একলব্য হরিণ
একজন কবির ষোল বছর ধরে লিখে চলা কবিতার বইগুলি থেকে যখন নির্বাচিত সংগ্রহ পড়া হয় তখন তা শুধুই কবিতাপাঠ থাকে না,তা হয়ে ওঠে অভিযাত্রাও। কবির ভাঙা-গড়া আলো-অন্ধকার হয়ে ওঠে পাঠকেরও আত্মজ্ঞান।কবিতার মাধ্যমে একজন কবি তো নির্মাণ করে চলেন তাঁর বিশ্ববোধ,তাঁর সময়। চলমানতার এই বিষয়টি পাঠকের একটি বাড়তি পাওয়া।এই বাড়তি পাওয়া টুকু সঙ্গে নিয়েই আমরা হাতে তুলে নিই সুবীর সরকারের নিবার্চিত কবিতা।এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ যাপনচিত্র থেকে ২০১১-তে প্রকাশিত বিনোদন বিচিত্রা পর্যন্ত ১৬ টি গ্রন্থের নিবার্চিত কবিতাগুলি।
প্রথম কবিতাটি শুরুই হচ্ছে -অথচ নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সুপুরীবাগান পর্যন্ত/ যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার।একটি কবিতা যখন অথচ এই সংযোজক দিয়ে শুরু হয় তখন আমরা বুঝি কবি পাঠককে একটু অচেনা পথে হাঁটার আমন্ত্রন জানাচ্ছেন।সংযোজক দিয়ে কবিতা আরম্ভের ব্যাপারে অনেকে তাঁদের অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বাংলাসাহিত্যে।আমরা সেইসব নিষেধাজ্ঞা আপাতত অমান্যই করছি।আসলে যে পংক্তিটি হওয়া উচিত ছিল কবিতার শেষ পংক্তি তাকেই প্রথমে নিয়ে এসে ভেঙে দিয়েছেন মান্য পারম্পর্য।বাধ্যতার রাস্তাঘাটগুলি কবিকে তাঁর একান্ত গন্তব্য থেকে বিরত রাখছেঃ আর সেই শহরের ঝুলে থাকা রাস্তাঘাট/আমি কিছুতেই অতিক্রম করতে পারিনা।বাধাস্বরূপ এইগুলি তো আসলে গুরুত্বপুর্ন নয়,গুরুত্বপুর্ন ছিল প্রসঙ্গতঃ এই যে না যেতে পারা,আকাঙ্ক্ষা থেমে যাওয়া এই এক বিষন্নবোধ সুবীরকে বলা যায় কখনওই পিছু ছাড়ে না। পরবর্তীতে জোকারের দিনলিপি কবিতায় আবার তাকে আমরা বলতে শুনছি-বড় জোর কাঠের পুল তার বেশি আর যাওয়া হয় না।দূরে কোথায়,দূরে কবির মন ঘুরে বেড়ায়,সুবীর যেন কিছুতেই সেই দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে পারেন না।তাই রোমান্টিকতা সুবীরকে জারিত রাখে।যাই হোক,বিষয়টি ঠিক একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।উনিশে আগস্টের কবিতা থেকে আত্মজীবনীর ছেঁড়া অংশ-র প্রথম অংশ-র শুরুর শব্দটি হল তারপর; আরও স্পষ্ট করে কবিকে আমরা স্পর্শ করতে পারি যখন তৃতীয় অংশ তিনি শুরু করেন এই বলে যে-তো ব্যস্ত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে একা একা নদীর দিকে যায় জীবন—।আমাদের এইরকম মনে হয় যে কোনও আরোপিত অবস্থান নয়,এই লেখক কবিতাযাপন করেন।দিনের যে কোনও মুহুর্ত,উচ্চারিত যে কোনও প্রাত্যহিকতা থেকে সুবীরের কবিতা শুরু হতে পারে,হয়ে যায়।
যেমন অসুখ সংবাদ পড়ছি কবিতাটি।পরিচিত কেউ,হয়তো বিশেষ কেউই,হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর রয়েছে।কবি তাকে দেখতে গিয়েছেন।এই সরল স্বাভাবিক ঘটনা থেকে শুরু হয়ে কবিতাটি ভেঙে ফেলল তার স্বাভাবিক চলন।সুবীর লিখলেনঃ
অস্ত্রোপচারের পর তুমি কেমন আছো এটা জানবার
জন্য আমি হাসপাতালে যাই
অন্ধকারে বেজে ওঠে ব্যান্ডপার্টি... জলাশয়ে জল নেই
তাই সরাইখানা নাম পালটে এখন গার্লস হস্টেল
প্রতিরক্ষা ভেঙেপড়ছে...যদিও ডেটল সাবান, ব্লাডব্যাঙ্ক
অ্যাম্বুলেন্স-এইসব কেন্দ্রে রেখে
জীবন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে আমার
অসুস্থ-আমরা সঠিকভাবেই ধরে নিচ্ছি-মেয়েটির অবস্থা আমাদের কবি স্পষ্ট করে জানান না।ব্যান্ডপার্টির উল্লেখে আরোগ্যের কথা ভাবি,আবার প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ছে ভেবে আমাদের ভাবনা অন্যতর হয়।এবং এইসব অনুষঙ্গে এবং এই আরোগ্য বা আরোগ্যহীনতায় কবির জীবন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক এই কবিতার পাশাপাশি আমরা যখন তুমি দীর্ঘবেনী খুলে দিলে-র মত কবিতা পড়ি তখন পাঠক হিসেবে সে এক পরিপূরক প্রাপ্তি।নিজের মত করে বলে ওঠা সম্বোধনে,নিজের মত করে ভেবে ওঠা শব্দের রূপমায়ায় কবিতাটি সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।ধ্রুপদী রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্য যে বিষন্নতা-সেই বিষন্নতা কবিতাটিকে স্পর্ষ করে রয়েছে।তাই আমরা পড়ছিঃ
আলোঢালা আকাশ আমি তোমার কাছে
সমুদ্রের ঠিকানা চেয়েছিলাম
জীবনে আঙুল ডুবিয়ে বিষাদের আঙুল ডুবিয়ে
দেখি আরো আরো জীবন
তুমি দীর্ঘবেনী খুলে দিলে শুরু হবে নগরকীর্তন।
যে গল্পটির আভাস লুকিয়ে রেখেছে কবিতাটি,সেই গল্প এই সংকলনে প্রায় ফল্গুর মতন বহমান।কেবল পালিয়ে বেড়ানো এক অবয়ব, পরিপূর্নভাবে স্পর্ষ করতে না পারা এক অনুভব সংকলনটিকে এক মায়ারহস্যের আলোর ভরিয়ে রেখেছে।চাপা বিষাদের কবিতা-র নাম থেকে আমরা এই বোধটিকে চাপা বিষাদের বোধ হিসেবে অভিহিত করতে পারি।শোকচিহ্ন কবিতাটি জন্মদিনের কথা বলেছে,কিন্তু আমরা একটু বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করি তার পিছনে খেলা করছে কিছু অন্ধকার।বক্তব্যবিহীন দু-একটি ছবি-কিন্তু তারাই এঁকে দিচ্ছে জীবনের কোনও একটি টুকরো কিন্তু সম্পুর্ণ ক্যানভাসঃ
হারিয়ে যাবার কথা উঠলেই একটা গোটা
হাসপাতাল
জন্মদিন পালন করি রক্ত
ও ডেটল দিয়ে।
বিজ্ঞাপনের শহর-কবিতায় সুবীর সম্ভবত একটি আত্মস্বীকৃতি নথিভুক্ত করেছেনঃ ...এইসব
কেন্দ্র করে ধিরস্থির জমে ওঠে আমাদের
বিষাদযাপন
এই মূল ভরকেন্দ্রসম সুরটিকে আমরা মান্যতা দিলাম।
০২।
একজন কবিকে তাঁর শব্দব্যবহার,তাঁর দৃষ্টির ভিন্নতা দিয়ে যদি চিহ্নিত না করা যায় তাহলে তা কিঞ্চিৎ হতাশই করে।সুখের কথা সুবীরের কবিতা আমাদের হতাশ করে না।
জ্যোৎস্নায় কিছু বর্ণনা করলে আমরা চাঁদের আলোয়-ই সাধারণতঃ লিখে থাকি।সুবীর লেখেন-কিছুটা চাঁদের আলো ধার করে।এই যে ধার করা ক্রিয়াপদ তিনি চাঁদের আলো সম্পর্কে লিখলেন প্রথম পংক্তিতে (কবিতার নামকরণেও),আমরা অন্যমনস্ক হতে পারি না।আর তিনি শেষ করছেন এই লিখে যে-আর কিছুটা চাঁদের আলো ধার করে উড়ে/আসে বৃষ্টিঠোঁট পাখিরা। ছোট কবিতা; কিন্তু সূচনা ও সমাপ্তির মধ্যে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন ব্যক্তিগত শোকযাত্রা,মহাজাগতিক সংঘটন,লোকগান। প্রক্ষিপ্ত নয়,বিস্তারিত নয়___ কিন্তু নিজস্ব রসায়নে কবিতা হয়ে ওঠা।
কবিতা হয়ে ওঠা এই নৈপুন্যে সুবীর আমাদের আশ্চর্য করেন তাঁর মিতবাক দক্ষতায়।প্রায় সমস্ত কবিতাতেই সুবীর পংক্তির একটি বা দুইটি শব্দকে ভেঙে দিয়ে আলাদাভাবে লেখেন।একটু বেশি গুরুত্ব আদায় করে নেন পাঠকদের কাছ থেকে।ফলে কবিতার শরীরে যেমন একদিকে অতিরিক্ত শাখাপ্রশাখা যুক্ত হয়,অন্য দিকে নির্মিত হয় একটি নিজস্বতা।আমরা একটি মাত্র কবিতার উল্লেখ করছি___ আবহসংগীত (গ্রন্থঃ মেঘকলোনির কবিতা)।প্রথম পংক্তি থেকে দ্বিতীয়ে,দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়ে,তৃতীয় থেকে চতুর্থে... এই ভাবে পংক্তিগুলি সামান্য ছোট করতে করতে সুবীর গান গড়িয়ে নামার একটি চিত্র উপস্থাপিত করেন।তারপর,একদম শেষ পংক্তিতে শেষের শব্দটি ভেঙে নীচে লিখে কবিতাটি সম্পুর্ন করেন।শব্দটি পংক্তিতে সংযুক্ত থাকলে যে অভিঘাত জাগাত পাঠকের মনে, তার থেকে অনেক অনেক বেশি ভারী হয়ে ওঠে আলাদা লেখায়। শব্দটি?অন্যমনস্কতা।
সুবীর, ব্লারব থেকে জানলাম তিনি কুচবিহারে থাকেন।কুচবিহারে কিছুদিন ধরে রয়েছেন আরও এক অগ্রজ কবি সুব্রত রুদ্র।সহনাগরিকত্বের কোনও এক বন্ধন বোধহয় কবিতাকেও জারিত করে।সুব্রত –কে নিয়ে সুবীর লিখেছেন ওড টু এ টল পোয়েট...। আমরা যারা সুব্রত-র কবিতাকে চিনি,তারা জানি সুবীরের ___আপনার নিঃশ্বাসের ভিতর অতিমন্থর বৃষ্টিদিন বা নাতিদীর্ঘ সেতুর ওপর আপনি রেখে আসেন/পিতামহর চিরুনি,গত শতকের পালকি/আর আপনাকে অনুসরণ করে প্রেমের গল্প,টুকরো মেঘ।এবং পরবর্তী গ্রন্থের নাম-উনিশে আগস্টের কবিতা। নাম কবিতাটি এক কবির জন্মদিনে উৎসর্গ করা হয়েছে।ঘটনাচক্রে আমাদের জানা আছে দিনটি কবি সুব্রত রুদ্র-রও জন্মদিন।সব মিলিয়ে বিষয়টি বাংলাকবিতার বৃহত্তর ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।নব্বই-এর একজন সহযাত্রী হিসেবে সুবীরকে এই প্রতিবেদকের অভিনন্দন।
বোধে ও অনুভবে,মেধায় ও নির্মাণে সুবীর সরকার তাঁর প্রকৃতিসম্মেলনে,সংলাপময়তায় এবং প্রেমের সংবেদন ও বেদনায় বাংলাকবিতায় এক নিজস্ব ভুবন গড়ে তুলছেন।তাঁর শহরে,তাঁর কবিতায় কখনও কখনও আমাদের ভ্রমন আমাদের আনন্দ দিয়ে চলুক।
নির্বাচিত কবিতাঃ সুবীর সরকার
কবিতা ক্যাম্পাস,হাওড়া-০৬
কলকাতা বইমেলা,২০১২
একজন কবির ষোল বছর ধরে লিখে চলা কবিতার বইগুলি থেকে যখন নির্বাচিত সংগ্রহ পড়া হয় তখন তা শুধুই কবিতাপাঠ থাকে না,তা হয়ে ওঠে অভিযাত্রাও। কবির ভাঙা-গড়া আলো-অন্ধকার হয়ে ওঠে পাঠকেরও আত্মজ্ঞান।কবিতার মাধ্যমে একজন কবি তো নির্মাণ করে চলেন তাঁর বিশ্ববোধ,তাঁর সময়। চলমানতার এই বিষয়টি পাঠকের একটি বাড়তি পাওয়া।এই বাড়তি পাওয়া টুকু সঙ্গে নিয়েই আমরা হাতে তুলে নিই সুবীর সরকারের নিবার্চিত কবিতা।এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ যাপনচিত্র থেকে ২০১১-তে প্রকাশিত বিনোদন বিচিত্রা পর্যন্ত ১৬ টি গ্রন্থের নিবার্চিত কবিতাগুলি।
প্রথম কবিতাটি শুরুই হচ্ছে -অথচ নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সুপুরীবাগান পর্যন্ত/ যাওয়া হয়ে ওঠেনি আমার।একটি কবিতা যখন অথচ এই সংযোজক দিয়ে শুরু হয় তখন আমরা বুঝি কবি পাঠককে একটু অচেনা পথে হাঁটার আমন্ত্রন জানাচ্ছেন।সংযোজক দিয়ে কবিতা আরম্ভের ব্যাপারে অনেকে তাঁদের অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বাংলাসাহিত্যে।আমরা সেইসব নিষেধাজ্ঞা আপাতত অমান্যই করছি।আসলে যে পংক্তিটি হওয়া উচিত ছিল কবিতার শেষ পংক্তি তাকেই প্রথমে নিয়ে এসে ভেঙে দিয়েছেন মান্য পারম্পর্য।বাধ্যতার রাস্তাঘাটগুলি কবিকে তাঁর একান্ত গন্তব্য থেকে বিরত রাখছেঃ আর সেই শহরের ঝুলে থাকা রাস্তাঘাট/আমি কিছুতেই অতিক্রম করতে পারিনা।বাধাস্বরূপ এইগুলি তো আসলে গুরুত্বপুর্ন নয়,গুরুত্বপুর্ন ছিল প্রসঙ্গতঃ এই যে না যেতে পারা,আকাঙ্ক্ষা থেমে যাওয়া এই এক বিষন্নবোধ সুবীরকে বলা যায় কখনওই পিছু ছাড়ে না। পরবর্তীতে জোকারের দিনলিপি কবিতায় আবার তাকে আমরা বলতে শুনছি-বড় জোর কাঠের পুল তার বেশি আর যাওয়া হয় না।দূরে কোথায়,দূরে কবির মন ঘুরে বেড়ায়,সুবীর যেন কিছুতেই সেই দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে পারেন না।তাই রোমান্টিকতা সুবীরকে জারিত রাখে।যাই হোক,বিষয়টি ঠিক একেবারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।উনিশে আগস্টের কবিতা থেকে আত্মজীবনীর ছেঁড়া অংশ-র প্রথম অংশ-র শুরুর শব্দটি হল তারপর; আরও স্পষ্ট করে কবিকে আমরা স্পর্শ করতে পারি যখন তৃতীয় অংশ তিনি শুরু করেন এই বলে যে-তো ব্যস্ত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে একা একা নদীর দিকে যায় জীবন—।আমাদের এইরকম মনে হয় যে কোনও আরোপিত অবস্থান নয়,এই লেখক কবিতাযাপন করেন।দিনের যে কোনও মুহুর্ত,উচ্চারিত যে কোনও প্রাত্যহিকতা থেকে সুবীরের কবিতা শুরু হতে পারে,হয়ে যায়।
যেমন অসুখ সংবাদ পড়ছি কবিতাটি।পরিচিত কেউ,হয়তো বিশেষ কেউই,হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর রয়েছে।কবি তাকে দেখতে গিয়েছেন।এই সরল স্বাভাবিক ঘটনা থেকে শুরু হয়ে কবিতাটি ভেঙে ফেলল তার স্বাভাবিক চলন।সুবীর লিখলেনঃ
অস্ত্রোপচারের পর তুমি কেমন আছো এটা জানবার
জন্য আমি হাসপাতালে যাই
অন্ধকারে বেজে ওঠে ব্যান্ডপার্টি... জলাশয়ে জল নেই
তাই সরাইখানা নাম পালটে এখন গার্লস হস্টেল
প্রতিরক্ষা ভেঙেপড়ছে...যদিও ডেটল সাবান, ব্লাডব্যাঙ্ক
অ্যাম্বুলেন্স-এইসব কেন্দ্রে রেখে
জীবন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে আমার
অসুস্থ-আমরা সঠিকভাবেই ধরে নিচ্ছি-মেয়েটির অবস্থা আমাদের কবি স্পষ্ট করে জানান না।ব্যান্ডপার্টির উল্লেখে আরোগ্যের কথা ভাবি,আবার প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ছে ভেবে আমাদের ভাবনা অন্যতর হয়।এবং এইসব অনুষঙ্গে এবং এই আরোগ্য বা আরোগ্যহীনতায় কবির জীবন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক এই কবিতার পাশাপাশি আমরা যখন তুমি দীর্ঘবেনী খুলে দিলে-র মত কবিতা পড়ি তখন পাঠক হিসেবে সে এক পরিপূরক প্রাপ্তি।নিজের মত করে বলে ওঠা সম্বোধনে,নিজের মত করে ভেবে ওঠা শব্দের রূপমায়ায় কবিতাটি সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।ধ্রুপদী রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্য যে বিষন্নতা-সেই বিষন্নতা কবিতাটিকে স্পর্ষ করে রয়েছে।তাই আমরা পড়ছিঃ
আলোঢালা আকাশ আমি তোমার কাছে
সমুদ্রের ঠিকানা চেয়েছিলাম
জীবনে আঙুল ডুবিয়ে বিষাদের আঙুল ডুবিয়ে
দেখি আরো আরো জীবন
তুমি দীর্ঘবেনী খুলে দিলে শুরু হবে নগরকীর্তন।
যে গল্পটির আভাস লুকিয়ে রেখেছে কবিতাটি,সেই গল্প এই সংকলনে প্রায় ফল্গুর মতন বহমান।কেবল পালিয়ে বেড়ানো এক অবয়ব, পরিপূর্নভাবে স্পর্ষ করতে না পারা এক অনুভব সংকলনটিকে এক মায়ারহস্যের আলোর ভরিয়ে রেখেছে।চাপা বিষাদের কবিতা-র নাম থেকে আমরা এই বোধটিকে চাপা বিষাদের বোধ হিসেবে অভিহিত করতে পারি।শোকচিহ্ন কবিতাটি জন্মদিনের কথা বলেছে,কিন্তু আমরা একটু বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করি তার পিছনে খেলা করছে কিছু অন্ধকার।বক্তব্যবিহীন দু-একটি ছবি-কিন্তু তারাই এঁকে দিচ্ছে জীবনের কোনও একটি টুকরো কিন্তু সম্পুর্ণ ক্যানভাসঃ
হারিয়ে যাবার কথা উঠলেই একটা গোটা
হাসপাতাল
জন্মদিন পালন করি রক্ত
ও ডেটল দিয়ে।
বিজ্ঞাপনের শহর-কবিতায় সুবীর সম্ভবত একটি আত্মস্বীকৃতি নথিভুক্ত করেছেনঃ ...এইসব
কেন্দ্র করে ধিরস্থির জমে ওঠে আমাদের
বিষাদযাপন
এই মূল ভরকেন্দ্রসম সুরটিকে আমরা মান্যতা দিলাম।
০২।
একজন কবিকে তাঁর শব্দব্যবহার,তাঁর দৃষ্টির ভিন্নতা দিয়ে যদি চিহ্নিত না করা যায় তাহলে তা কিঞ্চিৎ হতাশই করে।সুখের কথা সুবীরের কবিতা আমাদের হতাশ করে না।
জ্যোৎস্নায় কিছু বর্ণনা করলে আমরা চাঁদের আলোয়-ই সাধারণতঃ লিখে থাকি।সুবীর লেখেন-কিছুটা চাঁদের আলো ধার করে।এই যে ধার করা ক্রিয়াপদ তিনি চাঁদের আলো সম্পর্কে লিখলেন প্রথম পংক্তিতে (কবিতার নামকরণেও),আমরা অন্যমনস্ক হতে পারি না।আর তিনি শেষ করছেন এই লিখে যে-আর কিছুটা চাঁদের আলো ধার করে উড়ে/আসে বৃষ্টিঠোঁট পাখিরা। ছোট কবিতা; কিন্তু সূচনা ও সমাপ্তির মধ্যে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন ব্যক্তিগত শোকযাত্রা,মহাজাগতিক সংঘটন,লোকগান। প্রক্ষিপ্ত নয়,বিস্তারিত নয়___ কিন্তু নিজস্ব রসায়নে কবিতা হয়ে ওঠা।
কবিতা হয়ে ওঠা এই নৈপুন্যে সুবীর আমাদের আশ্চর্য করেন তাঁর মিতবাক দক্ষতায়।প্রায় সমস্ত কবিতাতেই সুবীর পংক্তির একটি বা দুইটি শব্দকে ভেঙে দিয়ে আলাদাভাবে লেখেন।একটু বেশি গুরুত্ব আদায় করে নেন পাঠকদের কাছ থেকে।ফলে কবিতার শরীরে যেমন একদিকে অতিরিক্ত শাখাপ্রশাখা যুক্ত হয়,অন্য দিকে নির্মিত হয় একটি নিজস্বতা।আমরা একটি মাত্র কবিতার উল্লেখ করছি___ আবহসংগীত (গ্রন্থঃ মেঘকলোনির কবিতা)।প্রথম পংক্তি থেকে দ্বিতীয়ে,দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়ে,তৃতীয় থেকে চতুর্থে... এই ভাবে পংক্তিগুলি সামান্য ছোট করতে করতে সুবীর গান গড়িয়ে নামার একটি চিত্র উপস্থাপিত করেন।তারপর,একদম শেষ পংক্তিতে শেষের শব্দটি ভেঙে নীচে লিখে কবিতাটি সম্পুর্ন করেন।শব্দটি পংক্তিতে সংযুক্ত থাকলে যে অভিঘাত জাগাত পাঠকের মনে, তার থেকে অনেক অনেক বেশি ভারী হয়ে ওঠে আলাদা লেখায়। শব্দটি?অন্যমনস্কতা।
সুবীর, ব্লারব থেকে জানলাম তিনি কুচবিহারে থাকেন।কুচবিহারে কিছুদিন ধরে রয়েছেন আরও এক অগ্রজ কবি সুব্রত রুদ্র।সহনাগরিকত্বের কোনও এক বন্ধন বোধহয় কবিতাকেও জারিত করে।সুব্রত –কে নিয়ে সুবীর লিখেছেন ওড টু এ টল পোয়েট...। আমরা যারা সুব্রত-র কবিতাকে চিনি,তারা জানি সুবীরের ___আপনার নিঃশ্বাসের ভিতর অতিমন্থর বৃষ্টিদিন বা নাতিদীর্ঘ সেতুর ওপর আপনি রেখে আসেন/পিতামহর চিরুনি,গত শতকের পালকি/আর আপনাকে অনুসরণ করে প্রেমের গল্প,টুকরো মেঘ।এবং পরবর্তী গ্রন্থের নাম-উনিশে আগস্টের কবিতা। নাম কবিতাটি এক কবির জন্মদিনে উৎসর্গ করা হয়েছে।ঘটনাচক্রে আমাদের জানা আছে দিনটি কবি সুব্রত রুদ্র-রও জন্মদিন।সব মিলিয়ে বিষয়টি বাংলাকবিতার বৃহত্তর ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।নব্বই-এর একজন সহযাত্রী হিসেবে সুবীরকে এই প্রতিবেদকের অভিনন্দন।
বোধে ও অনুভবে,মেধায় ও নির্মাণে সুবীর সরকার তাঁর প্রকৃতিসম্মেলনে,সংলাপময়তায় এবং প্রেমের সংবেদন ও বেদনায় বাংলাকবিতায় এক নিজস্ব ভুবন গড়ে তুলছেন।তাঁর শহরে,তাঁর কবিতায় কখনও কখনও আমাদের ভ্রমন আমাদের আনন্দ দিয়ে চলুক।
নির্বাচিত কবিতাঃ সুবীর সরকার
কবিতা ক্যাম্পাস,হাওড়া-০৬
কলকাতা বইমেলা,২০১২
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন