অদ্বিতীয়ম
সীমা ব্যানার্জি-রায়
এই দেখো! আবার পাশ ফিরে শুয়েছো? কত দেরি করে যাবে শুনি? সবাই এসে গেলে তখন গেলে লোকে কি ভাববে বলো তো?
এই দুজন মানুষ সব সময় দেরি করে আসে। কোথাও যাবার আগে মিস্টি খুনসুটি-টা লেগেই থাকে শর্মি আর শৌর্য্যের মধ্যে।
-কেন আজ আবার কি আছে?
~~কতবার বল্লাম না যে, আজ শতদল পার্টি দিচ্ছে ম্যারিয়ট হোটেলে।
-ওহ! তাই নাকি? সত্যিই তো। এই যাঃ। তুমি তো বলেছিলে, কি যে হয়েছে আজকাল সব ভুলে যাই। আচ্ছা, তুমি আগে রেডি হয়ে নাও, আমার আর কত দেরি হবে? ছুটির দিন একটু ভাতঘুম দেব তা না। বেশ তো বিন্দাস ছিলাম সকাল থেকে। আবার নিমন্ত্রনটা কোথা থেকে এসে সব ম্যাশাকার করে দিল।
~~আমি রেডি হয়েই আছি। খালি শাড়িটা পড়ব। এবার উঠে নিজে রেডি হয়ে নাও প্লিজ। লক্ষ্মী সোনা। শর্মি জানে ওষুধের ডোজের মত "লক্ষ্মী সোনা" - কথাটা বললে কাজ হয় তাড়াতাড়ি।
-ওকে ম্যাডাম! জো হুকুম। বান্দা অভি রেডি হো যায়েগা।
দুজনে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গাড়ি করে পৌঁছে গেল ম্যারিয়টে।
শর্মিলার এই বয়সেও এখনও যা পড়ে মানিয়ে যায় বেশ। বেশ একটা এলিগ্যান্ট চেহারা, যে দেখে না বলে আর পারে না। দুজনেই বেশ ছিমছাম পোশাক ব্যবহার করে। আর চেহারাও খুব সুন্দর দুজনের। সব সময় মানুষকে সাহায্য করাকেই যারা জীবনের মূল ব্রত বলে মেনে নেয় তাদের চেহারা তো সুন্দর হবে, জানা কথা।
বেশ কিছু লোক এসে গেছিল। তাহলেও এইবার ওরা তাড়াতাড়ি এসেছে । শর্মিলা আর শৌর্যদের তাই আজ খুব খুশি খুশী ভাব।
#শতদল এগিয়ে এসে ওদের দুজনকে নিজের নতুন বৌ-দূর্বাকে দেখাতে নিয়ে গেল হলের ভেতর।
শর্মিলা তো অবাক। কি মিস্টি দেখতে, গায়ের রং একটু চাপা আর তার জন্যেই বোধহয় আরো সুন্দর লাগছে দেখতে। একটা আকাশি রঙের ব্রোকেট বেনারসী শাড়ি পরেছে, তার সাথে ম্যাচ করা জড়োয়ার সেট। চুলটা টেনে খোপা বাঁধা। বড় বড় চোখ আর পানের পাতার মতন মুখ। নাকটা দেখে মনে হচ্ছে একেই বলে বোধহয় টিয়াপাখীর নাক। একটা ছোট্ট হিরে চকচক করছে ওর সেই নাকে। অবাক হয়ে দেখছে দুজনে। বয়সও তো মনে হ্য় উনিশ কি কুড়ি। চুপচাপ একটা রিসেপশন চেয়ারে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন রাজসিংহাসনে বসে আছে রাজরানী। কি যে ভাল লাগছিল দেখতে তা বলার নয়।
এইসব সাত পাঁচ ভাবছে আর ওদিক থেকে মিত্রার ডাকঃ
-এই শর্মি কখন এলি ? বাবা কি মাঞ্জা দিয়েছিস রে তোরা দুজনে?
ও দেখলেই এরকম বলে। শর্মির লেডি ব্রাবোন কলেজের বন্ধু। এখনও সেই আগের মতনই চনমনে আর ছটফটে আছে। কোনো চেঞ্জ নেই ওর।
~কি পরেছি রে। একটা সাধারণ কাঁথা স্টিচ বেনারসী পরেছি আর নিজে কি কম গেছিস নাকি? বলছে আর দূর্বার দিকে তাকিয়ে আছে।
-শৌ ও তোর সাথে বেশ ম্যাচ করে পড়েছে দেখছি। বাব্বাঃ আছিস ভাল দ্যাবাদ্যাবি মিলে। আর দিনে দিনে যেন আরো সুন্দরী হয়ে যাচ্ছিস। হবি নাই-বা কেন বল। মেড ফর ইচ আদার যে । আর আমার উনি খালি খিটখিট করেই আছেন সব সময়। এটা পোরো না ওটা পোরো না, মানায় না। মেয়ে বড় হচ্ছে। আচ্ছাঃ এরা এই সাহেব মেমদের দেশে এসেও একটু বদলালো না রে! সত্যি ডিসগাসটিঙ। এদেশে আবার মানায় না কি রে? বয়স্ক-রা সবাই এখানে কি সুন্দর ব্রাইট কালার পর্ চোখ থাকতেও দেখে না কেন কে জানে।
শর্মি খালি হাসল।
-শতদল একটা জব্বর বৌ পাকড়াও করে এনেছে দেখেছিস? ভেবেছিলাম আমার পপিটাকে যদি পছন্দ করে। কত নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালাম। পপির সাথে বেশ ভাব ও তো হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ শুনলাম বিয়ে করে এসেছে। এইসব মেয়ে ছেড়ে কি আর আমার মেয়ে? হলেই বা ক্যালিফোর্নিয়ায় মানুষ হওয়া মেয়ে। আজকালকার ছেলেরা সুন্দরী আবার সরস্বতী মেয়ে চাইছে। জানি না রে আমার পপিটা আবার কাকে ধরবে। সাদা না কালো কি যে কপালে আছে, জানি না। এদেশে তো শুনছি সবাই আমেরিকান বিয়ে করছে,। জানি না রে কি হবে শেষে।
~~হ্যাঁ, সত্যি ভারি মিস্টি দেখতে। শর্মি বলল। মিত্রার আবার শুরু হলোঃ
-চোখদুটো দ্যাখ একেবারে মা দূর্গা।
~~থাক আর অত বোলতে হবে না তোকে, নজর লেগে যাবে। মা বাবাকে ছেড়ে এতদূর এসেছে আমাদের কাছে আর আমরাই তো ওর গার্জেন তাই না?
মনে মনে ভিষণ ভালো লেগে গেছে শর্মিলার দূর্বাকে একবার দেখেই।
খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ। ললিপপ চিকেন, তন্দুরী চিকেন, লেমন বাতার ফিস ফ্রাই, সামোসা, দহি বড়া আর ফ্রুট পাঞ্চ ড্রিঙ্কস আর এমনি ড্রিঙ্কস তো আছেই। স্ন্যাক্স থেকে শুরু করে এলাহি ডিনার। মটন বিরিয়ানী, ভেজিটেবল বিরিয়ানী, চিকেন মাখানি, বার-বি-কিউ চিকেন, মটর পনীর। কত বোলবো। সত্যি এলাহি ব্যাপার করেছে। কোরবেই বা না কেন? পয়সার তো অভাব কাকে বলে জানে না শতদল।
খাওয়া দাওয়ার পর শুরু হলো এখনকার ফেভারিট নাচ জুম্বা। দারুন নাচে এই শতদল। দেখতেও খুব সুন্দর। একেবারে রাজপুত্তুর বললেও বোধহয় কম বলা হবে। নাচছিল সব সময় রাহুলের বৌ তোতোর সাথে। সফটওয়্যারে এক সাথে কাজ করে রাহুল, তোতো আর শতদল। দূর্বা শুধু তাকিয়ে আছে তার শতদলের দিকে। বেচারাকে দু একজন টানাটানি করলো কিন্তু ও যেতে চাইল না ।
শৌর্য্য ওর তরফে হয়ে বললোঃ
-ছেড়ে দাও ওকে । আজ ও ক্লান্ত। ওর আজ দেখার পালা।
দেখলাম ওর মিস্টি মুখে কৃ্তজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠল।
ওর হাসি মুখ দেখে মিত্রা আবার ডগমগিয়ে উঠল।
-দেখেছিস ! এই দেখেছিস! হাসলে আবার গালে কি সুন্দর টোল পড়ে। নাঃ! সত্যি আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি রে। ইশ আমার মেয়েদুটোর একটাও যদি এরকম দেখতে হত? অবশ্য যেমন আমি তেমনি তো দেখতে হবে, তাই না ? কি বল?
বলে দুজনেই হেঁসে উঠল খিল খিল করে।
খুব বড়লোকের একমাত্র আদুরে ছেলে এই শতদল। কলকাতার ম্যানডেভিলা গার্ডেন্স-এর বারো তলা আকাশপ্রদীপ বিল্ডিংটা ওদের, বাবা মা থাকেন একটা বিরাট ফ্ল্যাট নিয়ে আর বাকি সব ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন ওঁনারা । একটা গরীব ছেলে আর মেয়েকে এ্যডপ্ট করে দেশে আছেন। বছরে একবার পৃথিবীর কোনো এক দেশে ভ্রমণে বেড়োন। এখন ছেলে আর ছেলের বৌ-এর সাথে আসেন নি কারণ, ওদের এনজয় করতে দিয়েছেন । জীবনকে চিনতে দিয়েছেন। নিজেরাই যাতে নিজেদের সমস্যার সনাধান করে তার উপযুক্ত এখনই সময়, মনে করেন তারা ।
অবশেষে নাচও শেষ হয়ে গেল। একে একে গেস্টরা যেতে আরম্ভ করলো । শর্মিলা আর শৌর্য্য ইচ্ছে করেই দেরি করতে লাগলো যাতে দূর্বার সাথে ভাল করে আলাপ করতে পারে । আস্তে আস্তে ভিড় কমলে ওঁরা দুজনে এগিয়ে গেল দূর্বার দিকে।
শর্মিলা ওর হাত ধরে বললঃ চিন্তা কোরো না, আমরা তো আছি। ওর হাত ধরে দেখে ঠান্ডা বরফ হাত। এখানে যারাই প্রথম আসে এরকম একলা ভাবে তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়। কাজেই তোমারও কোন অসুবিধা হবে না দেখো।”
শুধু বড় বড় চোখে ওদের দিকে তাকিয়েই প্রণামটা সেরে ফেলল। শর্মিলা ওকে জড়িয়ে অনেক আদর করল।
~~শতদলকে বলব, আমাদের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে আসতে, কেমন?
তারপর ওকে আবার আদর করে শর্মিলা আর শৌর্য্য বাড়ি ফিরে গেল। সারা রাস্তায় ওরা শুধু দূর্বার সুখ্যাতি করতে করতে গেল। বিছানায় শুয়ে শৌর্য্য বললঃ মেয়েটা যেন বড্ড সুন্দর! তাই না? একেবারে একটা ডল পুতুল। আমাদের যদি এরকম একটা মেয়ে থাকত, কি বলো। শর্মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
যখনই শুনেছিল যে ওরা মা বাবা হতে পারবে না, তখনই ওরা ভেবেছিল দেশ থেকে একটা বাচ্চা এ্যডপ্ট করবে কিন্তু এই ভিনদেশে বন্ধু-বান্ধবদের মুখে নানারকম গল্প শোনার পর আর সাহস করে নি এই নিঃসন্তান সুখী দম্পতি।
একদিন লঙ উইকেন্ড দেখে শর্মি ডাকল শতদল আর দূর্বাকে নিজেদের বাড়িতে। একটা হলুদ রঙের গাড়োয়াল শাড়িতে ম্যাচিঙ গয়না পরে এসেছে আর শতদল পরেছে হলুদ রঙের পাজ্ঞাবী আর চুড়িদার। দরজা খুলে ওদের দেখেই মনে মনে বলে ফেলল একেই বলে ভগবানের সৃষ্টি। ওদের আদর করে ঘরে নিয়ে আসল।
প্রথমে মাটন চপ, এগ ডেভিল আর ফ্রেস্কা-ক্যানবেরি জুস দিয়ে তৈরি ড্রিংকস দিল খেতে।
চুপ করে বসে আছে দূর্বা কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে। শতদল যেমন কথাতে তুবড়ি ছোটায়, দূর্বাকে দেখে মনে হলো তার একেবারে উল্টো। ওর আড়ষ্ট ভাব যাতে কেটে যায়, তাই ওকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের বাড়ী দেখাতে। ব্যাক-ইয়ার্ডে গার্ডেন চেয়ারে দুজনে বসল। দূর্বা এই প্রথম কথা বলল। কি সুন্দর তোমার বাড়ি।
শর্মি বললঃ তোমার ও হবে একদিন, আমরা তো বহুবছর এদেশে এসেছি।
শর্মি জিজ্ঞেস করলঃ তোমরা কয় ভাই বোন, দূর্বা?
-আমরা দুই জমজ বোন আর এক ভাই। ভাই অনেক ছোট।
~~তোমার বাবা কি করেন?
-আমার বাবা স্টেশন মাস্টার আর মা প্রাইমারি স্কুলে পড়ান।
শর্মি বল্লঃ
~~বাহ! খুব ভালো। আরেক যে জমজ বোন তার বিয়ে হয়ে গেছে?
-না, তবে ওর বিয়ে হবে আগামি বছর। ছেলে লন্ডনে থাকে।
~~তোমরা দেশে কোথায় থাকো?
-আমরা থাকি ধামুয়ায়।
~~আচ্ছা দূর্বা ! ধামুয়া আর কলকাতা –তোমাদের বিয়ে হলো কি ভাবে? একটু বোলবে?
ও তখন বললঃ
-আমার বাবার এক বন্ধু আমার শ্বশুর শাশুরিকে আমার কথা বলেছিলেন। তারপর ওনারা আমাকে দেখতে এসেই একেবারে শাশুরিমা নিজের গলার হার খুলে আশীর্বাদ করে গেছেন।
শর্মি বল্লঃ তা তো কোরবেনই। তুমি যে খুব মিস্টি একটা মেয়ে, কোরবেন না? না কোরলেই ভুল করতেন। ও হাসল তবে হাসিটা কেমন যেন করুণ।
হয়ত মন খারাপ লাগছে ভেবে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে শর্মি জিজ্ঞেস করলঃ
~~গান জানো?
-জানি তবে খুব ভাল না। শর্মি আর শৌর্য্য আবার অসম্ভব গান পাগল। নিজেরা গাইতে পারে না কিন্তু যেখানে গানের আসর সেখানেই ওরা হাজির।
কাজেই শর্মি গান জানে শুনে হাঁক ডাক শুরু করে দিল “ এই শুনছো? এদিকে এসো, দূর্বা গান জানে।”
শৌর্য্য আর শতদল বাইরে এলো। শতদল বললঃ বাহ! তোমাদের বাগান একেবারে হেভেন লাগছে তো। তোমরা বরং গান শোনো আর আমি ঘুরে ঘুরে দেখি। বেশ কিছু অজানা অচেনা গাছের মেলাও বসেছে দেখছি।
শৌর্য্য শর্মিলার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। গেরুয়া চাঁদ তখন দূরে শিরীষ গাছের মাথার ওপরে। তার ছায়া এসে পড়েছে সামনের নীল সুইমিঙ পুলের জলের গায়ে। কোথা থেকে নাম না জানা ফুলের মিস্টি গন্ধরা হেলে দুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-দূর্বা গান শুরু করো এবার। এই ওয়ানডারফুল ওয়েদারে গান~ আহা! উই আর রেডি নাও, সিঙ আ সঙ, বলে উঠল শৌর্য্য।
ও শুরু করলোঃ
ওহে দয়াময় , নিখিল আশ্রয় এ ধরা –পানে চাও-
পতিত যে জন করিছে রোদন, পতিত পাবন, তাহারে উঠাও......।
শৌর্য্য বললঃ এ গান কেন? এত সুন্দর সময়-এ তো আনন্দের গান হবে, প্রেমের গান হবে। কি বলো শর্মি? একটা প্রেমের গান হোক না কেন? তুমি তো ভিষণ ভাল গান করো। দাঁড়াও এবার পূজোর ফাংশনে তোমার নাম দিয়ে দেব। এই যে শতদল কি ব্যাপার বলো তো, রূপে লক্ষ্মী আর গুণে সরস্বতী নিয়ে এসেছো দেখছি। রিয়ালি প্রাউড অফ ইউ। আর কি কি গুণ আছে শিল্পীর বলে ফেলো তো? শর্মি তো অবাক –গান শুনে –একেবারে চুপ হয়ে গেছে। বললঃ
-না থাক এবার খেয়ে নাও সবাই। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাচ্চা মেয়ে খিদে পেয়ে গেছে বোধহয়।
খাওয়া দাওয়াও মিটে গেল আস্তে আস্তে। ওরা দুজনে গুড নাইট বলে চলে গেল।
বেশ কিছুদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল শর্মির। একদিন ফুরসুত পেয়ে ফোন করল দূর্বাকে। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর দূর্বার গলা শোনা গেল কিন্তু কেমন যেন নিরুত্তেজ। “হ্যালো।”
~~হ্যাঁ-রে, কেমন আছিস?’ হঠাত করে ‘তুই’ বলে ফেলেছে শর্মি।
কি হয়েছে দূর্বা? মন খারাপ লাগছে নাকি? ইশ আমার আর ফোন করা হয়নি তোকে আর তুইও তো একটা ফোন করতে পারতিস? মাসিকে ভাল লাগে নি বুঝি?
আবার ওদিকে চুপচাপ।
~~ কি হোল? এই মেয়ে? শরীর খারাপ নাকি? শতদল কখন অফিস থেকে ফিরবে’? হঠাৎ মনে হলো ও কাঁদছে। শর্মি আবার বললঃ ‘আচ্ছা মুশকিল, এই দূর্বা ? লক্ষ্মী সোনা মেয়ে, আমাকে বলবি না?’
তখন বলেঃ ‘শতদল আজ দুদিন হোল বাড়িতে আসে নি মাসি, হঠাত নাকি অফিসের কাজে ওকে যেতে হয়েছে। যাবার আগে বলে গেল যে, একদিন পরেই চলে আসবে আর আজ দুদিন হয়ে গেল মাসি, একটা ফোন পর্য্যন্ত করেনি সে’।
~~সে কি? একা গেছে না আরো কারুর সাথে গেছে?
বল্লঃ-ও আর তোতো
শর্মি বললঃ ‘আচ্ছা, দাঁড়া আমি আর তোর মেসো গিয়ে তোকে নিয়ে আসছি’।
-আমার খুব ভয় করছে মাসি। না না, আমি যাব না । ভাববে আমি তোমাদের বলে দিয়েছি। খালি বলে গেছে যে, কাউকে বলার দরকার নেই। এখানে এইরকম একলা থাকতে হবে মাঝে মাঝে।
বল্লামঃ ‘আচ্ছা! আমরা আসছি আজ, আমার কাজ নেই আর তোর মেসোর জানিস তো আমি কাজে না গেলে সে ও বাড়ীতে থাকবে। কাজেই আমরা আসছি এখুনি’।
শর্মি শৌর্য্য-কে বল্লঃ ‘চলো আমরা গিয়ে ওকে নিয়ে আসি’। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গাড়িতে করে ওরা চলে এল দূর্বা-দের এপার্টমেন্টে। রাস্তায় আসতে আসতে শর্মি সব বলল শৌর্য্য-কে।
শৌর্য্য সব শুনে বললঃ , ‘সে কি?’ এত সুন্দর একটা ফুটফটে বাচ্চা বৌকে একা রেখে গেছে? কেন? কেন? আর নতুন বৌকে কেউ একা রেখে যায়? ওকেও তো নিয়ে যেতে পারত? যাচ্ছেতাই একেবারে। চলো চলো আর দেরি না’।
দেখতে দেখতে ওরা দুজনে পৌছে গেল। দূর্বাকে দেখে তো ওরা অবাক। কেমন যেন চোখের কোলে কালি পরেছে, অমন যে মা দূর্গার মতন চেহারা একেবারে বিষন্নতায় ভরা।
~~আগে আমাদের জানাবি তো? শৌর্য্য তো রাগারাগি আরম্ভ করে দিয়েছিল আর কি? ওর ওই এক স্বভাব একটুকুতেই একেবারে টেনশন নিয়ে নেয়।
ওর জামা কাপড় কিছু নিয়ে ওকে শর্মিরা নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে এল।
তিনদিনের দিন এল শতদল-এর ফোন। শুনে মনে হলো রাগারাগি করছে। দূর্বা খালি চুপ করে আছে।
এবার ফোন রেখে দিল। আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন। শর্মিকে দিয়ে দিল ফোনটা।
শর্মি বললঃ ‘এই যে শতদল! কি ব্যাপার? কবে আসছো এখানে’?
বললঃ ‘সরি মাসি! দূর্বা নিশ্চয়-ই খুব ডিস্টার্ব করেছে। এত ভয় খেলে চলবে কি করে? থাকত তো গাঁয়ে, গেঁইয়া একটা’।
শর্মি বললঃ- ‘ছিঃ শতদল ওরকম করে কেউ নিজের নতুন বৌকে বলে নাকি? ও তো ফোন করে নি, আমিই করেছিলাম অনেকদিন খোঁজ-খবর নিই নি তাই, আজ সময় পেয়েই ফোন করেছি। সবাই প্রথম প্রথম এরকম ভয় পায়, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো’।
সব শুনে শতদল বললঃ ‘আচ্ছা এখন রাখি পরে কথা হবে। আমি তো কাল ফিরছি। ওকে এখন রাখো তোমাদের কাছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসব’।
শর্মি বললঃ “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। কোন অসুবিধা হবে না। আর আমাদের ভালই লাগছে বেশ’।
এবার দূর্বাকে নিয়ে ওরা খেতে বসল, খাবার পর ওকে নিজেদের সাজানো গেস্ট রুমের বিছানায় শুতে বলল। ওরা দেখল কত তাড়াতাড়ি সে ঘুমিয়ে পড়ল।
দরজা বন্ধ করে বাইরে এসে শৌর্য্য –এর সাথে আলোচনা করল কি করা যায়!
ও ঘুম থেকে উঠলে আবার ওরা গল্প শুরু করল। শৌর্য্য ওর কাছে সব শুনল।
বললঃ ‘কোন চিন্তার নেই। আমরা তো আছি, তাই না? কোন বিপদ ঘটতে দেব না আমরা।’ ওর মুখে নিশ্চিন্তের হাসি ফুটে উঠল।
দূর্বা যা বলল তার মানে হলো শতদল আর রাহুলের বৌ তোতো-র মধ্যে একটা ভালবাসা আগের থেকেই ছিল। এখন এটা রাহুল জানে কি না দূর্বা জানে না। তবে রাহুল ছেলেটা যে খুব ভাল তা শর্মিরা সবাই জানে ভালভাবে।
তবে তোতো-র একটু অহংকার আছে কারণ, সে একজন নামকরা হাই টেক নারী আবার সেতার-এ বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেছে। কথা একটু কম বলে সবার সাথে অবশ্য শর্মির মিস্টি মাতৃসুলভ ব্যবহারের জন্য সবাই তাকে ভালবাসে। তোতো-ও বাদ যায় না। তোতো-কে দেখে মনে হয় খুব মডার্ন বাড়ীর মেয়ে সে।
দেখতে দেখতে শতদল এসে গেল দুদিন পর। বাড়ী থেকে বেশ ফ্রেশ হয়ে এসেছে দেখে তাই মনে হল। কোন রকম চিন্তার রেশ নেই মুখে চোখে।
শর্মিরা ওদের খেয়ে দেয়ে বাড়ী যেতে বলল। এইবার শতদল রেগে গেল, বললঃ “ দেখো মাসি! তোমরা হয়ত অনেককিছু ভাবছো আমাদের সম্বন্ধে, মনে রেখো ওসব কিচ্ছু না। আমরা সত্যি খুব সুখী। এখন দূর্বাকে এখানকার অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হবে, এতে তো রাগারাগি বা মান-অভিমানের কিছু নেই । আন্ডারস্ট্যান্ডিং-টাই আসল, তাই না?
দূর্বাকে দেখে মনে হল কেমন যেন ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে আছে। শর্মি শতদল-কে আলাদা করে ডেকে নিয়ে এসে বললঃ –‘দেখো শতদল! তোমাদের পারসোনাল ব্যাপারে আমাদের মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই, কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য যে একটা নিরীহ জীবন কষ্ট পাচ্ছে তা তো করতে দেওয়া উচিত নয়, তাই নয় কি’? এই ভিনদেশে আমরা সবাই সবার ভালো চাই।
আবার শতদল গেল রেগে। বললঃ
-তোমরা খালি আমার দোষটা দেখছো। আমার চাকরির ক্ষেত্রে এরকম হতেই পারে, এই জন্য মা বাপি-কে বলেছিলাম আমার এডুকেটেড মেয়ে চাই কিন্তু কোথা থেকে একে জবরদস্তি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা তাদের কর্তব্য শেষ করেছেন, এদিকে সে নাকি সব সময় আমাকে সন্দেহ করে। এ তো টলারেট করা যায় না, কি বলো তুমি? তুমি যদি রাতদিন সন্দেহ করো শৌর্য্যমেসোকে, তাহলে কি আর তোমরা সুখী দম্পতি নামে ফেমাস হতে? হতে না, তাই না?
শর্মিও এডামান্ড। ‘তুমি ওকে বোঝো শতদল, একটা জীবন নস্ট করে দিয়ো না’। দেখল, বলে কোন লাভ হবে না । কিছু পরে শতদল খালি বললঃ ‘রেখে দাও তোমাদের কাছে। আমার এরকম বৌ চাই না। টিকিট কেটে দিচ্ছি ওকে, দেশের বাড়িতে ফেরত যাক। মা বাপি বিয়ে দিয়েছেন তাদের পছন্দ করা মেয়ের সাথে কাজেই তারাই নিয়ে থাকুন সেই মেয়েকে। তোমাদের যা করার তোমরা কর। আই ডোন্ট কেয়ার এ্যট অল’। বলেই গটগট করে চলে গেল।
যাই হোক, দূর্বাকে আর যেতে দিল না ওরা। বলা যায় না যদি কিছু খারাপ হয়।
এবার একদিন তোতো-কে বাড়িতে ডেকে বোঝালো শর্মি। দেখল মেয়েটা কিন্তু বেশ ভাল। ভাবার মন আছে। যা ভেবেছিল ওরা, তা সে নয়।
-সব শুনে তোতো বললঃ, ‘ সত্যি বলতে আমার দ্বিধা নেই মাসি। আমি আর রাহুল কোনদিন মা বাবা হতে পারব না অথচ আমরা দুজন দুজনকে ভিষণ ভালবাসি। শর্মি দেখল তোতো-র চোখে জল। জানো মাসি একমাত্র শতদল যে আমাকে আর রাহুলকে আশা দিতে পারে। যদিও এটা ইল্লিগাল তবুও আমরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছি।
শর্মি বললঃ এ্যডপ্ট করো।
তোতো মুখ নিচু করে বললঃ, নাঃ, রাহুল চায় আমার রক্তের সন্তান।
শর্মি আবার বললঃ আজকাল তো কত কিছু হয়েছে, টিউব বেবি তাই ট্রাই করো। বললঃ নাঃ মাসি তা হয় না।
~শতদল রাজী হয়েছে?
তোতোর সপাট উত্তরঃ হ্যাঁ।
হতবাক শর্মি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললঃ ‘দেখো তোতো! সিনেমাতে অনেক কিছুর সমাধান হয় খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু বাস্তব জীবনে তা সম্ভব হয় না। কাজেই তুমি, শতদল বা রাহুল যা ভাবছো তা কিন্তু মোটেই ভাল না। এখন এই অল্প বয়সে তোমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো, তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করার ভাবনা তোমাদের আজ নেই। আইনের একটা দিক আছে। একটা অবলা মেয়ের জীবন খারাপ কোরো না তোতো। তুমি অনেক শিক্ষিত তোমাকে বোঝানো বাতুলতা জানি...তাও!
তোতো মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল কিছুক্ষণ! তারপরেই হঠাৎ কেঁদে ফেলল সে, ধরা গলায় বললঃ “মাসি আমাকে ক্ষমা করো। আমার মডার্ন মা কিন্তু কখনই জীবনের ভাল দিকটার শিক্ষা দেন নি। সত্যি তো আমি একবার-ও ভেবে দেখি নি কেন? আমিও তো এক সুখ দুঃখ দিয়ে গড়া নারী। আজ আমার যদি এইরকম অবস্থা হতো, তাহলে আমি কি করতাম? ছিঃ ছিঃ এ আমি কি করছিলাম সমাজ আমাদের কি চোখে দেখত, নিজেদের বিবেকের কাছে আমরা কি জবাবদিহি করতাম? তুমি আমার চোখ খুলে দিলে মাসি। আমি সত্যি আজ খুব লজ্জিত।
কাজেই মাসি আজ থেকে তুমি আমার মাসি নও -আমার ‘মা’।
দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সবাই বলে হাই টেক নারী, কিন্তু কোথায়? মায়া মমতা দিয়ে যে নারী তৈ্রী তা দেখিয়ে দিল তোতো। বললঃ ‘ আমি আজকেই ফিরিয়ে দেব শতদল-কে সেই দূর্গা প্রতিমার কাছে। আমি নিজে স্বার্থের কথা ভাবছিলাম আর সেই মেয়েটার কথা একবার-ও ভাবি নি। ধিক্! আমার শিক্ষাকে! চলো ওর কাছে যাই –বলে তোতো ছুটে দূর্বার কাছে গিয়ে বললঃ ‘চল বোন! তোর শতদল যে অপেক্ষা করছে তোর জন্য, যাবি না? তুই যে আমার একটা ছোট্ট মতন বোন, “তুই আমার ভোরের আলোর মিতা, জানিস কি তা?” তোর এই চেহারা দেখে কি দিদি থাকতে পারে, বল?'
চলি মা! আবার আসবো তোমার কাছে আমরা দুই বোনে। অনেক কিছু শেখার আছে যা নিজের মা জন্ম দিয়েও শেখাতে পারে না। মা হতে গেলে প্রকৃ্ত মা হবার শিক্ষা না পেলে আমার মতন অর্ধশিক্ষিত-র কোন সন্তানের জন্ম না দেওয়াই ভাল। কাজেই যেদিন আমি- সত্যি মা! - কাকে বলে জানতে শিখবো- সেদিন আবার মা হবার স্বপ্ন দেখবো।
সুখের অশ্রুধারা নেমে এলো শর্মির দুচোখ বেয়ে। শৌর্য্য আড়াল থেকে সব শুনছিল। এবার এসে শর্মির গলা জড়িয়ে বললঃ ‘~ ওই দেখো তোমার দুই মেয়ে কেমন হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, শুনলে তো তোতোর মুখে। মা হওয়া কি মুখের কথা নাকি? আমি আজ বড় গর্বিত তোমার জন্য শর্মি! জন্ম-জন্মান্তরে যেন তোমাকে পাই, এই প্রার্থনা জানাই ঠাকুরের কাছে।
শর্মি জল ভরা দুচোখ নিয়ে শৌর্য্যের বুকে মাথা রেখে দুই মানসী মেয়ের মিলিয়ে যাওয়া দেখতে লাগল।
এই দেখো! আবার পাশ ফিরে শুয়েছো? কত দেরি করে যাবে শুনি? সবাই এসে গেলে তখন গেলে লোকে কি ভাববে বলো তো?
এই দুজন মানুষ সব সময় দেরি করে আসে। কোথাও যাবার আগে মিস্টি খুনসুটি-টা লেগেই থাকে শর্মি আর শৌর্য্যের মধ্যে।
-কেন আজ আবার কি আছে?
~~কতবার বল্লাম না যে, আজ শতদল পার্টি দিচ্ছে ম্যারিয়ট হোটেলে।
-ওহ! তাই নাকি? সত্যিই তো। এই যাঃ। তুমি তো বলেছিলে, কি যে হয়েছে আজকাল সব ভুলে যাই। আচ্ছা, তুমি আগে রেডি হয়ে নাও, আমার আর কত দেরি হবে? ছুটির দিন একটু ভাতঘুম দেব তা না। বেশ তো বিন্দাস ছিলাম সকাল থেকে। আবার নিমন্ত্রনটা কোথা থেকে এসে সব ম্যাশাকার করে দিল।
~~আমি রেডি হয়েই আছি। খালি শাড়িটা পড়ব। এবার উঠে নিজে রেডি হয়ে নাও প্লিজ। লক্ষ্মী সোনা। শর্মি জানে ওষুধের ডোজের মত "লক্ষ্মী সোনা" - কথাটা বললে কাজ হয় তাড়াতাড়ি।
-ওকে ম্যাডাম! জো হুকুম। বান্দা অভি রেডি হো যায়েগা।
দুজনে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গাড়ি করে পৌঁছে গেল ম্যারিয়টে।
শর্মিলার এই বয়সেও এখনও যা পড়ে মানিয়ে যায় বেশ। বেশ একটা এলিগ্যান্ট চেহারা, যে দেখে না বলে আর পারে না। দুজনেই বেশ ছিমছাম পোশাক ব্যবহার করে। আর চেহারাও খুব সুন্দর দুজনের। সব সময় মানুষকে সাহায্য করাকেই যারা জীবনের মূল ব্রত বলে মেনে নেয় তাদের চেহারা তো সুন্দর হবে, জানা কথা।
বেশ কিছু লোক এসে গেছিল। তাহলেও এইবার ওরা তাড়াতাড়ি এসেছে । শর্মিলা আর শৌর্যদের তাই আজ খুব খুশি খুশী ভাব।
#শতদল এগিয়ে এসে ওদের দুজনকে নিজের নতুন বৌ-দূর্বাকে দেখাতে নিয়ে গেল হলের ভেতর।
শর্মিলা তো অবাক। কি মিস্টি দেখতে, গায়ের রং একটু চাপা আর তার জন্যেই বোধহয় আরো সুন্দর লাগছে দেখতে। একটা আকাশি রঙের ব্রোকেট বেনারসী শাড়ি পরেছে, তার সাথে ম্যাচ করা জড়োয়ার সেট। চুলটা টেনে খোপা বাঁধা। বড় বড় চোখ আর পানের পাতার মতন মুখ। নাকটা দেখে মনে হচ্ছে একেই বলে বোধহয় টিয়াপাখীর নাক। একটা ছোট্ট হিরে চকচক করছে ওর সেই নাকে। অবাক হয়ে দেখছে দুজনে। বয়সও তো মনে হ্য় উনিশ কি কুড়ি। চুপচাপ একটা রিসেপশন চেয়ারে বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন রাজসিংহাসনে বসে আছে রাজরানী। কি যে ভাল লাগছিল দেখতে তা বলার নয়।
এইসব সাত পাঁচ ভাবছে আর ওদিক থেকে মিত্রার ডাকঃ
-এই শর্মি কখন এলি ? বাবা কি মাঞ্জা দিয়েছিস রে তোরা দুজনে?
ও দেখলেই এরকম বলে। শর্মির লেডি ব্রাবোন কলেজের বন্ধু। এখনও সেই আগের মতনই চনমনে আর ছটফটে আছে। কোনো চেঞ্জ নেই ওর।
~কি পরেছি রে। একটা সাধারণ কাঁথা স্টিচ বেনারসী পরেছি আর নিজে কি কম গেছিস নাকি? বলছে আর দূর্বার দিকে তাকিয়ে আছে।
-শৌ ও তোর সাথে বেশ ম্যাচ করে পড়েছে দেখছি। বাব্বাঃ আছিস ভাল দ্যাবাদ্যাবি মিলে। আর দিনে দিনে যেন আরো সুন্দরী হয়ে যাচ্ছিস। হবি নাই-বা কেন বল। মেড ফর ইচ আদার যে । আর আমার উনি খালি খিটখিট করেই আছেন সব সময়। এটা পোরো না ওটা পোরো না, মানায় না। মেয়ে বড় হচ্ছে। আচ্ছাঃ এরা এই সাহেব মেমদের দেশে এসেও একটু বদলালো না রে! সত্যি ডিসগাসটিঙ। এদেশে আবার মানায় না কি রে? বয়স্ক-রা সবাই এখানে কি সুন্দর ব্রাইট কালার পর্ চোখ থাকতেও দেখে না কেন কে জানে।
শর্মি খালি হাসল।
-শতদল একটা জব্বর বৌ পাকড়াও করে এনেছে দেখেছিস? ভেবেছিলাম আমার পপিটাকে যদি পছন্দ করে। কত নিমন্ত্রণ করে খাওয়ালাম। পপির সাথে বেশ ভাব ও তো হয়েছিল কিন্তু হঠাৎ শুনলাম বিয়ে করে এসেছে। এইসব মেয়ে ছেড়ে কি আর আমার মেয়ে? হলেই বা ক্যালিফোর্নিয়ায় মানুষ হওয়া মেয়ে। আজকালকার ছেলেরা সুন্দরী আবার সরস্বতী মেয়ে চাইছে। জানি না রে আমার পপিটা আবার কাকে ধরবে। সাদা না কালো কি যে কপালে আছে, জানি না। এদেশে তো শুনছি সবাই আমেরিকান বিয়ে করছে,। জানি না রে কি হবে শেষে।
~~হ্যাঁ, সত্যি ভারি মিস্টি দেখতে। শর্মি বলল। মিত্রার আবার শুরু হলোঃ
-চোখদুটো দ্যাখ একেবারে মা দূর্গা।
~~থাক আর অত বোলতে হবে না তোকে, নজর লেগে যাবে। মা বাবাকে ছেড়ে এতদূর এসেছে আমাদের কাছে আর আমরাই তো ওর গার্জেন তাই না?
মনে মনে ভিষণ ভালো লেগে গেছে শর্মিলার দূর্বাকে একবার দেখেই।
খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ। ললিপপ চিকেন, তন্দুরী চিকেন, লেমন বাতার ফিস ফ্রাই, সামোসা, দহি বড়া আর ফ্রুট পাঞ্চ ড্রিঙ্কস আর এমনি ড্রিঙ্কস তো আছেই। স্ন্যাক্স থেকে শুরু করে এলাহি ডিনার। মটন বিরিয়ানী, ভেজিটেবল বিরিয়ানী, চিকেন মাখানি, বার-বি-কিউ চিকেন, মটর পনীর। কত বোলবো। সত্যি এলাহি ব্যাপার করেছে। কোরবেই বা না কেন? পয়সার তো অভাব কাকে বলে জানে না শতদল।
খাওয়া দাওয়ার পর শুরু হলো এখনকার ফেভারিট নাচ জুম্বা। দারুন নাচে এই শতদল। দেখতেও খুব সুন্দর। একেবারে রাজপুত্তুর বললেও বোধহয় কম বলা হবে। নাচছিল সব সময় রাহুলের বৌ তোতোর সাথে। সফটওয়্যারে এক সাথে কাজ করে রাহুল, তোতো আর শতদল। দূর্বা শুধু তাকিয়ে আছে তার শতদলের দিকে। বেচারাকে দু একজন টানাটানি করলো কিন্তু ও যেতে চাইল না ।
শৌর্য্য ওর তরফে হয়ে বললোঃ
-ছেড়ে দাও ওকে । আজ ও ক্লান্ত। ওর আজ দেখার পালা।
দেখলাম ওর মিস্টি মুখে কৃ্তজ্ঞতার হাসি ফুটে উঠল।
ওর হাসি মুখ দেখে মিত্রা আবার ডগমগিয়ে উঠল।
-দেখেছিস ! এই দেখেছিস! হাসলে আবার গালে কি সুন্দর টোল পড়ে। নাঃ! সত্যি আমি ওর প্রেমে পড়ে গেছি রে। ইশ আমার মেয়েদুটোর একটাও যদি এরকম দেখতে হত? অবশ্য যেমন আমি তেমনি তো দেখতে হবে, তাই না ? কি বল?
বলে দুজনেই হেঁসে উঠল খিল খিল করে।
খুব বড়লোকের একমাত্র আদুরে ছেলে এই শতদল। কলকাতার ম্যানডেভিলা গার্ডেন্স-এর বারো তলা আকাশপ্রদীপ বিল্ডিংটা ওদের, বাবা মা থাকেন একটা বিরাট ফ্ল্যাট নিয়ে আর বাকি সব ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছেন ওঁনারা । একটা গরীব ছেলে আর মেয়েকে এ্যডপ্ট করে দেশে আছেন। বছরে একবার পৃথিবীর কোনো এক দেশে ভ্রমণে বেড়োন। এখন ছেলে আর ছেলের বৌ-এর সাথে আসেন নি কারণ, ওদের এনজয় করতে দিয়েছেন । জীবনকে চিনতে দিয়েছেন। নিজেরাই যাতে নিজেদের সমস্যার সনাধান করে তার উপযুক্ত এখনই সময়, মনে করেন তারা ।
অবশেষে নাচও শেষ হয়ে গেল। একে একে গেস্টরা যেতে আরম্ভ করলো । শর্মিলা আর শৌর্য্য ইচ্ছে করেই দেরি করতে লাগলো যাতে দূর্বার সাথে ভাল করে আলাপ করতে পারে । আস্তে আস্তে ভিড় কমলে ওঁরা দুজনে এগিয়ে গেল দূর্বার দিকে।
শর্মিলা ওর হাত ধরে বললঃ চিন্তা কোরো না, আমরা তো আছি। ওর হাত ধরে দেখে ঠান্ডা বরফ হাত। এখানে যারাই প্রথম আসে এরকম একলা ভাবে তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নেয়। কাজেই তোমারও কোন অসুবিধা হবে না দেখো।”
শুধু বড় বড় চোখে ওদের দিকে তাকিয়েই প্রণামটা সেরে ফেলল। শর্মিলা ওকে জড়িয়ে অনেক আদর করল।
~~শতদলকে বলব, আমাদের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে আসতে, কেমন?
তারপর ওকে আবার আদর করে শর্মিলা আর শৌর্য্য বাড়ি ফিরে গেল। সারা রাস্তায় ওরা শুধু দূর্বার সুখ্যাতি করতে করতে গেল। বিছানায় শুয়ে শৌর্য্য বললঃ মেয়েটা যেন বড্ড সুন্দর! তাই না? একেবারে একটা ডল পুতুল। আমাদের যদি এরকম একটা মেয়ে থাকত, কি বলো। শর্মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
যখনই শুনেছিল যে ওরা মা বাবা হতে পারবে না, তখনই ওরা ভেবেছিল দেশ থেকে একটা বাচ্চা এ্যডপ্ট করবে কিন্তু এই ভিনদেশে বন্ধু-বান্ধবদের মুখে নানারকম গল্প শোনার পর আর সাহস করে নি এই নিঃসন্তান সুখী দম্পতি।
একদিন লঙ উইকেন্ড দেখে শর্মি ডাকল শতদল আর দূর্বাকে নিজেদের বাড়িতে। একটা হলুদ রঙের গাড়োয়াল শাড়িতে ম্যাচিঙ গয়না পরে এসেছে আর শতদল পরেছে হলুদ রঙের পাজ্ঞাবী আর চুড়িদার। দরজা খুলে ওদের দেখেই মনে মনে বলে ফেলল একেই বলে ভগবানের সৃষ্টি। ওদের আদর করে ঘরে নিয়ে আসল।
প্রথমে মাটন চপ, এগ ডেভিল আর ফ্রেস্কা-ক্যানবেরি জুস দিয়ে তৈরি ড্রিংকস দিল খেতে।
চুপ করে বসে আছে দূর্বা কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে। শতদল যেমন কথাতে তুবড়ি ছোটায়, দূর্বাকে দেখে মনে হলো তার একেবারে উল্টো। ওর আড়ষ্ট ভাব যাতে কেটে যায়, তাই ওকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের বাড়ী দেখাতে। ব্যাক-ইয়ার্ডে গার্ডেন চেয়ারে দুজনে বসল। দূর্বা এই প্রথম কথা বলল। কি সুন্দর তোমার বাড়ি।
শর্মি বললঃ তোমার ও হবে একদিন, আমরা তো বহুবছর এদেশে এসেছি।
শর্মি জিজ্ঞেস করলঃ তোমরা কয় ভাই বোন, দূর্বা?
-আমরা দুই জমজ বোন আর এক ভাই। ভাই অনেক ছোট।
~~তোমার বাবা কি করেন?
-আমার বাবা স্টেশন মাস্টার আর মা প্রাইমারি স্কুলে পড়ান।
শর্মি বল্লঃ
~~বাহ! খুব ভালো। আরেক যে জমজ বোন তার বিয়ে হয়ে গেছে?
-না, তবে ওর বিয়ে হবে আগামি বছর। ছেলে লন্ডনে থাকে।
~~তোমরা দেশে কোথায় থাকো?
-আমরা থাকি ধামুয়ায়।
~~আচ্ছা দূর্বা ! ধামুয়া আর কলকাতা –তোমাদের বিয়ে হলো কি ভাবে? একটু বোলবে?
ও তখন বললঃ
-আমার বাবার এক বন্ধু আমার শ্বশুর শাশুরিকে আমার কথা বলেছিলেন। তারপর ওনারা আমাকে দেখতে এসেই একেবারে শাশুরিমা নিজের গলার হার খুলে আশীর্বাদ করে গেছেন।
শর্মি বল্লঃ তা তো কোরবেনই। তুমি যে খুব মিস্টি একটা মেয়ে, কোরবেন না? না কোরলেই ভুল করতেন। ও হাসল তবে হাসিটা কেমন যেন করুণ।
হয়ত মন খারাপ লাগছে ভেবে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে শর্মি জিজ্ঞেস করলঃ
~~গান জানো?
-জানি তবে খুব ভাল না। শর্মি আর শৌর্য্য আবার অসম্ভব গান পাগল। নিজেরা গাইতে পারে না কিন্তু যেখানে গানের আসর সেখানেই ওরা হাজির।
কাজেই শর্মি গান জানে শুনে হাঁক ডাক শুরু করে দিল “ এই শুনছো? এদিকে এসো, দূর্বা গান জানে।”
শৌর্য্য আর শতদল বাইরে এলো। শতদল বললঃ বাহ! তোমাদের বাগান একেবারে হেভেন লাগছে তো। তোমরা বরং গান শোনো আর আমি ঘুরে ঘুরে দেখি। বেশ কিছু অজানা অচেনা গাছের মেলাও বসেছে দেখছি।
শৌর্য্য শর্মিলার পাশের চেয়ারে এসে বসলো। গেরুয়া চাঁদ তখন দূরে শিরীষ গাছের মাথার ওপরে। তার ছায়া এসে পড়েছে সামনের নীল সুইমিঙ পুলের জলের গায়ে। কোথা থেকে নাম না জানা ফুলের মিস্টি গন্ধরা হেলে দুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
-দূর্বা গান শুরু করো এবার। এই ওয়ানডারফুল ওয়েদারে গান~ আহা! উই আর রেডি নাও, সিঙ আ সঙ, বলে উঠল শৌর্য্য।
ও শুরু করলোঃ
ওহে দয়াময় , নিখিল আশ্রয় এ ধরা –পানে চাও-
পতিত যে জন করিছে রোদন, পতিত পাবন, তাহারে উঠাও......।
শৌর্য্য বললঃ এ গান কেন? এত সুন্দর সময়-এ তো আনন্দের গান হবে, প্রেমের গান হবে। কি বলো শর্মি? একটা প্রেমের গান হোক না কেন? তুমি তো ভিষণ ভাল গান করো। দাঁড়াও এবার পূজোর ফাংশনে তোমার নাম দিয়ে দেব। এই যে শতদল কি ব্যাপার বলো তো, রূপে লক্ষ্মী আর গুণে সরস্বতী নিয়ে এসেছো দেখছি। রিয়ালি প্রাউড অফ ইউ। আর কি কি গুণ আছে শিল্পীর বলে ফেলো তো? শর্মি তো অবাক –গান শুনে –একেবারে চুপ হয়ে গেছে। বললঃ
-না থাক এবার খেয়ে নাও সবাই। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাচ্চা মেয়ে খিদে পেয়ে গেছে বোধহয়।
খাওয়া দাওয়াও মিটে গেল আস্তে আস্তে। ওরা দুজনে গুড নাইট বলে চলে গেল।
বেশ কিছুদিন ব্যস্ততার মধ্যে কাটল শর্মির। একদিন ফুরসুত পেয়ে ফোন করল দূর্বাকে। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর দূর্বার গলা শোনা গেল কিন্তু কেমন যেন নিরুত্তেজ। “হ্যালো।”
~~হ্যাঁ-রে, কেমন আছিস?’ হঠাত করে ‘তুই’ বলে ফেলেছে শর্মি।
কি হয়েছে দূর্বা? মন খারাপ লাগছে নাকি? ইশ আমার আর ফোন করা হয়নি তোকে আর তুইও তো একটা ফোন করতে পারতিস? মাসিকে ভাল লাগে নি বুঝি?
আবার ওদিকে চুপচাপ।
~~ কি হোল? এই মেয়ে? শরীর খারাপ নাকি? শতদল কখন অফিস থেকে ফিরবে’? হঠাৎ মনে হলো ও কাঁদছে। শর্মি আবার বললঃ ‘আচ্ছা মুশকিল, এই দূর্বা ? লক্ষ্মী সোনা মেয়ে, আমাকে বলবি না?’
তখন বলেঃ ‘শতদল আজ দুদিন হোল বাড়িতে আসে নি মাসি, হঠাত নাকি অফিসের কাজে ওকে যেতে হয়েছে। যাবার আগে বলে গেল যে, একদিন পরেই চলে আসবে আর আজ দুদিন হয়ে গেল মাসি, একটা ফোন পর্য্যন্ত করেনি সে’।
~~সে কি? একা গেছে না আরো কারুর সাথে গেছে?
বল্লঃ-ও আর তোতো
শর্মি বললঃ ‘আচ্ছা, দাঁড়া আমি আর তোর মেসো গিয়ে তোকে নিয়ে আসছি’।
-আমার খুব ভয় করছে মাসি। না না, আমি যাব না । ভাববে আমি তোমাদের বলে দিয়েছি। খালি বলে গেছে যে, কাউকে বলার দরকার নেই। এখানে এইরকম একলা থাকতে হবে মাঝে মাঝে।
বল্লামঃ ‘আচ্ছা! আমরা আসছি আজ, আমার কাজ নেই আর তোর মেসোর জানিস তো আমি কাজে না গেলে সে ও বাড়ীতে থাকবে। কাজেই আমরা আসছি এখুনি’।
শর্মি শৌর্য্য-কে বল্লঃ ‘চলো আমরা গিয়ে ওকে নিয়ে আসি’। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে গাড়িতে করে ওরা চলে এল দূর্বা-দের এপার্টমেন্টে। রাস্তায় আসতে আসতে শর্মি সব বলল শৌর্য্য-কে।
শৌর্য্য সব শুনে বললঃ , ‘সে কি?’ এত সুন্দর একটা ফুটফটে বাচ্চা বৌকে একা রেখে গেছে? কেন? কেন? আর নতুন বৌকে কেউ একা রেখে যায়? ওকেও তো নিয়ে যেতে পারত? যাচ্ছেতাই একেবারে। চলো চলো আর দেরি না’।
দেখতে দেখতে ওরা দুজনে পৌছে গেল। দূর্বাকে দেখে তো ওরা অবাক। কেমন যেন চোখের কোলে কালি পরেছে, অমন যে মা দূর্গার মতন চেহারা একেবারে বিষন্নতায় ভরা।
~~আগে আমাদের জানাবি তো? শৌর্য্য তো রাগারাগি আরম্ভ করে দিয়েছিল আর কি? ওর ওই এক স্বভাব একটুকুতেই একেবারে টেনশন নিয়ে নেয়।
ওর জামা কাপড় কিছু নিয়ে ওকে শর্মিরা নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে এল।
তিনদিনের দিন এল শতদল-এর ফোন। শুনে মনে হলো রাগারাগি করছে। দূর্বা খালি চুপ করে আছে।
এবার ফোন রেখে দিল। আবার কিছুক্ষণ পরে ফোন। শর্মিকে দিয়ে দিল ফোনটা।
শর্মি বললঃ ‘এই যে শতদল! কি ব্যাপার? কবে আসছো এখানে’?
বললঃ ‘সরি মাসি! দূর্বা নিশ্চয়-ই খুব ডিস্টার্ব করেছে। এত ভয় খেলে চলবে কি করে? থাকত তো গাঁয়ে, গেঁইয়া একটা’।
শর্মি বললঃ- ‘ছিঃ শতদল ওরকম করে কেউ নিজের নতুন বৌকে বলে নাকি? ও তো ফোন করে নি, আমিই করেছিলাম অনেকদিন খোঁজ-খবর নিই নি তাই, আজ সময় পেয়েই ফোন করেছি। সবাই প্রথম প্রথম এরকম ভয় পায়, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো’।
সব শুনে শতদল বললঃ ‘আচ্ছা এখন রাখি পরে কথা হবে। আমি তো কাল ফিরছি। ওকে এখন রাখো তোমাদের কাছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসব’।
শর্মি বললঃ “হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে। কোন অসুবিধা হবে না। আর আমাদের ভালই লাগছে বেশ’।
এবার দূর্বাকে নিয়ে ওরা খেতে বসল, খাবার পর ওকে নিজেদের সাজানো গেস্ট রুমের বিছানায় শুতে বলল। ওরা দেখল কত তাড়াতাড়ি সে ঘুমিয়ে পড়ল।
দরজা বন্ধ করে বাইরে এসে শৌর্য্য –এর সাথে আলোচনা করল কি করা যায়!
ও ঘুম থেকে উঠলে আবার ওরা গল্প শুরু করল। শৌর্য্য ওর কাছে সব শুনল।
বললঃ ‘কোন চিন্তার নেই। আমরা তো আছি, তাই না? কোন বিপদ ঘটতে দেব না আমরা।’ ওর মুখে নিশ্চিন্তের হাসি ফুটে উঠল।
দূর্বা যা বলল তার মানে হলো শতদল আর রাহুলের বৌ তোতো-র মধ্যে একটা ভালবাসা আগের থেকেই ছিল। এখন এটা রাহুল জানে কি না দূর্বা জানে না। তবে রাহুল ছেলেটা যে খুব ভাল তা শর্মিরা সবাই জানে ভালভাবে।
তবে তোতো-র একটু অহংকার আছে কারণ, সে একজন নামকরা হাই টেক নারী আবার সেতার-এ বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ড পেয়ে গেছে। কথা একটু কম বলে সবার সাথে অবশ্য শর্মির মিস্টি মাতৃসুলভ ব্যবহারের জন্য সবাই তাকে ভালবাসে। তোতো-ও বাদ যায় না। তোতো-কে দেখে মনে হয় খুব মডার্ন বাড়ীর মেয়ে সে।
দেখতে দেখতে শতদল এসে গেল দুদিন পর। বাড়ী থেকে বেশ ফ্রেশ হয়ে এসেছে দেখে তাই মনে হল। কোন রকম চিন্তার রেশ নেই মুখে চোখে।
শর্মিরা ওদের খেয়ে দেয়ে বাড়ী যেতে বলল। এইবার শতদল রেগে গেল, বললঃ “ দেখো মাসি! তোমরা হয়ত অনেককিছু ভাবছো আমাদের সম্বন্ধে, মনে রেখো ওসব কিচ্ছু না। আমরা সত্যি খুব সুখী। এখন দূর্বাকে এখানকার অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে হবে, এতে তো রাগারাগি বা মান-অভিমানের কিছু নেই । আন্ডারস্ট্যান্ডিং-টাই আসল, তাই না?
দূর্বাকে দেখে মনে হল কেমন যেন ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে আছে। শর্মি শতদল-কে আলাদা করে ডেকে নিয়ে এসে বললঃ –‘দেখো শতদল! তোমাদের পারসোনাল ব্যাপারে আমাদের মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই, কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য যে একটা নিরীহ জীবন কষ্ট পাচ্ছে তা তো করতে দেওয়া উচিত নয়, তাই নয় কি’? এই ভিনদেশে আমরা সবাই সবার ভালো চাই।
আবার শতদল গেল রেগে। বললঃ
-তোমরা খালি আমার দোষটা দেখছো। আমার চাকরির ক্ষেত্রে এরকম হতেই পারে, এই জন্য মা বাপি-কে বলেছিলাম আমার এডুকেটেড মেয়ে চাই কিন্তু কোথা থেকে একে জবরদস্তি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা তাদের কর্তব্য শেষ করেছেন, এদিকে সে নাকি সব সময় আমাকে সন্দেহ করে। এ তো টলারেট করা যায় না, কি বলো তুমি? তুমি যদি রাতদিন সন্দেহ করো শৌর্য্যমেসোকে, তাহলে কি আর তোমরা সুখী দম্পতি নামে ফেমাস হতে? হতে না, তাই না?
শর্মিও এডামান্ড। ‘তুমি ওকে বোঝো শতদল, একটা জীবন নস্ট করে দিয়ো না’। দেখল, বলে কোন লাভ হবে না । কিছু পরে শতদল খালি বললঃ ‘রেখে দাও তোমাদের কাছে। আমার এরকম বৌ চাই না। টিকিট কেটে দিচ্ছি ওকে, দেশের বাড়িতে ফেরত যাক। মা বাপি বিয়ে দিয়েছেন তাদের পছন্দ করা মেয়ের সাথে কাজেই তারাই নিয়ে থাকুন সেই মেয়েকে। তোমাদের যা করার তোমরা কর। আই ডোন্ট কেয়ার এ্যট অল’। বলেই গটগট করে চলে গেল।
যাই হোক, দূর্বাকে আর যেতে দিল না ওরা। বলা যায় না যদি কিছু খারাপ হয়।
এবার একদিন তোতো-কে বাড়িতে ডেকে বোঝালো শর্মি। দেখল মেয়েটা কিন্তু বেশ ভাল। ভাবার মন আছে। যা ভেবেছিল ওরা, তা সে নয়।
-সব শুনে তোতো বললঃ, ‘ সত্যি বলতে আমার দ্বিধা নেই মাসি। আমি আর রাহুল কোনদিন মা বাবা হতে পারব না অথচ আমরা দুজন দুজনকে ভিষণ ভালবাসি। শর্মি দেখল তোতো-র চোখে জল। জানো মাসি একমাত্র শতদল যে আমাকে আর রাহুলকে আশা দিতে পারে। যদিও এটা ইল্লিগাল তবুও আমরা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছি।
শর্মি বললঃ এ্যডপ্ট করো।
তোতো মুখ নিচু করে বললঃ, নাঃ, রাহুল চায় আমার রক্তের সন্তান।
শর্মি আবার বললঃ আজকাল তো কত কিছু হয়েছে, টিউব বেবি তাই ট্রাই করো। বললঃ নাঃ মাসি তা হয় না।
~শতদল রাজী হয়েছে?
তোতোর সপাট উত্তরঃ হ্যাঁ।
হতবাক শর্মি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললঃ ‘দেখো তোতো! সিনেমাতে অনেক কিছুর সমাধান হয় খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু বাস্তব জীবনে তা সম্ভব হয় না। কাজেই তুমি, শতদল বা রাহুল যা ভাবছো তা কিন্তু মোটেই ভাল না। এখন এই অল্প বয়সে তোমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছো, তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করার ভাবনা তোমাদের আজ নেই। আইনের একটা দিক আছে। একটা অবলা মেয়ের জীবন খারাপ কোরো না তোতো। তুমি অনেক শিক্ষিত তোমাকে বোঝানো বাতুলতা জানি...তাও!
তোতো মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল কিছুক্ষণ! তারপরেই হঠাৎ কেঁদে ফেলল সে, ধরা গলায় বললঃ “মাসি আমাকে ক্ষমা করো। আমার মডার্ন মা কিন্তু কখনই জীবনের ভাল দিকটার শিক্ষা দেন নি। সত্যি তো আমি একবার-ও ভেবে দেখি নি কেন? আমিও তো এক সুখ দুঃখ দিয়ে গড়া নারী। আজ আমার যদি এইরকম অবস্থা হতো, তাহলে আমি কি করতাম? ছিঃ ছিঃ এ আমি কি করছিলাম সমাজ আমাদের কি চোখে দেখত, নিজেদের বিবেকের কাছে আমরা কি জবাবদিহি করতাম? তুমি আমার চোখ খুলে দিলে মাসি। আমি সত্যি আজ খুব লজ্জিত।
কাজেই মাসি আজ থেকে তুমি আমার মাসি নও -আমার ‘মা’।
দুজনেই দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সবাই বলে হাই টেক নারী, কিন্তু কোথায়? মায়া মমতা দিয়ে যে নারী তৈ্রী তা দেখিয়ে দিল তোতো। বললঃ ‘ আমি আজকেই ফিরিয়ে দেব শতদল-কে সেই দূর্গা প্রতিমার কাছে। আমি নিজে স্বার্থের কথা ভাবছিলাম আর সেই মেয়েটার কথা একবার-ও ভাবি নি। ধিক্! আমার শিক্ষাকে! চলো ওর কাছে যাই –বলে তোতো ছুটে দূর্বার কাছে গিয়ে বললঃ ‘চল বোন! তোর শতদল যে অপেক্ষা করছে তোর জন্য, যাবি না? তুই যে আমার একটা ছোট্ট মতন বোন, “তুই আমার ভোরের আলোর মিতা, জানিস কি তা?” তোর এই চেহারা দেখে কি দিদি থাকতে পারে, বল?'
চলি মা! আবার আসবো তোমার কাছে আমরা দুই বোনে। অনেক কিছু শেখার আছে যা নিজের মা জন্ম দিয়েও শেখাতে পারে না। মা হতে গেলে প্রকৃ্ত মা হবার শিক্ষা না পেলে আমার মতন অর্ধশিক্ষিত-র কোন সন্তানের জন্ম না দেওয়াই ভাল। কাজেই যেদিন আমি- সত্যি মা! - কাকে বলে জানতে শিখবো- সেদিন আবার মা হবার স্বপ্ন দেখবো।
সুখের অশ্রুধারা নেমে এলো শর্মির দুচোখ বেয়ে। শৌর্য্য আড়াল থেকে সব শুনছিল। এবার এসে শর্মির গলা জড়িয়ে বললঃ ‘~ ওই দেখো তোমার দুই মেয়ে কেমন হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, শুনলে তো তোতোর মুখে। মা হওয়া কি মুখের কথা নাকি? আমি আজ বড় গর্বিত তোমার জন্য শর্মি! জন্ম-জন্মান্তরে যেন তোমাকে পাই, এই প্রার্থনা জানাই ঠাকুরের কাছে।
শর্মি জল ভরা দুচোখ নিয়ে শৌর্য্যের বুকে মাথা রেখে দুই মানসী মেয়ের মিলিয়ে যাওয়া দেখতে লাগল।
ভালো লাগলো। ইলাস্ট্রেশনের ফোটোগ্রাফটা কী লেখক প্রেরিত? বানানের ব্যাপারে সংসদ বাংলা অভিধান অনুসরণ করলে ভালো হয়।
উত্তরমুছুন