বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

বেনুর সঙ্গে ইডেনবনে - অশোক দেব

বেনুর সঙ্গে ইডেনবনে
অশোক দেব


বেনজির ভুট্টো তো দেখি আমার থেকে লম্বা! কেমন সংকোচ হচ্ছে। নচিকেতা পেছন থেকে এক ঠেলা দিতেই আমি গিয়ে পড়লাম তার বুকে। এ নচিকেতা কিন্তু জীবনমুখী না, এ হল মৃত্যুমুখী নচিকেতা। নিতান্ত বালক। কয়েকদিন থেকে শুনছি পৃথিবীর শেষ । ধ্বংস হয়ে যাবে ইংরাজি সিনেমার ঢঙে। মাত্র চালশে চলছে, কত ফস্টি বাকি, অনেক নস্টিও তো করা হল না। তাই চান্স পেলেই একমনে নচিকেতার ধ্যান করতে লাগলাম। দেবতারা নিশ্চয়ই ব্যস্ত। লবি করতে হলে এ ছেলেটাকে ধরলেই কাজ হবে বলে মনে হল। কী বাঘা বাঘা প্রশ্ন করে ছেলেটা! কে না জানে, বেশি যে প্রশ্ন করে সে আসলে ইমপরটেন্স চায়। এদের পটাতে সুবিধা। তাই হাঁটতে চলতে, উঠতে বসতে শুধু নচিকেতার ধ্যান। বৌ আমার ঢুলুঢুলু চোখ দেখে মনে করে মদ ছেড়ে এখন গাঁজা ধরেছি। মনে মনে বলি, কাঁহা তুম, কাঁহা বেনজির!

শনি না মঙ্গলবার মনে নেই। সন্ধ্যাবেলা একটা ছেলে এসে কোত্থেকে সামনে দাঁড়াল। স্পাইক করা চুল দেখলে মেজাজ খিঁচড়ে যায়, ‘অ্যাই তুই কেডা?’ বলতেই সে প্রশ্ন করল, ‘এ জগতের শেষ হলে কি সৃষ্টি শেষ হয়ে যাবে?’

- ভাই ভাই আমার অন্যায় হইয়া গেছে, তুমি...মানে আপনি নচিকেতা?

- হুম, বাট ইয়ু ক্যান কল মি নচি, ক্যান্ট ইয়ু?

নচি ফচি কাম নাই, আমি একটু হেই পার যাইতে চাই।

-কেন?

-না, মানে...

-আমি কি জানি না ভেবেছ?

শালা খালি প্রশ্ন করে কথা বলে। জানলে তো চুকেই গেল। নিয়ে চল। মনে মনে বলি। মুখে ঝোলাই পানসে হাসি।

- চন্দ্রপুর বাসস্টপ চেন না? সেখানে হেঁটে যেতে পারবে তো? কত অটো আছে না? জোড়সংখ্যার নম্বরের যেকোনও একটাতে উঠতে পারবে?

- পারব।

- ওকে। উঠে মনে মনে এই মন্ত্রটা বলতে পারবে না? বলেই কানে কানে একটা মন্ত্র ফুঁকে দিল।

চন্দ্রপুর বাসস্টপ থেকে ২১১২ নম্বরের অটোতে চেপে, মন্ত্র বলার সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে একটা ষাঁড় ডেকে উঠল। তারপর কিছু মনে নেই, দেখি আমি এখানে। সামনে বেনজির ভুট্টো, পেছনে নচিকেতা।

মায়া না কে জানি একটা ক্যালেন্ডার বানিয়েছে। তাতে পৃথিবীর এক্সপায়ারি ডেট ২১ ডিসেম্বর ২০১২। এটা জানতে পেরেই কচিকলাপাতাকাল থেকে ফেনাটিসাইজ করে আসা বেনজিরের সঙ্গে ডেটে যাবার বাসনায় নচিকেতাবন্দনা শেষ পর্যন্ত সাকসেস। কিন্তু টিউবলাইটের মত ফর্সা বেনজির দেখি আমার থেকে লম্বা।

নচির ধাক্কা খেয়ে আপাতত আমি তার বক্ষে। কী সুন্দর গন্ধ! এত ছিন্নভিন্ন হয়ে যে মারা গেছে কোথাও কোনও চিহ্ন নেই। স্বর্গীয় পার্লারে সব ঠিকঠাক করিয়ে নিয়েছে মনে হয়। একটা পাতলা চুল আমার কানের কাছে সুরসুরি দিতেই চকাম করে তার গালে দিলাম এক চুমু বসিয়ে। ইয়া খুদা কিতনা বদমাশ লেড়কা হায়... হিহি করে বলে উঠল বেনজির। লেড়কা, আমি লেড়কা... বেনু, আমার বেনু। কলার ধরে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিল কে? কে আবার, নচিকেতা।

- বসের সঙ্গে দেখা করবে না? তার আগেই চকাম চকাম শুরু?

- কে বস? কেডা?

- ইয়ম ইয়ম, যেতে হবে না?

ইস, এলাকা যমের, তার সঙ্গে একটু দেখা না করলে চলে? গেলাম। আরে, একে দেখি সঞ্জয় দত্তের মত দেখতে। প্রণাম করলাম। অবাক কাণ্ড, তার চকচকে জুতোয় নিজের মুখ দেখলাম। অবিকল শাহেদ কাপুর।

- হুম... কবি? কবিতা লেখেন? যমরাজ আমাকে আপনি করে কথা বলছেন, অবাক... কবিতা লিখি তো ...

- উঁ

- বলুন তো, আমরা সব গর্বিত বাঞ্চোতের দল, কার কথা? ফরাসি কবি জোয়ান কিলদের লেখা পড়েছেন?

কুঁকুঁ করে একটা আওয়াজ বেরোল আমার কণ্ঠ হতে শুনতে পেলাম

- ও,বাঙ্গাল তো... আচ্ছা, অনন্ত খুচরোজ্জমান খোকার পাল্কিনামা পড়েছেন?

-কুঁকুঁ...

শালা আঁতেল মইরা যম হইছে দেখি। কবি টবি কিছু না, আঁতেলরা নিজের ছেলেকেও আপনি করে কথা বলে। আমি কী করি! পড়েছি আতান্তরে

- ছোঁরীয়েঁ নাঁআআআ... বলে আহ্লাদে বাঁচাল বেনজিরই। আমাকে যমের কবল থেকে ছাড়িয়ে স্লো মোশনে ছুটতে লাগল বেনু আমার বেনু। হিন্দু স্বর্গ, মুসলিম স্বর্গ, ইডেন চৌমুহনী, প্যারাডাইসের মোড় পেরিয়ে আমরা চলে এলাম লাভারস পয়েন্টে। সির একাধারে সিন্নি খাওয়াচ্ছে ফরহাদকে। মজনুভাইয়ের পাজামা সেলাই করছে লাইলিদি। আমাদের পাড়ার নুনুদি নিমাইদার প্রেমে আত্মহত্যা করেছিল, তাকে দেখলাম রাজেশ খান্নার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। এসব দেখছি আর বেনু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্যায়া হুয়া? তার দিকে তাকাতেই চকচক করে উঠল গোলাপি ক্লিভেজ। তারপর আমরা দেশ পত্রিকার উপন্যাসের মত করলাম। সঙ্গে ইলাস্ট্রেসনের যত মুদ্রা আঁকা থাকে সব সব করলাম আমরা। কোথা দিয়ে কেটে গেল এতগুলি দিন। না ক্ষুধা না তৃষ্ণা। বেনজিরের মত মেয়ে হয় না, প্রধানমন্ত্রী, তা-ও শত্রুদেশের, একটুও দেমাক নেই। শরীরও টানটান জিংলাপোড়া সাপ। বহুজননের ক্লেশ সে পৃথিবীতেই ফেলে রেখে গেছে।

শুধু একজনকে দেখলেই সে সিঁটকে যায়। পাঠান ড্রেস পরা লোকটাকেই দেখলেই বোঝা যায়, সে আইএসআইয়ের হবে। বেনুর বর তামাক না জর্দা, সেই কি সুপারি দিয়ে পাঠালো? সেদিন আমরা একটা সানন্দামার্কা কাজ করছিলাম, দেখি সে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। ছুটে গিয়ে কষালাম এক লাথি। সে আমাকে কী জানি কী করল, আমি সোজা পৃথিবীতে। চারদিক থকথকে কাদায় ভরে আছে। শনিগ্রহের ডিসকভারি চ্যানেল থেকে ছবি তুলতে এসেছে একটা টিম। একটা পোকাটাইপের লোক সিলেটি অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলছে। ক্যামেরার দিকে কী একটা চকচকে জিনিস দেখিয়ে সে বলছে, ধ্বংসের আগে পৃথিবীর মানুষ কত সুন্দর অলঙ্কার বানাতে পারত। একটু কাছে গিয়ে দেখলাম একটা নাকছাবি। চোদ্দতম অ্যানিভারসারিতে বৌকে এটা দিয়েছিলাম।

২টি মন্তব্য:

  1. উফ্‌ ! অসাধারণ এক গদ্যে একই সাথে শ্লেষ, কল্পবিজ্ঞান, হতাশা, প্রতিবাদ সব একসাথে পাচিত ক'রে রেয়ার সব মশলার সুগন্ধসহযোগে পরিবেশন করেছেন মহামতি অশোক ! তার কলমের তুলনা নেই, কুর্নিশ জানাই। আধুনিক গদ্যে স্বতঃস্ফুর্ততা প্রাধান্য পায়। শূধু গদ্যে কেন? যে কোন শিল্পেই ! তাই, কোথাও কোথাও সেকেণ্ড বা ফাইনাল টাচের অভাবে উঁচুনীচু হয়েছে কিছুটা। তিলোত্তমা কইতে পারি না এ গদ্যকে ! কিন্তু - মানবিক তো বটেই, এই-ই তো মানুষের জন্মচিহ্ন ! তাছাড়া, পৃথিবি ধ্বংস হয়ে গেলে 'পর আর চিন্তাভাবনার জায়গা-ই কথায় থাকে? অসাধারন এবং শূভেচ্ছা !

    উত্তরমুছুন