ধারাবাহিক
বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর
সৌমিত্র চক্রবর্তী
(৭)
বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর
সৌমিত্র চক্রবর্তী
(৭)
‘বাবা শিবের চরণে সেবা লাগে
মহাদেএএএএএএব…’
সাদা ধুতি গলায় কাছা গেরুয়ার
চিহ্ন নিয়ে এক লাইনে হেঁটে যাওয়া মূর্তিগুলোর দিকে চেয়ে দেখলো সে। চৈতী গাজনের
বোলানের দল বেরিয়েছে। এরা আশেপাশের সব গ্রামের বাড়িতে যাবে। চেয়ে নেবে যাপনের আপাত
রসদ। একবেলা নিরামিষ খেয়ে, একাদশী
অমাবস্যা আরো বহু হাবিজাবি নিয়ম কানুন মেনে চৈত্র সংক্রান্তির দিন মাতবে গাজনে।
ফসলের এই বন্ধ্যা সময় এদের দিয়েছে নিরাকার অবসর। গ্রামীণ কাঠামোয় শহরের মত হাজার
বিনোদন ফাঁক ফোকর নেই এখানে। আর তাই এরা ধর্মকেই আশ্রয় করেছে। যদিও এই বোলানের দল
আস্তে আস্তে গ্রামীণ সংস্কৃতির একটা শাখা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুধুই ধর্মীয় বাকবিতন্ডা
নয়, এরা সমকালীন সামাজিক,রাজনৈতিক
বিষয় নিয়ে গান বাঁধে, সেই গান গেয়ে ফেরে গ্রামে
গ্রামান্তরে। সরল সাধাসিধে মানুষগুলো প্যাঁচ শেখেনি এখনো, তাই সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে কোনো দ্বিধাই হয়না এদের। যেখানে শহরের
কাঁড়িকাঁড়ি টাকাওয়ালা সমাজের মাথার মনিরা প্রচারের আলোয় থাকার জন্যে, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোর পদলেহন করতে ব্যাস্ত,
সেখানে এরা সত্যি কথাটা সোজা বলতে পিছপা হয়না।
চটকা ভেঙে নিজেই হেসে ফেলে
লোকটা। গভীর ক্ষোভের তলায় তলিয়ে গেছিল সে। তার এইসব ভাবনার কারো কাছে কোনো
গুরুত্বই নেই। কোনো পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে সে স্ট্রীটকর্নার করে চিৎকার করে এসব
বলতেও যাবেনা। বলবে সে নিজের মনকেই, আর শুনবেও সে নিজেই। তবুও… । চৈত্র শুরুর এই সময়ে এবার হঠাৎ দাবদাহ বেড়ে গেছে। অন্যবছর ঠিক এতটা গরম পড়েনা।
ইতিমধ্যেই হু হু করে বইতে শুরু করেছে লু। গরম হাওয়ার দাপট বেলা বাড়লেই চামড়ার সাত স্তর জ্বালিয়ে দিতে শুরু করেছে।
নিজের দুহাতের দিকে তাকাল সে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে হাতের চামড়া। তার ঢেকে
রাখা গায়ের রঙ একরকম, আর দুহাতের
রঙ অন্য। অবশ্য এসব নিয়ে কোনদিনই মাথা ঘামায় না সে। তার বহিরজীবনের অনিয়ন্ত্রিত
হাঁটাচলায় নিজের শারীরিক সৌন্দর্যকে পাত্তাই দেয়না সে। তবু এই লু এর থেকে বাঁচতে
ঝোলা থেকে গামছা বার করে ভালো করে নাক মুখ মাথায় জড়িয়ে নেয়। এই সময় কিছুতেই শরীর
খোলা রাখতে নেই। শরীরের ভেতরের তাপমাত্রার শেকল ভেঙে তছনছ করে দেয় বাইরের আগুন।
চলার এই সময়ে অকারণ অসুস্থ হতে চায়না সে।
ফনীমনসার ঝোপের ফাঁকে একটা
গিরগিটি মাথা নেড়ে যায় একমনে। একটু দাঁড়িয়ে ফনীমনসার পাতাগুলো দেখে সে। এত সুন্দর
গোলগাল তেল পিছলানো পাতায় এত কাঁটা কেন? তার জীবনে কিছুই কি মসৃণ ভাবে আসেনা? কেন এত
কাঁটা পায়ে পায়ে কেবল ফুটতেই থাকে-ফুটতেই থাকে! কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল এই নষ্ট জীবন। কিন্তু কাকেই বা দায়ী করবে এর
জন্যে? হাঁটতে হাঁটতে যখনই কোনো মসৃণ রাস্তার মুখোমুখি হয়
সে, হঠাৎই কোথা থেকে উদয় হয় জলহীন, রসহীন ধূ ধূ বালিয়াড়ি। রাস্তা গিয়ে মিশে যায়, শেষ
হয়ে যায় সেই বালিয়াড়িতে। চ্যালেঞ্জ জানায় তার অস্তিত্বকে। কোনো আলাদা অপশন তার
সামনে থাকেনা বেছে নেবার মত। চলতে বাধ্য হয়, পার হতে
বাধ্য হয় সেই নিস্করুন বালির মরুভূমি। সারা চলনচক্রে তার যে নিস্তার নেই এ সার সে
বুঝে গেছে। এখন আর এ নিয়ে আফশোষ বা চিন্তাও করেনা।
কাল ভোর রাতে স্বপ্ন দেখছিল, বিশাল এক হ্রদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে সে। অপরূপ সেই
হ্রদের অন্য পাড় আবছা। নীল অতলান্ত ডাক দিচ্ছে তাকে। পাড়ে ভাসছে এক একাকী নৌকা,
দাঁড়হীন হালহীন, মাঝিহীন। ন্যাড়া নৌকার
মধ্যে তার জন্যেই অপেক্ষা করছে এক বিষন্ন নারী। হয়তো সারা জীবনের চলনসময়ে সেও
বারবার ধাক্কা খেয়েছে। অপ্রাপ্তির বোঝা চেপেছে কাঁধে। সঙ্গে চেপেছে শুধুই অকারণ
দায়িত্ব। হয়তো স্নেহ ভালবাসার সামান্য অস্পষ্ট দাগও তার দিননামচায় খুঁজে পায়নি সেই
রমনী। পায়নি মন, মনের সঙ্গ দেবার মত সাথী। বঞ্চিত সেই একক
সৌন্দর্য আজ তারই অপেক্ষায় বিষাদ মেখে বসে আছে নৌকার গলুই এ। অপূর্ব হ্রদের নরম
পাড় বেয়ে ধীরে ধীরে সে উঠে বসে সেই কাঙ্খিত নৌকায়। দুহাতের তালুতে আলতো করে ধরে
পরম স্নেহে দেখে সেই রমনীয় পানপাতা মুখক, গভীর টলটলে
হ্রদেরই প্রতিরূপ চোখ, কপালের বিস্তীর্ণ মালভূমির ঠিক
নিচে শুরু হওয়া নাক, দুই গোলাপী গাল আর উষ্ণতায় মোড়া
দুঠোঁট। গভীর মুগ্ধতায় দুঠোঁটের গভীরে ডুবে যায় সে। হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে ফিরে
পায় সে। আর বেরসিকের মত তখনই ঘুমটা ভেঙে যায়। গতরাতে একটু জ্বর নিয়েই শুয়েছিল
লোকটা।
লাল কালো একটা কুবো পাখি উড়ে
এসে নতুন পাতা বেরনো নিম গাছে বসলো। এই পাখিটার ডাক শুনলে মনেই হয়না আসলে এতবড় হতে
পারে এর শরীর। কেমন যেন মন উদাস করা টানে কুব কুব করে ডেকে যায়। থমকে গিয়ে ভালো
করে একবার দেখে নিয়ে আবার চলতে শুরু করে লোকটা। থামলে হবেনা তাকে। চরৈবেতি-চরৈবেতি। যতদিন বাঁচবে এভাবেই চলতেই হবে তাকে। যেদিন
থামবে, সেদিন ঘড়ির কাঁটাও থেমে যাবে। থমকে যাবে হাওয়ার
স্ফূর্তি। নদীর জল। চাকার একটানা ঘূর্ণন। মাথায় ভিজে গামছা চাপিয়ে এক বৃদ্ধা হাতে
সদ্য কাচা কাপড় নিয়ে স্নান সেরে ফিরছে। তার পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। হয়তো এতদিন
চলতে চলতে সেও এক যন্ত্র হয়ে গেছে। যা কিছুই করে সব করতে হয় বলেই।
ওপরে তাকিয়ে অদৃশ্য বাজীকরকে
দেখার চেষ্টা করে লোকটা। চৈতি রোদ্দুরের ঝলকে চোখ ধাধিয়ে যায়। আকাশ টাকে মনে হয়
ঘষা কাচ। ওপারে যা কিছুই আছে অদৃশ্য। কিন্তু ওপারে বসে থাকা সেই বাজীকরের খুকখুক
হাসি স্পষ্ট শুনতে পায় সে। তার সাথে জন্ম বিবাদ ওই মহাশক্তির। যা কিছুই করতে চায়, যেভাবে চালাতে চায় তার রেখা, সব
সবকিছু বাজীকরের আঙুলে বাঁধা সুতোর টানে বানচাল হয়ে যায়। এখন সেও প্রবল অনীহায়
তাচ্ছিল্য করে ওই ভীরু ষড়যন্ত্রীকে। যা হচ্ছে তা হোক। যা করতে চেয়েছিল সে তার অনেক
কিছুই করতে পারেনি, আর যা করতে চায়নি অযাচিতভাবে তাই যেন
এসে টকটক করে কড়া নেড়েছে তার দরজায়। এখন আর কিছুতেই কিচ্ছু যায় আসে না তার। চলুক
এভাবেই। তার হাঁটা তো কেউ থামাতে পারবে না। আর যখন থামবে, তা দেখার জন্যে সেও চোখ খুলে থাকবে না। অতএব…
একটা অশ্বত্থ গাছের খোঁদলে
গুটিশুটি মেরে বসে থাকা নিশাচর এক প্যাঁচাকে ঘিরে কয়েকটা কাক তারস্বরে চিৎকার করতে
করতে উড়ছে। বেচারা প্যাঁচা এই দাবদাহের ঝলকে এখন অন্ধ। আন্দাজে বিপদ বুঝে যতটা
সম্ভব ভেতরে সেঁধিয়ে যাবার চেষ্টা করছে ওটা। কিন্তু গর্তটা মনে হয় তার শরীরের
পক্ষে যথেষ্ট অকুলান। কাকগুলো অপেক্ষায় এক সময় না এক সময় এই আপাত প্রতিবন্ধী
শিকারকে কব্জায় আনবেই তারা। এ যেন মানুষের চলনচক্রেরই এক প্রতিচ্ছিবি। সুযোগ পেলেই
এ ওকে ঠুকরাচ্ছে, এ ওকে কামড়ে
রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। ভালবাসার তপ্ত যোনি চরম ভালবাসাহীনতায় ছিঁড়েখুঁড়ে ফর্দাফাই
করে পাশবিক উল্লাসে পেশী ফোলাচ্ছে। আঃ! একি সভ্যতা!
তাহলে কিসের মানুষ জন্মের গর্ব? কিসের
সভ্যতার পেশী আস্ফালন? মধ্য অন্ধকার যুগের সঙ্গে কিসের
তফাৎ আজকের এ দগ্ধ সময়ের? প্রবল ঘেন্নায় একটা ভাঙা গাছের
ডাল দিয়ে কাকগুলোকে তাড়া করে সরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে/তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে…’। গলার কাছে একটা দলা পাকানো কষ্ট উঠে এসে টোকা দেয়। লু এর দাপটে চোখ খটখটে
শুকনো নালা। একটা ঘষে যাওয়া যান্ত্রিক
শব্দ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। দুপায়ের আঙুলের ওপরে ভর দিয়েও দিগন্ত প্রসারী
আবছায়ায় খুঁজে পাওয়া যায়না শব্দের উৎস। ক্র্যাশার মেশিনের হৃদপিন্ড চিরে যাওয়া সেই
আওয়াজ পাগল করে তোলে লোকটাকে। ঝোলাটা তুলে ধরে ছুটতে শুরু করে সে। পায়ের নিচে
অমসৃণ গ্রামের অমসৃণ নাম কা ওয়াস্তে পথ প্রতিমুহূর্তে আঘাত করে তার শরীরবাহনের
চামড়ায়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। পাগল হতে চলেছে নাকি সে? কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ছুটে যায় লোকটা। তাকে
পালাতেই হবে এই বিসদৃশ যান্ত্রিকতা থেকে। পারবে না সে নিজেকে গতানুগতিকতায় ভাসিয়ে
দিয়ে আরেকটা যন্ত্র হয়ে যেতে।
পালাও- ভাগো রে মুসাফির-খতরা ভিতর-খতরা বাহির-ভাগো-ভাগো
রে মুসাফির-যব তক জিনা চাহতে হো-ভাগো…
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন