিন্দু বা বৌদ্ধ , যেকোনো মন্দির চত্বরে গেলে দেখা যেত বৃদ্ধ মাদকসেবীরা গোল হয়ে বসে ছিলিম টানছেন ; তাঁদের পাশে বসে পড়লেই হলো, একখানা ফ্রি লম্বা টান দেবার জন্য । আর হিপি-হিপিনীরা তো ছিলই দরিয়াদিল ; চাইলে নিজেদেরই বিলিয়ে দেবার জন্যে তৈরি । স্বয়ম্ভূনাথ মন্দিরকে হিপিরা বলত মাংকি টেম্‌পল আর এই বৌদ্ধমন্দির ঘিরেই ছিল তাদের জমায়েত , নেশা করে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রাঙ্গন ।

স্হানীয় তরুণ কবিরা পছন্দ করতেন কান্ট্রি লিকার, বিশেষত রাকসি এবং জাঁড় , যা খাওয়া হতো মাংসের আচার দিয়ে । অনেক সময়ে মোষের কাঁচা মাংস চটকে-চটকে তৈরি করা কাচিলা দিয়ে । রাকসির গন্ধ অত্যন্ত ঝাঁঝালো ; বহুদূর পর্যন্ত যায় তার নিশিডাক । এই কবি-লেখকরা স্হানীয় সংবাদপত্রে আমাদের সম্পর্কে লিখে অনেককিছু সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন । প্রায়ই নিমন্ত্রণ আসতো কবিদের রাকসি-পান আড্ডায় কবিতাপাঠের জন্য ।

আমিও ওই জনপ্রাসাদটিতে থাকতুম । জুটেছিলুম গিয়ে বন্ধু করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের ডাকে । করুণা আর চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই গিয়েছিল বেনারস থেকে । হিপিরা ভারতে এসে উঠত বেনারসে । সেই সুবাদে করুণা হয়ে উঠেছিল ওদের গাইড এবং দরকার পড়লে স্লিপ-ইন পার্টনার । বেনারসে ওই সময়ের জীবন নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলুম , 'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা' নামে, যা প্রকাশিত হয়েছিল 'বিষয়মুখ' পত্রিকায় আর পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল 'তেহাই' পত্রিকায় । নেপালের জীবনযাত্রা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে । 'টাইম' পত্রিকায় আমার ফোটো বেরিয়েছিল বলে, আর আমার সঙ্গে বিটনিক কবি গিন্সবার্গ ও ফেরলিংঘেট্টির পরিচয় আছে এবং বিটনিকদের পত্রপত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশিত হবার দৌলতে আমার নাম জানতেন হবু-কবি হিপি-হিপিনীরা । সেকারণে মাদকের ও যৌনতার একটি বিভাময় হ্যালো ওনারা গড়ে দিয়েছিলেন আমার মাথাকে ঘিরে । জীবন হয়ে উঠেছিল অবাধ ও সীমালঙ্ঘনময় ।

আমার সবচেয়ে বেশি সমস্যা হত মাদকের নেশা করে রাতের বেলায় ওই প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়া । আমি রাতে ফিরে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতুম । আমরা ছিলুম দোতলায় । কতবার ঘোরার পর দোতলায় যাব তা খেয়াল রাখতে পারতুম না । প্রত্যেকদিন বাঁদিকের কারোর ঘরের কাছে পৌঁছে টের পেতুম যে, এটা নয় , নিচে বা ওপরে গিয়ে ডানদিকে যেতে হবে । কারোর কারোর দরজায় ঝোলানো থাকত পরদা, বেশ নোংরা , মনে হত যে পরদাতেই হাত পোঁছে ভাড়াটেরা । অবশ্য হিপিদের ঘরে গিয়েও খড়ের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া যেত, বিনা বাধায় ।

মদ খেলে লোকে টলতে থাকে । ভেষজের নেশায় যা ঘটে তাকে বোধহয় বলা উচিত ভাসতে থাকা বা উড়তে থাকা । ছাদ থেকে ফেলে দেয়া ফালিকাগজের মতোন ।

একদিন রাতে ফিরে সিঁড়ির পাক গুলিয়ে ওপরে গেলুম, টের না পেয়ে নেমে এলুম, আরও কয়েকবার অমন ওঠা-নামা করার পর, উঠছি, একটি বাঁদিকের ঘর থেকে পরদার মাঝ দিয়ে স্বাস্হ্যবতী নারীর ডান হাত বেরিয়ে এলো, সবুজ কাঁচের চুড়ি, লাল রঙের ব্লাউজের হাতা, এক হ্যাঁচকায় ভেতরে টেনে মহিলা নেপালি-টানের হিন্দিতে বললেন, 'রোজই দেখি দরজা অব্দি আসো , ফিরে যাও কেন ?' 

২টি মন্তব্য: