বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর – নয়
সারাটা জীবন একলাই হাঁটতে হয়েছে
এই শেষ না হওয়া উঁচু নিচু খানাখন্দ ভরা পথ। কখনো কোনো উদাসী অমাবস্যার রাতে ঝিলিক
দেওয়া উল্কাপাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হয়তো বা মনের গোপন রহস্য কোনে বেজে গেছে
মালেকাজানের সুরেলা গলা ভৈরবী ঠুমরী রাগ এ “বাবুল
মোরা নইহার ছুটহি যায়ে…”। হৃদয়ের অজানা অচেনা গতায়াত এখনো রপ্ত করে উঠতেই পারলো না
সে। এখনো বুঝলো না ঠিক কোন রাস্তায় শুধুই মধুর সুগন্ধ ভাসে। একা হাঁটতে হাঁটতে, একা থাকতে থাকতে একা থাকার অভ্যাস টা মজ্জার মধ্যে কিভাবে যেন সেঁধিয়ে
গেছে, গেড়ে বসেছে ভয়ংকর আগ্রাসী শেকড়, সেটা
তার নিজেরও জানা নেই। আর এজন্যে কোনো হাহুতাশও নেই তার। বড় বড় ফোঁটায় তেড়ে বৃষ্টি
নামলো আবার।
কামুক মৌসুমী হাওয়া বৈজয়ন্ত
উড়ায় পতপত করে। চৌষট্টি ঘোড়ার রথে হুহুঙ্কারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তীব্র সঙ্গম ইচ্ছায়।
কামশাস্ত্র মোতাবেক বর্ষাকাল হলো প্রবল কামোন্মাদনার সময়। চামড়া পুড়িয়ে দেওয়া, হাঁসফাঁস করা গরমের শেষ পর্যায়ে ঝিরঝির আকাশঝর্ণার শুরু থেকেই পেখম মেলতে
থাকে মন। বৈধ অবৈধ সব সম্পর্ক একসাথে বকমবকম শুরু করে। শরীরের প্রত্যেক খাঁজ সজল
হয়ে ওঠে। রমনের তীব্রতায় কাঁপতে থাকে গম্ভীর মাটি। এ ভরা বাদরে এ মাহ ভাদরে
কবিকথকতা হলেও ভাদ্রের অনেক আগে সে আষাঢ়েই বাদরের কুহু ডাক পাগল করে তোলে সব
প্রেমিক প্রেমিকাদের। অকারণ ভেজার কাংখ্যায় শরীরের মধ্যে সিরসিরে অনুভব নেশায়
মাতাল করে দেয় যৌবন মদমত্ত দের। আকাশের কালো ঘোড়াদের দিকে তাকিয়ে মুখে
বৃষ্টিফোঁটার স্বাদ নিতে নিতে মুচকি হাসে লোকটা।
মাটির নিচে গরম ঘুমে থাকা গাছ
আর আগাছার বীজেরা থইথই করে বেরিয়ে এসেছে। ছেয়ে ফেলেছে চারদিক। যেদিকে তাকানো যায়, যতদূরেই তাকানো যায় এখন শুধুই সবুজ আর সবুজ। গরমের পোড়ার, ফুটিফাটা ত্বকের সব চিহ্ন মুছে ফেলে উন্মত্ত হয়েছে পৃথিবী। হৈ হৈ করে
হাসছে, খেলছে, গান গাইছে সবুজের। একদল
ন্যাংটো ছেলে উপচে পড়া আনন্দের ঝুড়ি নিয়ে ঝপাং ঝপাং করে প্রায় ভরে যাওয়া একটা
পুকুরের জলে লাফাচ্ছে, উঠছে, ফের
লাফাচ্ছে। এই অজগ্রামের মানুষেরা জানেই না, বাচ্চাদের শাসন
করতে হয়। জলের আশেপাশে গেলে শিউরে উঠে আঁকড়ে ধরে নিষেধ করতে হয় তাদের। বৃষ্টির জলে
কিলবিল করা ভাইরাস আর ব্যাকটিরিয়ার কল্পনায় অ্যান্টিবায়োটিকের কোষক্ষয়ী দেওয়াল গড়ে
তুলতে হয়। ওদের বাবা মা রা এখন ব্যস্ত উদরপূরণের জোগাড়ে।
বহু কাজ এখন তাদের। কামারশালায়
গিয়ে ধারালো করে আনতে হবে লাঙলের ফলা। হালের ফেলে রাখা কাঠের গায়ে মাখাতে হবে
বর্জ্য তেল। সেই তেলের কিছুটা আবার গরুর গাড়ীর চাকাতেও দিয়ে রাখতে হবে। প্রথম কয়েক
দফার বৃষ্টির পরে মাটি একটু নরম হলেই রাত থাকতে উঠে বেরিয়ে পড়ে হাল দিয়ে চষার
প্রথম পর্ব সেরে রাখতে হবে। সার দিয়ে গর্ভ শক্তিশালী করতে হবে, এরপরে ছড়াতে হবে আমনের বীজ। দিতে হবে মই, জমি সমান
করার জন্যে। চারা বেরোলে সাবধানে সেই চারা তুলে সমান দূরত্বে ফের বসাতে হবে তাদের।
ছড়াতে হবে কীটনাশক। তারপর প্রতীক্ষা ‘আল্লা মেঘ দে-আল্লা
পানি দে’। সেই আশ্বিনের শেষে মাঠ
হাসবে। ভরে উঠবে সোনালী আমন ধানের খুশিতে। পরিবারের সবার পরনে উঠবে নতুন কাপড়, জমবে অন্তত ছমাসের পেট ভরানোর রসদ। একটু এদিক ওদিক হলেই চাষার কপালে নেমে
আসবে ভয়াবহ অন্ধকার। তাই এখন বাচ্চাদের দিকে তাকানোর সময় কোথায় তাদের?
নিজের মনেই হাসে লোকটা। মানুষ থেকে প্রকৃতি আর মাঝে অন্য
সব প্রাণীরাই চলে সেই এক চক্রে। কদিনের দেখাশোনা, মিষ্টি হাসি আর কথার
কারসাজি। সব গিয়ে শেষ হয় শারীরবৃত্তে। প্রকৃতি গর্ভবতী হয়। জন্ম নেয় নতুন ফসল।
অজান্তেই নিচের ঠোঁটের ডানদিকে জিভ টা বোলায় সে। কালরাতে মৈথিলি যৌবনবতী একটু
জোরেই কামড়ে ধরেছিল সেই জায়গা। তার অশক্ত বৃদ্ধ স্বামী কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি।
সম্ভবত কোনো পানশালার বাইরেই রাত কেটেছে তার। এই গ্রামে নাপিতের কাজ করতে এসেছিল
সেই ক্ষৌরকার বহুদিন আগে। আর ফেরা হয়নি তার। প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় পৌঁছে স্বজাতীয় হাঁটুর
বয়সীকে এনেছিল চিলতে কুঠরীতে। আজ সেই অঙ্গনা লকলকে তালস্পর্শী সবুজ। তার চাহিদা
পূরণের ক্ষমতা আজ আর নেই সেই নাপিতপুঙ্গবের। একথা জেনেই কুড়িটা টাকা চেয়ে নিয়ে সে
বাইরে চলে গেছিল। আর ফিরে আসেনি কাল সারারাত। বাইরে তখন প্রলয়, ঘনঘন
বিদ্যুৎ সঙ্গী করে জলধারা ভিজিয়ে চলেছে প্রকৃতিকে। আর ঘরের মধ্যে যত্নে দেওয়া রুটি
আর সবজী শেষ করে মাটিতে পেতে দেওয়া বিছানায় শোবার কিছুক্ষণ পরেই তার ওপরে ভেঙে
পড়েছিল বজ্রবিদ্যুৎসহ সারা আকাশ। তাথৈ নটরাজীয় সময় কিভাবে পেরিয়ে গেল দুজনের কেউই
বুঝতে পারেনি। সকালে দেখল নগ্ন মৈথিলি অর্ধেক শরীর দিয়ে আগলে রেখেছে তাকে। লোকটার
জিভ ফের ঘুরে যায় ঠোঁটের ওপর।
এখনো সম্পূর্ণ সভ্য হওয়া হলো না তার। সভ্যতার অ আ ক খ র
ভেতরের প্যাঁচালো গোলকধাঁধার গলিপথে ঢুকলেই পথ হারিয়ে ফেলে সে। কিছু টাকা, কিছু
বশ্যতা স্বীকৃতকারীদের সামনে অহমিকার সুযোগ নেবার জন্য ক্ষমতার অলিন্দে থেবড়ে বসে
থাকা। সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের কচুকাটা করা, সমস্ত অনৈতিক রাস্তায় আলোআঁধারিতে যাতায়াত, দুর্বৃত্ত
পোষা, তাদের হাতে আবার সাধারণের নিগ্রহ। এটাই কি সভ্যতা? এই জন্যেই
কি এত আত্মবলিদানের কোনো প্রয়োজন ছিল? রাজর্ষির সেই ছোট্ট তাতার আর্তনাদ যে এখনো ঈথারের
গায়ে কাঁপে –“ এত রক্ত কেন?” সত্যি তো কিছুদিনের ক্ষমতা
যে সারাজীবনের নয় এই সারসত্য হিটলারও বোঝেনি, আবার ইতিহাসের কাছে শিক্ষা
নিয়ে আজকের মুসোলিনিরাও কেন যে বুঝতে চায় না? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঁধের
ঝোলা আবার তুলে নেয় লোকটা। বৃষ্টি সম্পূর্ণ থামেনি। ঝিরিঝিরি পড়ছে। কিন্তু এসময় না
বেরোলে গঞ্জের ঘাটে পৌঁছনো যাবেনা সন্ধের আগে। ওপারে আজ যেতেই হবে। এপারের
দরিদ্রতম কুটির গুলোতে আশ্রয় চাওয়া মানে তাদের বিপদে ফেলা। পেঁজা তুলোর মেঘকান্নার
মাঝেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করে সে।
“ওয়ে রব তু নে কিঁউ তোড়া ইয়ে দিল,
ইস মৌসম মে…”।
কে শোনে এ গান এই পাগল করা ভেজা মাটির আঘ্রাণে? –‘ও পাগলা
নাও বাইতে পারিস?’ –‘হ্যাঁ ভালো কথা বলেছিস’। ব্যস পাগল চললো নৌকা বাইতে ঝড়জলের
রাতে। এ যেন ঠিক সেই পাগলকে পাগলামির আমন্ত্রণ জানানো। ঠিকই তো এই মৌসমে কেউ হৃদয়
চুরচুর করে চলে যায়? কতবড় পাষন্ড হলে তবেই প্রেমকে কাঁদিয়ে এভাবে চলে
যাওয়া যায়? মেরুদন্ডের ঠিক মাঝবরাবর একটা শীতল সাপ উঠে আসে
মস্তিষ্কে ছোবল মারার জন্যে। এই গান তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে কুড়ি বছর আগের বিবর্ণ
এক রাতে। চিত্রালি নামের যে পাঞ্জাবী বিদ্যুৎচমক তাকে প্রায় বেঁধে ফেলেছিল, গৃহস্থ
করে তুলছিল, মাঝবর্ষার এক রাতে হঠাৎই সে উধাও হয়ে গেল সব রঙিন
ছবি ছিঁড়ে ফেলে। প্রবল বর্ষণের হিংস্র তান্ডবের মধ্যে সেদিন একা হয়ে যাওয়া পৃথিবীর
মুখোমুখি হয়েছিল লোকটা। কয়েক ঘন্টার জন্যে ভ্যাবলা হয়ে গিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা
করেছিল মানবমনের অন্ধিসন্ধি। তারপর সব মায়াটানের মুখোশ খুলে ফেলে একবস্ত্রে নেমে এসেছিল রাস্তায়। আর কোনোদিন ঘরমুখো
হয়নি সে।
“আমি সাধ করিয়া বাঁধিলাম ঘর, জনম গেল
কাইন্দা। নদীভাঙ্গা পাড়ে ঘর বাইন্ধা”।
চোখের কোনে বেরিয়ে আসা এক ফোঁটা নোনতা ব্যর্থ জল বাইরের
আকাশকান্নায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
ফের মেঘ জমতে শুরু করেছে। টুকটুক করে বলদ সমেত চাষা
ফিরছে বাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের দিকে। যে কোনো সময় আবার বৃষ্টি নামবে। আর তাহলেই এই
শেষ বিকেলে নেমে আসবে অকালসন্ধ্যে। হনহন করে গতিবেগ আর একটু বাড়িয়ে দিল লোকটা। গতি
বাড়ালেই কি জীবনের সব লক্ষ্য কে ছোঁয়া যায়? তার লাইফস্টাইল দেখলে যেকোনো
গার্হস্থ জীবনের মানুষ হয়তো তাকে বলবে অপদার্থ, অকেজো, পরাজিত, ভাঙাচোরা।
তাদের জীবনপদ্ধতির সঙ্গে ছিটেফোঁটা মিলও দেখাতে পারবে না সে। আর সে ইচ্ছেও নেই। এই পায়ের
নিচে সরষে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর পেছনে অন্যেরা যতই হরেক কারন খোঁজার চেষ্টা করুক না
কেন, সে তো জানে যে সে জন্মইস্তক যাযাবর। তার কোনো নাভি
নেই, নাভিকুন্ডলও নেই। জন্ম নেই মৃত্যু নেই। সে আবাহনেও
থাকেনা, বিসর্জনেও ব্রাত্য। সে হলো মৌলমানুষ। তার
পূর্বপুরুষও নেই, নেই কোনো ফেলে যাওয়া উত্তরপুরুষের বীজ। তার যেখানে
শুরু সেখানেই শেষ নয়। সে ছড়িয়ে যায় প্রতিনিয়ত প্রত্যেক অঙ্কুরের আঁতুড়ঘরে, প্রত্যেক
বীজতলায়। প্রখর গ্রীষ্মে তাকে আপাতদর্শনে খুঁজে পাওয়া যায়না। কিন্তু সামান্য
ভালোবাসার জল গায়ে পড়লেই সে মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে, সবুজের সমারোহে সবাই কে রঙিন
করে চলে যায় এক জাগতিক দৃশ্যপট থেকে দৃশ্যান্তরে।
“ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ কে জানে...”।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন