চান্দের চর
অলোকপর্ণা
পঞ্চম কিস্তি
দোপাটি আজ ইংলিশ ক্লাসটা মিস করে গেল। দীপাম্যামের ক্লাস মিস করলে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় তার, কেন সে জানেনা। কম্পালসারী ইংলিশ পেপারে এতটা গুরুত্ব না দিলেও হবে,- সে জানে। তাও দীপাম্যামের ক্লাস মানেই প্রথম বেঞ্চের প্রথম জায়গাটা তার চাই চাই। কঙ্কাবতী এই ব্যাপারটা নিয়ে বিস্মিত হয়। কেন দোপাটি ওই জায়গাটা নিয়ে মারপিট করতেও পিছপা নয়, সেটা বেশ রহস্যজনক তার কাছে। মেয়েটা সত্যিই অদ্ভুত। এই তিনমাস ক্যান্টিনে বাউল গেয়ে গেয়ে পাগল করে দিলো! এখন আবার বলছে নাকি গান আর গাইবে না, এখন থেকে খালি আঁকবে। টিউশান সেরে ফেরার পথে রাত নটা নাগাদ এখন রোজ তার সাথে শিয়ালদহ আসছে আর প্ল্যাটফর্মেই খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে পড়ছে,- না স্টেশানবাসী, স্টেশানযাত্রীদের ছবি আঁকবে। যদিও দোপাটি বলে সে মাত্র এক সপ্তাহ হল আঁকছে তবু কঙ্কাবতীর মনে হয় সে এক্ষেত্রে এক্সপার্ট। কি দ্রুত এক এক জনের স্কেচ সারে মেয়েটা। নটা উনত্রিশ আসার আগেই তার দু তিন জনের রাফ স্কেচ সারা হয়ে যায়। কঙ্কাবতীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে যাদবপুরের বাস ধরে দোপাটি। সারা রাস্তা পথচারী, পথকুকুর, যানবাহন স্টাডি করতে করতে যায়। চোখ তৈরী করতে হবে, চোখ। আজ প্রবল বৃষ্টিপাতে নদী হয়ে গেছে কোলকাতা। বিকেলে পড়া হয়নি। সকালে দীপাম্যামের ক্লাসও দোপাটির হয়নি। পড়া হবে না তাই অফ পিরিয়ডে কলেজে বসেও থাকতে হয়নি। কঙ্কাবতী কলেজস্ট্রীট যাবে বই কিনতে, কোলকাতা নদী বেয়ে। তার সাথে যেতে সাহস হয় না দোপাটির। বিশাল আঁকার খাতাটাকে জলের হাত থেকে বাঁচাতে সে বাসে উঠে পড়ে।
কোলকাতা যেসব দিন নদী হয়ে যায়, রাস্তা ঘাটে সব যানবাহন থেমে যায়। জ্যামে দোপাটির বাসটাও আটকে গেছে। অফিস ফেরতা আওয়ার এখনও শুরু হয়নি তাই বাস প্রায় ফাকা। নদীর তলায় ড্রেনটানিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে সর্বক্ষণ হোয়ার্ল পুল তৈরী করে যাচ্ছে। অন্ধকারে অসময়ে স্ট্রীট লাইটগুলো দোপাটির চোখের অকাল বোধন ঘটিয়ে দিলো। কালো করে আসা কোলকাতা-আকাশের তলায় বাস, বাসের পাশে ট্রাম, ট্রামের পাশে জলে অর্ধেক ডোবা হাত রিক্সা সব মিলে মিশে ওয়াটার কালার চাইছে যেন তার কাছ থেকে। অথবা অয়েলও চলতে পারে। জানালা দিয়ে সে চোখদুটোকে ছুঁড়ে দিলো শহরের বুকে, জেলে যেভাবে নদীর বুকে জাল ছুঁড়ে দেয়। চোখ খোলা রাখলে ওয়াটার কালারের শহর ভিতরে ঢুকে পড়তে চাইছে, চোখ বুজলে বিচিত্র সব হর্ণের আওয়াজে কোলকাতা নদীটাকে হঠ করে পুকুর আর যানবাহনগুলোকে বর্ষার ব্যাঙের মতো শোনাচ্ছে। আহ, মল্লার কি ভালো শোনাত এই সময়ে! নাম নেওয়ার সাথে সাথেই অঝোর ধারায় ভিজে গেল বাস, ট্রাম, হাত রিক্সা, পথচারীর দল, সারা শহরে একসাথে আলাপ গেয়ে বৃষ্টি শুরু হোল। চোখ খুলতেই দোপাটির মনে হোল সামনের মোড়ে সিগনাল হওয়ার সাথে সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেন নৌকা বেয়ে পার হয়ে গেলেন, পদ্মা বোট নয়, পানসির লগি ঠেলতে ঠেলতে। দারুণ আঁকার বিষয় হতে পারে এটা। হাতনিশপিশ করতে করতে গোটা রাস্তা কোনো রকমে পার করে বাড়ি পৌঁছায় দোপাটি। মাথার মধ্যে গোটা ছবিটা পুরে সে সিঁড়ি বেয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ততায় উঠে আসছিল কিন্তু দোতলার করিডোরের দিকে নজর হতেই স্থির হয়ে যেতে হয় তাকে।
একদিন ক্লাস মিস হতেই পারে, তাই বলে দীপাম্যাম বাড়ি চলে আসবেন কল্পনাও করতে পারেনি সে। আর শুধু আসবেনই না মুখ চেপে কান্না শুরু করে দেবেন আর বাড়িশুদ্ধ লোক থমথমে মুখে দোপাটির জন্য অপেক্ষা করবে,- এ দৃশ্য দুই মিনিট আগেও ভাবতে পারেনি সে। নৌকা বেয়ে রবীন্দ্রনাথ শহরের পথে মিলিয়ে গেলেন। দোপাটি পা টিপে টিপে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে ছাদের ঘরে উঠে এল।
যৌথ পরিবার,- যাদবপুরের সেনবাড়ির ছবিটা চোখে ভেসে ঊঠতেই শব্দ দুটো আপনা থেকেই মনে আসছে দীপান্বিতার। এবং ছবিটা এতটাইনিখুঁত যে বাংলা অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রীমের বিজ্ঞাপনে এই পরিবারকে দেখানো যেতে পারে। মমতাময়ী মা, গম্ভীর কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল বাবা, স্নেহপ্রবণ জ্যেঠু, প্রাচীনপন্থি ঠাকুমা, মাই ডিয়ার ছোটকাকা, বৌদিসুলভ ছোটকাকি, ইয়াং যুবক ছোড়দা এবং খেলতে গিয়ে পা কেটে ফেলা দুরন্ত ছেলেটি, যার কাটা পায়ে অ্যান্টিসেপ্টিক লাগাতে লাগাতে মায়ের মুখ মমতায় ভরে যাবে আর বাকী ফ্যামিলি মেম্বাররাও এক এক করে ক্রীমের গুণ বর্ণনা করে প্রেক্ষাপটে এসে দাঁড়াবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হোল এদের পোষাকের রং,- শাড়ি, ব্লাউজ, জামা, গেঞ্জি, সার্ট, প্যান্ট সবই অ্যান্টিএপ্টিক ক্রীমের টিউব বা বোতলের রঙের হওয়াটা আবশ্যিক। নইলে সমগ্র বিজ্ঞাপনের অর্থই বৃথা!
