ক্লাসরুম ২০৮০
গৌতম যুথিপুত্র
“আরে এ মা , সুখিকাকা নাইরে , সুখিকাকা পলাইছে....আরে এ মা...সুখিকাকা পলাইছে বটে।
দু-পাশে বিস্তীর্ণ চাষের জমি । তার বুক চিরে চলে যাওয়া হাইওয়েটা শুয়ে আছে নিথর অজগরের মতো । দিন নেই রাত নেই দানবের মত বড় বড় ট্রাকগুলো দৌড়ে চলেছে সেই পথ বরাবর । রঘুনন্দনের নজর এল একদিন হঠাৎই ট্রাকগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তা্য়...একটার পর একটা , তারও পরে একটা । রঘুনন্দনের নিজের জমি নেই । অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করেই চলে তার সংসার । বাবুরা ভোটের সময় এসে আশ্বাস দেয় , এবার ভোটে জিতলেই তোরা বছরে একশো দিনের কাজ পাবি নিশ্চিত , সুতরাং...।নিরক্ষর রঘু্ ভোটের রাজনীতি খুব বোঝে , শুধু বোঝে না কত দিনে একশো দিন হয় ; ভোট বাবুরা বোঝায় একশো দিনেই তোদের বছর। আর জানে কাজ কাজ না জুটলে ফুলমনি আর ্বুধিয়াকে নিয়ে ভুখা থাকতে হয় ।
একদিন , দুইদিন ,তিনদিন....ট্রাকগুলোর নড়বার কোন লক্ষণই নেই । ড্রাইভার , খালাসি কয়েক’শ লোক হাইওয়েতেই পড়ে আছে । শুকনো খাবারেও তাদের টান পড়েছে। রঘুনন্দন অবস্থা বুঝে রাস্তার ধারে বাঁশ পুঁতে পলিথিনের চাদরে মুড়ে অস্থায়ী খাবারের দোকান খুলে ফেলল । সারাদিন তার দোকান চলে । ভোর হতেই বুধিয়া আর ফুলমুনিকে নিয়ে সে চলে আসে সেখানে । ভালই খদ্দের জোটে তার দোকানে । রঘু ভাবে কত লোক , কত বিচিত্র তাদের ভাষা । অবাক হয় রঘু ।
---কী হইয়েছে গো, হেথা কী মেলা লাগেছে ? ফুলমনি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ।
রঘু বলে , কী জানি , শুনতে পাই নেতারা রাস্তা জুড়ে মিটিং করছে আমাদের কাজের জন্য.....কাজ কবে পাবো সেটা মিটিং শেষ হলে বুলবে । এখন কাজে লাগ ; আটা মেখে ফেল জলদি জলদি ।
এরই মধ্যে ট্রাকওয়ালা সুখবিন্দরের সঙ্গে বুধিয়ার ভাব জমে গেছে । এবার সুখবিন্দর মাল নিয়ে মুলুকের দিকেই যাচ্ছিল । এখানে আটকে না গেলে এতদিনে ঘর পৌঁছে যেত সে । ঘরের কথা মনে হতে মনটা তার ভারী হয়ে যায়। তবু বুধিয়াকে নিয়ে খেলায় মেতে সে ঘরের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করে । এদিকে রঘুর কারবার ভালই চলতে থাকে। রাতে বাড়ি ফিরে রঘুনন্দন ফুলমনিকে বলে , কাল আরও আটা , আলু নিয়ে যাব । আরও কামাই করে লিতে হোবে। প্রায় মাঝরাত । হাইওয়েতে ঘরঘর আওয়াজ । সার দিয়ে ট্রাক চলতে শুরু করেছে । পুলিশের লোকেরা রাস্তা ফাঁকা করে গাড়ি চালু করে দিয়েছে । মিটিং অবরোধ সব আপাতত বন্ধ । আবার কবে শুরু হয়ে যাবে ঠিক নেই । সবার তাড়া লেগেছে । ট্রাক ছুটিয়ে দিয়েছে যার যার গন্তব্যস্থলের দিকে ।
পরদিন ভোরবেলা । বুধিয়াকে কাঁধে করে রঘুনন্দন আসে হাইওয়েতে । সঙ্গে ফুলমনি । ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে ট্রাক , গাড়ি সব ছুটে চলেছে । সুখবিন্দরকে দেখতে পায় না রঘু । বুধিয়া তার সুখি কাকাকে না পেয়ে কাঁদে । রঘু বলে , কান্দিস নাই বুধিয়া ; তোর সুখিকাকা তার ঘর গেছে । তারপর ফুলমনির দিকে ফিরে বলে , মিটিং শেষ হইছে রে ফুলমনি , এবার আমাদের কামকাজ মিলবে ; সারা বছরের কাম , একশো দিনের কাম । আর ভুখা মরতে হবে নাই .....।”
গল্পটা শেষ করে একটু থামলেন ইতিহাসের শিক্ষক বাদল রায় । ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের উপর আলতো দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন , সম্ভবতঃ গল্পটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কোন এক অখ্যাত গল্পকারের লেখা । এই গল্পটা থেকে আমরা আজ থেকে প্রায় আশি-নব্বই বছর আগেকার অর্থাৎ ২০০০-২০১০ সালের ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা ভয়ানক খন্ডচিত্র পাই । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষ বিদেশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তার প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছিল কিন্তু পরবর্ত্তী প্রায় একশো বছর সে শোষিত হয়েছিল রাজনৈ্তিক শঠতা , অর্থনৈ্তিক ভন্ডামি এবং সামাজিক ব্যাভিচারের দেশীয় দালালতন্ত্রের কাছে । দূর্বল সংবিধান , অক্ষম গণতন্ত্র , নিস্ক্রিয় বিচারব্যবস্থা দেশের সাধারন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হ’ল । ক্রমে এক ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হ’ল ভারত । কিন্তু হিস্ট্রি রিপিটশ ইটসেলফ ! আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই দুমড়ে যাওয়া ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াল রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শুরু হ’ল প্রতিরোধ তারপর প্রতিআক্রমন যাকে ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের“ স্বাধীনতার দ্বিতীয় যুদ্ধ “ বলে অভিহিত করেছেন । অবশেষে ২০৪৭ সালে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় শোষন গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হ’ল এক পরিচ্ছন্ন রাজনৈ্তিক , সামাজিক , অর্থনৈ্তিক বাতাবরন । ঘটনাক্রমে সে দিনটাও ছিল ১৫ই আগষ্ট, আমাদের স্বাধীনতা দিবস । আজ ২০৮২ সালে দাঁড়িয়ে তোমরা যে ভারতবর্ষকে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসাবে দেখছো সেখানে রাজনীতি আছে কিন্তু রাজনৈ্তিক ব্যাভিচার নেই , দৃঢ় অর্থনীতি আছে কারন অর্থনৈ্তিক শোষণ নেই , পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কারন কালোবাজারী নেই , ব্রথেল আছে কিন্তু ধর্ষক নেই ! সে অর্থে ভারতবর্ষ আজ সত্যিই স্বাধীন ; এখানে আজ কেউ বলার নেই , ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় । স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় যুদ্ধই যেন আমাদের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ হয় , আর সে দ্বায়িত্ব নিতে হবে তোমাদেরই ।
স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে উঠল ঢং..ঢং...ঢং...
“আরে এ মা , সুখিকাকা নাইরে , সুখিকাকা পলাইছে....আরে এ মা...সুখিকাকা পলাইছে বটে।
দু-পাশে বিস্তীর্ণ চাষের জমি । তার বুক চিরে চলে যাওয়া হাইওয়েটা শুয়ে আছে নিথর অজগরের মতো । দিন নেই রাত নেই দানবের মত বড় বড় ট্রাকগুলো দৌড়ে চলেছে সেই পথ বরাবর । রঘুনন্দনের নজর এল একদিন হঠাৎই ট্রাকগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তা্য়...একটার পর একটা , তারও পরে একটা । রঘুনন্দনের নিজের জমি নেই । অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করেই চলে তার সংসার । বাবুরা ভোটের সময় এসে আশ্বাস দেয় , এবার ভোটে জিতলেই তোরা বছরে একশো দিনের কাজ পাবি নিশ্চিত , সুতরাং...।নিরক্ষর রঘু্ ভোটের রাজনীতি খুব বোঝে , শুধু বোঝে না কত দিনে একশো দিন হয় ; ভোট বাবুরা বোঝায় একশো দিনেই তোদের বছর। আর জানে কাজ কাজ না জুটলে ফুলমনি আর ্বুধিয়াকে নিয়ে ভুখা থাকতে হয় ।
একদিন , দুইদিন ,তিনদিন....ট্রাকগুলোর নড়বার কোন লক্ষণই নেই । ড্রাইভার , খালাসি কয়েক’শ লোক হাইওয়েতেই পড়ে আছে । শুকনো খাবারেও তাদের টান পড়েছে। রঘুনন্দন অবস্থা বুঝে রাস্তার ধারে বাঁশ পুঁতে পলিথিনের চাদরে মুড়ে অস্থায়ী খাবারের দোকান খুলে ফেলল । সারাদিন তার দোকান চলে । ভোর হতেই বুধিয়া আর ফুলমুনিকে নিয়ে সে চলে আসে সেখানে । ভালই খদ্দের জোটে তার দোকানে । রঘু ভাবে কত লোক , কত বিচিত্র তাদের ভাষা । অবাক হয় রঘু ।
---কী হইয়েছে গো, হেথা কী মেলা লাগেছে ? ফুলমনি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ।
রঘু বলে , কী জানি , শুনতে পাই নেতারা রাস্তা জুড়ে মিটিং করছে আমাদের কাজের জন্য.....কাজ কবে পাবো সেটা মিটিং শেষ হলে বুলবে । এখন কাজে লাগ ; আটা মেখে ফেল জলদি জলদি ।
এরই মধ্যে ট্রাকওয়ালা সুখবিন্দরের সঙ্গে বুধিয়ার ভাব জমে গেছে । এবার সুখবিন্দর মাল নিয়ে মুলুকের দিকেই যাচ্ছিল । এখানে আটকে না গেলে এতদিনে ঘর পৌঁছে যেত সে । ঘরের কথা মনে হতে মনটা তার ভারী হয়ে যায়। তবু বুধিয়াকে নিয়ে খেলায় মেতে সে ঘরের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করে । এদিকে রঘুর কারবার ভালই চলতে থাকে। রাতে বাড়ি ফিরে রঘুনন্দন ফুলমনিকে বলে , কাল আরও আটা , আলু নিয়ে যাব । আরও কামাই করে লিতে হোবে। প্রায় মাঝরাত । হাইওয়েতে ঘরঘর আওয়াজ । সার দিয়ে ট্রাক চলতে শুরু করেছে । পুলিশের লোকেরা রাস্তা ফাঁকা করে গাড়ি চালু করে দিয়েছে । মিটিং অবরোধ সব আপাতত বন্ধ । আবার কবে শুরু হয়ে যাবে ঠিক নেই । সবার তাড়া লেগেছে । ট্রাক ছুটিয়ে দিয়েছে যার যার গন্তব্যস্থলের দিকে ।
পরদিন ভোরবেলা । বুধিয়াকে কাঁধে করে রঘুনন্দন আসে হাইওয়েতে । সঙ্গে ফুলমনি । ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে ট্রাক , গাড়ি সব ছুটে চলেছে । সুখবিন্দরকে দেখতে পায় না রঘু । বুধিয়া তার সুখি কাকাকে না পেয়ে কাঁদে । রঘু বলে , কান্দিস নাই বুধিয়া ; তোর সুখিকাকা তার ঘর গেছে । তারপর ফুলমনির দিকে ফিরে বলে , মিটিং শেষ হইছে রে ফুলমনি , এবার আমাদের কামকাজ মিলবে ; সারা বছরের কাম , একশো দিনের কাম । আর ভুখা মরতে হবে নাই .....।”
গল্পটা শেষ করে একটু থামলেন ইতিহাসের শিক্ষক বাদল রায় । ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের উপর আলতো দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন , সম্ভবতঃ গল্পটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কোন এক অখ্যাত গল্পকারের লেখা । এই গল্পটা থেকে আমরা আজ থেকে প্রায় আশি-নব্বই বছর আগেকার অর্থাৎ ২০০০-২০১০ সালের ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা ভয়ানক খন্ডচিত্র পাই । ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষ বিদেশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তার প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছিল কিন্তু পরবর্ত্তী প্রায় একশো বছর সে শোষিত হয়েছিল রাজনৈ্তিক শঠতা , অর্থনৈ্তিক ভন্ডামি এবং সামাজিক ব্যাভিচারের দেশীয় দালালতন্ত্রের কাছে । দূর্বল সংবিধান , অক্ষম গণতন্ত্র , নিস্ক্রিয় বিচারব্যবস্থা দেশের সাধারন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হ’ল । ক্রমে এক ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হ’ল ভারত । কিন্তু হিস্ট্রি রিপিটশ ইটসেলফ ! আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই দুমড়ে যাওয়া ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াল রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শুরু হ’ল প্রতিরোধ তারপর প্রতিআক্রমন যাকে ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের“ স্বাধীনতার দ্বিতীয় যুদ্ধ “ বলে অভিহিত করেছেন । অবশেষে ২০৪৭ সালে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় শোষন গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হ’ল এক পরিচ্ছন্ন রাজনৈ্তিক , সামাজিক , অর্থনৈ্তিক বাতাবরন । ঘটনাক্রমে সে দিনটাও ছিল ১৫ই আগষ্ট, আমাদের স্বাধীনতা দিবস । আজ ২০৮২ সালে দাঁড়িয়ে তোমরা যে ভারতবর্ষকে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসাবে দেখছো সেখানে রাজনীতি আছে কিন্তু রাজনৈ্তিক ব্যাভিচার নেই , দৃঢ় অর্থনীতি আছে কারন অর্থনৈ্তিক শোষণ নেই , পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কারন কালোবাজারী নেই , ব্রথেল আছে কিন্তু ধর্ষক নেই ! সে অর্থে ভারতবর্ষ আজ সত্যিই স্বাধীন ; এখানে আজ কেউ বলার নেই , ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় । স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় যুদ্ধই যেন আমাদের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ হয় , আর সে দ্বায়িত্ব নিতে হবে তোমাদেরই ।
স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে উঠল ঢং..ঢং...ঢং...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন