বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১২

সূরজ দাশ



পুস্তক পর্যালোচনা

আত্মার ট্রিগার : কবি রঞ্জন আচার্য
সূরজ দাশ

কবি পুরুলিয়ায় থাকেন । কবিতায় সারাক্ষণ শব্দের চাবুক চালান । যারা কম বেশি রঞ্জনের কবিতার খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন মহানগর থেকে অনেক দূরে, তথাকথিত কবিতার ধ্যাস্টামো থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে নিজের লেখাটা অতি সন্তর্পণে লিখে চলেছেন । কোনোও চালাকি নেই, ভান নেই, নিরভেজাল কবিতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করায় কবির কাজ । কঠোরভাবে নির্বাচিত তাঁর কবিতা পাঠককে সমকালীন বিভিন্ন যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে । কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা পাই এক নির্মল প্রশান্তি ।
যারা এই সময়ের কবিতা সম্পর্কে টুকটাক খোঁজ খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, রঞ্জনের কবিতার ধার । মূলত শূন্য দশকের শুরু থেকে রঞ্জনদা ও তাদের বন্ধুরা ‘নাটমন্দির’ নিয়ে সারাক্ষণ হইচই করে কাটাতেন । হয়তো এখন আর সেই উন্মাদনা নেই, নেই তারুন্যের ছটফটানি, তবু এখনো নিরলস প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ‘নাটমন্দির’কে বাঁচিয়ে রেখেছেন ।
কবিতার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা যে কি ভীষণ সংগ্রাম, তা পাঠক মাত্রই অবগত আছেন । নব্বই এর শেষে এবং শূন্য দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমরা যারা মফসসল শহরে কবিতা নিয়ে, পত্রিকা নিয়ে হইচই করতাম, তখন থেকেই রঞ্জন দা আমাদের ঠেকে একটা পরিচিত নাম, আলোচনার বিষয় । সে সময় আমাদের বন্ধুদের মুখে মুখে তার কবিতার প্রচুর পঙক্তি ঘুরতো ।

আমার এখনো মনে আছে কিছু অসাধারণ পঙক্তি । যেমন .....
অভিশাপ দিল সময়ের হাততালি
ঝাণ্ডা হাসলো রাক্ষসদের হাতে
তেলের খুঁটিতে বাঁদর হলাম খালি
দেশ ভরে গেলো বাঞ্চোতে বাঞ্চোতে
একই কবিতার আরও একটি পঙক্তি যা আমাদের ভীষণভাবে আলোড়িত করতো ।
        গুছালো আখের আসছে আসছে বলে
        মিথ্যে আশায় মিছিলে ছোটালো পা
        সন্ধ্যে হলেই জিন মিশে যায় জলে
        ভালোই আছেন বিপ্লবী কাকুরা
২০০১ সালে রঞ্জনদার প্রথম কবিতার বই ‘কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ বের হয় । মাত্র ১ ফর্মার বইয়ে ১২টি কবিতা । তাতেই জাত চিনিয়েছেন কবি । আমাদের বন্ধুদের এ হাত সে বদলা বদলি হতে হতে একদিন ‘কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ বেহাত হয়ে যায় । রুগ্ন একটি কবিতার বই, তাতেই কিনা আমাদের টগবগানি । এখনো স্বপ্নে খুজে বেরাই সে বই ।
        দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১২ তে কবির দ্বিতীয় কবিতার বই ‘আত্মার ট্রিগার’ (৪ ফর্মা), বের হয় কলকাতা বইমেলায় । প্রকাশক – ‘নাটমন্দির’, স্বরূপ দত্ত, ‘কথা কও’, ডাক্তার ডাঙা, পুরুলিয়া । প্রচ্ছদ – জিশান রায় ।  রচনাকাল – ২০০১ – ২০১১ ।
        যে বই নিয়ে আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, তার সূচক কবিতাটি আপনাদের পড়তে বলবো ।
        রাগ দিলে মাথার ভেতরে
        শরীরে ছড়িয়ে দিলে দুরারোগ্য ব্যাধি
        ফাঁসে আটকে যাওয়া জন্তুর মতো
        চিৎকার করছি – হৈ হৈ করে ছুটে আসছে ব্যাধ
        শালা শয়তানের বাচ্চা
        ভগবান সেজে বসে আছে মাথার ওপরে
মরে যাচ্ছি – আগুন আগুন
নেভানোর জন্যে কেউ জেগে নেই
ওসি-র মেয়ের বিয়ে, মেজোবাবু মদে চুর
একটার ওপর আর একটা চেপে বসে আছে আগুন নেভানো গাড়ি
রাতের বাংলায় অন্ধকার গোপন গুহায়
জ্বলে পুড়ে মরছি আর অভিশাপ দিচ্ছি –
                আমি আমার পূর্বপুরুষকে...

রঞ্জনদা লেখেন এমনই । সোজা কথা সহজভাবে কবিতায় ব্যক্ত করা খুব কঠিন কাজ । সে কাজটায় উনি ভীষণ সাবলীলভাবে করে চলেছেন ।

                দুহাত তুলেছি
                দেখে নাও আপাদমস্তক
                ষড়যন্ত্রে ঘৃণা করি
                যা হবে সামনা সামনিই হবে

ভিন্ন ধারার ভিন্ন মতের কবিকে যারা চেনেন, তারা জানেন, কবির লেখনির জোড় । ‘ঠোক্কর খেতে খেতে বিশ্বাস বোবা হয়ে গেছে’ । এই সমাজ , এই সংসার সব কিছুরিই একটা মানে আছে । মানে আছে এই অচেনা অজানা সম্পর্কেরও । কিন্তু সেটা একবার ফাঁস হলেই ভয়ঙ্কর শব্দে থেমে যাবে পৃথিবী । মানুষের মৃত্যুর ভেতরেও কিভাবে শুয়ে থাকে বেড়াল ... কবির ছোট ছোট বাস্তব অনুভুতি পাঠককে সব সময় বিমোহিত করে রাখে । কবি মনে করেন ,
                সব সত্যের গিঁট হাল্কা করে দিতে নেই
                কিছু রেখে দিতে হয় উত্তর পুরুষের জন্য ...

যেকোনোও সাধারণ মানুষের সামান্য বেঁচে থাকার ইছচ্ছাগুলো কবি বার বার ছুঁয়ে দেখতে চান । সেসব নিয়েই কবি ভালো থাকেন । ভালো থাকার এটাই তাঁর পাসওয়ার্ড । পাঠক পড়ুন ...

        কোনো কারণ ছাড়াই মানুষ মানুষের পোঁদে লাগে আজকাল
কোনো কারণ ছাড়াই সকালের প্রেম বিকেলে ভেঙে যায়
তবু এসবের মধ্যেও তোমাকে লিখতে চাই
রমেন ফমেন আমি চিনি না
তুমি যার সঙ্গে ইচ্ছে ঘুমোও জেগে ওঠো
গ্যাংটকে যাও জাহান্নামে যাও
আমার কিছু যায় আসে না
কিন্তু আমি যখন তাকিয়ে থাকব
কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে

এরকম অসংখ্য মুগ্ধ করা কবিতার বিদ্যুৎ ছড়িয়ে আছে তাঁর আত্মার ট্রিগার-এ । এই সময়ের প্রত্যেক তরুণ কবির অবশ্য পাঠ্য এই কবিতার বই । রঞ্জনদার কবিতা নিয়ে বেশি কথা নয় । যারা এখনো ওনার এই কবিতার বইটি হাতে পান নি, তাদের জন্য আমি আমার পছন্দের কিছু পঙক্তি পরপর উঠিয়ে দিলাম পাঠকের জন্য ।
               
                এসবের মাঝেও লড়ে যাচ্ছি রতনখুড়ো
                খিদে চেপে যৌনতা চেপে
                দু ফরমার জীবন উল্টে চলেছি
                দুপাশে ফিসফিস করে কথা বলছে লোকজন
                মাকড়শার ফাঁদে পোকা দেখে জিভ চাটছে টিকটিকি

আমি আমার কবিতায় লিখেছি
একই সাথে পুরুষ ও গরীব হয়ে জন্মানো কী ভীষণ অপরাধ
কিন্তু কেউই তা উল্টে পাল্টে দেখেনি আজ পর্যন্ত
আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়
মানুষ চটজলদি সভ্য হয়ে যাওয়ার ফলে
প্রকৃত যৌনতা অনাবিষ্কৃতই থেকে গেলো বোধহয় !

যদিও যৌনতার ভেতর দিয়েই
আমিও একদিন চলে এসেছি পৃথিবীতে
তবু আজও পাণ্ডুলিপি বগল দাবায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছি
আমার কোনো পাঠক নেই
                                প্রকাশক নেই
যাদের অন্তত একান্তে পড়ে শোনাতে পারবো
আমি ঠিক কীভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম এই পৃথিবীতে


...................................................
আত্মার ট্রিগার : রঞ্জন আচার্য
রচনা কাল : ২০০১-২০১১
১ম প্রকাশ : কলকাতা বইমেলা ২০১২
প্রকাশক : ‘নাটমন্দির’, স্বরূপ দত্ত , ‘কথা কও’, ডাক্তারডাঙা, পুরুলিয়া- ৭২৩১০১ ।

1 টি মন্তব্য:

  1. দারুণ। কবিকে ধন্যবাদ। আলোচককে আরো বেশি ধন্যবাদ এমন একটি কলমকে দুরন্ত করে ফুটিয়ে তোলার জন্য।

    উত্তরমুছুন