বাবার ফোন রাখার পর কলেজে থাকতে দেয়নি ভাইয়ের প্রতি অসন্তোষ আর সেনদের অদূরদর্শিতা। কৃষ্ণ স্যার! এটা পিকুর মতো কারোর নাম হওয়া সম্ভব! অবাক হয়েছে দীপা। শুনেই কৃষ্ণসার হরিনের কথা মনে পড়েছে তার। মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ঢুকলেও বনেদিবাড়িটার গন্ধ, হাওয়া দীপার মনকে মুহুর্তে রেশম করে দিয়েছে। কি নিপাট পারিবারিক সেনরা! মা মারা যাওয়ার পর পরিবার শব্দটা শুধু অন্যলোকদের হয় বলে জেনে এসেছে দীপা। একটা চকলেটকে যে সমান নয় ভাগে ভাগ করা যায় তা যাদবপুরে না এলে দীপার মনেই পরতো না। শুধু কলিং বেল টিপে সে বলেছিল, “আমি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের দিদি। ” গোটা পরিবার একসাথে তার উদ্বেগ, আশঙ্কানিমেষে চকলেটের মতো সমান ভাগ করে নিয়েছিল। লম্বা করিডোরটায় শোকের ছায়া নেমে এসেছিল, পরিবারের সবাই সেই ছায়ার তলায় ধূসর মুখে দাঁড়িয়ে, যা দেখে বহিরাগত হয়েও দীপার অনেক দিন পর নিরাপদ লেগেছে নিজেকে। মনে হয়েছে সেও একা নয়। ওই আটটি মানুষ তার সব দায় দায়িত্ব সমানভাবে যেন বহন করবে। দীপাকে তারা অজান্তেই আগলে ফেলেছেন যেন,- ঠাকুমা বলেছেন, “কৃষ্ণ তো ঠাকুর গো, কতদিন সকালে আগে এসে পড়েছে, বাবু ঘুমায় তখনও। আমি চুপি চুপি মহাভারতখানা নিয়ে এসেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে আমায় সঙসকৃত শ্লোকের মানে বুঝিয়েছে। আমায় তাজা পীরের ডেরা থেকে বাতের তেলখানা এনে দিয়েছে প্রতি মাসে, এরা কেউ কিচ্ছুটি টের পায়নি। ”
দীপা অবাক হয়েছে, “সংস্কৃত!” পিকু সংস্কৃত জানলো কবে থেকে!
মা বলেছেন, “নিজে মুখে একটিবারও মাইনে চায়নি। একবার তো একমাসে দিতেই ভুলে গেলুম! দেখি পর পর চারদিন লেট করে আসছে, জিজ্ঞেস করে করে তারপর জানলুম বাসভাড়া দিতে পারছে না! কি লজ্জা বলুন তো! খুব ফায়দা লুটেছি আমরা আপনার ভাইয়ের। সেদিন লজ্জায় ক্ষমা চাইতে পারিনি, আপনার কাছে আজ চেয়েনিলুম। ”
দীপা বিব্রত বোধ করেছে, একই সাথে জীবনে প্রথমবার নিজে হাতে বড় করে তোলা ভাইয়ের প্রশংসা শুনে গর্বও হয়েছে তার।
জ্যেঠু রেশ ধরেছেন কথার, “আমরা জানতেই পারতাম না যে ওনার পুরো নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আমরা কৃষ্ণ স্যার বলেই চিনতাম। আমার ভাইঝি আবার আড়ালে ডাকত কৃষ্ণসার!”
কোণার চেয়ার থেকে বাবুর বাবা বলে উঠলেন, “দাদা! লঘু কথা না বলে উনি কি জানতে চান দেখ। ওনার সাহায্য কর!”
দীপার মুখের দিকে সবাই তাকিয়ে। দীপা খুব হাল্কা গলায় বলে, “আপনাদের এখানে না এলে জানতেও পারতাম না আমার অপদার্থ ভাইটা এত প্রশংসার দাবী রাখে। বাস্তব বুদ্ধি খুব কম, বুঝলেন! আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট। এত আগলে আগলে রেখেছি যে দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণাই হয়নি ওর। আর ভাবুন আজ সে এই বিরাট শহরের কোন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ” সে আর কান্না সামলাতে পারে না। সেন পরিবার নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
পরিস্থিতি সহজ করতে ছোটকাকি বলে ওঠেন, “বাবু, চকোলেটটা সাবাড় করে ফেলেছ, না আছে এখনও?”
বাবু অভিযোগের স্বরে বলে, “আমি আর ছোট আছি নাকি যে চুরি করে খাবো?”
বাবুর ছোড়দা বলে, “গতকালই তো ছাদ থেকে আচার চুরি করে খাচ্ছিলি, আজকেই বড় হয়ে গেলি!”
বাবু লজ্জা পায়, ঘর থেকে চকোলেট নিয়ে আসে। কি অদ্ভুত উপায়ে যে ও খালি হাতে চকোলেটটা সমান সমান ভাগ করে সবাইকে দিলো ভেবে দীপা অবাক হয়।
ঠাকুমা বলেন, “মেয়েটার জন্যেও রাখ একটুকু!”
মা বলেন, “এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে সে কোথায় পড়ে আছে কে জানে। আমার মেয়ে, কলেজে পড়ে। ”
কোণার চেয়ার থেকে বাবুর বাবা বলেন, “ছাড়না ওর কথা। কাজের কথা বল। ”
ছোটকাকি বলেন, “হ্যাঁ, বলুন আপনি, কী জানতে চান। ”
“ও কোথায় থাকত সে সম্পর্কে কিছু জানিয়েছিল আপনাদের?”
জ্যেঠু বললেন, “বাবু এসব ভালো বলতে পারবে। ওর সাথেই তো সবচেয়ে বেশি ইন্টার্যাকশান হতো কৃষ্ণর। ”
বাবু ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট হয়েও অনেক ইমম্যাচিওর। অথবা ওর সারল্যটা কাটেনি এখনও। মানসিকভাবে প্রথাগত পুরুষ হয়ে উঠতে এখনও দু তিন বছর লেগে যেতে পারে। কোথাও পিকুর সাথে বাবুর মিল আছে,- মনে হতে লাগলো দীপার। মাতৃমুখী ছেলেটা পিকুর মতোই প্যাঁচপয়জারহীন। পিকুর মতো এরও দিদি আছে। কে জানে সে বাবুর খেয়াল রাখে কিনা। দেরী করে স্কুল থেকে ফিরলে, পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে চিন্তা করে কিনা। দীপার আবার কান্না পায়।
কান্না চেপে সে বলে, “বাবু, তোমার কৃষ্ণ স্যার সম্পর্কে যা যা জানো বলবে আমায়?”
দীপা জানতে পারে পিকুর মেসের কথা, যেখানে প্রায় একশো পায়রা পোষা হয়, পায়রার ঘরের পাশে পিকুর খোপ, তাতে একটাই জানালা যার সামনে অথচ নাগালের বাইরের কুল গাছে পাখি নির্জন বাসা বেঁধেছে। যে সময় পায়রা পোষার সখ জেগে উঠেছিল সেসব সময়ে পায়রা সম্বন্ধে খোঁজ খবর করতে কৃষ্ণ স্যার খুব হেল্প করেছে তাকে, বাবু জানায়। এছাড়াও কৃষ্ণ স্যার জন্মদিনে গলিভার ট্রাভেলস দিয়েছে, চাঁদে টিনটিন দিয়েছে। বেকার ছেলেটা এত দূর থেকে শুধু মাত্র টাকার প্রয়োজনে সংস্কৃত পড়াতে আসতো, তার পরেও সে ছাত্রের জন্মদিনে উপহার দেওয়ার শৌখিনতা দেখিয়েছে,- অনেক গর্ব হয় দীপার পিকুর জন্য, অনেক অনেক গর্ব হয়। যদিও বাবার কাছে এসব নির্বুদ্ধিতা, তবু আজ পিকুর জন্য সমস্ত গর্বটা একা ভাগ করে নিতে দারুণ লাগে তার। বৃষ্টি থামার পর যখন সে শহরের রাস্তায় নামে তখন তার খেয়াল হয়, অস্বস্তিটা যেন সেনবাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিল তার জন্য, কোন এক মন্ত্রবলে বনেদি বাড়িটার ভিতরে তার প্রবেশনিষেধ ছিল। এই সব অস্বস্তির দিনেই পিকুকে হারাতে হলো! ছেলেটা কী করছে এখন, কোথায় আছে চিন্তা করতে করতে রাত গভীর হয় শহরের।
বই কিনে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে দিলো না বৃষ্টিটা। কঙ্কাবতীর অভিমান হয়। আজকাল ঘন ঘন অভিমান হয় তার। দোপাটি ইয়ারকি মেরে বলে, “মেয়ে নির্ঘাত প্রেমে পড়েছে। ” কঙ্কাবতীর তখন আবার রাগ হয়। আজকাল মুডও খুব ঘন ঘন বদলাচ্ছে তার। গন্ধটা সত্যিই সন্দেহজনক। সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ফিরতেই তাই মায়ের সালিশি সভায় হাজিরা দিতে হয় তাকে। “কোথায় ছিলি?”, “কেন ছিলি?”, “কোন বই কিনলি?”, “একটা বই কিনতে এত সময় লাগে!” ইত্যাদি... ইত্যাদি... কঙ্কাবতী নিজের ঘরে পালিয়ে আসতে চায়। অবশেষে আগামীকালের পড়ার অজুহাত দিয়ে ছাড় পাওয়া যায়। কঙ্কাবতীর হিংসে হয় দোপাটির ওপর। অহেতুক স্বাধীনতা পায় মেয়েটা, তাও সময় মেনে বাড়ি ঢোকে, ছবি আঁকতে না বসলে এর অন্যথা হওয়া খুবই ব্যতীক্রমী ব্যপার। ঘরে ঢুকেও স্বস্তি মেলে না কঙ্কাবতীর। গত তিন মাস মায়ের নির্দেশে দক্ষিণের জানলা বন্ধ। কোন ছেলে নাকি উঁকি মেরে তাকে দেখে তাই। ছেলেটা সত্যিই দেখে তাকে মাঝে মাঝে, সেনিজেও টের পেয়েছে। মা জানেনা, কেউই জানেনা যে- কঙ্কাবতীই আগে ছেলেটাকে দেখতে শুরু করেছিল। বিরক্ত হওয়ার বদলে চাপা গর্ব হয়েছে তার। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীনই সে তার স্কুলের বন্ধুদের বলতে পেরেছে, “হ্যাঁ আমাকেও একটা ছেলে আজকাল লাইন মারছে”, পুরো স্কুল লাইফটাই আলুনি কাটেনি। জীবন বিজ্ঞান পড়তে পড়তে যখন ভাজক কলা আর লসিকা বাহ গুলিয়ে যাওয়া পরিস্থিতি হোত তখন তার চোখ সমস্ত সংযম অগ্রাহ্য করে জালনা বেয়ে বাইরে চলে যেত। ছেলেটা হয়তো তখন একমনে আকাশের ঘুড়ি দেখছে বা ছোট মটর গাছটা মিষ্টির হাঁড়িবন্দী করে জানালার সামনে এনে রাখছে। পুরনো দেওয়াল বেয়ে আগাছাগুলো তার ঘরে উঁকি মারে, তাও দিনের পর দিন ছেলেটা তাদের প্রশয় দিয়ে অল্প অল্প করে জল ঢালে। কঙ্কাবতীর ইচ্ছে করে উঠে গিয়ে দুই হাতে উপড়ে নিয়ে আসতে চারাগুলো। জঞ্জাল যত রাজ্যের! সে দেখেছে বৃষ্টি হলেও ছেলেটা জানালা বন্ধ করে না, বসে বসে ছাঁট খায়। আর তারপরের দিন কঙ্কাবতীর পড়ায় বাঁধা দিয়ে বিশাল বিশাল হাঁচি দেয়। ডিসগাস্টিং! জানালা দিয়ে ছেলেটার গোটা ঘরটাই প্রায় নজরে আসে তার। ছেলেটা বেশ গরীব। কাজ কর্মও কিছু করে বলে মনে হয় না। সারাক্ষণই প্রায় বই পড়ে গান গেয়ে কাটায়। তাও যদি সে গান শ্রুতিমধুর হোত। খালি দোপাটির মতো বেছে বেছে বাঙাল ভাষার বাউলগুলো গাইবে আর তার বিন্দুমাত্র কঙ্কাবতীকে বুঝতে দেবে না। খুবই বিরক্তিকর ছেলেটা। এতই রোগা যে মাঝে মাঝে তাকে নিজের চেয়েও ছোট বলে মনে হয় তার। কে জানে ঠিক ঠাক খায় কিনা। আজ অবধি তো রাতে মুড়ি ছাড়া কিছুই খেতে দেখেনি সে তাকে। ওই একবাটি মুড়িতে আর যাই হোক কঙ্কাবতী এত বড় রাত কাটাতে পারত না। তাই হয়তো নিজের ঘরে বসে এগ, চিকেন রোল, ম্যাগি আরও কোনো ফাস্ট ফুড খেতে পারে না সে, খালি মনে হয় হাতে একবাটি মুড়ি নিয়ে ছেলেটা দেখছে হয়তো। একদিন দুপুরে অঙ্ক করতে করতে, মনে মনে, আঙুলের মাথায় লেগে থাকা জলপাইয়ের আচারের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে ছেলেটার সাথে চোখাচুখি হয়। তার পর থেকেই কঙ্কাবতী দেখেছে ছেলেটাও ঘুড়ি ওড়ান দেখতে গিয়ে রোজ অন্তত একবার করে তার ঘরের দিকে তাকাবেই। এক সপ্তাহ পর তাকে অবাক করে দিয়ে মটর গাছের পাশে একটা নতুন টব এলো, তাতে কিছু দিন পরে কোলকাতার সবচেয়ে লাল গোলাপটা ফুটলো। তখনই সাবধান হয়েছিল কঙ্কাবতী, মায়ের নজর লাগলে ফুল ঝরে শুধু কাঁটাগায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গাছটার একবেলাও লাগবে না। ছেলেটা আবার এর মধ্যে কোত্থেকে বাঁশি যোগাড় করেছে একটা! যেসব বিকেলে কঙ্কাবতী পড়ে না, বেছে বেছে তখনই সে বাঁশি বাজায়। ছেলেটার আর সব কিছু বিরক্তিকর লাগলেও এই সময়ে কঙ্কাবতী আর প্রতিরোধ করতে পারে না নিজেকে, ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে খুব ভালোবাসে, বিকেলের ফাস্টফুডগুলোর কিছুটা ভাগ ওকে দেয়, ওর ঘরে গিয়ে ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে আসে, যা অগোছালো! আর আসার আগে অবশ্যই দুই হাত দিয়ে দেওয়ালের আগাছাগুলো টেনে ছিঁড়ে দিয়ে আসে।
মায়ের বারণে কঙ্কাবতী অনেক দিন, অনেক দিন ছেলেটাকে দেখেনি। উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ এসবের ফাঁকে কোথায় হারিয়ে গেল জানালার অধ্যায়গুলো! কঙ্কাবতীর কান্না পায়। কতদিন অবহেলা করেছে ও ছেলেটাকে! বেচারা! জানালা বন্ধ করে দেওয়ার পর আর বাঁশির আওয়াজ বা গান কিছুই শোনা যায়নি। হয়তো কষ্টও পেয়েছে ও! কঙ্কাবতী সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে দক্ষিণের জানালা খুলে দেয়। বৃষ্টি শেষের দমকা হাওয়া সারা ঘরে ছেয়ে যায়, আরাম লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বহুদিন বন্ধ থাকায় ওবাড়ির পায়রাগুলো যা নোংরা করে রেখেছে জানালার সামনেটা! ইস! মুখ তুলে কঙ্কাবতী ওপাশের জানালা দিয়ে তাকায়। জানালা বন্ধ! গত তিন বছরে এই প্রথম। খুব শূন্য লাগে চারদিক। শূন্যতা বাড়িয়ে আরও ঠান্ডা আর্দ্র হাওয়া এসে শীত লাগিয়ে দেয় তার গায়ে। কঙ্কাবতী দেখে জানালার আর নাগালের বাইরের কুল গাছটায় একটা পাখির বাসা,- একটু আগের বৃষ্টিতেই যা ভেঙে গিয়েছে।
অলোকপর্ণা
পঞ্চম কিস্তি
দোপাটি আজ ইংলিশ ক্লাসটা মিস করে গেল। দীপাম্যামের ক্লাস মিস করলে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয় তার, কেন সে জানেনা। কম্পালসারী ইংলিশ পেপারে এতটা গুরুত্ব না দিলেও হবে,- সে জানে। তাও দীপাম্যামের ক্লাস মানেই প্রথম বেঞ্চের প্রথম জায়গাটা তার চাই চাই। কঙ্কাবতী এই ব্যাপারটা নিয়ে বিস্মিত হয়। কেন দোপাটি ওই জায়গাটা নিয়ে মারপিট করতেও পিছপা নয়, সেটা বেশ রহস্যজনক তার কাছে। মেয়েটা সত্যিই অদ্ভুত। এই তিনমাস ক্যান্টিনে বাউল গেয়ে গেয়ে পাগল করে দিলো! এখন আবার বলছে নাকি গান আর গাইবে না, এখন থেকে খালি আঁকবে। টিউশান সেরে ফেরার পথে রাত নটা নাগাদ এখন রোজ তার সাথে শিয়ালদহ আসছে আর প্ল্যাটফর্মেই খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে পড়ছে,- না স্টেশানবাসী, স্টেশানযাত্রীদের ছবি আঁকবে। যদিও দোপাটি বলে সে মাত্র এক সপ্তাহ হল আঁকছে তবু কঙ্কাবতীর মনে হয় সে এক্ষেত্রে এক্সপার্ট। কি দ্রুত এক এক জনের স্কেচ সারে মেয়েটা। নটা উনত্রিশ আসার আগেই তার দু তিন জনের রাফ স্কেচ সারা হয়ে যায়। কঙ্কাবতীকে ট্রেনে তুলে দিয়ে যাদবপুরের বাস ধরে দোপাটি। সারা রাস্তা পথচারী, পথকুকুর, যানবাহন স্টাডি করতে করতে যায়। চোখ তৈরী করতে হবে, চোখ। আজ প্রবল বৃষ্টিপাতে নদী হয়ে গেছে কোলকাতা। বিকেলে পড়া হয়নি। সকালে দীপাম্যামের ক্লাসও দোপাটির হয়নি। পড়া হবে না তাই অফ পিরিয়ডে কলেজে বসেও থাকতে হয়নি। কঙ্কাবতী কলেজস্ট্রীট যাবে বই কিনতে, কোলকাতা নদী বেয়ে। তার সাথে যেতে সাহস হয় না দোপাটির। বিশাল আঁকার খাতাটাকে জলের হাত থেকে বাঁচাতে সে বাসে উঠে পড়ে।
কোলকাতা যেসব দিন নদী হয়ে যায়, রাস্তা ঘাটে সব যানবাহন থেমে যায়। জ্যামে দোপাটির বাসটাও আটকে গেছে। অফিস ফেরতা আওয়ার এখনও শুরু হয়নি তাই বাস প্রায় ফাকা। নদীর তলায় ড্রেনটানিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে সর্বক্ষণ হোয়ার্ল পুল তৈরী করে যাচ্ছে। অন্ধকারে অসময়ে স্ট্রীট লাইটগুলো দোপাটির চোখের অকাল বোধন ঘটিয়ে দিলো। কালো করে আসা কোলকাতা-আকাশের তলায় বাস, বাসের পাশে ট্রাম, ট্রামের পাশে জলে অর্ধেক ডোবা হাত রিক্সা সব মিলে মিশে ওয়াটার কালার চাইছে যেন তার কাছ থেকে। অথবা অয়েলও চলতে পারে। জানালা দিয়ে সে চোখদুটোকে ছুঁড়ে দিলো শহরের বুকে, জেলে যেভাবে নদীর বুকে জাল ছুঁড়ে দেয়। চোখ খোলা রাখলে ওয়াটার কালারের শহর ভিতরে ঢুকে পড়তে চাইছে, চোখ বুজলে বিচিত্র সব হর্ণের আওয়াজে কোলকাতা নদীটাকে হঠ করে পুকুর আর যানবাহনগুলোকে বর্ষার ব্যাঙের মতো শোনাচ্ছে। আহ, মল্লার কি ভালো শোনাত এই সময়ে! নাম নেওয়ার সাথে সাথেই অঝোর ধারায় ভিজে গেল বাস, ট্রাম, হাত রিক্সা, পথচারীর দল, সারা শহরে একসাথে আলাপ গেয়ে বৃষ্টি শুরু হোল। চোখ খুলতেই দোপাটির মনে হোল সামনের মোড়ে সিগনাল হওয়ার সাথে সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যেন নৌকা বেয়ে পার হয়ে গেলেন, পদ্মা বোট নয়, পানসির লগি ঠেলতে ঠেলতে। দারুণ আঁকার বিষয় হতে পারে এটা। হাতনিশপিশ করতে করতে গোটা রাস্তা কোনো রকমে পার করে বাড়ি পৌঁছায় দোপাটি। মাথার মধ্যে গোটা ছবিটা পুরে সে সিঁড়ি বেয়ে চূড়ান্ত ব্যস্ততায় উঠে আসছিল কিন্তু দোতলার করিডোরের দিকে নজর হতেই স্থির হয়ে যেতে হয় তাকে।
একদিন ক্লাস মিস হতেই পারে, তাই বলে দীপাম্যাম বাড়ি চলে আসবেন কল্পনাও করতে পারেনি সে। আর শুধু আসবেনই না মুখ চেপে কান্না শুরু করে দেবেন আর বাড়িশুদ্ধ লোক থমথমে মুখে দোপাটির জন্য অপেক্ষা করবে,- এ দৃশ্য দুই মিনিট আগেও ভাবতে পারেনি সে। নৌকা বেয়ে রবীন্দ্রনাথ শহরের পথে মিলিয়ে গেলেন। দোপাটি পা টিপে টিপে পিছনে সিঁড়ি দিয়ে ছাদের ঘরে উঠে এল।
যৌথ পরিবার,- যাদবপুরের সেনবাড়ির ছবিটা চোখে ভেসে ঊঠতেই শব্দ দুটো আপনা থেকেই মনে আসছে দীপান্বিতার। এবং ছবিটা এতটাইনিখুঁত যে বাংলা অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রীমের বিজ্ঞাপনে এই পরিবারকে দেখানো যেতে পারে। মমতাময়ী মা, গম্ভীর কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল বাবা, স্নেহপ্রবণ জ্যেঠু, প্রাচীনপন্থি ঠাকুমা, মাই ডিয়ার ছোটকাকা, বৌদিসুলভ ছোটকাকি, ইয়াং যুবক ছোড়দা এবং খেলতে গিয়ে পা কেটে ফেলা দুরন্ত ছেলেটি, যার কাটা পায়ে অ্যান্টিসেপ্টিক লাগাতে লাগাতে মায়ের মুখ মমতায় ভরে যাবে আর বাকী ফ্যামিলি মেম্বাররাও এক এক করে ক্রীমের গুণ বর্ণনা করে প্রেক্ষাপটে এসে দাঁড়াবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হোল এদের পোষাকের রং,- শাড়ি, ব্লাউজ, জামা, গেঞ্জি, সার্ট, প্যান্ট সবই অ্যান্টিএপ্টিক ক্রীমের টিউব বা বোতলের রঙের হওয়াটা আবশ্যিক। নইলে সমগ্র বিজ্ঞাপনের অর্থই বৃথা!
বাবার ফোন রাখার পর কলেজে থাকতে দেয়নি ভাইয়ের প্রতি অসন্তোষ আর সেনদের অদূরদর্শিতা। কৃষ্ণ স্যার! এটা পিকুর মতো কারোর নাম হওয়া সম্ভব! অবাক হয়েছে দীপা। শুনেই কৃষ্ণসার হরিনের কথা মনে পড়েছে তার। মনে মনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ঢুকলেও বনেদিবাড়িটার গন্ধ, হাওয়া দীপার মনকে মুহুর্তে রেশম করে দিয়েছে। কি নিপাট পারিবারিক সেনরা! মা মারা যাওয়ার পর পরিবার শব্দটা শুধু অন্যলোকদের হয় বলে জেনে এসেছে দীপা। একটা চকলেটকে যে সমান নয় ভাগে ভাগ করা যায় তা যাদবপুরে না এলে দীপার মনেই পরতো না। শুধু কলিং বেল টিপে সে বলেছিল, “আমি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের দিদি। ” গোটা পরিবার একসাথে তার উদ্বেগ, আশঙ্কানিমেষে চকলেটের মতো সমান ভাগ করে নিয়েছিল। লম্বা করিডোরটায় শোকের ছায়া নেমে এসেছিল, পরিবারের সবাই সেই ছায়ার তলায় ধূসর মুখে দাঁড়িয়ে, যা দেখে বহিরাগত হয়েও দীপার অনেক দিন পর নিরাপদ লেগেছে নিজেকে। মনে হয়েছে সেও একা নয়। ওই আটটি মানুষ তার সব দায় দায়িত্ব সমানভাবে যেন বহন করবে। দীপাকে তারা অজান্তেই আগলে ফেলেছেন যেন,- ঠাকুমা বলেছেন, “কৃষ্ণ তো ঠাকুর গো, কতদিন সকালে আগে এসে পড়েছে, বাবু ঘুমায় তখনও। আমি চুপি চুপি মহাভারতখানা নিয়ে এসেছি। বিনা বাক্যব্যয়ে আমায় সঙসকৃত শ্লোকের মানে বুঝিয়েছে। আমায় তাজা পীরের ডেরা থেকে বাতের তেলখানা এনে দিয়েছে প্রতি মাসে, এরা কেউ কিচ্ছুটি টের পায়নি। ”
দীপা অবাক হয়েছে, “সংস্কৃত!” পিকু সংস্কৃত জানলো কবে থেকে!
মা বলেছেন, “নিজে মুখে একটিবারও মাইনে চায়নি। একবার তো একমাসে দিতেই ভুলে গেলুম! দেখি পর পর চারদিন লেট করে আসছে, জিজ্ঞেস করে করে তারপর জানলুম বাসভাড়া দিতে পারছে না! কি লজ্জা বলুন তো! খুব ফায়দা লুটেছি আমরা আপনার ভাইয়ের। সেদিন লজ্জায় ক্ষমা চাইতে পারিনি, আপনার কাছে আজ চেয়েনিলুম। ”
দীপা বিব্রত বোধ করেছে, একই সাথে জীবনে প্রথমবার নিজে হাতে বড় করে তোলা ভাইয়ের প্রশংসা শুনে গর্বও হয়েছে তার।
জ্যেঠু রেশ ধরেছেন কথার, “আমরা জানতেই পারতাম না যে ওনার পুরো নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আমরা কৃষ্ণ স্যার বলেই চিনতাম। আমার ভাইঝি আবার আড়ালে ডাকত কৃষ্ণসার!”
কোণার চেয়ার থেকে বাবুর বাবা বলে উঠলেন, “দাদা! লঘু কথা না বলে উনি কি জানতে চান দেখ। ওনার সাহায্য কর!”
দীপার মুখের দিকে সবাই তাকিয়ে। দীপা খুব হাল্কা গলায় বলে, “আপনাদের এখানে না এলে জানতেও পারতাম না আমার অপদার্থ ভাইটা এত প্রশংসার দাবী রাখে। বাস্তব বুদ্ধি খুব কম, বুঝলেন! আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট। এত আগলে আগলে রেখেছি যে দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণাই হয়নি ওর। আর ভাবুন আজ সে এই বিরাট শহরের কোন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ” সে আর কান্না সামলাতে পারে না। সেন পরিবার নিরুত্তর তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
পরিস্থিতি সহজ করতে ছোটকাকি বলে ওঠেন, “বাবু, চকোলেটটা সাবাড় করে ফেলেছ, না আছে এখনও?”
বাবু অভিযোগের স্বরে বলে, “আমি আর ছোট আছি নাকি যে চুরি করে খাবো?”
বাবুর ছোড়দা বলে, “গতকালই তো ছাদ থেকে আচার চুরি করে খাচ্ছিলি, আজকেই বড় হয়ে গেলি!”
বাবু লজ্জা পায়, ঘর থেকে চকোলেট নিয়ে আসে। কি অদ্ভুত উপায়ে যে ও খালি হাতে চকোলেটটা সমান সমান ভাগ করে সবাইকে দিলো ভেবে দীপা অবাক হয়।
ঠাকুমা বলেন, “মেয়েটার জন্যেও রাখ একটুকু!”
মা বলেন, “এই বৃষ্টি বাদলার মধ্যে সে কোথায় পড়ে আছে কে জানে। আমার মেয়ে, কলেজে পড়ে। ”
কোণার চেয়ার থেকে বাবুর বাবা বলেন, “ছাড়না ওর কথা। কাজের কথা বল। ”
ছোটকাকি বলেন, “হ্যাঁ, বলুন আপনি, কী জানতে চান। ”
“ও কোথায় থাকত সে সম্পর্কে কিছু জানিয়েছিল আপনাদের?”
জ্যেঠু বললেন, “বাবু এসব ভালো বলতে পারবে। ওর সাথেই তো সবচেয়ে বেশি ইন্টার্যাকশান হতো কৃষ্ণর। ”
বাবু ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট হয়েও অনেক ইমম্যাচিওর। অথবা ওর সারল্যটা কাটেনি এখনও। মানসিকভাবে প্রথাগত পুরুষ হয়ে উঠতে এখনও দু তিন বছর লেগে যেতে পারে। কোথাও পিকুর সাথে বাবুর মিল আছে,- মনে হতে লাগলো দীপার। মাতৃমুখী ছেলেটা পিকুর মতোই প্যাঁচপয়জারহীন। পিকুর মতো এরও দিদি আছে। কে জানে সে বাবুর খেয়াল রাখে কিনা। দেরী করে স্কুল থেকে ফিরলে, পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে চিন্তা করে কিনা। দীপার আবার কান্না পায়।
কান্না চেপে সে বলে, “বাবু, তোমার কৃষ্ণ স্যার সম্পর্কে যা যা জানো বলবে আমায়?”
দীপা জানতে পারে পিকুর মেসের কথা, যেখানে প্রায় একশো পায়রা পোষা হয়, পায়রার ঘরের পাশে পিকুর খোপ, তাতে একটাই জানালা যার সামনে অথচ নাগালের বাইরের কুল গাছে পাখি নির্জন বাসা বেঁধেছে। যে সময় পায়রা পোষার সখ জেগে উঠেছিল সেসব সময়ে পায়রা সম্বন্ধে খোঁজ খবর করতে কৃষ্ণ স্যার খুব হেল্প করেছে তাকে, বাবু জানায়। এছাড়াও কৃষ্ণ স্যার জন্মদিনে গলিভার ট্রাভেলস দিয়েছে, চাঁদে টিনটিন দিয়েছে। বেকার ছেলেটা এত দূর থেকে শুধু মাত্র টাকার প্রয়োজনে সংস্কৃত পড়াতে আসতো, তার পরেও সে ছাত্রের জন্মদিনে উপহার দেওয়ার শৌখিনতা দেখিয়েছে,- অনেক গর্ব হয় দীপার পিকুর জন্য, অনেক অনেক গর্ব হয়। যদিও বাবার কাছে এসব নির্বুদ্ধিতা, তবু আজ পিকুর জন্য সমস্ত গর্বটা একা ভাগ করে নিতে দারুণ লাগে তার। বৃষ্টি থামার পর যখন সে শহরের রাস্তায় নামে তখন তার খেয়াল হয়, অস্বস্তিটা যেন সেনবাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিল তার জন্য, কোন এক মন্ত্রবলে বনেদি বাড়িটার ভিতরে তার প্রবেশনিষেধ ছিল। এই সব অস্বস্তির দিনেই পিকুকে হারাতে হলো! ছেলেটা কী করছে এখন, কোথায় আছে চিন্তা করতে করতে রাত গভীর হয় শহরের।
“চিত্তে ধৈর্য ধর, রাধে, প্রেম রেখ গোপনে
প্রেম রেখ গোপনে, রাধে, প্রেম রেখ গোপনে। ”
প্রেম রেখ গোপনে, রাধে, প্রেম রেখ গোপনে। ”
বই কিনে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে দিলো না বৃষ্টিটা। কঙ্কাবতীর অভিমান হয়। আজকাল ঘন ঘন অভিমান হয় তার। দোপাটি ইয়ারকি মেরে বলে, “মেয়ে নির্ঘাত প্রেমে পড়েছে। ” কঙ্কাবতীর তখন আবার রাগ হয়। আজকাল মুডও খুব ঘন ঘন বদলাচ্ছে তার। গন্ধটা সত্যিই সন্দেহজনক। সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি ফিরতেই তাই মায়ের সালিশি সভায় হাজিরা দিতে হয় তাকে। “কোথায় ছিলি?”, “কেন ছিলি?”, “কোন বই কিনলি?”, “একটা বই কিনতে এত সময় লাগে!” ইত্যাদি... ইত্যাদি... কঙ্কাবতী নিজের ঘরে পালিয়ে আসতে চায়। অবশেষে আগামীকালের পড়ার অজুহাত দিয়ে ছাড় পাওয়া যায়। কঙ্কাবতীর হিংসে হয় দোপাটির ওপর। অহেতুক স্বাধীনতা পায় মেয়েটা, তাও সময় মেনে বাড়ি ঢোকে, ছবি আঁকতে না বসলে এর অন্যথা হওয়া খুবই ব্যতীক্রমী ব্যপার। ঘরে ঢুকেও স্বস্তি মেলে না কঙ্কাবতীর। গত তিন মাস মায়ের নির্দেশে দক্ষিণের জানলা বন্ধ। কোন ছেলে নাকি উঁকি মেরে তাকে দেখে তাই। ছেলেটা সত্যিই দেখে তাকে মাঝে মাঝে, সেনিজেও টের পেয়েছে। মা জানেনা, কেউই জানেনা যে- কঙ্কাবতীই আগে ছেলেটাকে দেখতে শুরু করেছিল। বিরক্ত হওয়ার বদলে চাপা গর্ব হয়েছে তার। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীনই সে তার স্কুলের বন্ধুদের বলতে পেরেছে, “হ্যাঁ আমাকেও একটা ছেলে আজকাল লাইন মারছে”, পুরো স্কুল লাইফটাই আলুনি কাটেনি। জীবন বিজ্ঞান পড়তে পড়তে যখন ভাজক কলা আর লসিকা বাহ গুলিয়ে যাওয়া পরিস্থিতি হোত তখন তার চোখ সমস্ত সংযম অগ্রাহ্য করে জালনা বেয়ে বাইরে চলে যেত। ছেলেটা হয়তো তখন একমনে আকাশের ঘুড়ি দেখছে বা ছোট মটর গাছটা মিষ্টির হাঁড়িবন্দী করে জানালার সামনে এনে রাখছে। পুরনো দেওয়াল বেয়ে আগাছাগুলো তার ঘরে উঁকি মারে, তাও দিনের পর দিন ছেলেটা তাদের প্রশয় দিয়ে অল্প অল্প করে জল ঢালে। কঙ্কাবতীর ইচ্ছে করে উঠে গিয়ে দুই হাতে উপড়ে নিয়ে আসতে চারাগুলো। জঞ্জাল যত রাজ্যের! সে দেখেছে বৃষ্টি হলেও ছেলেটা জানালা বন্ধ করে না, বসে বসে ছাঁট খায়। আর তারপরের দিন কঙ্কাবতীর পড়ায় বাঁধা দিয়ে বিশাল বিশাল হাঁচি দেয়। ডিসগাস্টিং! জানালা দিয়ে ছেলেটার গোটা ঘরটাই প্রায় নজরে আসে তার। ছেলেটা বেশ গরীব। কাজ কর্মও কিছু করে বলে মনে হয় না। সারাক্ষণই প্রায় বই পড়ে গান গেয়ে কাটায়। তাও যদি সে গান শ্রুতিমধুর হোত। খালি দোপাটির মতো বেছে বেছে বাঙাল ভাষার বাউলগুলো গাইবে আর তার বিন্দুমাত্র কঙ্কাবতীকে বুঝতে দেবে না। খুবই বিরক্তিকর ছেলেটা। এতই রোগা যে মাঝে মাঝে তাকে নিজের চেয়েও ছোট বলে মনে হয় তার। কে জানে ঠিক ঠাক খায় কিনা। আজ অবধি তো রাতে মুড়ি ছাড়া কিছুই খেতে দেখেনি সে তাকে। ওই একবাটি মুড়িতে আর যাই হোক কঙ্কাবতী এত বড় রাত কাটাতে পারত না। তাই হয়তো নিজের ঘরে বসে এগ, চিকেন রোল, ম্যাগি আরও কোনো ফাস্ট ফুড খেতে পারে না সে, খালি মনে হয় হাতে একবাটি মুড়ি নিয়ে ছেলেটা দেখছে হয়তো। একদিন দুপুরে অঙ্ক করতে করতে, মনে মনে, আঙুলের মাথায় লেগে থাকা জলপাইয়ের আচারের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে ছেলেটার সাথে চোখাচুখি হয়। তার পর থেকেই কঙ্কাবতী দেখেছে ছেলেটাও ঘুড়ি ওড়ান দেখতে গিয়ে রোজ অন্তত একবার করে তার ঘরের দিকে তাকাবেই। এক সপ্তাহ পর তাকে অবাক করে দিয়ে মটর গাছের পাশে একটা নতুন টব এলো, তাতে কিছু দিন পরে কোলকাতার সবচেয়ে লাল গোলাপটা ফুটলো। তখনই সাবধান হয়েছিল কঙ্কাবতী, মায়ের নজর লাগলে ফুল ঝরে শুধু কাঁটাগায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গাছটার একবেলাও লাগবে না। ছেলেটা আবার এর মধ্যে কোত্থেকে বাঁশি যোগাড় করেছে একটা! যেসব বিকেলে কঙ্কাবতী পড়ে না, বেছে বেছে তখনই সে বাঁশি বাজায়। ছেলেটার আর সব কিছু বিরক্তিকর লাগলেও এই সময়ে কঙ্কাবতী আর প্রতিরোধ করতে পারে না নিজেকে, ইচ্ছে হয় ছেলেটাকে খুব ভালোবাসে, বিকেলের ফাস্টফুডগুলোর কিছুটা ভাগ ওকে দেয়, ওর ঘরে গিয়ে ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে আসে, যা অগোছালো! আর আসার আগে অবশ্যই দুই হাত দিয়ে দেওয়ালের আগাছাগুলো টেনে ছিঁড়ে দিয়ে আসে।
মায়ের বারণে কঙ্কাবতী অনেক দিন, অনেক দিন ছেলেটাকে দেখেনি। উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ এসবের ফাঁকে কোথায় হারিয়ে গেল জানালার অধ্যায়গুলো! কঙ্কাবতীর কান্না পায়। কতদিন অবহেলা করেছে ও ছেলেটাকে! বেচারা! জানালা বন্ধ করে দেওয়ার পর আর বাঁশির আওয়াজ বা গান কিছুই শোনা যায়নি। হয়তো কষ্টও পেয়েছে ও! কঙ্কাবতী সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে দক্ষিণের জানালা খুলে দেয়। বৃষ্টি শেষের দমকা হাওয়া সারা ঘরে ছেয়ে যায়, আরাম লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বহুদিন বন্ধ থাকায় ওবাড়ির পায়রাগুলো যা নোংরা করে রেখেছে জানালার সামনেটা! ইস! মুখ তুলে কঙ্কাবতী ওপাশের জানালা দিয়ে তাকায়। জানালা বন্ধ! গত তিন বছরে এই প্রথম। খুব শূন্য লাগে চারদিক। শূন্যতা বাড়িয়ে আরও ঠান্ডা আর্দ্র হাওয়া এসে শীত লাগিয়ে দেয় তার গায়ে। কঙ্কাবতী দেখে জানালার আর নাগালের বাইরের কুল গাছটায় একটা পাখির বাসা,- একটু আগের বৃষ্টিতেই যা ভেঙে গিয়েছে।
(চলবে...)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন