শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডায়রি

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডায়রি

খামচানো কালপৃষ্ঠা
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঠেলাগাড়িতে


দাদার অধিকাংশ সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে আমার পরিচয় দাদা কলকাতায় সিটি কলেজে পড়ার সময় থেকেই হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই আমাদের পাটনার বাড়িতে আসতেন । দাদার চাইবাসায় পোস্টিঙের সময়ে দল বেঁধে আসতেন বন্ধুরা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় চাইবাসায় তাঁদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে নিজেদের মতন করে উপন্যাস লিখেছেন --- একই ঘটনা নিয়ে ।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বহু পরে । শ্যামল দাদার কলেজের বন্ধু ছিলেন না ।উনি কখনও পাটনা বা চাইবাসায় আসেননি । আসেননি বলে আক্ষেপ করতেন । বলতেন, অনেক গল্প লিখতে পারতাম । মিস করলাম সুযোগটা । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল দাদার বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে । দাদা পাটনায় থাকতেন বলে ওই বিশাল বাড়িতে থাকার জন্য বন্ধুদের অনুরোধ করতেন । কেউ রাজি হতেন না । বলতেন, ওটা কলকাতার বাইরে । তখন বাঁশদ্রোণীতে এখনকার মতন এত বাড়িঘর তৈরি হয়নি । প্রায় ফাঁকা ছিল । দাদার বাড়ি থেকে উষা ফ্যান মোড় পর্যন্ত রিকশা পাওয়া যেত না । এখন অটো চলে । উষায় মেট্রো ট্রেন স্টেশন তৈরি হয়েছে ।



বাড়িটা ফাঁকা পড়েছিল বলে দুশ্চিন্তায় ছিলেন দাদা । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রাজি হয়ে গেলেন বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে থাকতে । তিনি একাকীত্ব খুঁজছিলেন, বিভিন্ন কারণে । প্রথমত সুনীল-সন্দীপনদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে অবিরাম গল্প-উপন্যাস লেখার চাপ। দ্বিতীয়ত, তিনি প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেকারণে পরিবার থেকে দূরে থাকতে চাইছিলেন । তৃতীয়ত, 'দারা শিকো' লেখার জন্য গবেষণা আর একাগ্রতার প্রয়োজন ছিল তাঁর ; কম বয়সী প্রেমিকাটি তাঁকে প্রচুর সাহায্য করতেন তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে ।

দাদার বাড়িতে যাঁরা গেছেন তাঁরাই জানেন সেখানে মশার দাপট কেমন । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ছিলেন তখন মশারা শুকনো মৌরি গাছ থেকে মৌরির মতন ঝরে-ঝরে পড়ত । দাদার বাড়িতে ঢোকার মুখে আট বর্গ ফুটের যে বারান্দা আছে তার মাপের বিশাল মশারি তৈরি করিয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার মধ্যে চেয়ার-টেবিল পেতে লেখালিখি করতেন । তাঁর সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে আসতেন তাঁরাও বসতেনওই মশারির ভেতরে । দাদার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কেই দেখেছি পাঁজি মেনে দশকর্ম করতে, পৈতে পরতে, হোমযজ্ঞ করতে । একবার গিয়ে দেখি দাদার ছোটো সফেদা গাছ কাটিয়ে তার কাঠ দিয়ে যজ্ঞে বসেছেন ।

আমার সঙ্গে উনি সাহিত্যের আলোচনা করতেন না । কিন্তু আমার 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর সেটা পড়ে জানতে চাইলেন টাকা গোলমালের ঘটনাগুলো সত্যি নাকি আমার কলম আমাকে দিয়ে ঘটনাগুলো লিখিয়ে নিয়েছে । আমি জানিয়েছিলুম যে ওগুলো আমার প্রথম চাকরি থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা । শুনে উনি 'আজকাল' সংবাদপত্রের হয়ে চলে গেলেন ব্যাঙ্গালুরু, সংবাদটা ফলাও করে ছাপলে বেশ সাড়া ফেলে দেয়া যাবে অনুমান করে । যাবার পথে আমার সঙ্গে দেখা করতেএসেছিলেন লাল টকটকে টিশার্ট পরে । ফিরে এসে বললেন, "ধ্যুৎ, অনেক পুরানো ঘটনা , তুমি তো ওই চাকরি করতে পঁচিশ বছর আগে, খেয়াল ছিল না" । ফলে 'আজকাল' সংবাদপত্রে উনি লিখলেন, বিয়েতেউপহার দেবার জন্য 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' একটি উৎকৃষ্ট উপন্যাস ।


আরকবার গেছি বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে । আমি মশারির ভেতরে বসে ওনার জন্য অপেক্ষা করলুম প্রায়আধ ঘন্টা । সিল্কের পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরে, পারফিউম মেখে বেরিয়ে এলেন । বললেন, তাড়াআছে । বুঝলুম যে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন । বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কোনো রিকশা পাওয়া গেল না । মাথার ওপর দুপুরের রোদ । কিছুক্ষণ পর একটা ভ্যান রিকশাকে দেখা গেল গলির মুখে, সিমেন্টের ধুলোয় অত্যন্ত নোংরা, সঙ্গে দুটো সিমেন্টের বস্তা । । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে বললেন মোড় পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিতে । টের পেলুম, ইনিই আসল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বেশিক্ষণআড়ালে থাকতে পারেন না । অমন জামাই-সুলভ সাজগোজ করে দিব্বি বসে পড়লেন গুঁড়ো-গুঁড়ো সিমেন্টের ওপর । আমাকেও বসতে হল ওনার পাশে । দেখলুম উঠে বসতে গিয়ে ওনার পা বেশ ছড়ে গেছে । রুমাল দিয়ে পুঁছে নিলেন ।

মোড়ে নেমে বললেন, চলো ওই দোকানটায় । আমি ভাবলুম কিছু-কেনাকাটা করার আছে । উনি কিছুই কিনলেন না । সামনে রাখা সৈন্ধ্যব লবণের চটের বস্তা থেকে এক চিমটি নুন নিয়ে বললেন, "কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে শুনেছ তো ? দেখতে চাই তার প্রকৃত অর্থটা কী " !

1 টি মন্তব্য: