শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১২

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি
খামচানো কালপৃষ্ঠা

শ্যাল আই ?

মালিশ কথাটা শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় 'প্যায়াসা' ফিল্মে জনি ওয়াকারের অভিনয় ও মোহম্মদ রফির গান, 'সর যো তেরা চকরায়ে' । ছোটো শহরগুলোয় এখনও মালিশওয়ালাদের দেখতে পাওয়া যায়, হাতে তেলের শিশি নিয়ে 'চম্পি'র খদ্দেরের খোঁজে । কলকাতায় ময়দানেও দেখেছি বছর দশেক আগে ; এখনও আছে কিনা জানি না । এই জনিওয়াকারি মালিশ সনাতন ভারতের নাকি আরবদেশ থেকে এসেছিল ? বোধহয় সনাতন ভারতেরই আরামখোরদের আবিষ্কার । কেননা জনিওয়াকারি মালিশ তো তেল ছাড়া হবে না । কেরালাতেও আজকাল আয়ুর্বেদিক ম্যাসাজ করাতে বিদেশ থেকে ট্যুরিস্টরা আসেন । তাতেও তেল লাগে । হয়ত আদি শঙ্করাচার্য এত বেশি হাঁটাচলা করতেন যে তিনিই তেল-মালিশ ব্যাপারটার জন্মদাতা । তবে মালিশ আর ম্যাসাজ শব্দ দুটি একই ধরণের কাজ বা কুকাজের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে দেখে মনে হল যে ম্যাসাজ প্রক্রিয়াটার অন্য নাম থাকা দরকার ছিল । ভারতের উত্তরউদারনীতি আক্রান্ত শহরগুলোয় স্পা দেখা দিয়েছে , যেখানে নানারকম আরাম বিক্রি করা হয় নারী বা পুরুষ শরীরের জন্যে । এয়ারপোর্টগুলোয় দেখেছি পা টেপানোর স্পা রয়েছে, যাত্রীরা এদেশ-সেদেশ করার ফাঁকে পা টিপিয়ে নেন । ওগুলো হল পাশ্চাত্য কায়দার 'স্কুপিং' পদ্ধতির ডলারি মালিশ , যত আড়ম্বর তত আরামদায়ক সেবা পাওয়া যায় না ।


যুবক কবি-লেখকরা যদি বিদেশে যেতে চান, বিদেশে যেতে হলে, আমার মনে হয়, কম বয়সেই যাওয়া ভালো । আরও ভালো অবিবাহিত থাকার সময়ে যাওয়া । কেননা যত পারা যায় অভিজ্ঞতা এই সময়েই যোগাড় করে নিলে তা পরে ম্যাজিক-বাস্তব জগত গড়তে কাজে দেবে । যুবাবস্হায় আমার পকেটে খুচরোও থাকত না ; রোজগেরে হবার পর বিদেশগুলোয় যখন গেছি তখন, মগজ চাঙ্গা থাকলেও, মাংসের তাপ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । অত হাঁটতে পারি না ; সিঁড়ি চড়তে পারি না ; সবরকম মাংস খেয়ে হজম করতে পারি না ; পেগের পর পেগ মদ, জাগের পর জাগ বিয়ার খেতে পারি না ; ইচ্ছানুযায়ী মাদকসেবন করতে পারি না । আর নারীসঙ্গের কথা তো বাদই দিতে হয় ।

ম্যাসাজের প্রসঙ্গ এলে থাইল্যান্ডের 'নুয়াড বো রান' পদ্ধতির কথা বলতেই হবে । থাইল্যাণ্ডের ম্যাসাজ একটি প্রধান রোজগারস্রোত হয়ে উঠেছে সে-দেশটায় । ম্যাসাজ শেখাবার সংস্হা আছে, বিশেষজ্ঞ আছেন । আমেরিকানরা ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমোদ-প্রমোদের জন্যে আশেপাশের দেশে যাওয়া আরম্ভ করলে থাইল্যান্ডের পাট্টায়ায় নারীসঙ্গ, ম্যাসাজ আর ভোজন তাদের কাছে ডলার খরচের প্রয়োজনীয় ভোগপথ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । পাট্টায়া ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় গো-গো বার গজিয়ে ওঠে । গো-গো বারে গিয়ে কোনও তরুণীকে পছন্দ হলে তাকে সেই রাতের জন্য বা বহু রাতের জন্য সঙ্গিনী করে নেয়া যায়, বার-মালিককে তরুণীটির অনুপস্হিতির জরিমানা দিয়ে । পাট্টায়া, ব্যাংকক ইত্যাদি শহরের হট জোনে কাঁচের দেয়ালের ওপাশে কেবল থং-পরা কচি-কচি তরুণীরা দাঁড়িয়ে থাকেন, রাতপ্রেমিকদের ডাকের আশায় । স্বাভাবিক যে থং পরে দাঁড়িয়ে যখন খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে তখন তারা তো কেবল ম্যাসাজ করবে না, আরও অনেককিছু করবে ।
তার আগেও থাইল্যাণ্ডে পেশা হিসাবে মালিশ ব্যাপারটা থাকলেও, তার তেমন করকরে বাজার ছিল না । মালিশ থাইল্যাণ্ডে গিয়েছিল বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে । বৌদ্ধভিক্ষুদের পরিব্রজনে ক্লান্ত পা দুটিকে আবার চাঙ্গা করে তোলার জন্য ভারতেই আবির্ভাব হয়েছিল এই মালিশের, অর্থে এখন যাকে বলা হচ্ছে থাই মালিশ পদ্ধতি । গৌতম বুদ্ধের শিষ্য ও চিকিৎসক শিভাগা কোমারপাজ ( জীবক কুমারভট্ট ) হলেন থাই ম্যাসাজপদ্ধতিত জনক । ব্যাংককের ওয়াট ফো মন্দিরের দেয়ালে খোদাই করা আছে দেহের কোন-কোন জায়গায় হাত, কনুই, বাহু আর পা দিয়ে ম্যাসাজ করতে হবে । বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের বদলে ম্যাসাজ করেন থাই তরুণীরা ; অবশ্য তাঁরাও বৌদ্ধ । থাই ম্যাসাজ পদ্ধতিতে বিন্দু-নির্ভর চাপ, অ্যাকুপ্রেশার, পেশি-প্রসারণ আর সংকুচন করা হয় , তালে-তালে , হালকা সঙ্গীতের আবহে ।

থাইল্যান্ডে যখন এসেছি তখন থাই ম্যাসাজ না করিয়ে তো আর ফেরত যাওয়া যায় না, বিশেষ করে যখন শুনলুম যে আরথ্রাইটিস, বায়ুদোষ, মাইগ্রেন, পিঠব্যথা ইত্যাদি সারাবার-কমাবার জন্য অব্যর্থ । একবার ম্যাসাজ করালে দেহে ছয় মাস টানা এনার্জি থাকবে ! আমাদের দেশের মালিশের মতন সস্তা নয় কিন্তু থাই ম্যাসাজ । আমি দুই ঘণ্টার জন্য খরচ করেছিলুম দেড় হাজার টাকা ; এখন শুনি আরও বেশি দিতে হয় । প্রায়ান্ধকার সারি-সারি শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘর ; মাটিতে শাদা ধবধবে বিছানা পাতা । প্যান্ট ছেড়ে শাদা লুঙ্গি পরতে হল ; শার্ট ছেড়ে ঢোলা বুশশার্ট । কাকে দিয়ে ম্যাসাজ করাতে চাই তা বেছে নেয়া যায় ; তার কারণ , মানসিক আনন্দও চাই তো ! ম্যাসাজ আরম্ভ হল । যেমন যেমন নির্দেশ পাচ্ছিলুম, সেইমতো একবার উপুড় একবার এপাশ একবার ওপাশ করে-করে চলল ম্যাসাজ । বেশ আরামদায়ক , কোনো সন্দেহ নেই । পায়ের পাতা থেকে একজন তরুণীর দুটি হাত একটু-একটু করে ওপর দিকে উড়তে লাগল, বহুক্ষণ ধরে । ঘুমিয়েই পড়েছিলুম বলা যায় ।
হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে গেল । আমার কুঁচকির কাছে অর্ধচন্দ্রাকারে হাত দুটি এনে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, "শ্যাল আই?"

1 টি মন্তব্য:

  1. সত্যি! অভূতপূর্ব...
    এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে বাধ্য হলাম।
    অসাধারণ এই ডায়েরি।

    উত্তরমুছুন