চান্দের চর (অষ্টম কিস্তি)
অলোকপর্ণা
তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কোলকাতার সেরা উঠতি সাহিত্যিককে বেছে সবার সামনে তুলে আনতে হবে। দিনরাত হাজার হাজার গল্প, কবিতা পড়ে চলেছেন, বইতে, ম্যাগাজিনে, খবরের কাগজে, ল্যাপটপে, ট্যাবলেটে। মাথা ভরে যাচ্ছে লেখায়। নতুন নতুন চিন্তা ভাবনাগুলো মাথা থেকে উপচে উপচে পড়ে কোলকাতায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর মনে হচ্ছে তিনি লেখাগুলোর তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন আর উপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, দীপা আর পিকু,- হাত ধরাধরি করে।
সেরাত্রে অনেক খুঁজেও পাঁচমাথা চত্তর থেকে তীর্থঙ্কর পিকুর কোনো হদিস পাননি। শেষরাতে চোখের তলায় ঘুম বয়ে এডিটরের অফিসে এসেছেন, তাকে ডেকে এনেছেন হোটেলে আটক হওয়ার ছবি সমেত। জালনা দিয়ে তখন শহরের প্রথম আলোটা এসে পড়ছিল এডিটারের টেবিলে।
“এই নিন দাদা, আপনার ছবি। মোট ছটা পাঠিয়েছে ছেলেটা।”
কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রাখেন তীর্থঙ্কর। এডিটার সহাস্যে তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। অনেক খুঁজলেন তীর্থ, কোথায় পিকু!
“আপনি কার সাথে আমার শ্যালকের মিল পেয়েছেন বলছিলেন?”
এডিটর স্ক্রীণে হুমড়ি খেয়ে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে অবশেষে একজনের দিকে আঙুল তোলেন। তীর্থঙ্কর ছবির নির্দিষ্ট জায়গাটা জুম করেন, একজনকে দেখা যাচ্ছে। ফুলহাতা জামা পড়া, চেহারায় মিল আছে পিকুর সাথে, কিন্তু মুখে? একেবারেই না। লোকটার সারা মুখময় শ্বেতী! ঘুমহীণ রাত আর খবরের শিরোনামের ব্যর্থতায় মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে তীর্থঙ্করের।
“আপনি এই চেয়ারে বসেছেন ক বছর হোল যেন?”
এডিটর থতমত খেয়ে যান, “কেন বলুন তো?”
“আপনি অন্য কাউকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বলে ভেবেছেন, আর সেই কারণে আজ সারারাত আমি নিজের ঘুম বরবাদ করে নর্থ কোলকাতা চষেছি!” এডিটর চেয়ারের এক কোণায় সিঁটিয়ে যান।
“শুধু তাই নয়, আমার তৈরী খবরও নিজ দায়িত্বে আপনি ধ্বংস করলেন! শুনুন, মন দিয়ে,” শান্ত ভাবে তীর্থঙ্কর বলে চলেন, “যদি ভবিষ্যতেও এই চেয়ার স্পর্শ করতে চান তাহলে তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী আর তাঁর খবরকে চোখ খুলে হ্যান্ডেল করুন! কোলকাতা বদলাবার ক্ষমতা রাখে আমার পেন। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর মান আর মন রাখতে না পারলে খরকুটোর মত উবে যাবেন বুঝলেন! মান আর মনের প্রশ্নে আমি নিজের পরিবারকেও রেয়াত করিনি। বুঝে সম্পাদনা করবেন!” এডিটর কে শঙ্কিত করে তিনি বিনাবাক্যে খবরের কাগজের অফিস থেকে বের হয়ে আসেন। জেগে ওঠা কোলকাতা তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই। তীর্থঙ্কর ঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে দেখে যান তার পেনের তলায় শহরটাকে যেন ফালাফালা করে দিচ্ছেন তিনি। দীপা, পিকু, ডঃ ঘোষ কেউ বাদ পড়ছে না। অবশ্য দীপা আগেই ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
তিনি নিজের হাতেই দীপাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে ভেঙেছেন। তীর্থঙ্করের এ নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই। বিয়ের আগে দীপাকে বলাই ছিল তাঁদের মধ্যে আসক্তি কমে গেলে সবার প্রথম কাজ হবে আলাদা হয়ে যাওয়া, তার পরেও যদি নিজেদের আবশ্যিক মনে হয় তখন ফিরে আসার কথা ভাবা যেতে পারে। দীপা শোনেনি। তাই নিজের চোখের সামনে তীর্থকে অন্য নারীর সাথে নিজেরই বেডরুম শেয়ার করতে দেখতে হয়েছে তাকে। তীর্থঙ্কর কিই বা করতে পারেন। শারীরিক সান্নিধ্যে এসে দীপা অসম্ভব জমাট বেঁধে থেকেছে বরাবর। যেন যন্ত্র, না আছে কোনো যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ, না আছে কোনো শিল্প সে দেওয়া নেওয়ার মধ্যে। অথচ দীপা এরকম নয়, মানসিক ক্ষেত্রে সে অসম্ভব ক্রিয়েটিভ। বিছানার ঘেরাটোপে এনে ফেললে নিঃসার, শূন্য এক গহ্বর ছাড়া সে আর কিচ্ছু নয়। প্রথম দিকে ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবা হয়েছে, ওষুধ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়নি। তাই দুটো পথ বেছে নেওয়া নিজেদের জন্য। কোনো সন্তান না থাকায় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হয়নি। দীপা খোরপোশ দাবী করবে না জানা ছিল তাঁর, তাই নিশ্চিন্তে কোর্টরুমে পা রেখেছিলেন তিনি। বিবাহিত জীবনের সপ্তম বর্ষে সব কাজ সেরে মুক্ত হলেন তীর্থঙ্কর। এরপর এক এক করে প্রেমিকা এসেছে, প্রেমিকা গেছে, হিসেব রাখেননি তিনি। কোলকাতার বুকে বসে লিখে গিয়েছেন অনর্গল। আর একসময় লেখার মধ্যে দীপা আর অন্যান্য মেয়েরা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
পুলিশের জীপে ওঠার দুর্ভাগ্য দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর আগে হয়নি। তাই সেখান থেকে নেমে যেন পায়ের তলায় মাটি ফিরে পেল সে। দমদম নাগের বাজার এলাকার মেস, যেমন হওয়া উচিৎ ঠিক তেমনই। ধূসর বাড়িটার গায়ে রঙের আঁচড়ের শেষ দাগটুকু লেগে আছে, দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে অশ্বত্থ চারার নরম হাত লেগেছে, কোনো রকমে একটা অন্ধকার সিঁড়ির পক প্রনালী দোতলার সঙ্গে নীচ তলার সংযোগ বজায় রেখেছে। যেকটা ঘর থাকা সম্ভব এরকম ছোট বাড়িতে ঠিক সেকটা ঘরই সারি বেঁধে রয়েছে, যেন মেস বানানোর জন্যই গোটা বাড়িটা তৈরী হয়েছিল। এই রকম না হলে সে মেসে পিকু থাকতোই না। থাকা সম্ভবও হোত না। মাসে চার পাঁচশো টাকায় এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করার মত নির্বোধও পিকু নয়।
বিকেলের মুখে পুলিশি জীপ দেখে গলিতে লোকেদের উৎসাহ বেড়ে যায়, দীপাকে দেখে সে উৎসাহ সমারোহে বদলায়। ম্যানেজার ভয় আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো ফল মিলছে না। দীপা চারদিক দেখতে থাকে। পিকু পিকু গন্ধটা খোঁজার চেষ্টা করে, কিন্তু দেওয়ালের পানের পিক, গলির নর্দমা আর মেসে ঢোকার মুখে শ্যাওলা ভরা পথ যেন কিছুতেই সেই গন্ধটাকে দীপার কাছে আসতে দিলো না। পরিবর্তে অস্বস্তিটা পসার বিস্তার করে দীপার মনে, মাথায়, কান্না পায় তার। বহুবার বলে বলেও পিকুকে নিজের ফ্ল্যাটে আনা যায়নি। সেই কোন আঠারো বছর বয়সে বাবা বলেছিল খেটে খেতে, সেই অভিমান সে আজও পুষে রেখেছে মনে। এতো অভিমানী ছেলেটা, কোনোদিন বড় হবে না। দীপা ভাঙা রেলিং আঁকড়ে ধরে উপরে আসে। পায়রা নোংরা করে রেখেছে পুরো দোতলাটা। ম্যানেজার গর্ব করে শোনাচ্ছে তার প্রায় একশো পায়রার গল্প। পায়রার ঘরের ঠিক আগে পিকুর ঘর, দীপাকে পিকুই জানিয়েছিল ফোনে। খাবার দেওয়ার ছেলেটা দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথে গুমোট ঘরে বন্দী থাকা পিকুর গন্ধটা দীপার গায়ে আছড়ে পড়ে। আলো না জ্বালালে পুরো ঘর অন্ধকার। ম্যানেজার এসে একমাত্র জালনাটা খুলে দেয়। বাইরে মেঘ, মেঘের আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। সিঙ্গেল খাটের এক কোণায় দলা পাকিয়ে পড়ে আছে বরাবরের শীতকাতুরে পিকুর গায়ে দেওয়ার চাদর, মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা আড় বাঁশি, পিকু বাঁশি বাজানো শিখলো কবে! অবাক হয় দীপা। দেওয়ালে দুই বছর আগেকার ক্যালেন্ডার ঝুলছে। জালনায় জল না পেয়ে শুকিয়ে আসা গোলাপ আর মটর চারা। ছোটবেলার মত এখনো পিকু মিষ্টির হাঁড়িতে মটর চারা বড়ো করে! ছেলেমানুষ! অস্বস্তিটা দীপাকে কাঁদতে দেয়না, না হলে সে জানে যে এই সময়ে পুলিশ, ম্যানেজার সবাইকে উপেক্ষা করে সে কাঁদতে পারতো। কান্নাটাকে গলা বন্দী করে দীপা জালনার কাছে এসে দাঁড়ায়। সামনের কুল গাছে বাবুর কথা মত পাখির বাসাটা পড়ে আছে,- ভাঙা, পিকুর মেসের ঘরটার মত। সব আয়োজন ফেলে রেখে কোথায় হারিয়ে গেল পিকু, এই পাখিগুলোর মত! কান্না চেপে চেপে গলা ব্যথা করতে শুরু করে দীপার। মন ব্যস্ত রাখতে সে জালনা দিয়ে বাইরে তাকায়। সামনেই পাশের বাড়ির জালনা। খোলা। অস্বস্তির সাথে পাল্লা দিয়ে মাথা ব্যথা শুরু হয় তার। জালনা থেকে ফিরে আসতে গিয়েও সে থেমে যায়। ওপাশের জালনা একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দুচোখে অনেক অপেক্ষা নিয়ে সে এসেছে যেন। মেয়েটা দীপাকে দেখেই সচেতন হয়ে সরে যায়। যদিও অলস- নির্বোধ পিকুর দ্বারা প্রেম অসম্ভব তবুও দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় পিকুর সাথে মেয়েটার কোনো সংযোগ ছিল। দৃঢ় সংযোগ যা বিকেলের মেঘের আলোয় শুকনো গোলাপের মত আরও বিষণ্ণ লাল হয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“তুই কে?”
“আমি রেজ্জাক।”
“রেজ্জাক কে?”
“আমি চাইনিজ হোটেলে কাজ করি।”
“আচ্ছা। পড়াশোনা করিস?”
“না”
“কেন?”
রেজ্জাক চুপ করে থাকে। মায়ের মুখটা এক ঝলক ভেসে উঠেই চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায়।
“এরপর থেকে হাসপাতালে খাবার নিয়ে আসার সময় হাত ধুয়ে আসবি। আর জেনে আসবি কোলকাতার বয়স কত, বুঝেছিস?”
হ্যাঁ বলতে গিয়ে পারলে প্রায় পা অবধি মাথা ঝুঁকিয়ে দেয় রেজ্জাক।
“যা, ফিরে যা। হাবুলকে বলবি তোকে স্কুলে দিয়ে আসতে। টাকা লাগলে আমি দেব।”
রেজ্জাক আবার মাথা নাড়ায়।
“কি বলবি বুঝেছিস? আমার নাম বলবি, জানিস আমার নাম?”
“না”
“কি যে করিস... বলবি ডঃ ঘোষ বলেছে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে। যা এবার।”
রেজ্জাক যেন কোনো মতে পাঁচমাথা-মোড়ে-দাঁড়িয়ে-ঢিল-ছোঁড়া-দূরত্বের হাসপাতাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। ডাক্তারটা খুব রাগী। হাবুলদাকে বললে আবার স্কুলে যেতে পারবে রেজ্জাক,- সে জানে। রোজ ভোর বেলা পাঁচ মাথা ঘুরপাক খেয়ে স্কুল বাসগুলো শহরের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, রেজ্জাক দেখেছে। হোটেলের সাদাকালো টিভির অ্যাডের মত ছেলেরা তাতে বসে থাকে- সাদা সাদা। রেজ্জাক বেখেয়ালে দাঁড়িয়ে যায় রাস্তার মাঝে। তার চোখের সামনে দেশনায়কের মূর্তি পাক খেয়ে চলে যাচ্ছে হলুদ বাসগুলো, রেজ্জাক দেখে বাসের জালনায় মা বসে, মা হাসছে, জলে রেজ্জাকের চোখ ভরে যায়। পিঠে জোরে খোঁচা খেতেই সে জল ঝরে পড়ে তার চোখ থেকে। ভারী ঠেলাগাড়ী ঠেলতে ঠেলতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় একটা লোক, রেজ্জাকের প্রতি মন্তব্য করে, “**র বাচ্চা!” জীবনের প্রথম ব্যকরণ বহির্ভূত শব্দ শিখতে শিখতে রেজ্জাক দেখে হলুদ বাসগুলো উবে যাচ্ছে পাঁচ মাথা মোড় থেকে। শহরের রাস্তায় তারই মত বেওয়ারিশ কান্নাটা ফেলে রেখে রেজ্জাক হোটেলের দিকে ছুটে যায়,- হাবুলদা খোঁজ করবে।
“দীপা ম্যাম কাল আমাদের বাড়ীর পাশের মেসে এসেছিলেন পুলিশ নিয়ে।” ক্লাসে বসে কঙ্কাবতী ফিসফিস করে দোপাটিকে জানায়।
মিন ভ্যাল্যু থিয়োরেম কানে ঢোকেনা দোপাটির, “তোদের বাড়ির পাশে?”
“হ্যাঁ, ওই ছেলেটার ঘরে এসেছিলেন, কেন বলতো? ওনার ভাই কি তাহলে মেসটায় থাকতেন?”
“কোন ছেলেটার ঘরে?”
“ওই যে আমার জন্য গোলাপ গাছ এনেছিলো, বলেছিলাম না তোকে... এইচ এস এর পর আর দেখতে পাইনি জালনা দিয়ে...”
“তুই ওনার ভাইকে দেখেছিস?”
“না কি করে দেখবো?”
“কেন টিভিতে তো রোজ দেখায় ছবি,”
“ধুর মা আমায় রিমোট ধরতে দিলে তো, কেন রে?”
“কিছু না,” দোপাটি হঠাৎ চুপ হয়ে যায়, এক হাত দিয়ে ডেস্কে থাকা ব্যাগের মধ্যের বাঁশির অবয়বটা চেপে ধরে,- “তুই দেখিস ছবিটা, আমার মনে হয়,”
“কি মনে হয়? চুপ করে গেলি কেন?” কঙ্কাবতী অধৈর্য হয়ে ওঠে।
প্রবীন প্রফেসর ঘুরে দাঁড়ান, “সেকেন্ড বেঞ্চ, নেক্সট টাইম ইউ টক আই উইল থ্রো ইউ আউট!”
এই সুযোগে দোপাটি চেষ্টা করে সাদা পাতায় ঝাঁপ মারতে, ডুবিয়ে দিতে নিজেকে, কাছাকাছি একটা অংককে কলসি করে সে পৃষ্ঠাটায় ডুব দেয়, তলিয়ে যেতে যেতে দেখে পারে বসে বাঁশিটা কুড়িয়ে নিচ্ছে কঙ্কাবতী। দোপাটি নিশ্চিন্তে চোখ বোজে।
“কিছু দেখলি মেসেটায়?”
বিরক্ত হয় দীপা, অস্বস্তিটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বলে, “না। থাকলেও ওরা রাখবে না কি কিছু দেখার মত!”
“পুলিশ কিছু বলছে?”
দীপা কিছু না বলে মাথা নাড়ায়, সুলগ্না নিজের ক্লাসের ঢুকে পড়ে। ফাঁকা করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরো একা লেগে যায় তার নিজেকে। ক্লাসের পর ক্লাস পার হয়ে যায় সে, লাইব্রেরীর কাছে এসে পড়ে। অস্বস্তির চোখে নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে তার এই হেঁটে বেড়ানো। লাইব্রেরীতে এসে অনাবশ্যক বেরসিক বইগুলো নাড়াচাড়া করে ফেরার পথ ধরে দীপান্বিতা। প্রবীনতম প্রফেসরটি ক্লাস নিচ্ছেন। সেকেন্ড বেঞ্চের কোণায় বসা মুখটা দীপার নজর কেড়ে নেয়,- সেই গান গাওয়া মেয়েটা, কি যেন নাম... মনে পড়ে না। সুলগ্না জানবে। ফিরে আসার জন্য পা বাড়ায় দীপা, নিজেকে বড় হালকা লাগে... দীপা থেমে যায় করিডোরে। মেয়েটা, মেয়েটার কাছে কিছু আছে। নিশ্চয়ই কিছু আছে, নাহলে রেস্টুরেন্টে, কলেজে দুম করে অস্বস্তিটা গায়েব হয়ে যাবে কেন মেয়েটাকে দেখলেই? দীপা আবার ফিরে আসে ক্লাসটার সামনে, লুকিয়ে সেকেণ্ড বেঞ্চের দিকে তাকায়। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় হঠাৎ, অস্বস্তিটা যেন গলা টিপে ধরে, মেয়েটার পাশে পিকুর মেসের পাশের বাড়ির মেয়েটা বসে। নিজেকে অসহায় লাগে দীপার, মাথা ঘুরে যায়, শরতের দুপুর অন্ধকার করে চোখ বুজে আসে তার। মাটিতে পড়ে যেতে যেতে সে দেখে সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে গান গাওয়া মেয়েটা ছুটে আসছে তার দিকে।
অলোকপর্ণা
তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কোলকাতার সেরা উঠতি সাহিত্যিককে বেছে সবার সামনে তুলে আনতে হবে। দিনরাত হাজার হাজার গল্প, কবিতা পড়ে চলেছেন, বইতে, ম্যাগাজিনে, খবরের কাগজে, ল্যাপটপে, ট্যাবলেটে। মাথা ভরে যাচ্ছে লেখায়। নতুন নতুন চিন্তা ভাবনাগুলো মাথা থেকে উপচে উপচে পড়ে কোলকাতায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর মনে হচ্ছে তিনি লেখাগুলোর তলায় চাপা পড়ে যাচ্ছেন আর উপর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে, দীপা আর পিকু,- হাত ধরাধরি করে।
সেরাত্রে অনেক খুঁজেও পাঁচমাথা চত্তর থেকে তীর্থঙ্কর পিকুর কোনো হদিস পাননি। শেষরাতে চোখের তলায় ঘুম বয়ে এডিটরের অফিসে এসেছেন, তাকে ডেকে এনেছেন হোটেলে আটক হওয়ার ছবি সমেত। জালনা দিয়ে তখন শহরের প্রথম আলোটা এসে পড়ছিল এডিটারের টেবিলে।
“এই নিন দাদা, আপনার ছবি। মোট ছটা পাঠিয়েছে ছেলেটা।”
কম্পিউটারের পর্দায় চোখ রাখেন তীর্থঙ্কর। এডিটার সহাস্যে তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। অনেক খুঁজলেন তীর্থ, কোথায় পিকু!
“আপনি কার সাথে আমার শ্যালকের মিল পেয়েছেন বলছিলেন?”
এডিটর স্ক্রীণে হুমড়ি খেয়ে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে অবশেষে একজনের দিকে আঙুল তোলেন। তীর্থঙ্কর ছবির নির্দিষ্ট জায়গাটা জুম করেন, একজনকে দেখা যাচ্ছে। ফুলহাতা জামা পড়া, চেহারায় মিল আছে পিকুর সাথে, কিন্তু মুখে? একেবারেই না। লোকটার সারা মুখময় শ্বেতী! ঘুমহীণ রাত আর খবরের শিরোনামের ব্যর্থতায় মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে তীর্থঙ্করের।
“আপনি এই চেয়ারে বসেছেন ক বছর হোল যেন?”
এডিটর থতমত খেয়ে যান, “কেন বলুন তো?”
“আপনি অন্য কাউকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বলে ভেবেছেন, আর সেই কারণে আজ সারারাত আমি নিজের ঘুম বরবাদ করে নর্থ কোলকাতা চষেছি!” এডিটর চেয়ারের এক কোণায় সিঁটিয়ে যান।
“শুধু তাই নয়, আমার তৈরী খবরও নিজ দায়িত্বে আপনি ধ্বংস করলেন! শুনুন, মন দিয়ে,” শান্ত ভাবে তীর্থঙ্কর বলে চলেন, “যদি ভবিষ্যতেও এই চেয়ার স্পর্শ করতে চান তাহলে তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী আর তাঁর খবরকে চোখ খুলে হ্যান্ডেল করুন! কোলকাতা বদলাবার ক্ষমতা রাখে আমার পেন। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীর মান আর মন রাখতে না পারলে খরকুটোর মত উবে যাবেন বুঝলেন! মান আর মনের প্রশ্নে আমি নিজের পরিবারকেও রেয়াত করিনি। বুঝে সম্পাদনা করবেন!” এডিটর কে শঙ্কিত করে তিনি বিনাবাক্যে খবরের কাগজের অফিস থেকে বের হয়ে আসেন। জেগে ওঠা কোলকাতা তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয় বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই। তীর্থঙ্কর ঘুমে ঢলে পড়তে পড়তে দেখে যান তার পেনের তলায় শহরটাকে যেন ফালাফালা করে দিচ্ছেন তিনি। দীপা, পিকু, ডঃ ঘোষ কেউ বাদ পড়ছে না। অবশ্য দীপা আগেই ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
তিনি নিজের হাতেই দীপাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে ভেঙেছেন। তীর্থঙ্করের এ নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই। বিয়ের আগে দীপাকে বলাই ছিল তাঁদের মধ্যে আসক্তি কমে গেলে সবার প্রথম কাজ হবে আলাদা হয়ে যাওয়া, তার পরেও যদি নিজেদের আবশ্যিক মনে হয় তখন ফিরে আসার কথা ভাবা যেতে পারে। দীপা শোনেনি। তাই নিজের চোখের সামনে তীর্থকে অন্য নারীর সাথে নিজেরই বেডরুম শেয়ার করতে দেখতে হয়েছে তাকে। তীর্থঙ্কর কিই বা করতে পারেন। শারীরিক সান্নিধ্যে এসে দীপা অসম্ভব জমাট বেঁধে থেকেছে বরাবর। যেন যন্ত্র, না আছে কোনো যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ, না আছে কোনো শিল্প সে দেওয়া নেওয়ার মধ্যে। অথচ দীপা এরকম নয়, মানসিক ক্ষেত্রে সে অসম্ভব ক্রিয়েটিভ। বিছানার ঘেরাটোপে এনে ফেললে নিঃসার, শূন্য এক গহ্বর ছাড়া সে আর কিচ্ছু নয়। প্রথম দিকে ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবা হয়েছে, ওষুধ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়নি। তাই দুটো পথ বেছে নেওয়া নিজেদের জন্য। কোনো সন্তান না থাকায় ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে দেরী হয়নি। দীপা খোরপোশ দাবী করবে না জানা ছিল তাঁর, তাই নিশ্চিন্তে কোর্টরুমে পা রেখেছিলেন তিনি। বিবাহিত জীবনের সপ্তম বর্ষে সব কাজ সেরে মুক্ত হলেন তীর্থঙ্কর। এরপর এক এক করে প্রেমিকা এসেছে, প্রেমিকা গেছে, হিসেব রাখেননি তিনি। কোলকাতার বুকে বসে লিখে গিয়েছেন অনর্গল। আর একসময় লেখার মধ্যে দীপা আর অন্যান্য মেয়েরা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
পুলিশের জীপে ওঠার দুর্ভাগ্য দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর আগে হয়নি। তাই সেখান থেকে নেমে যেন পায়ের তলায় মাটি ফিরে পেল সে। দমদম নাগের বাজার এলাকার মেস, যেমন হওয়া উচিৎ ঠিক তেমনই। ধূসর বাড়িটার গায়ে রঙের আঁচড়ের শেষ দাগটুকু লেগে আছে, দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে অশ্বত্থ চারার নরম হাত লেগেছে, কোনো রকমে একটা অন্ধকার সিঁড়ির পক প্রনালী দোতলার সঙ্গে নীচ তলার সংযোগ বজায় রেখেছে। যেকটা ঘর থাকা সম্ভব এরকম ছোট বাড়িতে ঠিক সেকটা ঘরই সারি বেঁধে রয়েছে, যেন মেস বানানোর জন্যই গোটা বাড়িটা তৈরী হয়েছিল। এই রকম না হলে সে মেসে পিকু থাকতোই না। থাকা সম্ভবও হোত না। মাসে চার পাঁচশো টাকায় এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করার মত নির্বোধও পিকু নয়।
বিকেলের মুখে পুলিশি জীপ দেখে গলিতে লোকেদের উৎসাহ বেড়ে যায়, দীপাকে দেখে সে উৎসাহ সমারোহে বদলায়। ম্যানেজার ভয় আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো ফল মিলছে না। দীপা চারদিক দেখতে থাকে। পিকু পিকু গন্ধটা খোঁজার চেষ্টা করে, কিন্তু দেওয়ালের পানের পিক, গলির নর্দমা আর মেসে ঢোকার মুখে শ্যাওলা ভরা পথ যেন কিছুতেই সেই গন্ধটাকে দীপার কাছে আসতে দিলো না। পরিবর্তে অস্বস্তিটা পসার বিস্তার করে দীপার মনে, মাথায়, কান্না পায় তার। বহুবার বলে বলেও পিকুকে নিজের ফ্ল্যাটে আনা যায়নি। সেই কোন আঠারো বছর বয়সে বাবা বলেছিল খেটে খেতে, সেই অভিমান সে আজও পুষে রেখেছে মনে। এতো অভিমানী ছেলেটা, কোনোদিন বড় হবে না। দীপা ভাঙা রেলিং আঁকড়ে ধরে উপরে আসে। পায়রা নোংরা করে রেখেছে পুরো দোতলাটা। ম্যানেজার গর্ব করে শোনাচ্ছে তার প্রায় একশো পায়রার গল্প। পায়রার ঘরের ঠিক আগে পিকুর ঘর, দীপাকে পিকুই জানিয়েছিল ফোনে। খাবার দেওয়ার ছেলেটা দরজা খুলে দেয়। সাথে সাথে গুমোট ঘরে বন্দী থাকা পিকুর গন্ধটা দীপার গায়ে আছড়ে পড়ে। আলো না জ্বালালে পুরো ঘর অন্ধকার। ম্যানেজার এসে একমাত্র জালনাটা খুলে দেয়। বাইরে মেঘ, মেঘের আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। সিঙ্গেল খাটের এক কোণায় দলা পাকিয়ে পড়ে আছে বরাবরের শীতকাতুরে পিকুর গায়ে দেওয়ার চাদর, মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা আড় বাঁশি, পিকু বাঁশি বাজানো শিখলো কবে! অবাক হয় দীপা। দেওয়ালে দুই বছর আগেকার ক্যালেন্ডার ঝুলছে। জালনায় জল না পেয়ে শুকিয়ে আসা গোলাপ আর মটর চারা। ছোটবেলার মত এখনো পিকু মিষ্টির হাঁড়িতে মটর চারা বড়ো করে! ছেলেমানুষ! অস্বস্তিটা দীপাকে কাঁদতে দেয়না, না হলে সে জানে যে এই সময়ে পুলিশ, ম্যানেজার সবাইকে উপেক্ষা করে সে কাঁদতে পারতো। কান্নাটাকে গলা বন্দী করে দীপা জালনার কাছে এসে দাঁড়ায়। সামনের কুল গাছে বাবুর কথা মত পাখির বাসাটা পড়ে আছে,- ভাঙা, পিকুর মেসের ঘরটার মত। সব আয়োজন ফেলে রেখে কোথায় হারিয়ে গেল পিকু, এই পাখিগুলোর মত! কান্না চেপে চেপে গলা ব্যথা করতে শুরু করে দীপার। মন ব্যস্ত রাখতে সে জালনা দিয়ে বাইরে তাকায়। সামনেই পাশের বাড়ির জালনা। খোলা। অস্বস্তির সাথে পাল্লা দিয়ে মাথা ব্যথা শুরু হয় তার। জালনা থেকে ফিরে আসতে গিয়েও সে থেমে যায়। ওপাশের জালনা একটা মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দুচোখে অনেক অপেক্ষা নিয়ে সে এসেছে যেন। মেয়েটা দীপাকে দেখেই সচেতন হয়ে সরে যায়। যদিও অলস- নির্বোধ পিকুর দ্বারা প্রেম অসম্ভব তবুও দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় পিকুর সাথে মেয়েটার কোনো সংযোগ ছিল। দৃঢ় সংযোগ যা বিকেলের মেঘের আলোয় শুকনো গোলাপের মত আরও বিষণ্ণ লাল হয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“তুই কে?”
“আমি রেজ্জাক।”
“রেজ্জাক কে?”
“আমি চাইনিজ হোটেলে কাজ করি।”
“আচ্ছা। পড়াশোনা করিস?”
“না”
“কেন?”
রেজ্জাক চুপ করে থাকে। মায়ের মুখটা এক ঝলক ভেসে উঠেই চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায়।
“এরপর থেকে হাসপাতালে খাবার নিয়ে আসার সময় হাত ধুয়ে আসবি। আর জেনে আসবি কোলকাতার বয়স কত, বুঝেছিস?”
হ্যাঁ বলতে গিয়ে পারলে প্রায় পা অবধি মাথা ঝুঁকিয়ে দেয় রেজ্জাক।
“যা, ফিরে যা। হাবুলকে বলবি তোকে স্কুলে দিয়ে আসতে। টাকা লাগলে আমি দেব।”
রেজ্জাক আবার মাথা নাড়ায়।
“কি বলবি বুঝেছিস? আমার নাম বলবি, জানিস আমার নাম?”
“না”
“কি যে করিস... বলবি ডঃ ঘোষ বলেছে তোকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে। যা এবার।”
রেজ্জাক যেন কোনো মতে পাঁচমাথা-মোড়ে-দাঁড়িয়ে-ঢিল-ছোঁড়া-দূরত্বের হাসপাতাল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। ডাক্তারটা খুব রাগী। হাবুলদাকে বললে আবার স্কুলে যেতে পারবে রেজ্জাক,- সে জানে। রোজ ভোর বেলা পাঁচ মাথা ঘুরপাক খেয়ে স্কুল বাসগুলো শহরের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে, রেজ্জাক দেখেছে। হোটেলের সাদাকালো টিভির অ্যাডের মত ছেলেরা তাতে বসে থাকে- সাদা সাদা। রেজ্জাক বেখেয়ালে দাঁড়িয়ে যায় রাস্তার মাঝে। তার চোখের সামনে দেশনায়কের মূর্তি পাক খেয়ে চলে যাচ্ছে হলুদ বাসগুলো, রেজ্জাক দেখে বাসের জালনায় মা বসে, মা হাসছে, জলে রেজ্জাকের চোখ ভরে যায়। পিঠে জোরে খোঁচা খেতেই সে জল ঝরে পড়ে তার চোখ থেকে। ভারী ঠেলাগাড়ী ঠেলতে ঠেলতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় একটা লোক, রেজ্জাকের প্রতি মন্তব্য করে, “**র বাচ্চা!” জীবনের প্রথম ব্যকরণ বহির্ভূত শব্দ শিখতে শিখতে রেজ্জাক দেখে হলুদ বাসগুলো উবে যাচ্ছে পাঁচ মাথা মোড় থেকে। শহরের রাস্তায় তারই মত বেওয়ারিশ কান্নাটা ফেলে রেখে রেজ্জাক হোটেলের দিকে ছুটে যায়,- হাবুলদা খোঁজ করবে।
“দীপা ম্যাম কাল আমাদের বাড়ীর পাশের মেসে এসেছিলেন পুলিশ নিয়ে।” ক্লাসে বসে কঙ্কাবতী ফিসফিস করে দোপাটিকে জানায়।
মিন ভ্যাল্যু থিয়োরেম কানে ঢোকেনা দোপাটির, “তোদের বাড়ির পাশে?”
“হ্যাঁ, ওই ছেলেটার ঘরে এসেছিলেন, কেন বলতো? ওনার ভাই কি তাহলে মেসটায় থাকতেন?”
“কোন ছেলেটার ঘরে?”
“ওই যে আমার জন্য গোলাপ গাছ এনেছিলো, বলেছিলাম না তোকে... এইচ এস এর পর আর দেখতে পাইনি জালনা দিয়ে...”
“তুই ওনার ভাইকে দেখেছিস?”
“না কি করে দেখবো?”
“কেন টিভিতে তো রোজ দেখায় ছবি,”
“ধুর মা আমায় রিমোট ধরতে দিলে তো, কেন রে?”
“কিছু না,” দোপাটি হঠাৎ চুপ হয়ে যায়, এক হাত দিয়ে ডেস্কে থাকা ব্যাগের মধ্যের বাঁশির অবয়বটা চেপে ধরে,- “তুই দেখিস ছবিটা, আমার মনে হয়,”
“কি মনে হয়? চুপ করে গেলি কেন?” কঙ্কাবতী অধৈর্য হয়ে ওঠে।
প্রবীন প্রফেসর ঘুরে দাঁড়ান, “সেকেন্ড বেঞ্চ, নেক্সট টাইম ইউ টক আই উইল থ্রো ইউ আউট!”
এই সুযোগে দোপাটি চেষ্টা করে সাদা পাতায় ঝাঁপ মারতে, ডুবিয়ে দিতে নিজেকে, কাছাকাছি একটা অংককে কলসি করে সে পৃষ্ঠাটায় ডুব দেয়, তলিয়ে যেতে যেতে দেখে পারে বসে বাঁশিটা কুড়িয়ে নিচ্ছে কঙ্কাবতী। দোপাটি নিশ্চিন্তে চোখ বোজে।
রস খাইয়া হইয়া মাতাল, ওই দেখো
হাত ফসকে যায় ঘরের লাগাম
সেই লাগাম খানা ধরে দেখো কোন জনা কোন জনা...
হাত ফসকে যায় ঘরের লাগাম
সেই লাগাম খানা ধরে দেখো কোন জনা কোন জনা...
“কিছু দেখলি মেসেটায়?”
বিরক্ত হয় দীপা, অস্বস্তিটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বলে, “না। থাকলেও ওরা রাখবে না কি কিছু দেখার মত!”
“পুলিশ কিছু বলছে?”
দীপা কিছু না বলে মাথা নাড়ায়, সুলগ্না নিজের ক্লাসের ঢুকে পড়ে। ফাঁকা করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরো একা লেগে যায় তার নিজেকে। ক্লাসের পর ক্লাস পার হয়ে যায় সে, লাইব্রেরীর কাছে এসে পড়ে। অস্বস্তির চোখে নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে তার এই হেঁটে বেড়ানো। লাইব্রেরীতে এসে অনাবশ্যক বেরসিক বইগুলো নাড়াচাড়া করে ফেরার পথ ধরে দীপান্বিতা। প্রবীনতম প্রফেসরটি ক্লাস নিচ্ছেন। সেকেন্ড বেঞ্চের কোণায় বসা মুখটা দীপার নজর কেড়ে নেয়,- সেই গান গাওয়া মেয়েটা, কি যেন নাম... মনে পড়ে না। সুলগ্না জানবে। ফিরে আসার জন্য পা বাড়ায় দীপা, নিজেকে বড় হালকা লাগে... দীপা থেমে যায় করিডোরে। মেয়েটা, মেয়েটার কাছে কিছু আছে। নিশ্চয়ই কিছু আছে, নাহলে রেস্টুরেন্টে, কলেজে দুম করে অস্বস্তিটা গায়েব হয়ে যাবে কেন মেয়েটাকে দেখলেই? দীপা আবার ফিরে আসে ক্লাসটার সামনে, লুকিয়ে সেকেণ্ড বেঞ্চের দিকে তাকায়। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় হঠাৎ, অস্বস্তিটা যেন গলা টিপে ধরে, মেয়েটার পাশে পিকুর মেসের পাশের বাড়ির মেয়েটা বসে। নিজেকে অসহায় লাগে দীপার, মাথা ঘুরে যায়, শরতের দুপুর অন্ধকার করে চোখ বুজে আসে তার। মাটিতে পড়ে যেতে যেতে সে দেখে সেকেন্ড বেঞ্চ থেকে গান গাওয়া মেয়েটা ছুটে আসছে তার দিকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন