ঘোমটা, বোরখা এবং অবগুন্ঠন
পৌলমী চক্রবর্তী
নারীজীবনের স্বাধীনতার ওপর প্রাচীন এবং প্রথম হস্তক্ষেপ নিয়ে আসে অবগুণ্ঠন, কখনো-বা বোরখা কখনো-বা ঘোমটা হিসেবে পরাধীনতাকে নারী জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখেছে এই ক্ষুদ্র পোশাকটি। প্রকৃতপক্ষে ঘোমটা ছিল শালীনতার আবরণ ধারণের প্রচেষ্টা । কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি অনগ্রসর নারী জাতির অবরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে নারীরা পর্দানসিন হয়ে পরে এবং তাঁদের স্বাভাবিক বিমুক্ত গতিপথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। বহু আগে থেকেই ঘোমটা দেবার রীতি আমাদের ভারতবর্ষ তথা বিভিন্ন দেশগুলিতে ছিল। বর্তমানে তার প্রচলন বহু কমে এলেও এখনও বোরখা কোনো বিশেষ জাতির নারীদের বাকিদের থেকে আলাদা করে - এই ধারণাসিদ্ধ মানুষরা নারীদের এখনও পর্দাবিমুক্ত হতে দেয়নি এবং কোনো জাতি বিশেষে নারীদের স্বতন্ত্র রাখবার প্রয়াস তাদের নিজস্ব অসংবদ্ধ থাকার ইচ্ছাকে অবগুন্ঠিত করে অনায়াসে । যদি প্রশ্ন করা হয় ঘোমটা বা বোরখার প্রয়োজনীয়তাটা কোথায়, তাহলে হয়ত উত্তর হবে নারীর লজ্জা নিবারণ, অগ্রজের প্রতি (বিশেষত পুরুষের) অনুজের শ্রদ্ধা প্রদর্শন ইত্যাদি । কিন্তু আমরা মানুষরা বরাবরই নিজের মস্তক এবং কুন্তলকে গর্ব এবং অহংকারের স্থান দিয়ে থাকি সেই কারণেই ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অনেকেই (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) নিজেদের কেশরাজি ঈশ্বরের চরনে সমর্পণ করেন । এর অর্থ দেবের উদ্দেশ্যে নিজেদের সেই গর্ব বা অহংকারকে ভূলিসাৎ করা। তাহলে নারীরা যখন নিজেদের গর্বকে পুরুষদের সম্মুখে অবগুণ্ঠিত করে তখন এই অবগুণ্ঠনের রীতি খুব সহজেই নারী পুরুষের সমান অধিকার এবং মানের প্রশ্ন তুলে ধরে । প্রশ্ন এও আসতে পারে যে বোরখা বা ঘোমটা প্রচলিত দেশগুলিতে পুরুষদের সেই ধরণের আচ্ছাদনের নিয়ম নেই কেন ? লজ্জা এবং সম্ভ্রম কি শুধু নারীদেরই ভূষণ! শুধুমাত্র ঘোমটা বা বোরখার ব্যবহারই কি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাসূচক অভিব্যক্তি ঘটাতে পারে? যদি তাই হয়, তবে জানতে চাইব বোরখা আচ্ছাদিত মেয়েরা কি ধর্ষিতা হন’না ? প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে আরও বলা যেতে পারে যে নিতান্ত প্রয়োজনীয় নয় বলেই প্রথমে ফ্রান্স এবং পরে নেদারল্যান্ডের সরকার কত্তৃক বোরখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
অবশ্যই বলা উচিৎ ঘোমটার একটা সাংস্কৃতিক দিকও আছে, দূর্গাপুজোর সিঁদুর খেলার মতো অনুষ্ঠানে বাঙালি নারীদের ঘোমটা একটা ভিন্ন পর্যায়ের সৌন্দর্য এনে দেয় । কিন্তু তৎস্বত্ত্বেও বলা যায় যে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কোনো আবেশাত্মক বা বাধ্যতামূলক নিয়মে বদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। সময়ের সাথে সাথে বর্তমানে ঘোমটার প্রতি বংশানুক্রমিক নিয়মানুবর্তীতার প্রভাব অনেক শিথিল হয়েছে - সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল থেকে এখন মাথা, এবং মাথা থেকে সিঁথি, এবং অবশেষে ক্রমশ খোঁপার দিকে পিছিয়েছে। কিন্তু আশা করা যায় শালীনতা ও শিষ্ঠাচার সম্পর্কে নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার রদবদল না ঘটালে ঘোমটা ব্যতিত নারী জীবন কখনই নিরাভরণ হয়ে পড়বে না । কে বলতে পারে, এই ঘোমটা- বোরখার অজস্র নিয়মের মধ্যে মালালা ইউসুব যাই (চোদ্দ বছরের কিশোরী যে বোরখা পড়ার রীতির প্রতিবাদ করে নির্মম মৃত্যুবরণ করেছিল) এর মতো কতো কিশোরী- নারীর নীরব অভিমান আছে যারা বলতে চায় অপেক্ষা আর উপেক্ষার মাঝে দাঁড়িয়ে নারী জাতির সম্ভ্রম শুধুমাত্র পর্দাবৃত থাকার জন্য নয়। আমার এই লেখা তাঁদের জন্য যারা আজও চার দেওয়ালের চৌহদ্দির ভেতর থেকে সোচ্চারে চিৎকার করে বলতে চায়, আকাশকে আমার সীমা হতে দাও, এই অবগুণ্ঠনকে নয়।
পৌলমী চক্রবর্তী
নারীজীবনের স্বাধীনতার ওপর প্রাচীন এবং প্রথম হস্তক্ষেপ নিয়ে আসে অবগুণ্ঠন, কখনো-বা বোরখা কখনো-বা ঘোমটা হিসেবে পরাধীনতাকে নারী জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখেছে এই ক্ষুদ্র পোশাকটি। প্রকৃতপক্ষে ঘোমটা ছিল শালীনতার আবরণ ধারণের প্রচেষ্টা । কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি অনগ্রসর নারী জাতির অবরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে নারীরা পর্দানসিন হয়ে পরে এবং তাঁদের স্বাভাবিক বিমুক্ত গতিপথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। বহু আগে থেকেই ঘোমটা দেবার রীতি আমাদের ভারতবর্ষ তথা বিভিন্ন দেশগুলিতে ছিল। বর্তমানে তার প্রচলন বহু কমে এলেও এখনও বোরখা কোনো বিশেষ জাতির নারীদের বাকিদের থেকে আলাদা করে - এই ধারণাসিদ্ধ মানুষরা নারীদের এখনও পর্দাবিমুক্ত হতে দেয়নি এবং কোনো জাতি বিশেষে নারীদের স্বতন্ত্র রাখবার প্রয়াস তাদের নিজস্ব অসংবদ্ধ থাকার ইচ্ছাকে অবগুন্ঠিত করে অনায়াসে । যদি প্রশ্ন করা হয় ঘোমটা বা বোরখার প্রয়োজনীয়তাটা কোথায়, তাহলে হয়ত উত্তর হবে নারীর লজ্জা নিবারণ, অগ্রজের প্রতি (বিশেষত পুরুষের) অনুজের শ্রদ্ধা প্রদর্শন ইত্যাদি । কিন্তু আমরা মানুষরা বরাবরই নিজের মস্তক এবং কুন্তলকে গর্ব এবং অহংকারের স্থান দিয়ে থাকি সেই কারণেই ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে অনেকেই (নারী-পুরুষ নির্বিশেষে) নিজেদের কেশরাজি ঈশ্বরের চরনে সমর্পণ করেন । এর অর্থ দেবের উদ্দেশ্যে নিজেদের সেই গর্ব বা অহংকারকে ভূলিসাৎ করা। তাহলে নারীরা যখন নিজেদের গর্বকে পুরুষদের সম্মুখে অবগুণ্ঠিত করে তখন এই অবগুণ্ঠনের রীতি খুব সহজেই নারী পুরুষের সমান অধিকার এবং মানের প্রশ্ন তুলে ধরে । প্রশ্ন এও আসতে পারে যে বোরখা বা ঘোমটা প্রচলিত দেশগুলিতে পুরুষদের সেই ধরণের আচ্ছাদনের নিয়ম নেই কেন ? লজ্জা এবং সম্ভ্রম কি শুধু নারীদেরই ভূষণ! শুধুমাত্র ঘোমটা বা বোরখার ব্যবহারই কি নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাসূচক অভিব্যক্তি ঘটাতে পারে? যদি তাই হয়, তবে জানতে চাইব বোরখা আচ্ছাদিত মেয়েরা কি ধর্ষিতা হন’না ? প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে আরও বলা যেতে পারে যে নিতান্ত প্রয়োজনীয় নয় বলেই প্রথমে ফ্রান্স এবং পরে নেদারল্যান্ডের সরকার কত্তৃক বোরখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
অবশ্যই বলা উচিৎ ঘোমটার একটা সাংস্কৃতিক দিকও আছে, দূর্গাপুজোর সিঁদুর খেলার মতো অনুষ্ঠানে বাঙালি নারীদের ঘোমটা একটা ভিন্ন পর্যায়ের সৌন্দর্য এনে দেয় । কিন্তু তৎস্বত্ত্বেও বলা যায় যে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কোনো আবেশাত্মক বা বাধ্যতামূলক নিয়মে বদ্ধ থাকা উচিৎ নয়। সময়ের সাথে সাথে বর্তমানে ঘোমটার প্রতি বংশানুক্রমিক নিয়মানুবর্তীতার প্রভাব অনেক শিথিল হয়েছে - সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল থেকে এখন মাথা, এবং মাথা থেকে সিঁথি, এবং অবশেষে ক্রমশ খোঁপার দিকে পিছিয়েছে। কিন্তু আশা করা যায় শালীনতা ও শিষ্ঠাচার সম্পর্কে নিজস্ব ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার রদবদল না ঘটালে ঘোমটা ব্যতিত নারী জীবন কখনই নিরাভরণ হয়ে পড়বে না । কে বলতে পারে, এই ঘোমটা- বোরখার অজস্র নিয়মের মধ্যে মালালা ইউসুব যাই (চোদ্দ বছরের কিশোরী যে বোরখা পড়ার রীতির প্রতিবাদ করে নির্মম মৃত্যুবরণ করেছিল) এর মতো কতো কিশোরী- নারীর নীরব অভিমান আছে যারা বলতে চায় অপেক্ষা আর উপেক্ষার মাঝে দাঁড়িয়ে নারী জাতির সম্ভ্রম শুধুমাত্র পর্দাবৃত থাকার জন্য নয়। আমার এই লেখা তাঁদের জন্য যারা আজও চার দেওয়ালের চৌহদ্দির ভেতর থেকে সোচ্চারে চিৎকার করে বলতে চায়, আকাশকে আমার সীমা হতে দাও, এই অবগুণ্ঠনকে নয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন