মিঠি আর খরগোস
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
এটা মিঠির গল্প । নাকি তাতানদের ? মিঠি হোল আমার ভাইঝি । আর তাতানরা ওর খরগোস । তাতান আর বুতাই । নামগুলো আমারই দেওয়া । আমি যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করি তার কাছেই একটা হাট আছে । সপ্তাহে দুদিন বসে । আমি মাঝে সাঝে চক্কর দিয়ে আসি। খুব ভালো লাগে টাটকা সব্জির গন্ধ , জ্যান্ত মাছের লাফানি , মানুষের কলরব । এই হাটে একদিকে আবার হাঁস, মুরগি , পায়রা এসবও বিক্রি হয়। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় থমকে গেছি । দেখি , তুলতুলে দুটো তুলোর বল ঘাসের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে । একটা বছর দশেকের ছেলে ওগুলোর পেছনে পেছনে দৌঁড়চ্ছে । আমি যেই না থেমেছি, ওমা ! বলদুটো গড়াতে গড়াতে এক্কেবারে আমার পায়ের কাছে হাজির । আরে , বল কোথায় , এ যে দেখি দুটো খরগোসের ছানা , লাল লাল পুঁতির মতো চকচকে চোখ ! আদর করার লোভ সামলাতে পারলাম না। যেই না হাঁটু গেড়ে বসেছি আদর করতে , পুঁচকে দুটো বোঁচা বোঁচা নাক আচ্ছা করে আমার হাতে ঘষে টসে একসার। কোথায় আমার মতো একটা হুমদো লোক দেখে ভয়ে পালাবে , তা না , এক্কেবারে বশ করে ফেললো আমায় । আমিও আগুপিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম , বাড়ি নিয়ে যাবো ওদের । ছেলেটার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে একটা ব্যাগ কিনে ভরে ফেললাম ও’দুটোকে । একটা ছানা ,যেটা বেশি ডাকাবুকো, তুলনায় শান্ত আর নাদুসনুদুসটার পিঠের ওপর চড়ে , ব্যাগের ওপর দিয়ে মুখ বের করে বিশ্ব দেখতে দেখতে আমার সাথে চলল । এরপর আমার মাথায় চিন্তাটা এলো । ঝোঁকের মাথায় বাড়ি নিয়ে তো চললাম , কিন্তু তারপর ? আমি তো ব্যাচেলর মানুষ , সেই সক্কাল বেলায় বাড়ি থেকে বের হই , ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা । মা একেই বুড়ো মানুষ , তায় আবার বাতিকগ্রস্ত । আর এতো সাজিয়ে রাখার পুতুল নয় , যে শো-কেসে নিয়ে ঢুকিয়ে রাখব । আবার সারাদিন খাঁচাবন্দী রেখে শুধু দুবেলা খেতে দেবো, সেটাও খুব অমানবিক ব্যাপার হবে । ভাবতে ভাবতে মিঠির কথা মনে হোল । একমাত্র ওই হতে পারে আমার বিপদতারণ ।বাড়ি ঢুকতেই ‘তাকু , তাকু ‘ বলে কোলে ওঠার জন্য ছুটে এলো । আর এসেই , ‘ও তাকু এটা কী এনেছ ?,’ বলে এক চিৎকার দিলো । আমি তো ভাবলাম , হয়ে গেল , এবার আমাকেই না ভিটে ছাড়া হতে হয়! ভাগ্য ভালো , কাছে পিঠে কেউ ছিল না। আমিও ওকে চকলেট দিয়ে হাত করে গোপন ষড়যন্ত্র ছকে ফেললাম । ও ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে উঠল এই পরিকল্পনায় অংশীদার হতে পেরে । ওকে বললাম, ‘তোর মা কোথায় রে?’ ও হাত দিয়ে ছাদ দেখাল । যাক , বাঁচা গেছে । শুকনো কাপড় তুলে, ভাঁজ করে , গাছে জলদিয়ে নামতে দেরী আছে কিছুক্ষণ । এর মধ্যেই কম্ম সারতে হবে । আমার নির্দেশে রান্নাঘর থেকে তরকারির ঝুড়ি থেকে এক আঁটি ধনেপাতা চুরি করে আনল । হ্যাংলাদুটো মুহূর্তের মধ্যে তা সাবাড় করে দিলো । সে এক দেখার মতো দৃশ্য । নিজের ভাগেরটা খেয়ে, আরেকজনের মুখ থেকে টানাটানি । পরের কাজ , রান্নাঘর থেকে তরকারি ঢাকার প্লাস্টিকের ঝুড়ি চুরি করা । সেটা দিয়ে বিচ্ছু দুটোকে ঢাকতে যেতেই একটা কাণ্ড হলো । ওরা ঝুড়িটা টেনে টেনে চলতে শুরু করতেই , মিঠি যাবতীয় প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে ‘ওমা , কী দারুণ !’বলে লাফিয়ে উঠলো । আর ওর চিৎকারে ‘কী হয়েছে রে ?’ , বলতে বলতে আমার মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো । আমার জলখাবার তৈরি হচ্ছিল , কিন্তু এখন তার আশা পরিত্যাগ করাই শ্রেয় মনে হোল ।‘ এ বাবা , এটা কী ?’, বলে বেতো কোমরেও প্রায় একহাত উঁচু একখান লাফ দিলেন আমার মা জননী । কিন্তু মিঠিও বহুত ম্যানেজ মাস্টার । ‘ ও ঠাম্মি , দেখ, কী সুন্দর দুটো খরগোসের ছানা এনেছে তাকু ! আমি তো কবে থেকে চাইছিলাম – ঠিক এমনি তুলতুলে , ওলে আমার কুটুন মুনু , ওলে আমার পুঁচকে তুনু ,’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ও খরগোস আদরে মন দিলো । মাতৃদেবী এবার আমায় নিয়ে পড়লেন । প্রথমে আমার বুদ্ধিহীনতা, হঠকারিতা ইত্যাদি নিয়ে একপ্রস্থ জ্ঞান প্রদান করে আমার স্বর্গত পিতৃদেবের সাথে আমার তুলনামূলক আলোচনা করে , আমাদের দুজনের জন্য সারাজীবন তাকে কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে , তার একটা বহু চর্চিত লিস্ট পুনরায় কীর্তন করে নিজ কপালের দোষ দিতে দিতে পুনরায় রান্নাঘরে গেলেন । মিঠি আমার দিকে একটা দুষ্টু হাসি ছুঁড়ে দিল । আমি জানি, এখন ওদের জল দিতে বললে, মা তাও দেবে। শতহলেও তাঁর দয়ার শরীর , জীবকে কষ্ট দিয়ে পাপের ভাগী তিনি হবেন না ! ভাইঝি বলল , ‘তাকু , ওদের সিঁড়ি ঘরে রেখে এসো , তারপর ওদের জন্য বাস্ক কিনে আন’। ওর বর্ণ বিপর্যয়ের দোষ আপাতত না শোনার ভান করে কাটিয়ে দিলাম । হাতি কাদায় পড়লে... । দাদা বাড়ি ফিরে ওখানে বাইক রাখবে রাত দশটায়। ততক্ষণ তো ওরা নিরাপদ ! আমিও । তারপর বাজারে গিয়ে কেজি খানেক পাঁঠার মাংস আর ভালো গলদা চিংড়ি কিনে , ফেরার পথে একটা কাঠের মিটসেফ কিনে বাড়ি এলাম । বৌদি এই দুটোই খুব ভালোবাসে। সুতরাং বাড়ি ফিরে অভ্যর্থনা জুটল ভালোই । বৌদির মেজাজ খুশ । আর মিটসেফটা দেখিয়ে বললাম , ‘আমার ঘরে বড্ড ইঁদুরের উৎপাত , খাবার দাবারে মুখ দেবে কোন সময় , তাই’... । এরপর গোটা বাড়ি সুগন্ধে মাতিয়ে বৌদি রান্না বসাল, আমি নিউজ চ্যানেলের সামনে কাত হলাম , আর ভাইঝি পড়তে বসলো । আমিও জানি , ও কেমন পড়ছে আজ , ও ও বুঝে গেছে আমার নিউজে কত মন ! আমাদের মধ্যে ইশারায় কথা হচ্ছিল। টয়লেট যাবার নাম করে ও মাঝে মাঝেই ছানা দুটোকে দেখে আসছিল । অশান্তির ভয়ে তখন থেকেই মায়ের মুখ থমথমে । দাদা বাড়ি ফিরলে আমার কপালে খাওয়া নাও জুটতে পারে আজ , সেই ভয়ে সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই আমিও ক্লান্তির ছুতোয় ভাইঝির সাথে খেতে বসে গেলাম । বৌদি আমার রন্ধনে পটু । কিন্তু আজ সব আইটেম ই বিস্বাদ লাগলো , পেটের মধ্যে গুড়গুড় করতে লাগল ,বুঝলাম , টেনশন ই টেনশন । ছোট বেলায় পরীক্ষার রেসাল্ট বেরনোর দিন এমন হোত ।এখন ও হয়। বসের ঘরে তলব হলে!শুনতে পেলাম দাদার বাইক থামার শব্দ , গেট খোলার শব্দ । আমি তো গায়ত্রী মন্ত্র জপছি রীতিমতো,বলছি, ‘ হে, ভগবান , এবারকার মতো ভালোয় ভালোয় উতরে দাও , আর কক্ষনো এমন হঠকারিতা করব না’। কিন্তু একমিনিট যায় , দু মিনিট যায়, নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রায় পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল , কই , বজ্রপাত ঘটল না তো ! একবার ভাবলাম সরেজমিনে তদন্ত করি , তারপর ভাবলাম , দেখাই যাক , কী হয় । কতক্ষণে বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে দাদার মিলিটারি মেজাজ! তাই শুয়ে পড়লাম চুপচাপ । দুগ্গা, দুগ্গা । শুয়ে কখন ঘুমিয়েও পড়েছিলাম । ঘুম ভাঙ্গল বৌদির চিল চিৎকারে । প্রথমেই ছুটে গেলাম সিঁড়ির তলায় । যা ভেবেছি , ঠিক তাই । বাচ্চা দুটো ঢেকে রাখার ডালি সমেত উধাও ! বেড়াল টেরালে নিয়ে গেল নাতো? ডালি তুলল কী করে, ভাবতে ভাবতে শুনি আওয়াজ আসছে দাদার ঘর থেকে । গিয়ে দেখি দরজায় মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ , বৌদি খাটের ওপর লাফাচ্ছে , দাদার হাতে ঝাঁটা , ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে । মাকে জিজ্ঞাসা করে যা জানা গেল তা এই , রাতে মশারি টাঙ্গাতে গিয়ে বৌদি দেখে তাতে ইয়া বড়বড় ফুটো । কি করে হোল ভাবতে ভাবতেই কোলের ওপর একটা বলের মতো কী গড়িয়ে পড়েছে । বৌদি লাফিয়ে উঠতেই দেখে লাল জুলজুলে চোখ মেলে আর একটা বল মেঝেতে বসে বৌদিকে পর্যবেক্ষণ করছে । তাহলে কালপ্রিট এরাই, কিন্তু এ দুটো এলো কোত্থেকে ? লোকে বেড়াল বাচ্চা ছেড়ে দিয়ে যায় বটে , তা বলে খরগোস ছানা ? আমি চটপট দাদাকে হেল্প করলাম ওদের ধরতে । বৌদিও মুহূর্তে সব ভুলে , ‘ ও মা , কী কিউট’! বলে আদিখ্যেতা দেখাতে বসে গেল । মিঠি ওর বাবা আর তাকুর সাথে ওদের নাম ঠিক করতে বসে গেল । যেটা একটু গাবলু গুবলু ওটার নাম তাতান , আর যেটা তিড়িং বিরিং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেটার নাম বুতাই । খানিক বাদে সবার হুঁশ হোল , ওরা থাকবে কোথায় । অনেক ভেবে বৌদি বলল , ‘ ঠাকুরপো , আপাতত তোমার মিটসেফ টায় রাখো না গো’। ভাইঝি আমাকে চোখ টিপল । দাদা খালি খুঁত খুঁত করতে লাগল , কিন্তু মা আর মেয়ের উৎসাহের চোটে খাপ খুলতে পারল না। সবাই ফের শুতে গেল ।আমি ভাবতে লাগলাম,এসব হলো কী করে । কে ছেড়ে দিল ওদের ? তবে কি মিঠিই... ? ও কিন্তু দোষ স্বীকার করল না। সকাল হতে ব্যাপারটা পরিস্কার হোল । খরগোস ঢাকার ডালি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম সিঁড়ির শেষ ধাপে । বিচ্ছু দুটো টানতে টানতে সিঁড়ির কিনারায় এনে ডালি উল্টে ফেলেছে, তারপর নিজেরা ডিগবাজি খেয়ে মুক্ত হয়েছে। যাইহোক , মিঠি নাকি বাবা- মা কে কিছুই বলবে না, তবে ওর এবারে একটা গোল্ডফিসের গ্লোব চাই । চলেগা , আমারও মনে মনে ইচ্ছেটা ছিল অনেকদিন ধরেই !
এটা মিঠির গল্প । নাকি তাতানদের ? মিঠি হোল আমার ভাইঝি । আর তাতানরা ওর খরগোস । তাতান আর বুতাই । নামগুলো আমারই দেওয়া । আমি যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করি তার কাছেই একটা হাট আছে । সপ্তাহে দুদিন বসে । আমি মাঝে সাঝে চক্কর দিয়ে আসি। খুব ভালো লাগে টাটকা সব্জির গন্ধ , জ্যান্ত মাছের লাফানি , মানুষের কলরব । এই হাটে একদিকে আবার হাঁস, মুরগি , পায়রা এসবও বিক্রি হয়। ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় থমকে গেছি । দেখি , তুলতুলে দুটো তুলোর বল ঘাসের ওপর গড়াগড়ি যাচ্ছে । একটা বছর দশেকের ছেলে ওগুলোর পেছনে পেছনে দৌঁড়চ্ছে । আমি যেই না থেমেছি, ওমা ! বলদুটো গড়াতে গড়াতে এক্কেবারে আমার পায়ের কাছে হাজির । আরে , বল কোথায় , এ যে দেখি দুটো খরগোসের ছানা , লাল লাল পুঁতির মতো চকচকে চোখ ! আদর করার লোভ সামলাতে পারলাম না। যেই না হাঁটু গেড়ে বসেছি আদর করতে , পুঁচকে দুটো বোঁচা বোঁচা নাক আচ্ছা করে আমার হাতে ঘষে টসে একসার। কোথায় আমার মতো একটা হুমদো লোক দেখে ভয়ে পালাবে , তা না , এক্কেবারে বশ করে ফেললো আমায় । আমিও আগুপিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম , বাড়ি নিয়ে যাবো ওদের । ছেলেটার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে একটা ব্যাগ কিনে ভরে ফেললাম ও’দুটোকে । একটা ছানা ,যেটা বেশি ডাকাবুকো, তুলনায় শান্ত আর নাদুসনুদুসটার পিঠের ওপর চড়ে , ব্যাগের ওপর দিয়ে মুখ বের করে বিশ্ব দেখতে দেখতে আমার সাথে চলল । এরপর আমার মাথায় চিন্তাটা এলো । ঝোঁকের মাথায় বাড়ি নিয়ে তো চললাম , কিন্তু তারপর ? আমি তো ব্যাচেলর মানুষ , সেই সক্কাল বেলায় বাড়ি থেকে বের হই , ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা । মা একেই বুড়ো মানুষ , তায় আবার বাতিকগ্রস্ত । আর এতো সাজিয়ে রাখার পুতুল নয় , যে শো-কেসে নিয়ে ঢুকিয়ে রাখব । আবার সারাদিন খাঁচাবন্দী রেখে শুধু দুবেলা খেতে দেবো, সেটাও খুব অমানবিক ব্যাপার হবে । ভাবতে ভাবতে মিঠির কথা মনে হোল । একমাত্র ওই হতে পারে আমার বিপদতারণ ।বাড়ি ঢুকতেই ‘তাকু , তাকু ‘ বলে কোলে ওঠার জন্য ছুটে এলো । আর এসেই , ‘ও তাকু এটা কী এনেছ ?,’ বলে এক চিৎকার দিলো । আমি তো ভাবলাম , হয়ে গেল , এবার আমাকেই না ভিটে ছাড়া হতে হয়! ভাগ্য ভালো , কাছে পিঠে কেউ ছিল না। আমিও ওকে চকলেট দিয়ে হাত করে গোপন ষড়যন্ত্র ছকে ফেললাম । ও ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে উঠল এই পরিকল্পনায় অংশীদার হতে পেরে । ওকে বললাম, ‘তোর মা কোথায় রে?’ ও হাত দিয়ে ছাদ দেখাল । যাক , বাঁচা গেছে । শুকনো কাপড় তুলে, ভাঁজ করে , গাছে জলদিয়ে নামতে দেরী আছে কিছুক্ষণ । এর মধ্যেই কম্ম সারতে হবে । আমার নির্দেশে রান্নাঘর থেকে তরকারির ঝুড়ি থেকে এক আঁটি ধনেপাতা চুরি করে আনল । হ্যাংলাদুটো মুহূর্তের মধ্যে তা সাবাড় করে দিলো । সে এক দেখার মতো দৃশ্য । নিজের ভাগেরটা খেয়ে, আরেকজনের মুখ থেকে টানাটানি । পরের কাজ , রান্নাঘর থেকে তরকারি ঢাকার প্লাস্টিকের ঝুড়ি চুরি করা । সেটা দিয়ে বিচ্ছু দুটোকে ঢাকতে যেতেই একটা কাণ্ড হলো । ওরা ঝুড়িটা টেনে টেনে চলতে শুরু করতেই , মিঠি যাবতীয় প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে ‘ওমা , কী দারুণ !’বলে লাফিয়ে উঠলো । আর ওর চিৎকারে ‘কী হয়েছে রে ?’ , বলতে বলতে আমার মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো । আমার জলখাবার তৈরি হচ্ছিল , কিন্তু এখন তার আশা পরিত্যাগ করাই শ্রেয় মনে হোল ।‘ এ বাবা , এটা কী ?’, বলে বেতো কোমরেও প্রায় একহাত উঁচু একখান লাফ দিলেন আমার মা জননী । কিন্তু মিঠিও বহুত ম্যানেজ মাস্টার । ‘ ও ঠাম্মি , দেখ, কী সুন্দর দুটো খরগোসের ছানা এনেছে তাকু ! আমি তো কবে থেকে চাইছিলাম – ঠিক এমনি তুলতুলে , ওলে আমার কুটুন মুনু , ওলে আমার পুঁচকে তুনু ,’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ও খরগোস আদরে মন দিলো । মাতৃদেবী এবার আমায় নিয়ে পড়লেন । প্রথমে আমার বুদ্ধিহীনতা, হঠকারিতা ইত্যাদি নিয়ে একপ্রস্থ জ্ঞান প্রদান করে আমার স্বর্গত পিতৃদেবের সাথে আমার তুলনামূলক আলোচনা করে , আমাদের দুজনের জন্য সারাজীবন তাকে কত কিছু সহ্য করতে হয়েছে , তার একটা বহু চর্চিত লিস্ট পুনরায় কীর্তন করে নিজ কপালের দোষ দিতে দিতে পুনরায় রান্নাঘরে গেলেন । মিঠি আমার দিকে একটা দুষ্টু হাসি ছুঁড়ে দিল । আমি জানি, এখন ওদের জল দিতে বললে, মা তাও দেবে। শতহলেও তাঁর দয়ার শরীর , জীবকে কষ্ট দিয়ে পাপের ভাগী তিনি হবেন না ! ভাইঝি বলল , ‘তাকু , ওদের সিঁড়ি ঘরে রেখে এসো , তারপর ওদের জন্য বাস্ক কিনে আন’। ওর বর্ণ বিপর্যয়ের দোষ আপাতত না শোনার ভান করে কাটিয়ে দিলাম । হাতি কাদায় পড়লে... । দাদা বাড়ি ফিরে ওখানে বাইক রাখবে রাত দশটায়। ততক্ষণ তো ওরা নিরাপদ ! আমিও । তারপর বাজারে গিয়ে কেজি খানেক পাঁঠার মাংস আর ভালো গলদা চিংড়ি কিনে , ফেরার পথে একটা কাঠের মিটসেফ কিনে বাড়ি এলাম । বৌদি এই দুটোই খুব ভালোবাসে। সুতরাং বাড়ি ফিরে অভ্যর্থনা জুটল ভালোই । বৌদির মেজাজ খুশ । আর মিটসেফটা দেখিয়ে বললাম , ‘আমার ঘরে বড্ড ইঁদুরের উৎপাত , খাবার দাবারে মুখ দেবে কোন সময় , তাই’... । এরপর গোটা বাড়ি সুগন্ধে মাতিয়ে বৌদি রান্না বসাল, আমি নিউজ চ্যানেলের সামনে কাত হলাম , আর ভাইঝি পড়তে বসলো । আমিও জানি , ও কেমন পড়ছে আজ , ও ও বুঝে গেছে আমার নিউজে কত মন ! আমাদের মধ্যে ইশারায় কথা হচ্ছিল। টয়লেট যাবার নাম করে ও মাঝে মাঝেই ছানা দুটোকে দেখে আসছিল । অশান্তির ভয়ে তখন থেকেই মায়ের মুখ থমথমে । দাদা বাড়ি ফিরলে আমার কপালে খাওয়া নাও জুটতে পারে আজ , সেই ভয়ে সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই আমিও ক্লান্তির ছুতোয় ভাইঝির সাথে খেতে বসে গেলাম । বৌদি আমার রন্ধনে পটু । কিন্তু আজ সব আইটেম ই বিস্বাদ লাগলো , পেটের মধ্যে গুড়গুড় করতে লাগল ,বুঝলাম , টেনশন ই টেনশন । ছোট বেলায় পরীক্ষার রেসাল্ট বেরনোর দিন এমন হোত ।এখন ও হয়। বসের ঘরে তলব হলে!শুনতে পেলাম দাদার বাইক থামার শব্দ , গেট খোলার শব্দ । আমি তো গায়ত্রী মন্ত্র জপছি রীতিমতো,বলছি, ‘ হে, ভগবান , এবারকার মতো ভালোয় ভালোয় উতরে দাও , আর কক্ষনো এমন হঠকারিতা করব না’। কিন্তু একমিনিট যায় , দু মিনিট যায়, নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রায় পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল , কই , বজ্রপাত ঘটল না তো ! একবার ভাবলাম সরেজমিনে তদন্ত করি , তারপর ভাবলাম , দেখাই যাক , কী হয় । কতক্ষণে বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে দাদার মিলিটারি মেজাজ! তাই শুয়ে পড়লাম চুপচাপ । দুগ্গা, দুগ্গা । শুয়ে কখন ঘুমিয়েও পড়েছিলাম । ঘুম ভাঙ্গল বৌদির চিল চিৎকারে । প্রথমেই ছুটে গেলাম সিঁড়ির তলায় । যা ভেবেছি , ঠিক তাই । বাচ্চা দুটো ঢেকে রাখার ডালি সমেত উধাও ! বেড়াল টেরালে নিয়ে গেল নাতো? ডালি তুলল কী করে, ভাবতে ভাবতে শুনি আওয়াজ আসছে দাদার ঘর থেকে । গিয়ে দেখি দরজায় মায়ের উদ্বিগ্ন মুখ , বৌদি খাটের ওপর লাফাচ্ছে , দাদার হাতে ঝাঁটা , ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে । মাকে জিজ্ঞাসা করে যা জানা গেল তা এই , রাতে মশারি টাঙ্গাতে গিয়ে বৌদি দেখে তাতে ইয়া বড়বড় ফুটো । কি করে হোল ভাবতে ভাবতেই কোলের ওপর একটা বলের মতো কী গড়িয়ে পড়েছে । বৌদি লাফিয়ে উঠতেই দেখে লাল জুলজুলে চোখ মেলে আর একটা বল মেঝেতে বসে বৌদিকে পর্যবেক্ষণ করছে । তাহলে কালপ্রিট এরাই, কিন্তু এ দুটো এলো কোত্থেকে ? লোকে বেড়াল বাচ্চা ছেড়ে দিয়ে যায় বটে , তা বলে খরগোস ছানা ? আমি চটপট দাদাকে হেল্প করলাম ওদের ধরতে । বৌদিও মুহূর্তে সব ভুলে , ‘ ও মা , কী কিউট’! বলে আদিখ্যেতা দেখাতে বসে গেল । মিঠি ওর বাবা আর তাকুর সাথে ওদের নাম ঠিক করতে বসে গেল । যেটা একটু গাবলু গুবলু ওটার নাম তাতান , আর যেটা তিড়িং বিরিং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেটার নাম বুতাই । খানিক বাদে সবার হুঁশ হোল , ওরা থাকবে কোথায় । অনেক ভেবে বৌদি বলল , ‘ ঠাকুরপো , আপাতত তোমার মিটসেফ টায় রাখো না গো’। ভাইঝি আমাকে চোখ টিপল । দাদা খালি খুঁত খুঁত করতে লাগল , কিন্তু মা আর মেয়ের উৎসাহের চোটে খাপ খুলতে পারল না। সবাই ফের শুতে গেল ।আমি ভাবতে লাগলাম,এসব হলো কী করে । কে ছেড়ে দিল ওদের ? তবে কি মিঠিই... ? ও কিন্তু দোষ স্বীকার করল না। সকাল হতে ব্যাপারটা পরিস্কার হোল । খরগোস ঢাকার ডালি শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলাম সিঁড়ির শেষ ধাপে । বিচ্ছু দুটো টানতে টানতে সিঁড়ির কিনারায় এনে ডালি উল্টে ফেলেছে, তারপর নিজেরা ডিগবাজি খেয়ে মুক্ত হয়েছে। যাইহোক , মিঠি নাকি বাবা- মা কে কিছুই বলবে না, তবে ওর এবারে একটা গোল্ডফিসের গ্লোব চাই । চলেগা , আমারও মনে মনে ইচ্ছেটা ছিল অনেকদিন ধরেই !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন