*খাচ্ছি কিন্তু, গিলছি না* -
লেজ তুলে দেখে নেব, মাদি না মদ্দা
অনেক দিন হল, কথা হয়য় নি আপনাদের সঙ্গে। ভোতের ফল বেরিয়ে গেল, সরকার তৈরি হয়ে
গেল, ছন্দা গায়েন পাহাড়েই হারিয়ে গেল এমনকি ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ফুটবলেরও উদ্বোধন
হয়ে গেল…। ভাবা যায়! সবই কি না ‘গেল’ ‘গেল’। এতো গেল গেল করার কি আছে? যা কিছু
‘হল’, সেটাই ‘হয়ে গেল’ কেন হবে? হোক না, হতে দিন, গেল গেল করার দরকার নেই। আবার
গেল গেল শব্দকেই কেউ না কেউ ঘুরিয়ে নিয়ে পড়বেন ‘গেলো গেলো’ করে। যেন গিলতে না
চাইলেও গিলিয়ে ছাড়বেন। এমনকি খেতেও হবে না আপনাকে, গিলিয়েই দেবেন।
আমার এতে ঘোর আপত্তি জানিয়ে দেই আগেভাগে। মম আপত্তিম টুওয়ার্ডস গেলানো। আমি
খেতে রাজি আছে, কিন্তু গিলতে রাজি নই। খেতে তো হবেই, কিন্তু সবকিছুই গেলায় নেই।
গলাধঃকরণে রাজি নই। এই ব্যাপারে আমার ইস্টদেবতা আমার সহায়। তিনিও খান, কিন্তু
গেলেন না। তাঁর নাম শ্রী শ্রীল শ্রীমৎ কেতু মহারাজ।
এই যে দেখুন না, বিরাট জনসমর্থন সঙ্গে নিয়ে বিজেপি এবার দেশের শাসন
ক্ষমতায় এল, এর তো একটা অর্থ আছে! বিজেপি এককভাবেই ২৮২টি আসনে জিতেছে। তাঁর
শরিকদের নিয়ে সংখ্যাটা ৩০০ পেরিয়ে গেছে। মানে, ১৯৮৫-র পর এই প্রথম একটা দল একক
গরিষ্টতায় সরকারে এল। কিন্তু, ১৯৮৫তে কংগ্রে পেয়েছিল ৪৮ শতাংশের বেশী ভোট,
অর্থাৎ ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষ কংগ্রেসকে সমর্থন দিয়েছিল, যদিও ৫১ শতাংশের
বেশীই ছিল বিরোধী। আর এবার? বিজেপি পেয়েছে প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩১ শতাংশ। আর
যদি মোট ভোটারের হিসাবে দেখেন, তাহলে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ২১ শতাংশের সমর্থন।
ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, এত কোন জনসমর্থন নিয়ে (হ্যাঁ, শব্দটা
এত কম জনসমর্থন) নিয়ে কোনও দলই আগে ক্ষমতায় আসে নি। শেষ যে বার কম জনসমর্থনের
একক দলের সরকার হয়েছিল, সেটা ছিল ১৯৬৭ সাল। কংগ্রেস মাত্র ৪০.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে
সংসদে ৫২০টির মধ্যে ২৮৩টি আসন পেয়েছিল। জোট হিসাবে সবচেয়ে কম মানুষের সমর্থনে
সরকার তৈরি হয়েছিল ১৯৯১ সালে পি ভি নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে। সেবার কংগ্রেস
পেয়েছিল ৩৮.২ শতাংশ ভোট। তাই সংখ্যাগরিষ্টতার জন্য বাইরের সমর্থনের উপর নির্ভর
করতে হয়েছিল। ফলে, সরকারের পক্ষে জনসমর্থন বেরে ৪৩ শতাংশের কাছে গিয়েছিল। প্রথম
ইউপিএ সরকারের পক্ষেও ভোত পড়েছিল মাত্র ৩৫.৯ শতাংশ। কিন্তু ইউপিএ-কে সমর্থন
দেয় সমাজবাদী পার্টি, পিডিপি এবং বামপন্থী দলগুলি। তাঁদের ভাগে ছিল ১১.২ শতাংশ
ভোট এবং ১০০টি আসন। ফলে ৪৭ ভোটের মালিক ছিল ইউপিএ। মাত্র ৩৮.৫ শতাংশ ভোটের
হিসাবটাও জোট হিসাবে সর্বনিম্ন ভোটের ঘটনা।
এ-সবই ইতিহাস, আর জানেনই তো ইতিহাস হল গাধা। কারণ সে তো অতীতের বোঝা
বয়ে বেড়ায়। আবার, এ-সব হল পরিসংখ্যানের বিষয়। আর অনেকে বলেন, পরিসংখ্যান হল
তৃতীয় মিথ্যে বা থার্ড লাই। তবু ইতিহাস আর পরিসংখ্যানের দোহাই দিয়েই বলি (
যেহেতু, আমি খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না), ২০০৯ সালে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট ৩.৫
শতাংশ কমে হয়েছিল ১৮.৮ শতাংশ, আসন ১৩৮ থেকে কমে হয়েছিল মাত্র ১১৬টি। অর্থাৎ,
প্রতি ১০০ জনের হিসাব যদি ধরেন, তাহলে বিজেপি জনসমর্থন বেড়েছে ১৮.৮ থেকে ৩১।
কিন্তু আসন বেড়েছে অকল্পণীয় হারে, যা কোনও সমীক্ষক আগাম অনুমান করতে পারেন নি।ৎ
পরিসংখ্যানের নির্মমতাটাও দেখুন। বিজেপি ২০০৯ সালে ১৮.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন
পেয়েছিল ১১৬। আর, কংগ্রেস এবার তাঁর থেকে ০.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে, মানে ১৯.৩ শতাংশ
ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে মাত্র ৪৪টি।
সঙ্গী দলগুলির ভোটকে এবার বিজেপির সঙ্গে যোগ করে দেখুন। সব মিলিয়ে ৩৮
শতাংশ। অর্থাৎ, গোটা দেশের শতকরা চারজন মানুষও শাসক এনডিএ-র পক্ষে নেই। ইউপিএ-র
দলগুলির পক্ষে আছে মাত্র ২৩ জনসমর্থন। প্রধান দুই দল – কংগ্রেস আর বিজেপির
প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশের একটু বেশি। অর্থাৎ, বাকি দেশ এই দুই
দলের বিরোধী। এনডিএ আর ইউপিএ-র ভোট যোগ করলে হয় ৬১ শতাংশ, অর্থাৎ, ৪০ শতাংশ
এদের বিরোধী। তবু এরাই দেশ শাসন করে চলে। কারণ, এরাই রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক
দলগুলির মধ্যে বিভাজন করতে পারে, বাণিজ্যিক সংস্থার মধুটা পায় আর ক্ষমতার আঠায়
কর্মী বাহিনীকে তুষ্ট রাখতে পারে।
আবার দেখুন, ভোট বেশি পেলেই যে সে আসন বেশি পাবে, তারও কোনও মানে
নেই। ৩৪ বছরের বাম শাসনকে হটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে
৩৪টি আসন। সারা দেশে শতাধিক আসনে প্রার্থী দিয়ে তাঁরা পেয়েছে ৩.৮ শতাংশ ভোট।
সিপিএম পেয়েছে ৩.২ শতাংশ ভোট, মাত্র ০.৬ শতাংশ কম। কিন্তু জিতেছে মাত্র
১১টিতে। আর, ৪.১শতাংশ ভোট পেয়েও মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি একটি আসনেও
জেতেনি।অবাক হতে হয়য়, মায়াবতীর বিএসপি প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের বিচারে আছনবিজেপি
আর কংগ্রেসের পরেই। তবু, কোনও আসনে জেতেনি। আম আদমি পার্টি ২ শতাংশ ভোট পেয়ে
মাত্র ৪টি আসনে জিতেছে। দিল্লিতে একটি আসনও পায়নি, যদিও দিল্লিতে তাঁদের ভোট
বেড়েছে। আর, আপ-এর চেয়ে কম ভোত পেয়ে শিবসেনা (১.৯ শতাংশ) ১৮টি আসনে জিতেছে।
এমনই মজার ব্যাপার হয়েছে ওডিশায় নবীন পট্টনায়েকের বিজেডির ক্ষেত্রে। এই দলটি
পেয়েছে ১.৭ শতাংশ ভোট, যা বিএসপি-র থেকে কমতো বটেই, ১১ আসনে জেতা সিপিএমের
চেয়েও কম। কিন্তু এই দল পেয়েছে ২০টি আসন। একই পরিমাণ ভোট পেয়ে ডিএমকে কিন্তু
কোনও আসনেই জেতেনি। সিপিআই এবার মাত্র ০.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আসন জিতেছে মাত্র
একটি। অন্যদিকে তার অর্ধেক ভোট পেয়েছে আসামের এআইইউডিএফ এবং রামবিলাস
পাশোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। দুই দলেরই ভোট মাত্র ০.৪ শতাংশ। দুই দলের ভোট
যোগ করলে সিপিআই-এঁর সমান হয়য়। অথচ, এই দল পেয়েছে যথাক্রমে ৩টি এবং ৬টি আসন,
অর্থাৎ হিসাবে ৯ গুন।
ভারতের গণতন্ত্রের অনেক দিক অনুকরণীয়, সন্দেহ নেই। এখানে শুরু থেকেই
প্রাপ্তবয়স্কের পূর্ণ ভোটাধিকার স্বীকৃত। জাতপাত, শিক্ষার মান, নারী-পুরুষের
ভেদাভেদ এখানে হয় নি। এত বড় দেশে যেভাবে ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাও
পৃথিবীতে এক উদাহরণ। কিন্তু, এখি সঙ্গে এটাও মেনে নেওয়া ভাল, এই পদ্ধতিতে
নির্বাচনে মানুষের রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন সংসদে বা আইনসভায় হয় না। নির্বাচনী
বিধি সংশোধনের নানা কথা আলোচিত হয় নানা সময়ে। এমনকি যে সাংসদেররা নিজেদের
‘জনগণের প্রতিনিধি’ বলতে ভালবাসেন এবং সংসদে গিয়েই নিজেদের ‘সরকারি কর্মচারী’
হিসাবে গণ্য করিয়ে জীবনভর ‘পেনসন’এর ব্যবস্থা করেন, বেতন ছাড়াও নিজেদের
কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য অতিরিক্ত টাকা নেন, তারা কখনই প্রাপ্ত ভোটের হারে
প্রতিনিধিত্বের দাবী করেন না। দীর্ঘ টালবাহানার পর নোটা স্বীকৃতি পেয়েছে, তাঁর
আদালতের হস্তক্ষেপের পর।
সংসদ কার্যত রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপূরণের সঙ্ঘে পরিণত। একবার
সেখানে যেতে পারলে এবং কোনও রকমে দুটো বছর কাটাতে পারলে সারা জীবন পেনসন ও
ভাতা বাঁধা। জনগণের কাজ করার জন্য জীবন উতসর্গ করার পর অবর্ণনীয় অর্থকষ্ট মেনে
নিয়েছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, তবুও পেনসনের ফর্মে স্বাক্ষর দেন নি।
বলেছিলেন, “সরকার দিচ্ছে বলেই আমাকে নিতে হবে?”
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়া তাই সংসদ সাধারণ মানুষের আশা-আকাংখার,
ভাবনাচিন্তার প্রতিফলক হবে না। এই দাবিটি অনেকদিন আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি
তুলেছিল। তারপর কেন যে চুপ করে গেল, কেউ জানে না। এই যুক্তিতে যে সারবত্তা
আছে, তা মানতে বাধ্য হলেও সিপিএম একটু বদলে নিয়ে দাবি করল – আংশিক আনুপাতিক
প্রতিনিধিত্ব। সোনার পাথর বাটি। বোধ হয় ভাবল, সিপিআই-র দাবি মেনে নিলে ছোট হতে
হবে। যাক, দলের লোকেরাই এখন দলটা ছোটো করে দিচ্ছে, অন্যদের ভাবতে হচ্ছে না।
সম্প্রতি করুণানিধির ডিএমকে একই দাবি করেছে। মায়াবতীর দলেও এই নিয়ে আলচনা চলছে।
তাই শুধু জেতার আসনের হিসাবেই ভুলছি না, প্রাপ্ত ভোটের হিসাবটাও
দেখতে চাই। গ্রামীণ মানুষের ভাষায়, লেজ তুলে দেখে নেব, মাদি না মদ্দা। টা না
হলে খাওয়াতে পারবেন, কিন্তু গেলাতে? … উহু।
লেজ তুলে দেখে নেব, মাদি না মদ্দা
অনেক দিন হল, কথা হয়য় নি আপনাদের সঙ্গে। ভোতের ফল বেরিয়ে গেল, সরকার তৈরি হয়ে
গেল, ছন্দা গায়েন পাহাড়েই হারিয়ে গেল এমনকি ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ফুটবলেরও উদ্বোধন
হয়ে গেল…। ভাবা যায়! সবই কি না ‘গেল’ ‘গেল’। এতো গেল গেল করার কি আছে? যা কিছু
‘হল’, সেটাই ‘হয়ে গেল’ কেন হবে? হোক না, হতে দিন, গেল গেল করার দরকার নেই। আবার
গেল গেল শব্দকেই কেউ না কেউ ঘুরিয়ে নিয়ে পড়বেন ‘গেলো গেলো’ করে। যেন গিলতে না
চাইলেও গিলিয়ে ছাড়বেন। এমনকি খেতেও হবে না আপনাকে, গিলিয়েই দেবেন।
আমার এতে ঘোর আপত্তি জানিয়ে দেই আগেভাগে। মম আপত্তিম টুওয়ার্ডস গেলানো। আমি
খেতে রাজি আছে, কিন্তু গিলতে রাজি নই। খেতে তো হবেই, কিন্তু সবকিছুই গেলায় নেই।
গলাধঃকরণে রাজি নই। এই ব্যাপারে আমার ইস্টদেবতা আমার সহায়। তিনিও খান, কিন্তু
গেলেন না। তাঁর নাম শ্রী শ্রীল শ্রীমৎ কেতু মহারাজ।
এই যে দেখুন না, বিরাট জনসমর্থন সঙ্গে নিয়ে বিজেপি এবার দেশের শাসন
ক্ষমতায় এল, এর তো একটা অর্থ আছে! বিজেপি এককভাবেই ২৮২টি আসনে জিতেছে। তাঁর
শরিকদের নিয়ে সংখ্যাটা ৩০০ পেরিয়ে গেছে। মানে, ১৯৮৫-র পর এই প্রথম একটা দল একক
গরিষ্টতায় সরকারে এল। কিন্তু, ১৯৮৫তে কংগ্রে পেয়েছিল ৪৮ শতাংশের বেশী ভোট,
অর্থাৎ ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষ কংগ্রেসকে সমর্থন দিয়েছিল, যদিও ৫১ শতাংশের
বেশীই ছিল বিরোধী। আর এবার? বিজেপি পেয়েছে প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩১ শতাংশ। আর
যদি মোট ভোটারের হিসাবে দেখেন, তাহলে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ২১ শতাংশের সমর্থন।
ভারতের গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, এত কোন জনসমর্থন নিয়ে (হ্যাঁ, শব্দটা
এত কম জনসমর্থন) নিয়ে কোনও দলই আগে ক্ষমতায় আসে নি। শেষ যে বার কম জনসমর্থনের
একক দলের সরকার হয়েছিল, সেটা ছিল ১৯৬৭ সাল। কংগ্রেস মাত্র ৪০.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে
সংসদে ৫২০টির মধ্যে ২৮৩টি আসন পেয়েছিল। জোট হিসাবে সবচেয়ে কম মানুষের সমর্থনে
সরকার তৈরি হয়েছিল ১৯৯১ সালে পি ভি নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে। সেবার কংগ্রেস
পেয়েছিল ৩৮.২ শতাংশ ভোট। তাই সংখ্যাগরিষ্টতার জন্য বাইরের সমর্থনের উপর নির্ভর
করতে হয়েছিল। ফলে, সরকারের পক্ষে জনসমর্থন বেরে ৪৩ শতাংশের কাছে গিয়েছিল। প্রথম
ইউপিএ সরকারের পক্ষেও ভোত পড়েছিল মাত্র ৩৫.৯ শতাংশ। কিন্তু ইউপিএ-কে সমর্থন
দেয় সমাজবাদী পার্টি, পিডিপি এবং বামপন্থী দলগুলি। তাঁদের ভাগে ছিল ১১.২ শতাংশ
ভোট এবং ১০০টি আসন। ফলে ৪৭ ভোটের মালিক ছিল ইউপিএ। মাত্র ৩৮.৫ শতাংশ ভোটের
হিসাবটাও জোট হিসাবে সর্বনিম্ন ভোটের ঘটনা।
এ-সবই ইতিহাস, আর জানেনই তো ইতিহাস হল গাধা। কারণ সে তো অতীতের বোঝা
বয়ে বেড়ায়। আবার, এ-সব হল পরিসংখ্যানের বিষয়। আর অনেকে বলেন, পরিসংখ্যান হল
তৃতীয় মিথ্যে বা থার্ড লাই। তবু ইতিহাস আর পরিসংখ্যানের দোহাই দিয়েই বলি (
যেহেতু, আমি খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না), ২০০৯ সালে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোট ৩.৫
শতাংশ কমে হয়েছিল ১৮.৮ শতাংশ, আসন ১৩৮ থেকে কমে হয়েছিল মাত্র ১১৬টি। অর্থাৎ,
প্রতি ১০০ জনের হিসাব যদি ধরেন, তাহলে বিজেপি জনসমর্থন বেড়েছে ১৮.৮ থেকে ৩১।
কিন্তু আসন বেড়েছে অকল্পণীয় হারে, যা কোনও সমীক্ষক আগাম অনুমান করতে পারেন নি।ৎ
পরিসংখ্যানের নির্মমতাটাও দেখুন। বিজেপি ২০০৯ সালে ১৮.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন
পেয়েছিল ১১৬। আর, কংগ্রেস এবার তাঁর থেকে ০.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে, মানে ১৯.৩ শতাংশ
ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে মাত্র ৪৪টি।
সঙ্গী দলগুলির ভোটকে এবার বিজেপির সঙ্গে যোগ করে দেখুন। সব মিলিয়ে ৩৮
শতাংশ। অর্থাৎ, গোটা দেশের শতকরা চারজন মানুষও শাসক এনডিএ-র পক্ষে নেই। ইউপিএ-র
দলগুলির পক্ষে আছে মাত্র ২৩ জনসমর্থন। প্রধান দুই দল – কংগ্রেস আর বিজেপির
প্রাপ্ত ভোট যোগ করলে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশের একটু বেশি। অর্থাৎ, বাকি দেশ এই দুই
দলের বিরোধী। এনডিএ আর ইউপিএ-র ভোট যোগ করলে হয় ৬১ শতাংশ, অর্থাৎ, ৪০ শতাংশ
এদের বিরোধী। তবু এরাই দেশ শাসন করে চলে। কারণ, এরাই রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক
দলগুলির মধ্যে বিভাজন করতে পারে, বাণিজ্যিক সংস্থার মধুটা পায় আর ক্ষমতার আঠায়
কর্মী বাহিনীকে তুষ্ট রাখতে পারে।
আবার দেখুন, ভোট বেশি পেলেই যে সে আসন বেশি পাবে, তারও কোনও মানে
নেই। ৩৪ বছরের বাম শাসনকে হটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে
৩৪টি আসন। সারা দেশে শতাধিক আসনে প্রার্থী দিয়ে তাঁরা পেয়েছে ৩.৮ শতাংশ ভোট।
সিপিএম পেয়েছে ৩.২ শতাংশ ভোট, মাত্র ০.৬ শতাংশ কম। কিন্তু জিতেছে মাত্র
১১টিতে। আর, ৪.১শতাংশ ভোট পেয়েও মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি একটি আসনেও
জেতেনি।অবাক হতে হয়য়, মায়াবতীর বিএসপি প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের বিচারে আছনবিজেপি
আর কংগ্রেসের পরেই। তবু, কোনও আসনে জেতেনি। আম আদমি পার্টি ২ শতাংশ ভোট পেয়ে
মাত্র ৪টি আসনে জিতেছে। দিল্লিতে একটি আসনও পায়নি, যদিও দিল্লিতে তাঁদের ভোট
বেড়েছে। আর, আপ-এর চেয়ে কম ভোত পেয়ে শিবসেনা (১.৯ শতাংশ) ১৮টি আসনে জিতেছে।
এমনই মজার ব্যাপার হয়েছে ওডিশায় নবীন পট্টনায়েকের বিজেডির ক্ষেত্রে। এই দলটি
পেয়েছে ১.৭ শতাংশ ভোট, যা বিএসপি-র থেকে কমতো বটেই, ১১ আসনে জেতা সিপিএমের
চেয়েও কম। কিন্তু এই দল পেয়েছে ২০টি আসন। একই পরিমাণ ভোট পেয়ে ডিএমকে কিন্তু
কোনও আসনেই জেতেনি। সিপিআই এবার মাত্র ০.৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আসন জিতেছে মাত্র
একটি। অন্যদিকে তার অর্ধেক ভোট পেয়েছে আসামের এআইইউডিএফ এবং রামবিলাস
পাশোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি। দুই দলেরই ভোট মাত্র ০.৪ শতাংশ। দুই দলের ভোট
যোগ করলে সিপিআই-এঁর সমান হয়য়। অথচ, এই দল পেয়েছে যথাক্রমে ৩টি এবং ৬টি আসন,
অর্থাৎ হিসাবে ৯ গুন।
ভারতের গণতন্ত্রের অনেক দিক অনুকরণীয়, সন্দেহ নেই। এখানে শুরু থেকেই
প্রাপ্তবয়স্কের পূর্ণ ভোটাধিকার স্বীকৃত। জাতপাত, শিক্ষার মান, নারী-পুরুষের
ভেদাভেদ এখানে হয় নি। এত বড় দেশে যেভাবে ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাও
পৃথিবীতে এক উদাহরণ। কিন্তু, এখি সঙ্গে এটাও মেনে নেওয়া ভাল, এই পদ্ধতিতে
নির্বাচনে মানুষের রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন সংসদে বা আইনসভায় হয় না। নির্বাচনী
বিধি সংশোধনের নানা কথা আলোচিত হয় নানা সময়ে। এমনকি যে সাংসদেররা নিজেদের
‘জনগণের প্রতিনিধি’ বলতে ভালবাসেন এবং সংসদে গিয়েই নিজেদের ‘সরকারি কর্মচারী’
হিসাবে গণ্য করিয়ে জীবনভর ‘পেনসন’এর ব্যবস্থা করেন, বেতন ছাড়াও নিজেদের
কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য অতিরিক্ত টাকা নেন, তারা কখনই প্রাপ্ত ভোটের হারে
প্রতিনিধিত্বের দাবী করেন না। দীর্ঘ টালবাহানার পর নোটা স্বীকৃতি পেয়েছে, তাঁর
আদালতের হস্তক্ষেপের পর।
সংসদ কার্যত রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপূরণের সঙ্ঘে পরিণত। একবার
সেখানে যেতে পারলে এবং কোনও রকমে দুটো বছর কাটাতে পারলে সারা জীবন পেনসন ও
ভাতা বাঁধা। জনগণের কাজ করার জন্য জীবন উতসর্গ করার পর অবর্ণনীয় অর্থকষ্ট মেনে
নিয়েছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, তবুও পেনসনের ফর্মে স্বাক্ষর দেন নি।
বলেছিলেন, “সরকার দিচ্ছে বলেই আমাকে নিতে হবে?”
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ছাড়া তাই সংসদ সাধারণ মানুষের আশা-আকাংখার,
ভাবনাচিন্তার প্রতিফলক হবে না। এই দাবিটি অনেকদিন আগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি
তুলেছিল। তারপর কেন যে চুপ করে গেল, কেউ জানে না। এই যুক্তিতে যে সারবত্তা
আছে, তা মানতে বাধ্য হলেও সিপিএম একটু বদলে নিয়ে দাবি করল – আংশিক আনুপাতিক
প্রতিনিধিত্ব। সোনার পাথর বাটি। বোধ হয় ভাবল, সিপিআই-র দাবি মেনে নিলে ছোট হতে
হবে। যাক, দলের লোকেরাই এখন দলটা ছোটো করে দিচ্ছে, অন্যদের ভাবতে হচ্ছে না।
সম্প্রতি করুণানিধির ডিএমকে একই দাবি করেছে। মায়াবতীর দলেও এই নিয়ে আলচনা চলছে।
তাই শুধু জেতার আসনের হিসাবেই ভুলছি না, প্রাপ্ত ভোটের হিসাবটাও
দেখতে চাই। গ্রামীণ মানুষের ভাষায়, লেজ তুলে দেখে নেব, মাদি না মদ্দা। টা না
হলে খাওয়াতে পারবেন, কিন্তু গেলাতে? … উহু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন