মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কবিতা ভাবনা - কুহক মাহমুদ

কবি ও কবিতা
কুহক মাহমুদ


যান্ত্রিকতার ছায়া আজ এতটাই বড় যে কোনটা নিজের ছায়া আর কোনটা আধুনিকতার তাতে ভ্রম হয়। মাঝখান থেকে ঐতিহ্যের রূপ-রস আহরণ করে সুস্থ-সংস্কৃতির বিকাশ কিভাবে সম্ভব তা প্রশ্নের সম্মুখিত করে বৈকি, যেখানে নিজেকে দেবার মতো সময় বের করা আর গোধূলির প্রস্থানে পূর্ণিমা নামানোর মতই দূরহ। তবু আশার কথা এই যে, জীবন চর্চার আরাধনা আর ফসল ফলানো সংস্কৃতির বুনিয়াদ গড়ে উঠছে আয়ি রাণী পিপিলিকার শশব্যস্ততায়। ঐতিহ্যের নানান উপকরণ সংস্কৃতির রন্দ্রে রন্দ্রে সঞ্চারমান কিন্তু সব উপকরণ বিরাজমান নয়। তাই মনে করি কবির কাজ অতীতের দিকে ফিরে তাকানো। সে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। ইতিহাস থেকে সব উপকরণ সংগ্রহ করে সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করাটাও যে কাজ, আজকের সব উত্তর আধুনিক কবিরা তা ভুলতে বসেছেন। এহেন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবো কি করে বুঝতে পারি না। এটা আমাদের মানতেই হবে যে চিন্তাধারার পরিবর্তন এলে আমাদের চারপাশের পার্থিব বস্তুর রূপ-রস-গন্ধ ভিন্ন মাত্রা পায়। যা হয়তো পূর্বে বাস্তব ছিলো বা ধ্রুব সত্য ছিলো তার মাঝে কতটুকু মিথ্যা আছে তা প্রস্ফুটিত হয় চর্চার মাধ্যমেই। পশ্চিম থেকে ধার করা উত্তর আধুনিকতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে তীব্র আলোর ঝলসানিতে দেখা যায় আমাদেরই দগ্ধমুখ আর আয়নার সামনে দাঁড়ালে এই মুখশ্রীই আমাদের বিমোহিত করছে। পশ্চিম আমাদের যতটা না শিখিয়েছে সাহিত্যকলা তার চাইতে বেশী শিখিয়েছে প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়কে বারুদগন্ধ সহ্য করবার ক্ষমতা। এটা অস্বীকার করবার জো নেই যে, হাজার বছরের ইংরেজী সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ তাই হয়তো অনেক কবিকেই ইংরেজী সাহিত্যের প্রভাবদোষে আক্রান্ত বলে দোষারপ করা থেমে যাবে না। এখানে হয়তো বলা যেতে পারে আমাদের চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় কবিতার মাঝে গীতিময়তা শ্রুতিময়তার স্বাদে-গন্ধে প্রাণ উছলানো গতিময়তার ঝরণা কল্লোল থেমে গিয়েছিলো? তারপর কি আর আর কখনোই ফিরে পায়নি তার বাঙালিরূপ? এ প্রশ্ন অমীমাংসিত বা বাংলা কবিতার আত্মপরিচয়ের যে রূপ প্রকাশ করা হয়েছে তাতে মোটেও তুষ্টি নেই। অনেক বিদগ্ধ দার্শনিক চিন্তাবিদ এখনও এনলাইটমেন্টের ব্যাখ্যা করে চলেছেন এবং তাতে নিয়েজিত আছেন। মিশেল ফুকোর রূপ উদ্ঘাটনের জন্যে অষ্টাদশ শতকে প্রকাশিত ইম্যানুয়েল ক্যান্টের একটা লেখনির উপর ভর করে চমৎকার মন্তব্য করেছেন; আধুনিকতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমানা সংকীর্ণ, বিশ্লেষণ অস্পষ্ট আর তাই আধুনিকতা না বুঝে এনলাইটমেন্টের প্রয়োগ করাটাও ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হবে। আমাদের বর্তমান সময়ের এই উত্তর আধুনিক কাব্যচর্চাটা হওয়া উচিৎ রেঁনেসা বা রিফর্মেশনের মতোই ইতিহাস খ্যাত। একজন কবি মাত্রই শিল্পী; আর শিল্পের জন্ম অনুভব থেকে। এই অনুভব থেকেই ভাবাবেগের জন্ম যা প্রকাশিত হলে শিল্পরসিকদের আনন্দ প্রদান করে। এ বিষয়টি প্রয়োজন না মিটিয়েই আনন্দ দেয় তাই তা সুন্দর; হতে পারে তা জাগ্রত স্বপ্ন তবে এটাই ইচ্ছা পূরণের উপায়। হতে পারে তা কল্পনার বিষয়, তবে তা প্রকাশ ক্ষমতাকে নিখুঁতভাবেই গড়ে তোলে। শিল্পের আছে স্থিতি আর জীবনের আছে গতিময়তা। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের যোগ বিয়োগ, অভিজ্ঞতার সাথে চিন্তার সমন্বয়, হৃদয়ের সঙ্গে বুদ্ধির প্রয়োগ, বিশ্লেষণের সাথে আত্মার বিমলানন্দ, বিচারের সাথে সহানুভূতির অবস্থান, রূপের মাঝে বিষাদ, জলের মাঝে রঙ এমনি সব ইন্দ্রিয়ানুভূতি পরিবেশনার নানান আকারে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়ে যখন একটা সংগতি বা সামঞ্জস্যপূর্ণ সৌন্দর্যকে খুঁজে নিয়ে আনন্দ দেওয়া সম্ভব হয় তাতেই শিল্পের দক্ষতা বা তাঁর ফসল জন্মদানকারীগণ এক একটা প্রতিভা। বেনেদেত্তোর ক্রোচের ভাষায় বলা চলে- ‘প্রতিভা- শব্দটি শুধুই শিল্পস্রষ্টার।’ তাই শিল্পীকে তার নিজস্ব চর্চাকৃত বিষয় সম্পর্কে সম্মক ধারনা পোষন করতে হবে, বিশেষভাবে জানতে হবে, গভীরভাবে অনুভব করতে হবে নয়তো তা হবে কারিগরের সৃস্টি বাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্য। কোনক্রমেই শিল্প হবে না। শিল্পী একাধারে দ্রষ্টা ও স্রষ্টা উন্নততর সৃজনীক্ষমতা ও মূল্যবোধের প্রতীক। কবি কথার বর্ণচ্ছটায় ষ্পর্শ ঘামে রঞ্জিত হওয়া তারুণ্যের সকাল-দুপুর-রাত স্বপ্ন আর ইচ্ছের সাম্পানমাঝি দরিয়ার বুকে তরতর করে বইয়ে দিবে বাক্যের স্রোতে। স্বপ্নকে সত্যি করবার উদ্দাম প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত করা কবিতার সান্নিধ্য দ্যুতি ছড়াবে সমাজে সংসারে। মনন আর মেধার মিশ্রনে জীবনের আভা ছড়াবে স্বতঃস্ফূর্ততার কবিতা। আবেগ তাড়িত সম্পন্ন মানুষের প্রতিকৃতিতে থাকবে বিশুদ্ধ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবার নান্দনিকতায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যার মাঝে থাকবে দায়বদ্ধতা মিটিয়ে দেবার নৈকট্য। জীবন ও সামাজিক নিগূঢ় বন্ধনের অন্বেষায় মগ্ন কবি অস্তিত্বের পথ ধরে ইতিহাসের প্রজ্ঞা লগ্নিকারী হবেন, বিষন্ন বস্তুবিশ্বের একাত্মতায় যোগি না হয়ে জ্বালিয়ে দিবেন তন্দ্রালীন জোনাকির মশাল আর তার প্রতীক আশ্রিত শব্দমালায় সূর্য হবে নতজানু পদ্মের দোসর। আর খোঁজার আগ্রহ যাদের আছে, যারা বোঝেন ভাব-বাচ্যের আবেদন শব্দের নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ হয়, নিজকে অন্যকে পুনরায় ভাবনার সুযোগ করে দেয় যে এইতো আমাদের নিত্য দিনের সংস্কৃতি তেমনি প্রাত্যহিক সমস্ত গ্লানি সরিয়ে দেবার কৌশল শিখে নেবার প্রত্যয় যেখানে আত্মবিশ্বাস বাড়ায় সেখান থেকে কবিতার জন্ম। আর সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি- তাই কাব্য ভাষা সকলের জন্যেও নয়। কবিতার সামনে দাঁড়ালে তার কাব্য ভাষার রূপময়তায় যা সুন্দর বা বাহ্ বলে উঠবার মতো চোখের অঞ্জন হয় তারাই আপন খেয়ালে শুদ্ধ কাব্য ভাষায় আমাদের সামনে দাড়িয়ে বলতে পারেন, আমি কবি বা কবিতা লিখতে পারি। সব মিলিয়ে আপন খেয়ালে নতুন কাব্য ভাষায় কবি অবলীলায় বন্দি করতে পারেন পাঠককে। পাঠক তাঁকে ঘিরে গড়তে পারেন যে কোনো বৃত্ত, যেখানে থাকে মুক্তির মতো আস্বাদ। এছাড়াও কবির মাঝে কবিতার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় সারল্য, সহজ জীবন বোধের দিন, উপমা ব্যাঞ্জনার সুখ প্রহ্লাদ। অনেক সময় দেহজ কামজ যন্ত্রনার বাইরেও যে অতিন্দ্রিয় কোন অনুভব থাকে, সেখানে কবি মাত্রই শব্দের আবেশে দিতে পারেন শুশ্রুষা, কবিকে তাই মুন্সিয়ানার ঘটকও বলা যেতে পারে, আমি আমরা যেথা হতে নিতেই পারি আত্মার বিমলানন্দ। কবি- নীলকণ্ঠী কৃষ্ণ অবতার। নৈঃশব্দ্যের মাঝ থেকে আহরণ করা শব্দের আকর খোঁজা চাষী। মাছরাঙার মতো জল অক্ষরের ভূগোল স্পর্শ করা দরাজ স্বর, হাওড় সংগীতে সময়কে স্তব্ধ করে দেবার অপার্থিব যাদুকর বা অর্ফিয়ুসের অমোঘ নিয়তি বা নার্সিসাসের আত্মমগ্নতার আত্মহুতি যেখানে দস্তায়েভস্কি প্রশ্ন ঝুলে থাকে টেলিগ্রাফের তারে- কবিরা মহিমান্বিত বেদনার সন্তান পূর্বাপর, আজন্ম ও অদ্যাবধি। তাই এই শৈল্পিক নৈতিকতার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা অবশ্যকরণীয় কবির কর্ম, তাইতো কবিতা হৃদয়কে সৎ করে দেয়। আর কবিতা লেখার সময় কবি হয়ে ওঠেন বিশুদ্ধ, সৎ এক ধ্যানী সন্ত।


২টি মন্তব্য:

  1. কুহক ভাই,
    আমার একটা কেন-র উত্তর পেলাম আপনার লেখায়।
    আর ভাবনাগুলো আরো সচকিত ও স্বচ্ছ হয়ে গেল।
    ধন্যবাদ অনিঃশেষ।

    উত্তরমুছুন