বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

"ড্রইং"-এর খাতা থেকে - বাণীব্রত কুণ্ডু

“ড্রইং”-এর খাতা থেকে : কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়
বাণীব্রত কুণ্ডু


‘ড্রইং’। একটি বই। ছবির বই। বাইশটি ছবি রচিত হয়েছে। কালো মলাটে মোড়া এই বইটিতে চিত্রিত ছবিগুলো কোনো আক্রেলিক বা প্যস্টেল, চারকোল কিংবা জল রঙ, তেল রঙ নয়, শিল্পী এঁকেছেন অক্ষরমাধ্যমে। আর যে শিল্পী অক্ষর সাজিয়ে ছবি আঁকেন তিনি তো কবি! আর কেউ নন। কোনো চিত্রশিল্পী তাঁর অমোঘ সৃষ্টি প্রস্ফুটিত করে তোলেন ক্যানভাসের উপর; আর একজন কবির ক্যানভাস হল সমকালীন সমাজ, দেশ-কাল-পাত্র। আর তেমনই কিছু কবিতার খোঁজ পাওয়া গেল এই “ড্রইং” বইটাতে। কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়। জন্ম – ১৯৫৩, নিবাস অক্ষরশহর শ্রীরামপুর, পেশা এবং নেশা যে একনিষ্ঠ সাহিত্যচর্চা সে বিষয়ে অঞ্চলের অনেক মানুষই জানেন। সম্পূর্ণ একক দায়িত্বে নিয়মিতভাবে (বর্তমানে) তিনি প্রকাশ করে যাচ্ছেন নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক কাগজ “শ্রীরামপুর”। এছাড়াও কবিতাপত্র “চিত্রল”। এবং সম্প্রতি “কলকাতা কলকাতা” নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা। এই নিভৃতচারী কবি আশির দশকের একজন অন্যতম কবি। আলোর নিচে যাঁর বাস। অথচ আলেয়া যাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি।

কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার ঝাঁ চকচকে প্যালেসের অভ্যন্তরের ঘষা কাঁচের আড়ালে যিনি রয়ে গেছেন! তাঁর কবিতাগুলিও যে আজকের সমাজের প্রেক্ষিতে দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক তা বলাই বাহুল্যমাত্র। “ড্রইং” থেকে কয়েকটি কবিতার নিবিষ্টপাঠে তা জলস্বচ্ছ্ব রূপ পায়। গ্রন্থিত প্রথম কবিতাতেই কবি সতর্ক করে দিচ্ছেন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দুধকে দুধ আর জলকে জল আলাদা করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। যেহেতু কোনো কিছুই চিরদিন একই থাকে না। কবি “সংবাদ”এ লিখছেন –

“মাটি আর বালিকে বিচার করতে
না পারলে তুমি থেকে যেতে বাধ্য স্থানুবৎ

কারণ দু মলাটের ভিতর কোনোকিছুই
চিরকাল আটকে থাকে না

নিজের চোখেই তুমি দেখলে
ঘটনাগুলো এমন ছিল
যে তাদের নীরবতাই একমাত্র
আশ্রয় হয়নি”

“সার্কাস” কবিতায় অস্থির সমাজের ছবি এঁকেছেন কবি। যেখানে ঈশ্বর কিংবা শয়তানের প্রতিনিয়ত ছক পালটানোর ইতিহাস। সভ্যতার জ্বলে যাওয়ার ইতিহাস। কিংবা আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে ইতিহাস পুড়িয়ে দেবার কাহিনি প্রকট। য শুধু কবিই নন, পাঠকও সমভাবে হতবাক! সত্যিই এইসব তো কম কথা নয়!

“প্রতিনিয়ত দেখি তোর নতুন নতুন খেলা
জ্বলে যায় গ্রেনেডা, হণ্ডুরাস
অথবা পারস্য দ্বীপমালা

আগুন হাতে খেলা
আগুন নিয়ে খেলা
আগুনের সাথে খেলা

কম কথা!”

আবার “মুখ” কবিতায় কবি ধিক্কার জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিয়ত খাপ খাওয়ানোর বেঁচে থাকার জন্য যে নীতি-আদর্শ-বিবেকের বিকারকে। আর সেই বিকার যেন ঠিক দুধ থেকে দই-এর নয়, তা হল সেই ফলরসান্নের বিকারে উৎপন্ন বিষাক্ত সুরাস্বরুপ। আর আমাদের গজোল্লাকে। যার পানে হয়তো আমরা নিজেরাই চমকে উঠব নিজেদের সেই চেহারার মদোন্মত্ততায়। তাই মুখোশে ঢাকা পড়ে থাকা মুখ কি আর আহত শব্দের অর্থবোধে সক্ষম!

“সামনে কোনো আয়না নেই
যেমন খুশি বিকৃত করতে পারো মুখ
কি আসে যায়
মহৎ সে কখনোই নয়
তবু মানবিক যন্ত্রণা কাতর

আহত শব্দের অর্থ এখনও শেখোনি”

“প্রশ্ন” কবিতায় রচনা করেছেন দানবের লালসায় পৃথিবীর অন্ধত্ব। বর্তমান সময়ে পরিবেশের যে পরিস্থিতি স্থল-জল-বায়ু সর্বত্র তা থেকে রেহাই নেই নিরীহ জীবকূলেরও। আজ পৃথিবীর সব প্রাণ অস্তিত্বের সংকটসীমায়। মৃত্যুই আমাদের একমাত্র বাধ্য গন্তব্য। এমনই আষ্ঠেপৃষ্ঠে অতোপ্রতো যে সেখান থেকে মুক্তির আশা দুস্তর। আমাদের চোখের পাতায় ঘুম নামার মতোই একদিন পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে।

“দুঃসহ কঠিন সময়ের আবর্তে
জড়িয়েছ অজগরসম
ভয়ঙ্কর।
দেবে মৃত্যু চুম্বন
তারপর!

কোন পথে যাবে?
তোমার লোভের রক্তে
পৃথিবী কি অন্ধ হবে!”

“জন্মভূমি”র সম্পর্কেও কবি দারুণভাবে উত্কন্ঠিত। যে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য শতসহস্র তাজা প্রাণ বলি হয়েছে, ঝরেছে অঝোরে লক্ষ মায়ের অশ্রু! তা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি! ভুলে যাচ্ছি সেই সব মহান আত্মত্যাগ! আজ এই দুর্নীতিগ্রস্ত সময়েও যাঁরা এইসব ভাবি একান্তে, দেখি পাখি উড়ে যায়... উড়েই যায়... তেপান্তরের মাঠ ছাড়িয়ে...

“যাবে কি মুছে কোনোদিন
অশ্রুর দাগ –

বিষণ্ণ তুমি
পথ অন্ধকার!

প্রান্তর ছাড়িয়ে উড়ে যায় পাখি
তুমি দেখ শুধু দেখ
যতদূর চোখ যায়!

সমাজে প্রবঞ্চক, স্বার্থান্বেষী মানুষের ভিড়ে একাকী কবি নয় আমরাও প্রত্যেকে খুঁজে বেড়াই যে যার মতো বিশ্বাসী মানুষ। যেহেতু জগতে সবকিছুই আপেক্ষিক তাই সত্যের নিরিখে অবিশ্বাসীরাও খুঁজে বেড়ায় তাদের বিশ্বাসী তথা সত্যের মানদণ্ডে অবিশ্বাসীদের। যারা নিজেদের মধ্যেই শুধু কথা বলে যায়, অথচ জগতে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরাই বিশ্বাসকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীকে আগাম ধ্বংসের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে যাচ্ছে সকলের জন্য। তাই কবির “বিশ্বাস” প্রকৃতপ্রস্তাবে নীতিকথার মতোই শোনায় –

“তোমাদের বিশাওাস কতটা আছে
আমাদের জানা নেই
আমরা জেনে গেছি
তোমাদের শব্দের বাড়িগুলো
যার ভিতর একমাত্র তোমরাই বাস কর
জিভটা আলগা হতে হতে এখন এমন
এক জায়গায় এসে ঠেকেছে, যেখানে তোমরা
শুধু নিজেদের মধ্যেই কথা বলে যাচ্ছ

আমাদের বিশ্বাস কিন্তু আমরা
যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমাদেরই জন্য
কারণ এই পৃথিবীটাকে রোজ গড়ে পিটে
আমরাই তৈরি করছি কিনা”

শিরোনামের কবিতাটিতে কবি এক অপূর্ব আনন্দ রচনা করেছেন অবলীলায়। কবিতায় দুটি রঙের কথা বলা হচ্ছে। আসলে কিন্তু আমরা দেখি জগতে যা কিছু অস্তিত্ববান তা সবই এক এবং অন্য আর এক, অর্থাৎ মোট দুয়ের সহাবস্থান। এর বাইরে আর কিছুই হয় না। এটা অমোঘ। আর এই দুয়ের যথার্থ ব্যবহারই পারে সমস্তের সুবন্দোবস্ত। নির্মাণ স্বচ্ছতা। তাই কবির “ড্রইং” খাতায় –

“তোমার হাতে মাত্র দুটো রঙ
যদি ব্যবহারে কোথাও ভুল না হয়
তাহলে দ্বিবর্ণ এই রঙের খেলায়
সবকিছুই স্পষ্ট

মনে রেখো
জলের গভীরে যাওয়া ছাড়া
তোমার পথ নেই”

এভাবেই তিনি এঁকে গেছেন তাঁর ড্রইং খাতার পাতায় পাতায়। ক্কবির সমস্ত কবিতা নিছক কবিযশঃপ্রার্থী সাজা কবির কবিতা নয়। কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বহন করে ঔপনিষদিক তাত্পর্য। প্রতিটি কবিতায় দার্শনিক ভাবের অনায়াস সাহচর্য আর তার সঙ্গে বাস্তবিক জগতের সুষম জারণ নির্মাণ করেছে সত্য-শিব-সুন্দরের ধ্যানধারণায় সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতা। তাই অন্তরালের কবি হয়েও তাঁর রচনা শাশ্বত। যা আমাদের শেখায়, উর্বর করে মস্তিষ্কসঞ্চালন। তাই তাঁর সম্বন্ধে এবং তাঁর কবিতা সম্বন্ধে বেশি কিছু না বলে আমি চাইছি তাঁর সৃষ্টি অধিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। তাই আর একটি কবিতা তুলে দিয়ে শেষ করলাম ঘষা কাঁচের অন্তরাল থেকে খুঁজে নেওয়া কবিপরিচয়। যা সত্যিই “বিস্ময়”এর –

“জমে থাকা কান্না শুধু জমে যায়
কঠিন পাথরে
দুচোখের তারায় ভেসে আসে চৈত্রের রূপ
পৃথিবীর কচি কচি ঘাস মরে গিয়ে
জ্বলেছে আগুন
তাই এত তাপ, তীব্র জ্বালা
কঠিন রুক্ষ পথ ক্লান্ত শরীরে নিশ্চুপ হেঁটে
যাওয়া
এ বড় বিস্ময়, বড় বিদ্রূপ
জীবনের কাছে”

1 টি মন্তব্য:

  1. ভাই, খুব তাড়া দিয়েছি নিরুপায় হয়ে । ভালো লিখেছিস । আর হ্যাঁ, সম্পাদকরা আসলে শাঁখের করাতে বসে থাকে তাই আশা করি আবার জ্বালাবো :)

    উত্তরমুছুন