কম্পিউটার বনাম খেলনাবাটি
দৃশ্য ১
সামনের বিশাল কাঁচের দেওয়ালের দিকে চেয়ে আছে সৌরভ। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে । একটা ছোট্ট কফি ব্রেক নিয়েছে ও । এগার তলা থেকে ওপারের ছবিগুলো বেশ ঝাপসা । দূরের মাঠটিতে কয়েকটি ছেলে ছুটোছুটি করে ফুটবল খেলছে । কোন শব্দ না শুনে ও ওই হইচই, চেঁচামেচির প্রতিটি বর্ণ, অক্ষর, কমা, দাঁড়ি বুঝে যায় সৌরভ। নিজের ফেলে আসা সময়কে ছুঁতে চোখ বন্ধ করতে হয়না। অদ্ভুত এক গন্ধে জানান দেয়। হেসে ফেলে অজান্তেই । আচ্ছা তুকুন কি কখনো এই গন্ধ পাবে ? তুকুন ওর নয় বছরের ছেলে । সৌরভ ভীষণ চায় এই গন্ধটা তুকুনের সাথে শেয়ার করতে । কিন্তু তুকুন খেলতে ভালবাসেনা । ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি ওর ভীষণ আগ্রহ। স্কুলে যেতে শুরু করার আগেই ও বাবার ল্যাপটপ খুলতে আর বন্ধ করতে শিখে গিয়েছিল । এ জন্য অবশ্য সৌরভের গর্বের শেষ নেই। সবাই বলে বাপ কা বেটা । গত জন্মদিনে ওকে একটা ডেক্সটপ গিফট করেছে । সৌরভ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল - ক্লাসে ফার্স্ট হলে ওকে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে হবে। এখন সমস্ত অবসর সময় ওই কম্পিউটার নিয়েই কাটে ছেলের। নতুন নতুন গেমস, নতুন নতুন অ্যাচিভমেন্ট - বাড়ি ফিরতেই কলকল স্বরে গল্প শোনায় তুকুন । ভালই লাগে সৌরভের - তুকুনের উত্তেজনা, শীলার অপত্য- মুগ্ধতা । তবু মাঝে মাঝে একটা কষ্ট গলার কাছে আটকায় - তুকুন কি ওই গন্ধটা কখনই পাবে না ? নাকি ওর কাছে ও একটা গন্ধ আছে, যা ওর নিজের মতো - সৌরভের গন্ধের থেকে এক্কেবারে আলাদা !
দৃশ্য ২
হঠাৎ তন্দ্রা কেটে যায় মৃদুলার - শেষ দুপুরে একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল । মিঠির আলতো ঝাঁকিতে জেগে ওঠেন । 'ঠাম্মি আমার বারবির চুলটা একটু আঁচড়ে দেবে?' ধড়মড় করে উঠে বসেন মৃদুলা, কোলের কাছে টেনে নেন বছর পাঁচেকের নাতনিকে । ' গল্প বোলো ' - আবার আবদার , 'তোমার পুতুলের বিয়ের গল্প' , মৃদু হেসে গল্প শুরু করেন তিনি । পাশের বাড়ির গৌরীর সাথে কি বন্ধুত্বই না ছিল । রান্না বাটি, পুতুলের বিয়ে, আড়ি-ভাব -- বলতে বলতে হৃদয় জুড়ে ডানা ঝাপটায় একজোড়া সাদা পায়রা । এমন সময় থমথমে মুখে ঘরে ঢোকে রমিতা - ওনার পুত্রবধূ । ' মা, এইভাবে ওকে রোজ রোজ রান্না বাটি আর পুতুলের বিয়ের গল্প শোনাবেন না । রান্নাঘর আর সংসার সামলানো ছাড়াও যে মেয়েদের একটা অস্ত্বিত্ব আছে সেটা মিঠিকে বুঝতে হবে । আপনার ছেলে জানতে পারলে কিন্তু খুব আপসেট হবে । যাও মিঠি, ও ঘরে যাও , তোমাকে যে নতুন গেমটা বাপি এনে দিয়েছে সেটা নিয়ে খেলো সোনা , আমি এখুনি আসছি। ' খুব বিব্রত বোধ করেন মৃদুলা । গোধূলির রাঙ্গা আলোয় চাপা পড়ে যায় কুন্ঠারুন মুখ । তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেন না তার ভুলটা কোথায় ।
বলাবাহুল্য যে উপরে বর্ণিত চরিত্ররা কাল্পনিক, তবে ঘটনার নির্যাসটুকু কিন্তু ঘন বাস্তব । আমাদের আশেপাশে এই পরিবর্তিত শৈশবের অনুভুতি বেশ কড়া আর এই অনুভতির গায়ে লেগে আছে দুশ্চিন্তার আঁশটে গন্ধ । ইতি উতি উঁকি দেয় কিছু আশঙ্কা - এই সময়ের শৈশব কি হারাচ্ছে সেই স্বর্গীয় সারল্য ? কাঁচা মনের নির্ভেজাল সরলতা যাকে জগতের পবিত্রতম রূপে স্বীকার করে আমাদের হৃদয়, সেই দিব্য সরলতায় মিশছে কি খাদ ? কেন এই ছন্দপতন ? কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে মুখোমুখি হই এক ' যান্ত্রিক ' ইন্দ্রজালের - নাম তার কম্পিউটার গেমস ! গত দশক থেকেই হইহই করে ভারতীয় শৈশব ও কৈশোরে ঢুকে পড়েছে কম্পিউটার গেমস । ধুলো কাদা মাখা বাল্যাবস্থা থেকে ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত টিন এজ । কম্পিউটার গেমসের কল্যানে শিশুরা এখন অনেক বেশি ঘরমুখী । নাগরিক শৈশব তথা কৈশোর এখন অনেক বেশি স্মার্ট, তুখোড় - বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছায়ায় অনেক বেশি পরিনত । তবে এই পরিবর্তনে আমাদের ভুমিকাও ছোট নয় । 'দুধে - ভাতে ' নয়, মা - বাবার নব্য অভিলাষ এখন সন্তানের কম্পিউটারে দক্ষতা যেন হয় বিল গেটসের মতো, মা - বাবার নাপসন্দ বন্ধুদের থেকে যেন সর্বদা বজায় থাকে দূরত্ব ! আর যদিও বা ইচ্ছে হয় হাত-পা ছোঁড়ার, কংক্রিটের এই জঙ্গলে মাঠ কোথায় ? তাই সমাধানের ঠিকানা কম্পিউটার গেমস ! পাঁচ থেকে পঞ্চাশের সমান প্রিয় !
কম্পিউটার গেমসের সুলুক সন্ধান
বিগত সাত- আট বছরে কম্পিউটার গেমসের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে হু হু করে বেড়েছে । পশ্চিমের দেশগুলিতে প্রায় পঞ্চাশ বছরের ও বেশি সময় ধরে কম্পিউটার গেমস তথা ভিডিও গেমস রাজত্ব করছে । ভারতের মতো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশে ও এই ইলেক্ট্রনিক খেলাটির জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া । এটি মূলত একটি সফটওয়্যার যাকে মনিটর , মাউস ও কী-বোর্ডের মাধ্যমে অপারেট করা যায় ।
১৯৫৮ সালে মার্কিন পদার্থবিদ উইলিয়াম হিগিনবোথাম তার কর্মক্ষেত্র বিশেষত ল্যাবরেটরিতে আগত দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জনের জন্য 'টেনিস ফর টু' নামে একটি ইলেক্ট্রনিক গেম উদ্ভাবন করেন। তৎকালীন সময়ে এই ভাবনাটি ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ । এটি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম ভিডিও গেম রূপে স্বীকৃত । তবে 'স্পেসওয়ার' বানিজ্যিক ভাবে সফল প্রথম কম্পিউটার গেমস। এই গেমটি ১৯৬২ সালে রিলিজ হয় এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে । প্রথম পর্যায়ে এই গেমস গুলিতে অত্যন্ত সাধারন মানের গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হত। তাই প্রাথমিক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ১৯৮১-৮২ নাগাদ কম্পিউটার গেমসের বাজার পড়ে যায়। প্রধানত বেশি দাম অথচ ডিউরেবিলিটির অভাবই এর অন্যতম কারন । তবে ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে মাউসের ব্যবহার শুরু হলে কম্পিউটার গেমসের গ্রাফিকাল ইন্টারফেস যথেষ্ট উন্নত হয় এবং এর জনপ্রিয়তাও ফিরে আসে । ১৯৯৩ সালে বাজারে আসে থ্রিডি গেম ডুম । প্রথম আবির্ভাবেই তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে ডুম । এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি । বহু কম্পিউটার গেমস বাজারে এসেছে এবং আসছে । এখনো পর্যন্ত এই গেমসগুলির জনপ্রিয়তায় ভাঁটার টান পড়েনি।
কম্পিউটার গেমস মূলত চার প্রকারের - প্রথম হল ' স্ট্র্যাটেজিক ', এই ধরনের খেলায় প্রয়োজন ধৈর্য আর একাগ্রতা । দ্বিতীয় প্রকারের নাম হল ' ফার্স্ট পার্সন শুটার ' । এ ক্ষেত্রে এমন একটা আবহ তৈরি হয় যেন যে খেলছে সে নিজেকে ওই গেমটির সক্রিয় অংশ হিসেবে ভাবতে পারে । এই ধরনের গেমস গুলি ভীষণ জনপ্রিয় । তবে সব থেকে বেশি চাহিদা 'থার্ড পার্সন ভিউ' - এর । এই জাতীয় গেমের ভ্যারাইটি প্রচুর । এখানে প্লেয়ার বাইরে থেকে গেমটিকে নিয়ন্ত্রন করে । বিভিন্ন স্পোর্টস গেম যেমন ফুটবল, ক্রিকেট বা ফাইটিং গেমগুলি এই জাতীয় গেমের শ্রেনীভুক্ত । চতুর্থ তথা শেষ প্রকার হল 'রেসিং' গেম । ভীষণ ইন্টারেস্টিং এই গেমের চরিত্র। এখানে প্লেয়ার ইচ্ছে মতো গেমটিকে ফার্স্ট পার্সন বা থার্ড পার্সন মোডে চালাতে পারে । তবে কম্পিউটার গেমসের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ভায়লেন্সের বাড়াবাড়ি ।
বিশেষজ্ঞেরা কি বলছেন ?
পশ্চিমের দেশগুলিতে কিশোর মনে কম্পিউটার গেমসের প্রভাব রীতিমতো সিরিয়াস আলোচনার বিষয় । কম্পিউটার গেমসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লেখা হয়েছে । জে কর্ণওয়েল, এম গ্রিফিথের মতো সমাজবিদেরা পরিসংখ্যান ও তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই ধরনের গেমসের তীব্র ঋণাত্মক প্রভাবকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের মতে এই ধরনের ইলেকট্রনিক খেলার বহুল চর্চা তরুন প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পরশ্রীকাতরতা , অ্যাগ্রেসন, মানসিক ভঙ্গুরতা প্রভৃতি বিভিন্ন কুপ্রভাবের জন্ম দেয় । যেন তেন প্রকারেন জিত হাসিল করাতেই এদের অভীষ্ট পূরণ । পরাজয়ের মোকাবিলা করার ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে । সর্বোপরি এদের মধ্যে আক্রমনাত্মক ও হিংসাত্মক প্রবনতা তৈরি হতে পারে বলে তাঁদের ধারনা । তবে বিশিষ্ট প্রোফেসর হেনরি জেনকিন্স কম্পিউটার গেমসের পক্ষে সওয়াল করেছেন । তাঁর মতে কম্পিউটার গেমসকে শিখণ্ডীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে । বস্তুত পরিবর্তিত সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটই বাচ্চাদের মধ্যে অসহিস্নুতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি করছে । এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উপর ও সমান দায় বর্তায় । সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে কম্পিউটার গেমসের ব্যবহার কিশোর প্রজন্মের মধ্যে মানসিক দক্ষতা, একমুখীনতা, সাফল্যের খিদের মতো পজিটিভ গুণের বিকাশ ও ঘটাতে পারে ।
খেলনাবাটির অচিনপুর
খেলনাবাটি শব্দটি উচ্চারিত হলেই নক্ষত্রের নরম আলোয় ডুবে যায় যেন স্মৃতির উঠোন । শব্দটি আসলে রূপক মাত্র । এর আড়ালে আছে এক মায়াময় আশ্চর্য রূপকথার জগত । ছেলেবেলার নিশ্চিন্ত দিন প্রতিদিন । জীবনের সূর্য যখন মধ্য গগনে তখন ও এই মনকে ভেজায় ওই কিশলয় সময়ের সবুজ সুর । রোজ বিকেলের ফুটবল, ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন অথবা অসময়ে লুকিয়ে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো বা দুপুরের রোদকে ভেংচি কেটে বন্ধুদের সাথে সাইকেল নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাওয়া ! কখনো মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ বানানো আর অকারন কাদা জলে মাখামাখি এই সুযোগে । কানা মাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ ! হাওয়ায় ওড়ে কাগজের এরোপ্লেন, বর্ষার জমা জলে ভাসে অংক খাতার পাতা ছিঁড়ে বানানো নৌকা । কখনো আবার পড়ন্ত বিকেলের চড়ুইভাতি কিংবা পুতুলের বিয়ে । এই টুকরো সময়গুলো ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে চারপাশ থেকে । আমরা কিছুই করতে পারছিনা ।
উপক্রমণিকা
কম্পিউটার গেমস যে অতি আকর্ষণীয় টাইম পাস তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই । কচিকাঁচারা প্রান ভরে উপভোগ করুক । ভয় যদিও একটাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তির হাতের পুতুল না হয়ে যায়, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা থেকে দূরে কৃত্রিমতার আঁধারে ডুবে না যায় । সৃজনশীলতা, অনুভুতির গভীরতা যেন অটুট থাকে। এই খেলায় দর্শন ও শ্রবন যন্ত্রের যৌথ উত্তেজনা এক তীব্র আসক্তি তৈরি করে । এর জন্য বারবার এই খেলা খেলতে ইচ্ছে করে । হেরে গেলে জিততে ইচ্ছে করে, জিতলে আরও ভালো করে জিততে ইচ্ছে করে । আর এই ইচ্ছের উপর রাশ টানাই অভিভাবকদের দায়িত্ব । কালের প্রবাহ কিছু নতুনত্ব বয়ে আনবেই । তাকে সঠিক ভাবে গ্রহনের উপযুক্ত হয়ে ওঠা দরকার শুধু ।
দৃশ্য ১
সামনের বিশাল কাঁচের দেওয়ালের দিকে চেয়ে আছে সৌরভ। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে । একটা ছোট্ট কফি ব্রেক নিয়েছে ও । এগার তলা থেকে ওপারের ছবিগুলো বেশ ঝাপসা । দূরের মাঠটিতে কয়েকটি ছেলে ছুটোছুটি করে ফুটবল খেলছে । কোন শব্দ না শুনে ও ওই হইচই, চেঁচামেচির প্রতিটি বর্ণ, অক্ষর, কমা, দাঁড়ি বুঝে যায় সৌরভ। নিজের ফেলে আসা সময়কে ছুঁতে চোখ বন্ধ করতে হয়না। অদ্ভুত এক গন্ধে জানান দেয়। হেসে ফেলে অজান্তেই । আচ্ছা তুকুন কি কখনো এই গন্ধ পাবে ? তুকুন ওর নয় বছরের ছেলে । সৌরভ ভীষণ চায় এই গন্ধটা তুকুনের সাথে শেয়ার করতে । কিন্তু তুকুন খেলতে ভালবাসেনা । ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি ওর ভীষণ আগ্রহ। স্কুলে যেতে শুরু করার আগেই ও বাবার ল্যাপটপ খুলতে আর বন্ধ করতে শিখে গিয়েছিল । এ জন্য অবশ্য সৌরভের গর্বের শেষ নেই। সবাই বলে বাপ কা বেটা । গত জন্মদিনে ওকে একটা ডেক্সটপ গিফট করেছে । সৌরভ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল - ক্লাসে ফার্স্ট হলে ওকে একটা কম্পিউটার কিনে দিতে হবে। এখন সমস্ত অবসর সময় ওই কম্পিউটার নিয়েই কাটে ছেলের। নতুন নতুন গেমস, নতুন নতুন অ্যাচিভমেন্ট - বাড়ি ফিরতেই কলকল স্বরে গল্প শোনায় তুকুন । ভালই লাগে সৌরভের - তুকুনের উত্তেজনা, শীলার অপত্য- মুগ্ধতা । তবু মাঝে মাঝে একটা কষ্ট গলার কাছে আটকায় - তুকুন কি ওই গন্ধটা কখনই পাবে না ? নাকি ওর কাছে ও একটা গন্ধ আছে, যা ওর নিজের মতো - সৌরভের গন্ধের থেকে এক্কেবারে আলাদা !
দৃশ্য ২
হঠাৎ তন্দ্রা কেটে যায় মৃদুলার - শেষ দুপুরে একটু ঝিমুনি মতো এসেছিল । মিঠির আলতো ঝাঁকিতে জেগে ওঠেন । 'ঠাম্মি আমার বারবির চুলটা একটু আঁচড়ে দেবে?' ধড়মড় করে উঠে বসেন মৃদুলা, কোলের কাছে টেনে নেন বছর পাঁচেকের নাতনিকে । ' গল্প বোলো ' - আবার আবদার , 'তোমার পুতুলের বিয়ের গল্প' , মৃদু হেসে গল্প শুরু করেন তিনি । পাশের বাড়ির গৌরীর সাথে কি বন্ধুত্বই না ছিল । রান্না বাটি, পুতুলের বিয়ে, আড়ি-ভাব -- বলতে বলতে হৃদয় জুড়ে ডানা ঝাপটায় একজোড়া সাদা পায়রা । এমন সময় থমথমে মুখে ঘরে ঢোকে রমিতা - ওনার পুত্রবধূ । ' মা, এইভাবে ওকে রোজ রোজ রান্না বাটি আর পুতুলের বিয়ের গল্প শোনাবেন না । রান্নাঘর আর সংসার সামলানো ছাড়াও যে মেয়েদের একটা অস্ত্বিত্ব আছে সেটা মিঠিকে বুঝতে হবে । আপনার ছেলে জানতে পারলে কিন্তু খুব আপসেট হবে । যাও মিঠি, ও ঘরে যাও , তোমাকে যে নতুন গেমটা বাপি এনে দিয়েছে সেটা নিয়ে খেলো সোনা , আমি এখুনি আসছি। ' খুব বিব্রত বোধ করেন মৃদুলা । গোধূলির রাঙ্গা আলোয় চাপা পড়ে যায় কুন্ঠারুন মুখ । তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেন না তার ভুলটা কোথায় ।
বলাবাহুল্য যে উপরে বর্ণিত চরিত্ররা কাল্পনিক, তবে ঘটনার নির্যাসটুকু কিন্তু ঘন বাস্তব । আমাদের আশেপাশে এই পরিবর্তিত শৈশবের অনুভুতি বেশ কড়া আর এই অনুভতির গায়ে লেগে আছে দুশ্চিন্তার আঁশটে গন্ধ । ইতি উতি উঁকি দেয় কিছু আশঙ্কা - এই সময়ের শৈশব কি হারাচ্ছে সেই স্বর্গীয় সারল্য ? কাঁচা মনের নির্ভেজাল সরলতা যাকে জগতের পবিত্রতম রূপে স্বীকার করে আমাদের হৃদয়, সেই দিব্য সরলতায় মিশছে কি খাদ ? কেন এই ছন্দপতন ? কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে মুখোমুখি হই এক ' যান্ত্রিক ' ইন্দ্রজালের - নাম তার কম্পিউটার গেমস ! গত দশক থেকেই হইহই করে ভারতীয় শৈশব ও কৈশোরে ঢুকে পড়েছে কম্পিউটার গেমস । ধুলো কাদা মাখা বাল্যাবস্থা থেকে ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত টিন এজ । কম্পিউটার গেমসের কল্যানে শিশুরা এখন অনেক বেশি ঘরমুখী । নাগরিক শৈশব তথা কৈশোর এখন অনেক বেশি স্মার্ট, তুখোড় - বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছায়ায় অনেক বেশি পরিনত । তবে এই পরিবর্তনে আমাদের ভুমিকাও ছোট নয় । 'দুধে - ভাতে ' নয়, মা - বাবার নব্য অভিলাষ এখন সন্তানের কম্পিউটারে দক্ষতা যেন হয় বিল গেটসের মতো, মা - বাবার নাপসন্দ বন্ধুদের থেকে যেন সর্বদা বজায় থাকে দূরত্ব ! আর যদিও বা ইচ্ছে হয় হাত-পা ছোঁড়ার, কংক্রিটের এই জঙ্গলে মাঠ কোথায় ? তাই সমাধানের ঠিকানা কম্পিউটার গেমস ! পাঁচ থেকে পঞ্চাশের সমান প্রিয় !
কম্পিউটার গেমসের সুলুক সন্ধান
বিগত সাত- আট বছরে কম্পিউটার গেমসের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে হু হু করে বেড়েছে । পশ্চিমের দেশগুলিতে প্রায় পঞ্চাশ বছরের ও বেশি সময় ধরে কম্পিউটার গেমস তথা ভিডিও গেমস রাজত্ব করছে । ভারতের মতো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশে ও এই ইলেক্ট্রনিক খেলাটির জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া । এটি মূলত একটি সফটওয়্যার যাকে মনিটর , মাউস ও কী-বোর্ডের মাধ্যমে অপারেট করা যায় ।
১৯৫৮ সালে মার্কিন পদার্থবিদ উইলিয়াম হিগিনবোথাম তার কর্মক্ষেত্র বিশেষত ল্যাবরেটরিতে আগত দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জনের জন্য 'টেনিস ফর টু' নামে একটি ইলেক্ট্রনিক গেম উদ্ভাবন করেন। তৎকালীন সময়ে এই ভাবনাটি ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ । এটি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম ভিডিও গেম রূপে স্বীকৃত । তবে 'স্পেসওয়ার' বানিজ্যিক ভাবে সফল প্রথম কম্পিউটার গেমস। এই গেমটি ১৯৬২ সালে রিলিজ হয় এবং প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে । প্রথম পর্যায়ে এই গেমস গুলিতে অত্যন্ত সাধারন মানের গ্রাফিক্স ব্যবহৃত হত। তাই প্রাথমিক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ১৯৮১-৮২ নাগাদ কম্পিউটার গেমসের বাজার পড়ে যায়। প্রধানত বেশি দাম অথচ ডিউরেবিলিটির অভাবই এর অন্যতম কারন । তবে ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে মাউসের ব্যবহার শুরু হলে কম্পিউটার গেমসের গ্রাফিকাল ইন্টারফেস যথেষ্ট উন্নত হয় এবং এর জনপ্রিয়তাও ফিরে আসে । ১৯৯৩ সালে বাজারে আসে থ্রিডি গেম ডুম । প্রথম আবির্ভাবেই তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে ডুম । এরপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি । বহু কম্পিউটার গেমস বাজারে এসেছে এবং আসছে । এখনো পর্যন্ত এই গেমসগুলির জনপ্রিয়তায় ভাঁটার টান পড়েনি।
কম্পিউটার গেমস মূলত চার প্রকারের - প্রথম হল ' স্ট্র্যাটেজিক ', এই ধরনের খেলায় প্রয়োজন ধৈর্য আর একাগ্রতা । দ্বিতীয় প্রকারের নাম হল ' ফার্স্ট পার্সন শুটার ' । এ ক্ষেত্রে এমন একটা আবহ তৈরি হয় যেন যে খেলছে সে নিজেকে ওই গেমটির সক্রিয় অংশ হিসেবে ভাবতে পারে । এই ধরনের গেমস গুলি ভীষণ জনপ্রিয় । তবে সব থেকে বেশি চাহিদা 'থার্ড পার্সন ভিউ' - এর । এই জাতীয় গেমের ভ্যারাইটি প্রচুর । এখানে প্লেয়ার বাইরে থেকে গেমটিকে নিয়ন্ত্রন করে । বিভিন্ন স্পোর্টস গেম যেমন ফুটবল, ক্রিকেট বা ফাইটিং গেমগুলি এই জাতীয় গেমের শ্রেনীভুক্ত । চতুর্থ তথা শেষ প্রকার হল 'রেসিং' গেম । ভীষণ ইন্টারেস্টিং এই গেমের চরিত্র। এখানে প্লেয়ার ইচ্ছে মতো গেমটিকে ফার্স্ট পার্সন বা থার্ড পার্সন মোডে চালাতে পারে । তবে কম্পিউটার গেমসের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ভায়লেন্সের বাড়াবাড়ি ।
বিশেষজ্ঞেরা কি বলছেন ?
পশ্চিমের দেশগুলিতে কিশোর মনে কম্পিউটার গেমসের প্রভাব রীতিমতো সিরিয়াস আলোচনার বিষয় । কম্পিউটার গেমসের ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লেখা হয়েছে । জে কর্ণওয়েল, এম গ্রিফিথের মতো সমাজবিদেরা পরিসংখ্যান ও তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই ধরনের গেমসের তীব্র ঋণাত্মক প্রভাবকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের মতে এই ধরনের ইলেকট্রনিক খেলার বহুল চর্চা তরুন প্রজন্মের মধ্যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, পরশ্রীকাতরতা , অ্যাগ্রেসন, মানসিক ভঙ্গুরতা প্রভৃতি বিভিন্ন কুপ্রভাবের জন্ম দেয় । যেন তেন প্রকারেন জিত হাসিল করাতেই এদের অভীষ্ট পূরণ । পরাজয়ের মোকাবিলা করার ক্ষমতা ক্রমশ কমতে থাকে । সর্বোপরি এদের মধ্যে আক্রমনাত্মক ও হিংসাত্মক প্রবনতা তৈরি হতে পারে বলে তাঁদের ধারনা । তবে বিশিষ্ট প্রোফেসর হেনরি জেনকিন্স কম্পিউটার গেমসের পক্ষে সওয়াল করেছেন । তাঁর মতে কম্পিউটার গেমসকে শিখণ্ডীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে । বস্তুত পরিবর্তিত সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপটই বাচ্চাদের মধ্যে অসহিস্নুতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাব তৈরি করছে । এক্ষেত্রে অভিভাবকদের উপর ও সমান দায় বর্তায় । সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে কম্পিউটার গেমসের ব্যবহার কিশোর প্রজন্মের মধ্যে মানসিক দক্ষতা, একমুখীনতা, সাফল্যের খিদের মতো পজিটিভ গুণের বিকাশ ও ঘটাতে পারে ।
খেলনাবাটির অচিনপুর
খেলনাবাটি শব্দটি উচ্চারিত হলেই নক্ষত্রের নরম আলোয় ডুবে যায় যেন স্মৃতির উঠোন । শব্দটি আসলে রূপক মাত্র । এর আড়ালে আছে এক মায়াময় আশ্চর্য রূপকথার জগত । ছেলেবেলার নিশ্চিন্ত দিন প্রতিদিন । জীবনের সূর্য যখন মধ্য গগনে তখন ও এই মনকে ভেজায় ওই কিশলয় সময়ের সবুজ সুর । রোজ বিকেলের ফুটবল, ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন অথবা অসময়ে লুকিয়ে ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো বা দুপুরের রোদকে ভেংচি কেটে বন্ধুদের সাথে সাইকেল নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাওয়া ! কখনো মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ বানানো আর অকারন কাদা জলে মাখামাখি এই সুযোগে । কানা মাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ ! হাওয়ায় ওড়ে কাগজের এরোপ্লেন, বর্ষার জমা জলে ভাসে অংক খাতার পাতা ছিঁড়ে বানানো নৌকা । কখনো আবার পড়ন্ত বিকেলের চড়ুইভাতি কিংবা পুতুলের বিয়ে । এই টুকরো সময়গুলো ক্রমশ উধাও হয়ে যাচ্ছে চারপাশ থেকে । আমরা কিছুই করতে পারছিনা ।
উপক্রমণিকা
কম্পিউটার গেমস যে অতি আকর্ষণীয় টাইম পাস তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই । কচিকাঁচারা প্রান ভরে উপভোগ করুক । ভয় যদিও একটাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রযুক্তির হাতের পুতুল না হয়ে যায়, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা থেকে দূরে কৃত্রিমতার আঁধারে ডুবে না যায় । সৃজনশীলতা, অনুভুতির গভীরতা যেন অটুট থাকে। এই খেলায় দর্শন ও শ্রবন যন্ত্রের যৌথ উত্তেজনা এক তীব্র আসক্তি তৈরি করে । এর জন্য বারবার এই খেলা খেলতে ইচ্ছে করে । হেরে গেলে জিততে ইচ্ছে করে, জিতলে আরও ভালো করে জিততে ইচ্ছে করে । আর এই ইচ্ছের উপর রাশ টানাই অভিভাবকদের দায়িত্ব । কালের প্রবাহ কিছু নতুনত্ব বয়ে আনবেই । তাকে সঠিক ভাবে গ্রহনের উপযুক্ত হয়ে ওঠা দরকার শুধু ।
"কালের প্রবাহ কিছু নতুনত্ব বয়ে আনবেই । তাকে সঠিক ভাবে গ্রহনের উপযুক্ত হয়ে ওঠা দরকার শুধু ।"---- খুব সঠিক।
উত্তরমুছুন