ভাষা ভিত্তিক ও প্রেমের কবিতা :শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
 
ভাষা ভিত্তিক কবিতা : 
একটি আবেদন 
পশুরা ঠিক কবে সামাজিক হল 
কোন মাহেন্দ্রক্ষণে আবিষ্কার হল শব্দ 
ঠিক কোন মুহূর্তে কথা বলতে শিখে 
মানুষ হল তারা, 
কেউ কি জানি ? 
কেউ কি জানি – ঠিক কোন ভাষায় প্রথম 
কথা বলেছিল আদিম মানবশিশু ? 
  
খুব একটা জানার দরকারও অবশ্য নেই । 
  
তবে এ কথা জানার দরকার অবশ্যই আছে, যে 
সে কোন এমন ভাষা, যা কৈশোরেই পাল্লা দেয় 
অভিজাত ফ্রেঞ্চ, জর্মন, ইংরেজিদের সাথে । 
  
পদ্মা-গঙ্গার মাঝি যে ভাষায় সুর তোলে 
মূর্ত হয় বাউল ভাটিয়ালীর দর্শন 
চারণক্লান্ত রাখাল দুপুর রোদে বটের ছায়ায় বসে 
বাঁশিতে যে ভাষা বলে 
যে ভাষার মূলমন্ত্রে দেশ স্বাধীন হয় 
হাজার হাজার প্রাণের তাজা রক্তের স্রোত 
বয়ে যায় যার ডাকে, 
খামখেয়ালী জীবন সুকুমার হয় যার স্পর্শে, 
এ সেই – ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ । 
  
ধূসর সে পাণ্ডুলিপি যা দিয়েছে 
নিয়েছি দুহাত ভরে । 
আজ শুধু থাক অঙ্গীকার 
অগ্নিধ্বজা ছুঁয়ে যাক দিকচক্রবাল 
নতুন আলোর রঙ মেখে নাও আপাদমস্তক । 
  
গোয়ালন্দ
হিজল কাশের দেশে একদিন গিয়েছি বেড়াতে 
সবুজ সুপুরি ক্ষেতে জোলো হাওয়া 
উদার আকাশ জুড়ে তারাদের দিয়েছে প্রশ্বাস 
ধূসর জগত থেকে জেগে ওঠে ষ্টীমারের সুর 
গোয়ালন্দ কতদূর, গোয়ালন্দ আর কত দূর...... 
  
কেন এত ব্যবধান ভাটিয়ালী বাউলের মাঝে ? 
এপারে ওপারে ব্যাথা 
এপারে ওপারে কান্না 
এপারে ওপারে বাঁশি একই কথা বলে 
গোয়ালন্দ আমাদের ধূসর জগত 
গোয়ালন্দ একদিন ছিল । 
  হিজল কাশের দেশে ফের আমি গিয়েছি বেড়াতে 
সবুজ গ্রামের সীমা পার হয়ে ঝকমকে শহরের পথে 
উদার আকাশ জুড়ে আজও তারা ফোটে 
মেছুয়া মাঝির দল আজও সেই এক সুর বুকে নিয়ে 
ভেসে যায় জোয়ারের বুকে 
তিরতিরে জোলো হাওয়া আজও ঠিকই বয় 
ফিসফিস বলে যায় – 
দূরে নয়, গোয়ালন্দ বেশী দূরে নয়...... 
  
  
ভাষা দিবসের গান 
  
যে ভাষায় সূর্য ওঠে, জ্যোৎস্না হাসে 
যে ভাষায় শিশির নাচে সবুজ ঘাসে 
সে ভাষা শিকল ছিঁড়ে নিশান ওড়াক 
সে ভাষা আমার বুকে থাক...... 
  
যে ভাষায় রবীন্দ্রনাথ লালন মাতাল 
যে ভাষায় বুকের রক্তে মাটিও লাল 
সে ভাষা দৃপ্ত অমল আগুন জ্বালাক 
সে ভাষা আমার বুকে থাক...... 
  
যে ভাষার জন্যে সালাম বরকত ভাই 
ইতিহাস সৃষ্টি করে শহিদ সবাই 
সে ভাষার মধ্যে তারা থাক বেঁচে থাক 
সে ভাষা আমার বুকে থাক...... 
  
প্রেমের কবিতা: 
ফেরা 
এবার যখন আসবে তুমি 
বৃষ্টি নিয়ে এসো 
সাজিয়ে নেবো উতল ঢেউ 
ইচ্ছেমত ভেসো । 
  
এবার আসার সময় বন্ধু 
আকাশ এনো সাথে 
ঝিমিয়ে পড়া আকুল ডানা 
মেলে ধরবো তাতে । 
  
আসার সময় এবার এনো 
শিউলি দুহাত ভরে 
মালা গাঁথবো, রাণী সাজবো 
কুসুম ভাঙা ভোরে । 
  
এবার নাহয় আসার সময় 
এসো ঝড়ের মত 
তোমার সাথে হারাতে চাই 
ঝরা পাতার মত । 
  
এবার এসো বাঁধন খুলে 
এসো গো সংগ্রামী 
তোমার জন্যে কত জীবন 
অপেক্ষমাণ আমি । 
  
সেই রাত 
সেদিন তখন রাঙা ফাগুন মাস 
উতল বান শিমুল পলাশ বন 
সে রাত তখন ফাগুয়া পূর্ণিমা 
আগুন ঢেউয়ে মাতাল সন্তরণ । 
  
নিশুত রাতে চাঁদের কথকতা 
সারা দেহে আবীর আলপনা 
সেদিন তোর বিশ্বজয়ী রূপ 
সেজেছিলি পলাশ-আভুসনা । 
  
জ্যোৎস্না আলোয় স্বপ্ন সহবাস 
তখন তোর হাসির সম্মোহন 
গানের সুরে নাচের তালে তালে 
সে রাতে তোর প্রথম উন্মোচন । 
  
সে রাতে চাঁদ লজ্জা পেয়েছিল 
সে রাতে তোর প্রথম ঢেউয়ে ভাসা 
সে রাতে ফুল পাপড়ি মেলেছিল 
সে রাতে তোর তৃপ্ত ভালবাসা । 
  
  
প্রেম খেলা 
এই মেয়েটা, খেলবি নাকি 
প্রেম-প্রেম খেলা ? 
মন মাতিয়ে, রঙ ছড়িয়ে কাটবে সারা বেলা । 
  
সে কি রে ! তুই জানিস না তা ! 
শিখিয়ে দেবো আয় 
কেমন মজার আসর জমে দাহ্য দাহিকায় । 
  
বলছি তোকে, কেমন সেটা – 
এই আছে, এই নেই 
গভীর প্রেম ফুরিয়ে যায় দুচোখ ফেরালেই । 
  
এই ভাববি – একে ছাড়া 
কিছুতেই বাঁচবনা, 
এই ভাববি – লোকটা নেহাত বিচ্ছিরী, তালকানা । 
  
মনে হবে একে বোধহয় 
সঁপে দেয়া যায়, 
আবার ভাববি – এ তো কেবল হারাচ্ছি আমায় ! 
  
মনে হবে পাখীর পাখায় 
জীবন উড্ডীন 
ভাববি আবার – ভালো ছিল ফেলে আসা দিন । 
  
এইভাবে প্রেম মাতিয়ে দেবে 
তীব্র দোলাচলে 
ঝড়-ঝাপটে ভয় না পাওয়া মানুষ শুধু খেলে । 
  
এই খেলাতে রাজা উজির 
শরীর এবং বুদ্ধি 
যত পুড়বি, যত পোড়াবি, ততই আগশুদ্ধি । 
  
ফাউ হিশেবে কিছু মিথ্যে 
একটু চোখের জল 
লাগতে পারে এই খেলাতে, খেলবি যদি চল...... 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন