পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ : শব্দের পাঁজরে অনায়াস যাতায়াত
ব্রততী চক্রবর্তী
কবিতা আবৃত্তি ছেড়ে তখন কবিতা পড়া শুরু সবে । হোস্টেলের লাইব্রেরী থেকে হাতে এলো পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ । অবাক শব্দেরা, বিমুগ্ধতায় ভাবনারা । শুকনো পাতা সরিয়ে বুকের ভিতর নতুন আবিষ্কার । মেদহীন, ছিপছিপে সোজা সাপটা কিছু কথা, বাহুল্য বর্জিত কিছু ভাব, অলঙ্কার বিহীন কিছু আবেগ সামনে এসে দাঁড়ায় ।
              
ব্রততী চক্রবর্তী
কবিতা আবৃত্তি ছেড়ে তখন কবিতা পড়া শুরু সবে । হোস্টেলের লাইব্রেরী থেকে হাতে এলো পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ । অবাক শব্দেরা, বিমুগ্ধতায় ভাবনারা । শুকনো পাতা সরিয়ে বুকের ভিতর নতুন আবিষ্কার । মেদহীন, ছিপছিপে সোজা সাপটা কিছু কথা, বাহুল্য বর্জিত কিছু ভাব, অলঙ্কার বিহীন কিছু আবেগ সামনে এসে দাঁড়ায় ।
 " আমার শরীরে কোন গান নেই। কাঠুরেরা আসে 
 একে একে কেটে নেয় মরা ডাল গুঁড়ি ও শেকড় 
 তার পড়ে ফেলে রাখে মাঠের পশ্চিম পাশে, আর 
 দূরের লোকেরা এসে ধুলোপায়ে বেচাকেনা করে " 
 শঙ্খ ঘোষ আত্মমগ্নতার কবি । নিজেকে খুঁড়ে অমৃত ধারার সন্ধান । তার মৃদু উচ্চারণ সজোর ঝাঁকুনিতে পাঠকের অন্তরের অন্দরমহলে করাঘাত করে । নিজেকে ঘিরে যে প্রশ্নে কবি হৃদয় আলোড়িত, মুহূর্তে তা সার্বজনীন হয় ; আমাদের বুকের খাঁচায় তীক্ষ্ণ আঘাত - 
 "আমি আছি এই শুধু । আমার কি কথা ছিল কোনো ?
 যতদূর ফিরে ছাই আদি থেকে উপান্ত অবধি 
 কথা নয়, বাঁচা দিয়ে সমূহ প্রবাহ পাব বলে 
 এই দুই চোখ ভিজিয়ে নিয়েছি অন্ধকারে"
 অথবা 
 "এইসব যাওয়া আসা কিছু কষ্ট রেখে যায় শ্যাম বিকাশের অন্য পারে
 কোথায় চলেছি আমি ? পৃথিবী বা কত দূরে যাবে?
 আমারই নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছি এ ঘর
 হৃৎপিণ্ডে অন্ধকার ঢেলে এই দুই হাত বারিয়ে বলেছি : পান করো "
 তার কবিতায় শিকড়ের টান । মাটির কাছাকাছি তার মানস অবস্থান । কল্পনার রঙে মানুষের ঘাম আর ক্লান্ত শ্বাস মিশে যে রঙের জন্ম তার ফোঁটায় ফোঁটায় মানবতার অঙ্গীকার । চল্লিশ দশকের শেষে মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ যে চূড়ান্ত হতাশার জন্ম দিচ্ছিল পঞ্চাশের কবিমনে তা কিছুটা বোহেমিয়ানিসম আর কিছুটা আত্মখনন রূপে প্রকাশ পায় । যাঁদের কবিতায় এই যুগবাহী যন্ত্রনা ও সংশয় ক্রমশ মানুষের মঙ্গল চেতনার রূপ নেয় শঙ্খ ঘোষ তাদের মধ্যে অন্যতম। কখনো তিনি বলেন
 " বসতি ফুরিয়ে গেছে, ঘন হয়ে বসেছি কজন
 আমাদের ঘিরে আছে ঘনতর দেড়শ মন্দির
 কোন সমাগম নেই, সবুজ হয়েছে মরা জল
 আগল খলার শব্দে শিবলিঙ্গে বাদুড়ের ছায়া "
 কখনো নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন মনন ও বোধ - আমরা অকাতরে পান করি সেই অনন্ত দর্শন । চির পিয়াসী মানব মনের আকুলতার গান তার শব্দের ছন্দে -- 
 "চোখের পাতায় এসে হাত রাখে স্লথ বেলপাতা 
 পাকা ধান নুয়ে পড়ে আদরে ঘিরেছে শরীরকে 
 বালির গভীর তলে ঘন হয়ে বসে আছে জল
 এখানে ঘুমানো এত সনাতন, জেগে ওঠা, তাও ?"
 ভালবাসা এখানে মায়াময় রূপে জেগে ওঠে । পাড়া গাঁয়ের সবুজ মাঠের গায়ে লেগে থাকা সকাল রোদের মতো উষ্ণ কিন্তু অনাড়ম্বর । ঝরঝরে সরলতায় সাদামাটা শব্দে বয়ে যায় প্রেমের কথা -
 "এসো ভালোবাসো, এসো, সন্দেহ করো না, ভালোবাসো 
 মাটি ছুঁয়ে কথা বল হাতে হাত রাখো, চুপ করো "
 কখনো বা অসীম আকুতি শিশিরের মতো শীতের সকালে জমে -- বিন্দু বিন্দু । আমাদের মুগ্ধ করে ভোরের হালকা আলোয় শুকতারার মতো জ্বল জ্বল করে -
 " দাও ডুবে যেতে দাও ওই পদ্মে, কোরকে, কোমলে 
 দাও চোখ ধুয়ে দাও ভোরের আভায়, জন্মভোর
 শিরায় শিরায় বাঁধো, পাপড়ি গুলি ঢেকে বলে যাও 
 ফিরে যাওয়া নয় সেই আরো কাছাকাছি আসা "
 এ ভাবেই কবিতা থেকে আরেক কবিতায় ডুব, মনের আঙিনায় আলর রোশনাই । শঙ্খ ঘোষ খোলা চোখে দেখেছেন, খোলা মনে ভেবেছেন আর খোলা পথে হেঁটেছেন । পাঠকের মনের কুয়াশা সরিয়ে তাকে অবহেলায় পাঠিয়ে দেন এক নিমগ্ন যাত্রায় । গন জাগরনের জন্য ভিতর সত্ত্বার জেগে ওঠা প্রয়োজন । এই ভিতর সত্ত্বাকে জাগাতে তিনি কবিতা লেখেন, তিনি মাটির সাথে বৃষ্টিকে যুক্ত করতে চান, হৃদয়ের সাথে বোধকে । এভাবেই তিনি জীবনের উৎসবে নিজেকে যুক্ত করেন । 

bhalo laglo khub.
উত্তরমুছুন