সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

অমলেন্দু চন্দ


 
ধারাবাহিক Mirror ইমেজ

ঘুমের মধ্যে নিশির ডাকের মতো শুনছিলাম একটা স্বর। সে ডাকের বিরাট মৌতাত আমেজ আরও বেশী করে ঘুম ঘুম মেজাজ এনে দিচ্ছিল। চোখ খুলতে চাইলেও যেন খোলা যাবে না, এমনি তার জোর । একেবারে মাথা মন সব এক ঘরে নষ্ট হয়ে থাকার অনুভুতি নিয়ে আঁটা-আঁটা চোখ মেললাম। আলো আঁধার তখনও জড়াজড়ি, ভোর হচ্ছে। একতলার মেসের ঘরে জানালার বাইরে এক ফালি উঠোন মার্কা মাঠ, তার পরে বাউন্ড্রি ওয়াল আর গেট। সেই গেটের বাইরে শিবাজির চিৎকার আর হর্নের আওয়াজ, ঘরের অন্য প্রান্তের বিছানা থেকে দেবা’র ঘুম জড়ানো গলা ডাকছে, উঠে গিয়ে বাঞ্চোত কে থামাও, হাত নাড়লাম জানলা দিয়ে দাঁড়া দাঁড়া, আসছি।

মনে পড়ল আজ শনিবার, আমার ছুটি থাকে দু দিন আর শিবাজি সে সুত্রে মাঝে মাঝে শনিবার ডুব দেয়, আমার সঙ্গে হুইই ঘুরে আসি মার্কা এক ট্রিপে বেরিয়ে পড়ে, গোটা এলাকাটায় হুট বলতে দেড়-দু’শো কিলোমিটার ঘুরে আসা যখন যেদিকে ইচ্ছে, কোন সমস্যাই নয় এতো জায়গা, মনে পড়ল গতকাল কথা হয়েছে। ভোর বেলার ড্রাইভিং ও আমি দুজনেই খুব পছন্দ করি, বেশ লায়কোচিত মনে হয়, বেশি দিন তখনো হয়নি ইউনিভারসিটি থেকে বেরিয়েছি, চাকরি করছি।

কেমন আছিস শিবাজি আজকাল, এই পোষা পাখির মতো মেঘলা খাঁচায় নির্দিষ্ট আনন্দের ব্যাঙাচি জীবনচক্রে। এটাও জানি শুনতে পেলে শিবাজি হো হো করে উঠবে – বুড়ো ভাম, নিজের ল্যাজের ওমে মুখ গুঁজে শীত তাড়াচ্ছ, বেশ বেশ, আমি বেশ ভালো আছি। শিবাজি আজকাল ছোটোদের নিয়ে একটা নাটক দল করেছে, ইস্কুল গুলোতে ঘুরে ঘুরে প্রডাক্সান করে, দু একটা দেখেছি, ভালো যে তা নয়, কিন্তু ভরপুর মোচ্ছব লাইফ ফোর্সের। ভি আর এস নিয়েছে, ওর বউয়ের ডায়লগ – মুক্ত প্রাণের শ্লোগান ছাড়বে বলে।

আমাদের সেবার যাওয়ার কথা ছিল ঝরিয়ার এক মাইন্সের ম্যানেজার অনাবিল চৌধুরী – তার বাংলোয় সেদিন দুপুর আর রাতে মোচ্ছব হবে, তা সেরে আমরা ফিরব উল্টোদিকে, রাজরপ্পা। ঝরিয়ার সেই কোলিয়ারি আমাদের বোকারোর থেকে প্রায় সত্তর কি মি, আর রাজরপ্পা সে কোলিয়ারির থেকে প্রায় একশো কি মি। শনিবার রাতে সাহেব সুবোর সাজানো বাংলোয় নিওন আলোর উত্তাপের নীচে গেলাস বোতল ভাঙা আর রবিবার রাতে ভেড়া (ভালো নাম ভৈরবী নদী) নদীর তীরে টেন্টের সামনে পাথরে বসে নদীকে চিয়ার্স ডাকে মাতাল করতে চেয়ে বেঢপ বেতাল হওয়া, এরকমি ছিল টার্গেট। ফিরে আসা যথাস্থানে সোমবার সকালে তার পরেই আবার সেই ইদুর দৌড়। তো ফিরেওছিলাম শেষ রাত্তিরে রাজরপ্পা থেকে বেরিয়ে সাত টার আগেই মেসে, শিবাজি’ও শুয়ে পড়ল আমার খাটে, আমি দেবা’র খাটে, ও শনিবার প্রত্যেক বার রাঁচি তে ওর বাড়িতে চলে যেত আর ফিরত সোমবার সকালে। জানিনা আমাদের মেসের গৃহকর্তা মানে আমাদের ঘরণী, রাঁধুনি আর সব সামলে রাখার দিশারী ধনঞ্জয় কখন ফিরেছে, ওর কাছে চাবি থাকত তাই ধকা টের পাই নি অঘোর ঘুমের ঘোরে, ও বাড়ি গেছিল শুক্রবার, ফিরল সোমবার। দেবা তখন বুঝি প্রায় নটা সারে নটা হবে – ফিরে ধনঞ্জয় কে জিজ্ঞেস করছে – ওঁরা কখন ফিরেছে। শুনতে পেলাম ধনঞ্জয় বলছে ওঁরা ফিরেছে কই - ?

তার পরের কাহিনী দেবা’র অট্টহাসি। আসলে ধনঞ্জয় ছিলনা তাই জানতোই না যে আমরা শনিবার ভোররাত্রে বেরিয়ে গেছি, ও ফিরে এসে দেখেছে আমি আর শিবাজি ঘুমুচ্ছি, নতুন কিছু না তাই বলেছে গেল কোথায় যে ফিরবে, আর ওর টেলিগ্রাফিক ভাষায় ওটা হয়ে গেছে – ফিরেছে কই?

আর বিছানার পাশে ওল্ড মঙ্ক আর ব্যাগপাইপার এর খালি বোতল [সেদিনের সেই ব্যাগপাইপার আজকের বিশ্বজয়ী হারবার্টসান ব্র্যান্ড হয়ে ওঠেনি, তবুও ওই ছবিটা নিয়েই বোতল তৈরি হত]। দেবা’র মনে হয়েছিল ধনা রসিকতা করছে, মাতালগুলো এখনো খোঁয়ারি ভেঙে ফেরেনি। আমরা ফিরে এসে একটু একটু বাকি থাকা শেষ করে রসম পুরো করে ঘুম দিচ্ছিলাম। সে ঘুম বিলাস ভেঙে ভালোই হল, নাহলে আর সেদিন অফিস হতো না। খেউর টা বাজারে বেশ চালু হয়েছিল , মানে সেরম সেরম সময়ে আমরা জিজ্ঞেস করতাম নেশাশক্ত কে – ফিরবে কখন।

এফ ডি আই নিয়ে এতো চর্চা চলছে, লিকার এমন একটা মার্কেট যেখানে দেশি কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে বিদেশী মেজর জায়েগা করতে পারল না আজও। এক্সাইস ডিউটি বন্ডেড ওয়েরহাউসিং, ভিজে শুকনো সব রেগুলেসান, আর পছন্দের ব্যাপার যার সাথে জুড়ে রয়েছে ক্রয়ক্ষমতার গল্প – যেখানে মধ্যম আর যেখানে বেশী – কেউই ইন্ডিয়ানাইসড ব্র্যান্ড পছন্দ করে না – মধ্যম করে না প্রাইস ট্যাগের জন্য আর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্নর রয়েছে পছন্দের ডিউটি ফ্রি শপ। সুতরাং সেই ইউ বি, খোদে, মোহন মিকিন আর ষ ওয়ালেস – হয় নিজের নয় অন্যের ব্র্যান্ড মারকেতিং রাইট, শুধু প্যাকেজিং নির্দিষ্ট - ফ্যাসন ওরিয়েন্টেড ইউরোপিয়ান ডিজাইন বা ফারম ব্রিটিশ ডিজাইন বা ওইরকম কিছু মোনোলিথ ইন প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি, কত তাদের কায়দা আর কতো তাদের নাম – সামান্য বোতলের ক্যাপ, তো সেও নাকি নকল হয় আর তাই চালু হয়েছে গুয়ালা ক্যাপ – যার দাম প্রচলিত রোল অন পিলফার প্রুফ (পি ও পি পি) টুপীর দুগুণের বেশি, তাই চালু হয়েছে কারণ রাফ এস্টিমেট দেশি বাজারে নকল মালের মাত্রা পনেরো থেকে পঁচিশ পারসেন্তের মধ্যে যে কোন জায়গায় হতে পারে আর সেই বাজারটার আজকের রাফ সাইজ হল ২৮০ বিলিওন রুপি। একশো কোটিতে এক বিলিওন হলে সঙ্খ্যা টা হয় আঠাশ হাজার কোটি টাকা, আর তাই নাকি অ্যাঁন্টিকুইটি, সিগ্রাম, রয়াল চ্যালেঞ্জ, ভিন্টেজ, ম্যাকডাউয়েল প্রিমিয়াম, অ্যাঁরিস্টক্র্যাট সুপ্রীম বা কর্নেল’স স্পেসাল এরা সবাই গুয়ালা (গু-ওয়ালা নয় কিন্তু) টুপি পড়ছে, আরও অনেকেই আস্তে আস্তে একই তুপির তলায় আসছে – বাজারের চাপ কি বস্তু রে ভাই, সবাই একগত্ত দিয়েই নিজেকে ঢালবে এটাই স্থির হচ্ছে।

আনকাহিনীর টান - ছট ছট মনের আয়নায় উঁকি দিলাম প্রতিবিম্ব বলল দাঁড়াও, একটু সেজে নিই তারপর... হবেই তো অনেক আনকাহিনীর টানাপোড়েন তাই সব কিছু আলুস ঝুলুস, গল্প কথা দেখা দেয় কি করে এমন দুম করে।

মন কি ইচ্ছে করলেই সব কাহন কাহন গল্প ফিরিয়ে দিতে পারে! হয় না হয় না সেটা, এরকম সময়েই আলু থালু চিত্ত বলে দাঁড়াও, সবুর, একটু সেজে নিই তারপর দেখ'খন আর আমি তখন সব ছেড়ে বসে থাকি ধৈর্য পরীক্ষায়। কখন মন দেখা দেবে একটু সেজে একটু গুজে আনকাহিনীর ভ্রমর কথা - অনেক হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি, অনেক নিহত প্রেমের নিভে যাওয়া ফানুস অনেক দুরের দিনের মেঘের রঙ ময়ূরপঙ্খী আনকাহিনী, অনেক সাধ সাধ্যের আড়াআড়ির ফেরিওয়ালা হাঁক আরও কত কিছু - রত্নাকর ছেড়ে গেছে ধুলভরা মনের জাঙ্গালে, মন ভামিনী বিলাসিনী নাগরির মত অপাঙ্গে হাসবে ...কি গো নাগর কি খুঁজছ!

তখন একটা আধটা টুকরোই নাগালে আসে, একসঙ্গে অনেকগুলো নয়, সেটা হলে যেন সেই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলো দশজনা সব মুখেতেই ছায়া থাকায় কাউকেই পুরো দেখা হয় না। দশজন দশকথা আনকথা আর সারা হয় না তাদের সাথে।

নাহ আজ আর ভালো লাগছে না। তপ্ত নই তৃপ্ত নই স্মৃতির গম্বুজ শুধু ডালা খোলা ভয়ের তোরঙ - অভাবের অনুভাব স্মৃতির জাঙালে। ঘুম কেড়ে নেওয়া নির্লজ্জ রাতটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ছাড়ব না, আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী, আমি আবার ফিরব এখানে ভামিনী এ যে আমার মানবজমিন – আমার তোতাকাহিনী।




অলংকরণ –কৌশিক বিশ্বাস ও মেঘ অদিতি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন