মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প - আফসার নিজাম

সাহস এবং জলপাইড্রাগন
আফসার নিজাম



(স্বৈরশাসনের বিপক্ষে অবস্থানকারী ছাত্রদের জন্য)

আমরা অনুভব করতে পারছি একটি সাহস ক্যাটওয়াক করে ধীরে ধীরে উঠে আসছে আমাদের মাঝে। সূর্যালোকের রোদে যেমন করে গাছের ছায়া মাটিতে লম্বা হতে থাকে ঠিক তেমনি আমাদের ভেতরে সাহস বড় হয়ে প্রবেশ করতে থাকে হৃদয়ের ভেতর। সাহটা পায়ের কাছ থেকে উঠে এসে বুকের মধ্যখানে আসন নেয়। তারপর আরো শক্তি অর্জন করে আমাদের ঘাড়ের শাহীরগের মাঝে সঞ্চালিত হয় আর ‘চির উন্নত মম শির’ বলে বুক টান করে দাঁড়ায়। সাহস দাঁড়িয়ে গেলে সকল ভয় উবে গিয়ে ধু ধু প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। চোখের প্রিজমে তখন খেলা করে মুক্তির নেশা।

আমাদের মাঝে যে একটা সাহস জন্মেছে সে কথাটা আর গোপন থাকে না। এ কান থেকে ও কান হয়ে মানে মোবাইলে মোবাইলে ছড়িয়ে পরে খেলার মাঠ থেকে ছাত্রাবাসে। ছাত্রাবাস হয়ে রাজপথে। রাজপথ থেকে শহর-নগর-গ্রাম-গঞ্জে। গ্রাম তো আর গ্রাম নেই এখন এক একটা গ্রাম মানে এক একটা ছোট শহর। ছোট শহরে আর কোনো কথাই গোপন থাকে না। গোপন কথাগুলোও গোপনীয়তা খুলে বেড়িয়ে পরে সদর দরজা দিয়ে। তাই সাহসের কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে, বুকে বুকে। কারণ তারা সাহস দেখবে। সাহস দেখার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। আহা সাহস! প্রিয় সাহস।

হতাশায় ডুবে যাওয়া মানুষগুলো টের পায় সাহস জেগেছে। ঝড়ের মাঝে মেঘনা নদীতে বরিশালের লঞ্চগুলো যখন টালমাটাল অবস্থা ঠিক সেই সময় সারেং লঞ্চটা চরে ঠেকিয়ে দিলে মানুষ যেমন স্বস্তি অনুভব করে আজ তারা ঠিক সেই স্বস্তি অনুভব করে। আর ভয় পেলে মানুষ যেমন শব্দ করে চিৎকার করে। যতো ভয় ততো বেশি চিৎকার। ভয়কে জয় করার চিৎকার দিয়ে মানুষ বলতে থাকে, ‘সাহস জেগেছে; আমাদের সাহস।’ তখন সাহসের কথা গুঞ্জরিত হতে থাকে অলিতে-গলিতে। গুঞ্জরিত হতে থাকে কিশোর থেকে বৃদ্ধদের কানে কানে।

যুবকেরা সাহসের টের পেয়ে আর ঘরে বসে থাকতে পারে না। তারা বেরিয়ে পড়ে। ঘরের ভেতরে তারা অস্বস্তি অনুভব করে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় বলে মনে হয়। বাইরে বেরিয়ে এক বুক নিশ্বাস নিয়ে জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠে আর জ্বালাতে থাকে হৃদয়ের আগুনে মুক্তির রাজপথ। আগুনের জোগান দিতে জমি থেকে ছুটে আছে কৃষক, কারখানা থেকে ছুটে আসে শ্রমিক, পাঠশালা থেকে ছুটে আসে শিক্ষার্থীসহ শিক্ষক। আর ছুটে আসে প্রজাতন্ত্রের সকল চাকুরে। কারণ তারাও অপেক্ষা করতে ছিলো এমন একটা সাহসের। কবে সে সাহস জেগে ওঠবে। কবে মুক্তির নিশান উড়বে। কবে বুক খুলে নিশ্বাস নিবে। কবে মুখ খুলে কথা বলবে, একান্ত কথা; আপন কথা; মনের কথা; তর্কের কথা; প্রতিবাদের কথা; বলা কথা; না বলা কথা। অতপর খেলার মাঠ থেকে সাহস ফিরে এলো খেলাই হয়ে ওঠলো সাহসের কেন্দ্রবিন্দু। খেলায় খেলায় জমে ওঠলো খেলা। পুঞ্জিভুত ক্ষোভ আঁছড়ে পড়লো খেলার মাঠে, খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো রাজনীতির মুক্তমঞ্চ; খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো মুক্তিরক্যাম্প। খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো স্বাধীনতার উড়াল পাখি। খেলার মাঠ হয়ে ওঠলো স্বাধীনতার ভেতরের স্বাধীনতা।

খেলার মাঠ নিয়ে খেলুড়ের কপালে ভাঁজ হয়। ভাঁজে ভাঁজে জমে ওঠে বিষাক্ত ঘাম। ঘাম মুছতে মুছেতে ভাবে ‘খেলার মাঠে নেমে আসলো পদনের বৃষ্টি? নেমে আসলো খোদার লা’নত?’ ভাবতে ভাবতেই খেলুড়েরা হারাতে থাকে তাদের মায়াজাল। মায়াজাল ছিঁড়ে যাচ্ছে। মায়াজাল ছিঁড়ছে দেখে খেলুড়েরা জ্ঞানশূন্য হয়। তাদের জ্ঞানে পচন ধরে। পচে পচে জমিনের ওপর পড়ে। জমিন গ্রহণ করে না; জমিন ওগলে দেয়; জমি বমি করে। পানি বৃদ্ধি পায়; পানি বন্যা হয়। সূর্য রেগে ওঠে; সূর্য় তাদের মাথায় ঢেলে দেয় রাজ্যের তাপ। সে তাপে তাদের মাথার তালু গরম হয়। গরম মাথা জ্ঞান শূন্য হয়। জ্ঞান শূন্য মাথায় প্রস্তুতি নেয় আরো একটি শয়তানি খেলার। খেলার মাঠ থেকেই তাই শুরু হয় তাদের ইবলেশি অপারেশন।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নামে। সন্ধা নামে না যেনো প্রজাতন্ত্রে নেমে আসে অন্ধকার শুয়র। অন্ধকারে খেলা করে ভুতের বাচ্চা। ভুত ভুতের দোস্ত; ভুতেরা ভুতেরা মামাতো ভাই; ভুতেরা ভুতেরা শালাতো ভাই; ভুতেরা ভুতেরা তালতো ভাই। ভুতেরা ভুতেরা মিলিত হয়। এরপরই সারি সারি জলপাইড্রাগনে ভরে যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। জলপাইড্রাগনের গর্জনে কেঁপে ওঠে বইয়ের আলমিরা। কেঁপে ওঠে রাবেয়া হল, কার্জন হল, কলা ভবন, টিএসসি। কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ, কেঁপে ওঠে নজরুলে কবর। আর কেঁপে ওঠে কোমলমতি ছাত্রদের অন্তরআত্মা।

অন্ধকার গিলে খায় আলোর ফোয়ারা। নিজেকে ছাড়া আর কারোই মালুম হয় না। তখন জলপাইড্রাগনের সার্চলাইট জ্বলে ওঠে। জ্বলে ওঠে জলপাইড্রাগনের আগুন চোখ। যেনো এখনই জ্বালিয়ে দেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল জ্ঞান। জ্বালিয়ে দেবে আটষট্টি হাজার বর্গমাইল সবুজ। স্তব্ধ করে দেবে ষোল কোটি মুখের আওয়াজ। আওয়াজকে ড্রাগনজান্তারা খুব বেশি ভয় পায় । আওয়াজ শুনলেই কেঁপে ওঠে তার অন্তরআত্মা। তখন অন্ধতীরন্দাজের মতো অন্ধকারে তীর চালায় যেনো টিকটিকির মতো টিক টিক করে কেউ সত্য উচ্চারণ করতে না পারে। জান্তা জানে সত্যই মিথ্যাকে দূরভুত করে।

কিন্তু না। ড্রাগনজান্তার বিরুদ্ধে জেগে ওঠে সাহস। সাহসে সাহসে জেগে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সাহসেরা গেয়ে ওঠে বিজয়ের গান; সাহসেরা গেয়ে ওঠে মুক্তির গান। সাহস মানুষের মনে সাহস জোগায়। মানুষেরা আড়মোরা দিয়ে ওঠে। মানুষেরা সাহসে ভর করে ওঠে দাঁড়ায়। মানুষেরা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পরে। বিক্ষোভে, রাজপথে উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হয়; তরঙ্গ সৃষ্টি হয় শহর-নগর-বন্দরে; গ্রাম-গঞ্জে; অলিতে-গলিতে। তখন মিছিলের লাইন দীর্ঘ হয়। বন্ধ হয় স্বৈর শাসনের প্রজাতন্ত্র। গাড়ি চলে না; দোকান খোলে না। ব্যাবসা বন্ধ; ইশকুল বন্ধ; অফিস বন্ধ; আদালত বন্ধ। রাজপথ দিয়ে তখন টহল দেয় জলপাইড্রাগন। তার ক্রুড় শব্দে কেঁপে ওঠে রাজপথ। তখন মিছিলের শব্দও আরো জোড়ালো হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে ওঠে স্বৈরকুরসি।

ড্রাগনজান্তার ক্ষোভ হয়; গোস্বা হয়; রাগ হয়। তার অহং-এ ঘা লাগে। ঘা লেগে আরো বেড়ে যায় অহং। অহংকারে বুকের ছাতি ফেটে বেড়িয়ে আসে তার কলিজা; কালো কলিজা। কালো কলিজায় শুভ্রতার কোনো চিহ্ন নেই। নেই কোনো গোলাপের আঁচর কিংবা প্রিয়তমার কোনো চুমুর চিহ্ন। সে যেনো এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। টগবগ করে জ্বলে থাকে দোজগের কালোআগুন। যে আগুনলাভা ধ্বংস করে দেয় মানুষের সাজানো সভ্যতা। সেই কুৎসিত কলিজা থেকে বেরিয়ে আসে জানোয়ারের হুংকার। তার হুংকারে পেঁচা জানোয়ারও হুংকার দেয় প্রজাতন্ত্রের প্রজার ওপর। হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহসের ওপর। ট্যা ট্যা ট্যা শব্দে ভারি হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রান্তর। কাঁদানো গ্যাসে ছেয়ে যায় টিএসসি চত্বর; কাদানো গ্যাসের অন্ধকারে ভরে যায় কলাভবন; নিলক্ষেত, ফুলার রোড, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ। বিদ্যুৎ নিভে যায়। অন্ধকার গ্রাস করে জ্ঞানের আলো। এ যেনো ড্রাগনের কৃষ্ণগহবর থেকে নিয়ে আসে অন্ধকার। অন্ধকার দিয়ে ছেয়ে ফেলতে চায় জ্ঞানের জগৎ। পেঁচা শাসকের অন্ধকার পছন্দ। সে অন্ধকার ভালোবাসে। অন্ধকার ভালোবেসে অন্ধাকার ছড়িয়ে দেয় প্রজাতন্ত্রের ভেতর-বাহির। সেই কৃষ্ণঅন্ধকারে একটুকরো আলো নিয়ে এগিয়ে আসে সাহস। সাহসের সাহস দেখে কুপি নিয়ে এগিয়ে আসে আষট্টি হাজার বর্গমাইলের প্রজাসকল। এগিয়ে আসে প্রজাতন্ত্রের বৃদ্ধ মা। মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিটি ছাত্র হাতে করে নিয়ে আসে আলোর মশাল। এক এক করে জ্বলে ওঠে মশাল। মশালে মশালে আলোকিত হয় জ্ঞানের জমিন। আলোর মিছিল দেখে ভয় পায় অন্ধকার। আলো তার শত্র“। তখন অন্ধকার অন্ধকারকে শিষ দেয়। ড্রাগনশিৎকারে নোংরা হয় পরিবেশ। নোংরা দেখে শুয়র যেমন আনন্দ পায় তেমনি নোংরা শিৎকারে আনন্দ পায় ড্রাগনজান্তা। তাদের মুখ শিৎকার করে। চোখ শিৎকার করে। পা শিৎকার করে। আর হাতের মেশিনগান শিৎকার করে ওঠে। মেশিনগানের শিৎকার আলোর অগ্রপথিকের দিকে ছুটে আসে। ঠিক তখনই বাতাসের সকল শিকল ছিঁড়ে নপুংসক শাসকের একটি বুলেট ডুকে যায় সাহসের বুকে। বুলেটের প্রবেশ পথ দিয়ে বেরিয়ে আসে তপ্তলহু; মুক্তির লহু; স্বাধীকারে লহু; গণতন্ত্রের লহু। লাল হয়ে ওঠে শুভ্রজামা। জামা পরম আদরে গ্রহণ করে শুষে নেয় মুক্তির লাললহু। সাহসের বুকে বুলেট দিয়ে কিছুটা শান্ত হলেও আবার শুরু করে ড্রাগন আওয়াজ। সেই আওয়াজ আকাশ তোলপার করে তোলে। আকাশের মালিককে যেনো জানিয়ে দিতে চায় বুলেটই শক্তির মূল উৎস।

আমরা ছুটে যাই নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। কাধে তুলে নেই সাহস। সাহসেÑ সাহস ভর করে আমরা কলাভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই ওপরে। স্বৈর বুটগুলো আমাদের অনুসরণ করে কুকুরের মতো। আর সাহসের লাল রক্ত দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে। আমরাও সন্তর্পনে সাহসকে শুয়ে দেই কলাভবনের দোতালার একেবারে শেষ রুমের বারান্দার ওপর। যেনো মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকে সাহস। তারপর বই খাতা ছিঁড়ে গায়ের ওপর বিছিয়ে দেই ফুলের পাপড়ির মতো যেনো কোনো ভাবেই বুঝতে না পারে জলপাইড্রাগনের ক্রুদ্ধচোখ।

সাহসকে পরম যতেœ রেখে আমরা লুকিয়ে পড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে। কারণ প্রতি মুহূর্তে জলপাইড্রাগন চোখ খুঁজে ফিরছে সাহস। যেনো কোনো প্রকারেই মানুষের সাহস বৃদ্ধি না পায়। তাই তারা আমাদের অনুসরণ করে খুঁজে নেয়। বুটের শব্দে কলাভবনের বারান্দা কেঁপে ওঠে। হাজার হাজার অন্ধকারেও সেই বুটের আওয়াজ সন্ত্রস্ত করে তোলে বারান্দা। তারপর হঠাৎ করেই ড্রাগনটর্চগুলো জ্বলে ওঠে একসাথে। যেনো দোজখি আলো গ্রাস করে নেয় তামাম বারান্দা। বুটের শব্দে শব্দে এগিয়ে আসে ড্রাগনপা। আর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাহসের ওপর।

বাতাসে বইয়ের ছেঁড়াপাতা সরে গেলে সাহসের মুখের ওপর আলোর বন্যা এসে পড়েতেই বিদ্যুৎ আলোর মতোই উজ্জ্বল আলো ছড়াতে থাকে সাহসের চেহরা। তখন ভয় পেয়ে যায় জলপাইড্রগান। পিছিয়ে আসে আর একসাথে ট্যা ট্যা ট্যা আওয়াজ তুলে ঝাঁঝরা করে দেয় সাহসের অবশিষ্ট দেহ। তখন দেহের অবশিষ্ট রক্তের নহর শরীর থেকে বের হয়ে শিক্ষাঙ্গণকে মুক্তির স্বাদ দিতে দিতে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। জলপাইড্রাগন তাদের অগ্নিহাসি দেয়। অগ্নিহাসি মানুষে বুকে লাগে। মানুষ কেঁদে ওঠে। কেঁদে ওঠে মা, কেঁদে ওঠে বোন, কেঁদে ওঠে ভাই, কেঁদে ওঠে আত্মীয়-অনাত্মীয় প্রজাতন্ত্রের সকল বনিআদম।

অগ্নিহাসি শেষে জলপাইড্রাগনের সাঁড়াশি হাত সাহসের একটি পা ধরে নির্দয়ভাবে সিঁড়ি দিয়ে টানতে টানতে নিচে নামিয়ে থাকলে আমরা আমাদের ভেতরে আবার সাহস অনুভব করতে থাকলাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন