ঊষসী ভট্টাচার্য
“প্রতি মুহূর্তে স্নাতক যে আমি,প্রতি মুহূর্তে শব-
সে আমির মাটি বুক ভেঙে তোলে স্পন্দিত পল্লব।
সে আমিতে এসে হাজার আমির ঢেউ তোলে জাহ্নবী-
পথে আনপথে গঞ্জে বাজারে, আলীন সে –আমি কবি”
লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগানোর এবং স্বাধীনতা বিস্বাদে ভরা উত্তাল এক সময়-পঞ্চাশের দশক। দেশভাগের ম্লান ক্লান্তি ও রাজনীতি, অর্থনীতির নতুন অনিশ্চয়তায় তখন ধুকছে কলকাতা তথা সমগ্র ‘কলকেতিয়া’ সভ্যতা। কিন্তু নতুন কলমে উঠে আসছে না কোন দামাল হাওয়া বা কলমের রক্তাক্ত প্রতিবাদ । যৌন সাহসিকতা ,প্রেমের অহংকার আর অহংকারের প্রেমে মাতাল তখন কবিকুল। সেই সময়ে “দিনগুলি রাতগুলি” কাব্যগ্রন্থের হাত ধরে আবির্ভাব কবি শঙ্খ ঘোষের।‘নিভন্ত চুল্লিতে’ আগুন দিতে ও আরেক টু কাল বেঁচে থেকে বাঁচার আনন্দ নিতে এবং দিতে তিনি এলেন । তিনি বাংলা কবি ও পাঠক সমাজকে যেন বললেন “ একটু নড়ুন, চাপ সৃষ্টি করুন” । বাংলা কাব্য জগতে নতুন রুচি ও সম্ভ্রম নিয়ে এলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের ‘নুরলজিয়ার ব্যাথার’ বাঁশির সুর বুকে গেঁথে তিনি সৃষ্টি করলে আধুনিকতার নতুন মেঘমল্লার । তার কবিতার জবানীতে ভেসে উঠল-
“তুচ্ছ নীল বেদনা যদি ঘনিয়ে ওঠে বুকে,
বেদনাবতী – ধুলোতে তারা লুটোবে তার ও আগে,
আমার প্রতি রক্তকনা কবিতা কর ...
শঙ্খ ঘোষ এর কবিমানস নির্জন ও ঐতিহ্যানুসারী । বিগত দশকের কবি বিষ্ণু দে,সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় , অরুণ মিত্রের যথার্থ উত্তরসূরি তিনি হয়ে উঠলেন তাঁর কলমের জোরে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের পরবর্তি কাব্যগ্রন্থগুলি হোলো- ‘নিহিত পাতাল ছায়া’, ‘আদিম লতাগুল্মময়’, ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’ , ‘বাবরের প্রার্থনা’, , ‘তুমি তো তেমন গৌরি নও’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, প্রহর জোড়া ত্রিতাল’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’, ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’ প্রভৃতি।
‘কবি রে, তোর শূন্য হাতে
আকাশ হবে পূর্ণ-
উদাস পাগল গভীর সুরে
ডাক দে তারে ডাক দে’ ...
কবি শঙ্খ ঘোষ তথাকথিত ঝাঁকযমক পূর্ণ নন ,তিনি থাকেন ‘ আপাত সারল্যের আড়ালে’ । পুড়ে যাওয়া জীবনে, খসে পড়া সমাজে থেকে তিনি পাঠককে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন । এবং কবি কণ্ঠে ভেসে ওঠে “ ধ্বংস করে দাও , আমাকে যদি চাও, / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক”।
দেশকাল সমাজ পরিবেশের ক্রমাগত ভেঙে পড়ার শব্দের পাশাপাশি জীবনের প্রজ্ঞা ও অনুকরণীয় দার্শনিকতায় ঋদ্ধ হয়েছে তার কাব্যচর্চা । টুকরো শব্দের চমকে ঠমকে সংহত পরিসরে তিনি পাঠক মনের গভীরে ডুব দেন – “ প্রতি মুহূর্তে ধান আসক্ত মুঠোয় রাখি ধরে/ তার পরে যায় যদি অবাধ সন্ন্যাসে ঝরে যায়/ এই মাঠে আসে যারা সকলেই বোঝে একদিন/ এক মুহূর্তের মুখ আরেক মুহূর্তে সত্য নয়”
কবি হওয়ার পাশাপাশি তিনি অধ্যাপক,সমালোচক, রবীন্দ্র আলোচক এবং ছান্দসিক।
কবিতায় ছন্দের ব্যাবহার, অন্তমিল এর পাশাপাশি ছন্দের তরঙ্গায়িত খেলা উল্লেখযোগ্য । কখনো শ্লেষের মাধ্যমে কখনো জীবনাভূতি বর্ণনায় তিনি যে বিচিত্র ছন্দের দোলা দিয়েছেন তা বাংলাকবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার ‘বাবুমশাই’ নামক কবিতার ব্যাঙ্গের মাধ্যমে আমরা সেই অপূর্ব দোলা অনুভব করি-
“আমরা ঢের বুঝেছি
আমরা ঢের বুঝেছি, খেঁদি পেঁচি নামের এসব আদর
সামনে পেলেই ভরবে মুখে প্রাণ ভরে তাই সাধো
তুমি সে বন্ধু না,
তুমি সে বন্ধু না যে ধুপধূনা জ্বলে হাজার চোখে
দেখতে পাবে তাকে সেকি যেমন তেমন লোকে ... ।
আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয় মর্জি নিয়ে’। শঙ্খ ঘোষ আধুনিক মর্জির কবি। যিনি আধুনিকতা কে স্বেচ্ছাচার মনে করেননি বা ‘হাংরি’ দৃষ্টিতে আধুনিকতা বিচার করেন নি। তাঁর আধুনিকতা শুনতে পেয়েছে “শব্দ কোরো না/হেসো না বাচ্চা/ চুপ, হাত পা ছুঁড়ো না ।
কবি সম্প্রতি কয়েক বছরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হোলো- “সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি”, “হাসি খুশি মুখে সর্বনাশ” , “ প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে”
বয়সের ভার এবং জীবনের ক্লান্তি তবু কবির হৃদয়ে এক বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। যা পাঠক তথা বাংলা কাব্য জগতে এক যুগের সৃষ্টি করেছে তা বলা বাহুল্য মাত্র। কবি কলমে তাই উঠে এসেছে “ স্মৃতির চেয়ে কোন বাস্তবিক বাস্তুভুমি নেই”
তবু সময়ের ‘লহমা’য় কবির ‘স্বপ্নগুচ্ছ’ কখনই ম্লান হয়না। আধুনিক দরবারে তা হয় প্রতিভাত। তাই আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে শঙ্খ নিনাদ তাঁর মাধুর্যে চিরকাল আসীন থাকবে।
“প্রতি মুহূর্তে স্নাতক যে আমি,প্রতি মুহূর্তে শব-
সে আমির মাটি বুক ভেঙে তোলে স্পন্দিত পল্লব।
সে আমিতে এসে হাজার আমির ঢেউ তোলে জাহ্নবী-
পথে আনপথে গঞ্জে বাজারে, আলীন সে –আমি কবি”
লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগানোর এবং স্বাধীনতা বিস্বাদে ভরা উত্তাল এক সময়-পঞ্চাশের দশক। দেশভাগের ম্লান ক্লান্তি ও রাজনীতি, অর্থনীতির নতুন অনিশ্চয়তায় তখন ধুকছে কলকাতা তথা সমগ্র ‘কলকেতিয়া’ সভ্যতা। কিন্তু নতুন কলমে উঠে আসছে না কোন দামাল হাওয়া বা কলমের রক্তাক্ত প্রতিবাদ । যৌন সাহসিকতা ,প্রেমের অহংকার আর অহংকারের প্রেমে মাতাল তখন কবিকুল। সেই সময়ে “দিনগুলি রাতগুলি” কাব্যগ্রন্থের হাত ধরে আবির্ভাব কবি শঙ্খ ঘোষের।‘নিভন্ত চুল্লিতে’ আগুন দিতে ও আরেক টু কাল বেঁচে থেকে বাঁচার আনন্দ নিতে এবং দিতে তিনি এলেন । তিনি বাংলা কবি ও পাঠক সমাজকে যেন বললেন “ একটু নড়ুন, চাপ সৃষ্টি করুন” । বাংলা কাব্য জগতে নতুন রুচি ও সম্ভ্রম নিয়ে এলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্রনাথের ‘নুরলজিয়ার ব্যাথার’ বাঁশির সুর বুকে গেঁথে তিনি সৃষ্টি করলে আধুনিকতার নতুন মেঘমল্লার । তার কবিতার জবানীতে ভেসে উঠল-
“তুচ্ছ নীল বেদনা যদি ঘনিয়ে ওঠে বুকে,
বেদনাবতী – ধুলোতে তারা লুটোবে তার ও আগে,
আমার প্রতি রক্তকনা কবিতা কর ...
শঙ্খ ঘোষ এর কবিমানস নির্জন ও ঐতিহ্যানুসারী । বিগত দশকের কবি বিষ্ণু দে,সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় , অরুণ মিত্রের যথার্থ উত্তরসূরি তিনি হয়ে উঠলেন তাঁর কলমের জোরে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের পরবর্তি কাব্যগ্রন্থগুলি হোলো- ‘নিহিত পাতাল ছায়া’, ‘আদিম লতাগুল্মময়’, ‘মূর্খ বড় সামাজিক নয়’ , ‘বাবরের প্রার্থনা’, , ‘তুমি তো তেমন গৌরি নও’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, প্রহর জোড়া ত্রিতাল’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’, ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’ প্রভৃতি।
‘কবি রে, তোর শূন্য হাতে
আকাশ হবে পূর্ণ-
উদাস পাগল গভীর সুরে
ডাক দে তারে ডাক দে’ ...
কবি শঙ্খ ঘোষ তথাকথিত ঝাঁকযমক পূর্ণ নন ,তিনি থাকেন ‘ আপাত সারল্যের আড়ালে’ । পুড়ে যাওয়া জীবনে, খসে পড়া সমাজে থেকে তিনি পাঠককে সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন । এবং কবি কণ্ঠে ভেসে ওঠে “ ধ্বংস করে দাও , আমাকে যদি চাও, / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক”।
দেশকাল সমাজ পরিবেশের ক্রমাগত ভেঙে পড়ার শব্দের পাশাপাশি জীবনের প্রজ্ঞা ও অনুকরণীয় দার্শনিকতায় ঋদ্ধ হয়েছে তার কাব্যচর্চা । টুকরো শব্দের চমকে ঠমকে সংহত পরিসরে তিনি পাঠক মনের গভীরে ডুব দেন – “ প্রতি মুহূর্তে ধান আসক্ত মুঠোয় রাখি ধরে/ তার পরে যায় যদি অবাধ সন্ন্যাসে ঝরে যায়/ এই মাঠে আসে যারা সকলেই বোঝে একদিন/ এক মুহূর্তের মুখ আরেক মুহূর্তে সত্য নয়”
কবি হওয়ার পাশাপাশি তিনি অধ্যাপক,সমালোচক, রবীন্দ্র আলোচক এবং ছান্দসিক।
কবিতায় ছন্দের ব্যাবহার, অন্তমিল এর পাশাপাশি ছন্দের তরঙ্গায়িত খেলা উল্লেখযোগ্য । কখনো শ্লেষের মাধ্যমে কখনো জীবনাভূতি বর্ণনায় তিনি যে বিচিত্র ছন্দের দোলা দিয়েছেন তা বাংলাকবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তার ‘বাবুমশাই’ নামক কবিতার ব্যাঙ্গের মাধ্যমে আমরা সেই অপূর্ব দোলা অনুভব করি-
“আমরা ঢের বুঝেছি
আমরা ঢের বুঝেছি, খেঁদি পেঁচি নামের এসব আদর
সামনে পেলেই ভরবে মুখে প্রাণ ভরে তাই সাধো
তুমি সে বন্ধু না,
তুমি সে বন্ধু না যে ধুপধূনা জ্বলে হাজার চোখে
দেখতে পাবে তাকে সেকি যেমন তেমন লোকে ... ।
আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয় মর্জি নিয়ে’। শঙ্খ ঘোষ আধুনিক মর্জির কবি। যিনি আধুনিকতা কে স্বেচ্ছাচার মনে করেননি বা ‘হাংরি’ দৃষ্টিতে আধুনিকতা বিচার করেন নি। তাঁর আধুনিকতা শুনতে পেয়েছে “শব্দ কোরো না/হেসো না বাচ্চা/ চুপ, হাত পা ছুঁড়ো না ।
কবি সম্প্রতি কয়েক বছরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হোলো- “সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি”, “হাসি খুশি মুখে সর্বনাশ” , “ প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে”
বয়সের ভার এবং জীবনের ক্লান্তি তবু কবির হৃদয়ে এক বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। যা পাঠক তথা বাংলা কাব্য জগতে এক যুগের সৃষ্টি করেছে তা বলা বাহুল্য মাত্র। কবি কলমে তাই উঠে এসেছে “ স্মৃতির চেয়ে কোন বাস্তবিক বাস্তুভুমি নেই”
তবু সময়ের ‘লহমা’য় কবির ‘স্বপ্নগুচ্ছ’ কখনই ম্লান হয়না। আধুনিক দরবারে তা হয় প্রতিভাত। তাই আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যে শঙ্খ নিনাদ তাঁর মাধুর্যে চিরকাল আসীন থাকবে।
মন ছোঁয়া লেখা।
উত্তরমুছুনbah...bhalo laglo.
উত্তরমুছুনaro lekha jeto...otripti rekhe gelo
উত্তরমুছুন