আদিম জ্ঞান এখনও আমাদের অবচেতনে লুকিয়ে রয়েছে
ভাস্কর লাহিড়ী
গণেশ পাইনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় যখন আমার ১৪ বছর বয়স । অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় । ছোটবেলা থেকেই আঁকার দিকে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করতাম । হয়তো সেই জন্যই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভালো আঁকা বা চিত্রকলা নিয়ে কোনো আর্টিকেল পেলে পেপার কাটিং করে রেখে দিলাম । সেই সূত্রেই গণেশ পাইন নামটার সঙ্গে হঠাতই পরিচয় হয়ে গেল । সালটা খুব সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ হবে । সে সময় ‘সাপ্তাহিক অমৃত’ বলে একটা পত্রিকায় প্রতি সংখ্যাতেই একটা বিভাগ থাকত ‘একালের চিত্রশিল্পী’ । তাতে প্রায়ই গণেশ পাইনের আর্টিকেল থাকত । সেই সময় থেকেই গণেশ পাইন নাম ও তার ছবির প্রতি একটা মোহ এসে গেল । সেখানেই একবার মুখশ্রী বলে চিত্রবিষয়কে দেখেছিলাম তিনি ‘মহাবলী পুরম’-এর উল্লেখ করেছিলেন । সেখানে সমুদ্র, ঝাউগাছ, অর্জুন হ্রদ, আর সামনের ভাস্কর্যের সম্পর্কে বলেছিলেন । সেই বয়সে হয়তো মুগ্ধতা ছিল । পরিণত বয়সে তখন আবার পড়ি, তখন বুঝি কী গভীর তাৎপর্য তার মধ্যে ছিল । গণেশ পাইন শুধু ছবিতেই নয়, কথায় ও লেখায় সবেতেই ছিল অসীম দার্শনিক গভীরতা । সেই গভীরতার ছোঁয়া যেন আমাদের শিল্পীজীবনের বাল্যকাল থেকেই ঘিরে রাখত ।
গণেশ পাইনকে আমি পুরো জীবনে তিনবার পেয়েছি । ফলে সেই অনুভূতির তীব্রতা চিরকাল থাকবে । তার সঙ্গে কথা বলা, আলোচনা করা কিংবা তার দর্শনের কাছাকাছি যাওয়া বা যাবার চেষ্টা করা । ৮ এর দশকে সেবার আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে আমার প্রথম ডুয়েট শো । আর একজন বন্ধু চিত্রশিল্পীর সঙ্গে একসঙ্গে ছবির এগজিবিশন । প্রথম শো । শিল্পীদেরও আন্তরিক আহ্বান জানিয়েছি আমাদের কাজগুলো দেখাবার জন্য । সেবারেই প্রথম চাক্ষুস দেখেছিলাম আমাদের এই প্রিয় শিল্পী গণেশ পাইনকে । সে সময় তিনি প্রতি নতুন শিল্পীর কাজ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। প্রচুর সময় ধরে তিনি আমাদের কাজ দেখছেন । যেন মনে হচ্ছিল তিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ । “কেমন লাগল ?” সব শেষে জিজ্ঞেস করতে গণেশ পাইন বললেন, “তোমরা যখন জলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছ, তখন কোথাও না কোথাও তো ঠেকবেই । ” আমিও তখন বললাম, “আমাদের তো সব ছোট ছোট কাগজের নৌকো, আপনারা তো বড় বড় জাহাজ ।” শুনে উনি আরও একটা চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন । আসলে তিনি ছিলেন মাটির মানুষ, শিল্পীদের কাজ দেখতেন, শিল্পীদের উৎসাহ দিতে তাঁর কৃপণতা ছিল না । তাঁর ধারা বেঙ্গল আর্ট স্কুলকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল । তাঁর ছবিতে অনেক প্রভাব থাকলেও তাকে তিনি মডিফাইড করেছিলেন । আসলে গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্রের যে বেঙ্গল আর্ট ধারা প্রায় স্থবিরস্থায় চলে গেছিল , তিনি সেই ধারাকেই বাংলার মিথ, জীবন, গল্প আর নিজস্ব দর্শনকে একসঙ্গে মিশিয়ে তাতে গতি দিয়েছিলেন । নিজেও প্রভাবিত করেছেন বহু শিল্পীকে । এই সম্পর্কে আমি তাঁকে একটা প্রশ্নও করেছিলাম । সেবার আমাদের দ্বিতীয় দেখা । বর্তমানে এখন যিনি ‘সিমা আর্ট গ্যালারি’-এর কর্ণধার, সেই রাখি সরকার এর আয়জনায় ৮এর দশকেই গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোড় ও আর এক শিল্পী নিয়ে (এই মুহূর্তে ঠিক স্মরণে আসছে না, যাইহোক) বিড়লা একাদেমিতে “ভিশন ’৮৪” বলে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল । সেখানেই প্রথম বার গণেশ পাইনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার । সেখানে আমি কথায় কথায় প্রশ্ন করেছিলাম যে “আমাদের একজনের কাজের ওপর আর একজনের কাজের যে প্রভাব ফেলে সেটা কী ঠিক ?” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট ধরতে পারলেন তিনি । তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আসলে আমরা যে আদিম গুহামানবের উত্তরপুরুষ, তাঁর যে আদিম জ্ঞান, সেই জ্ঞান এখনও আমাদের অবচেতনে লুকিয়ে রয়েছে । আমরা তো কেউই স্বয়ংভু নই।” এই বিড়লা একাদেমিতেই আর একবার ওনার সঙ্গে শেষ দেখা । সেই সময়ের গণেশ পাইনের সঙ্গে আমাদের যৌবনের দেখা গণেশ পাইনের অমিল অনেক । তখন তিনি নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন । শুধুই নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন । কখনও কোনোদিন দলবাজি করেননি। তাঁর সম্পর্কে কথিত আছে তিনি নাকি হাওড়াব্রিজ পেরোননি । অবশ্য এই কথা শুনলে তিনি মৃদু হেসে বলতেন “আরে না না হাওড়া ব্রিজ পেরিয়েছি” । নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন শেষ জীবনে । হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় প্রদর্শনী করতেন । বিদেশের মাটিতেও ছিল শক্ত জমি । হয়তো আমরাও সেই পূর্বপুরুষ অগ্রজদের কাছে ঋণী হয়ে যাবো । যেমন বহু যুগ অন্তর এক একজন লোক আমাদের ভাবনা প্রকাশের এক একটা মাধম্যের এক একটা নতুন স্রোত তৈরি করে, তারপর বহু নুড়ি পাথর নিয়ে সেই স্রোত এগিয়ে চলে । তেমনই এক স্রোত তৈরি করে গেলেন গণেশ পাইন ।
অনুলিখন – জুবিন ঘোষ
গণেশ পাইনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় যখন আমার ১৪ বছর বয়স । অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় । ছোটবেলা থেকেই আঁকার দিকে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করতাম । হয়তো সেই জন্যই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভালো আঁকা বা চিত্রকলা নিয়ে কোনো আর্টিকেল পেলে পেপার কাটিং করে রেখে দিলাম । সেই সূত্রেই গণেশ পাইন নামটার সঙ্গে হঠাতই পরিচয় হয়ে গেল । সালটা খুব সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ হবে । সে সময় ‘সাপ্তাহিক অমৃত’ বলে একটা পত্রিকায় প্রতি সংখ্যাতেই একটা বিভাগ থাকত ‘একালের চিত্রশিল্পী’ । তাতে প্রায়ই গণেশ পাইনের আর্টিকেল থাকত । সেই সময় থেকেই গণেশ পাইন নাম ও তার ছবির প্রতি একটা মোহ এসে গেল । সেখানেই একবার মুখশ্রী বলে চিত্রবিষয়কে দেখেছিলাম তিনি ‘মহাবলী পুরম’-এর উল্লেখ করেছিলেন । সেখানে সমুদ্র, ঝাউগাছ, অর্জুন হ্রদ, আর সামনের ভাস্কর্যের সম্পর্কে বলেছিলেন । সেই বয়সে হয়তো মুগ্ধতা ছিল । পরিণত বয়সে তখন আবার পড়ি, তখন বুঝি কী গভীর তাৎপর্য তার মধ্যে ছিল । গণেশ পাইন শুধু ছবিতেই নয়, কথায় ও লেখায় সবেতেই ছিল অসীম দার্শনিক গভীরতা । সেই গভীরতার ছোঁয়া যেন আমাদের শিল্পীজীবনের বাল্যকাল থেকেই ঘিরে রাখত ।
গণেশ পাইনকে আমি পুরো জীবনে তিনবার পেয়েছি । ফলে সেই অনুভূতির তীব্রতা চিরকাল থাকবে । তার সঙ্গে কথা বলা, আলোচনা করা কিংবা তার দর্শনের কাছাকাছি যাওয়া বা যাবার চেষ্টা করা । ৮ এর দশকে সেবার আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে আমার প্রথম ডুয়েট শো । আর একজন বন্ধু চিত্রশিল্পীর সঙ্গে একসঙ্গে ছবির এগজিবিশন । প্রথম শো । শিল্পীদেরও আন্তরিক আহ্বান জানিয়েছি আমাদের কাজগুলো দেখাবার জন্য । সেবারেই প্রথম চাক্ষুস দেখেছিলাম আমাদের এই প্রিয় শিল্পী গণেশ পাইনকে । সে সময় তিনি প্রতি নতুন শিল্পীর কাজ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। প্রচুর সময় ধরে তিনি আমাদের কাজ দেখছেন । যেন মনে হচ্ছিল তিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ । “কেমন লাগল ?” সব শেষে জিজ্ঞেস করতে গণেশ পাইন বললেন, “তোমরা যখন জলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছ, তখন কোথাও না কোথাও তো ঠেকবেই । ” আমিও তখন বললাম, “আমাদের তো সব ছোট ছোট কাগজের নৌকো, আপনারা তো বড় বড় জাহাজ ।” শুনে উনি আরও একটা চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন । আসলে তিনি ছিলেন মাটির মানুষ, শিল্পীদের কাজ দেখতেন, শিল্পীদের উৎসাহ দিতে তাঁর কৃপণতা ছিল না । তাঁর ধারা বেঙ্গল আর্ট স্কুলকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল । তাঁর ছবিতে অনেক প্রভাব থাকলেও তাকে তিনি মডিফাইড করেছিলেন । আসলে গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্রের যে বেঙ্গল আর্ট ধারা প্রায় স্থবিরস্থায় চলে গেছিল , তিনি সেই ধারাকেই বাংলার মিথ, জীবন, গল্প আর নিজস্ব দর্শনকে একসঙ্গে মিশিয়ে তাতে গতি দিয়েছিলেন । নিজেও প্রভাবিত করেছেন বহু শিল্পীকে । এই সম্পর্কে আমি তাঁকে একটা প্রশ্নও করেছিলাম । সেবার আমাদের দ্বিতীয় দেখা । বর্তমানে এখন যিনি ‘সিমা আর্ট গ্যালারি’-এর কর্ণধার, সেই রাখি সরকার এর আয়জনায় ৮এর দশকেই গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোড় ও আর এক শিল্পী নিয়ে (এই মুহূর্তে ঠিক স্মরণে আসছে না, যাইহোক) বিড়লা একাদেমিতে “ভিশন ’৮৪” বলে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল । সেখানেই প্রথম বার গণেশ পাইনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার । সেখানে আমি কথায় কথায় প্রশ্ন করেছিলাম যে “আমাদের একজনের কাজের ওপর আর একজনের কাজের যে প্রভাব ফেলে সেটা কী ঠিক ?” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট ধরতে পারলেন তিনি । তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আসলে আমরা যে আদিম গুহামানবের উত্তরপুরুষ, তাঁর যে আদিম জ্ঞান, সেই জ্ঞান এখনও আমাদের অবচেতনে লুকিয়ে রয়েছে । আমরা তো কেউই স্বয়ংভু নই।” এই বিড়লা একাদেমিতেই আর একবার ওনার সঙ্গে শেষ দেখা । সেই সময়ের গণেশ পাইনের সঙ্গে আমাদের যৌবনের দেখা গণেশ পাইনের অমিল অনেক । তখন তিনি নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন । শুধুই নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন । কখনও কোনোদিন দলবাজি করেননি। তাঁর সম্পর্কে কথিত আছে তিনি নাকি হাওড়াব্রিজ পেরোননি । অবশ্য এই কথা শুনলে তিনি মৃদু হেসে বলতেন “আরে না না হাওড়া ব্রিজ পেরিয়েছি” । নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন শেষ জীবনে । হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় প্রদর্শনী করতেন । বিদেশের মাটিতেও ছিল শক্ত জমি । হয়তো আমরাও সেই পূর্বপুরুষ অগ্রজদের কাছে ঋণী হয়ে যাবো । যেমন বহু যুগ অন্তর এক একজন লোক আমাদের ভাবনা প্রকাশের এক একটা মাধম্যের এক একটা নতুন স্রোত তৈরি করে, তারপর বহু নুড়ি পাথর নিয়ে সেই স্রোত এগিয়ে চলে । তেমনই এক স্রোত তৈরি করে গেলেন গণেশ পাইন ।
অনুলিখন – জুবিন ঘোষ
কত জিনিস জানতে পারলাম ভাস্কর লাহিড়ির সাক্ষাতকার থেকে! এ সব পয়সা খরচ করেও সব সময় পাওয়া যায় না! জুবিনকে অঢেল কৃতজ্ঞতা।
উত্তরমুছুন