রমাকান্ত নামা—বোধোদয়
রমাকান্তর অভিজ্ঞতা বড় পরুষ ঘেঁষা। আর হবেই না বা কেন স্বয়ং যে তিনি পুরুষ ! পুরুষ বলতে কি বোঝায় তা তাঁর বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে এখানে নেই। জগতের দুই জাতি--নারী ও পুরুষ। আর বাকী সব অপরিণত রূপ—বাচ্চাকাচ্চা, বুড়বুড়ি, সুস্থ-অসুস্থ অথর্ব ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনেক কথা বলতে পারেন না রমাকান্ত যা তাঁর নিজের অভিজ্ঞতায়
ধরা থাকে--বিশেষ করে নারী জাতির
ব্যাপারে। এটাও যদি এক তরফা বলা হয়ে যায়, পুরুষ জাতির পক্ষপাতিত্ব এসেই যেতে পারে--এটা জোর করে অস্বীকার করতেও পারেন না তিনি।
জগতের সব
কিছুই তো প্রকৃতির—প্রাণীও তবে প্রাকৃতিক। প্রকৃতিজাত, প্রকৃত ছিন্নমূল, তারপর অনেক দূর এগিয়ে এসেও আবার জংলী হতে কার ভাল লাগে ? আর ঐ
একটা গর্ব আছে না--সবার ওপরে মানুষ সত্য--তাহার ওপর নাই ! কাজেই ব্যতিক্রমী ব্যাপারগুলি নিয়ে রমাকান্ত আর মাথা ঘামাতে চান না।
রমাকান্তর
পাশের বাড়ির উদ্ধব বাবুর কথা মনে পড়ে।
বেচারা নারী নিপীড়িত ব্যক্তি ! না ঠিক তা নয়, বলা যায়--স্ত্রী নির্যাতিত গোবেচারা। যখনকার কথা তখন তিনি সংসার নিয়ে একটু জর্জরিত ছিলেন।
উদ্ধব নামটা কিন্তু ওবিয়াসলি নিজের দেওয়া নয়। বাপ ঠাকুরদার দেওয়া অথবা মা ঠাকুরমার দেওয়া। এ ক্ষেত্রে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা যুক্তির ফাঁক ফোঁকর গলিয়ে আগ বাড়িয়ে বলতে পারেন--কেন দাদু দিদিমা না কেন ? এখানটা একটা রেষারেষির জাগা--সংসারী মাত্রেই অবগত হবার কথা যে স্ত্রীপক্ষ স্বাভাবিক ভাবে দুর্বল থাকে।
যাই হোক প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে লাভ নেই--ওই উদ্ধব বাবুর কথায় আসা যাক--বেচারার সংসারে বড় খেঁচাখেঁচি চলছিল। সাপোর্ট দেবার মত তার ঘরে মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ ছিল না।
বিয়ের আগে বাবা তারপর বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই উদ্ধব বাবুর মাও মারা গেলেন। স্ত্রী ছিলেন তাই বলবান। কারণ, স্ত্রী তার মা, বাবা, ভাই, বোন পরিবৃতা ছিলেন যে !
উদ্ধব বাবুর শাশুড়ি আর দশটা শাশুড়ির মত মেয়ের কান ভারি করতেন ।
স্বামী সেবার সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে নিজের মুঠোয় রাখাটাও নাকি স্ত্রীর ধর্ম ! আর এই ধর্মকর্ম বজায় রাখতে গেলে যা হয় আরকি--স্বামীর প্রতি চাপ পড়ে যায়--যাকে বলে প্রেশার !
সেদিন উদ্ধব বাবু রমাকান্তর বাড়ির দরজা খটখটালেন, স্ত্রীর কথায় ভয় নির্লিপ্ত হয়ে দরজা খুললেন রমাকান্ত, এত রাতে উদ্ধব বাবু ! পরিচিত হাসির দাঁতগুলি আজ বের হল না তাঁর--সোজা তিনি বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন। উদ্ধব বাবুর ওপর দিয়ে ঝড় ঝঞ্ঝা এ ধরনের কিছু বয়ে গেছে বলে মনে হল। মাথার চুলগুলি এলোঝেলো, চোখ দুটি ঈষৎ লালচে ! রমাকান্ত অধীর আগ্রহ নিয়ে বলে উঠলেন, কি হল উদ্ধব বাবু-- কোন বিপদ ?
বেজার মুখ নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, বিপদ আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকে--এ সংসার দেখছি আমায় ছাড়তেই হবে !
রমাকান্তর স্ত্রী শৈলবালা ততক্ষণে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছেন,অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কি হল উদ্ধব দা ?
--কি আর হবে--এক আপনাদের এখানে এসেই আমি একটু শান্তি পাই ! ঘরে যে ক্যাচাল--
--আবার কিছু নিয়ে লাগলেন নাকি ? শৈলবালা বলে উঠলেন।
--আমি কেন লাগতে যাব ? বলুন তো আপনারা তো আমায় চেনেন--
--আর চেনা--আপনাদের পুরুষ জাতটা তো--বাকি কথা বলার আগে রমাকান্তের মুখের দিকে চোখ পড়ে গেল শৈল বালার। তাঁর মুখ মণ্ডলের ছাপে হঠাৎ ধীর স্থির মহাপুরুষের গম্ভীরতা দেখে শৈলবালা থেমে গেলেন।
এই তো নিজের ঘরে কিছু সময় আগেই এক চোট হয়ে গিয়েছে, তার রেশ চট করে যায় ! স্ত্রী শৈলবালা ভালো যখন ভালো, আবার কোন কারণে বিগড়ে গেল তো তার মত খারাপ আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পান না রমাকান্ত। আর শুধু শৈলবালা কেন প্রায় ঘরের বালারাই এমনি ধরণের হবে! না হলে এত রাতে উদ্ধব বাবু তাঁদের ঘরে এসে উপস্থিত হন ? রমাকান্ত শৈলবালাকে থামালেন, তা না হলে যে নিজের ঘরেই আবার ছুঁচোর কীর্তন শুরু হয়ে যাবে !
--না, বউদি আপনি ঘটনাটা শুনুন—উদ্ধব বাবুর কাতর কণ্ঠ শোনা
গেল।
--ঠিক আছে, এখন শান্ত হয়ে বসুন, তারপর সব শোনা যাবে, রমাকান্ত বর্তমান পরিবেশে শান্তি আনার চেষ্টা করলেন।
উদ্ধব বাবু যেন ককিয়ে উঠলেন, আর শান্ত--আমার মা, বাপকে নিয়ে পড়েছে--আমার সব সহ্য হয় কিন্তু মরা মা,বাপ নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বললে বড় কষ্ট হয়--
--শুরু কি নিয়ে হল ? শৈলবালা আবার মুখ খুললেন।
--ওই এক কথা, আপনারা তো জানেন সরলা আমার ছাত্রী, ওকে নিয়ে সন্দেহ করার কি আছে ? সব সময় বলবে, তোমার সরলা, তোমার সরলা, কথাটা কার না গায়ে লাগবে ?
একটু খোলসা করে নেওয়া যাক, সরলা ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী, উদ্ধব সে স্কুলের টিচার। মাঝে মাঝে দু একজন ছাত্র ছাত্রী উদ্ধবের কাছে পড়া বুঝতে এসে পড়ে। তবে হবে সরলার আনাগোনা একটু বেশী।
--ওই মেয়েটা আপনাদের ঘরে না আসলেই পারে--শৈলবালার জেরা।
--কি বলব বৌদি, শুধু সরলা কেন--ঘরের ঝিটাকে নিয়েও--আমি নাকি ওকে বেশী লায় দিয়ে ফেলি--উদ্ধব তাঁর নিজের বয়ান দিয়ে যাচ্ছিল।
শৈলবালার নিজের ঘরের কোন্দলের রেশ তখনও মনে হয় রয়ে গেছে, আধো ঝাঁজের সুর নিয়ে বলে তিনি বলে উঠলেন, একটা কথা বলবো উদ্ধব বাবু--আপনাদের পুরুষদের
এটাই তো বড় দোষ--
রমাকান্ত বিব্রত হয়ে বলে উঠলেন, এখন এসব কথা থাক না, শৈলবালা !
শৈলবালা থামলেন না—বরং রমাকান্তর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, তোমার এত লাগছে কেন গো? উচিত কথা বললে গায়ে ফোস্কা পড়ে বুঝি?
এমনি কাটা কাটা কথা বলা ভদ্রমহিলাদের বোধ হয় একটা অভ্যাস। অন্তত রমাকান্তর এই মুহূর্তে এমনটাই মনে হল। তবে মাঝখানে
তিনি আর ফোঁড়ন কেটে তিক্ততা বাড়াতে চাইলেন না।
উদ্ধব বাবু মাথা নিচু করে অপরাধীর মত বসে আছেন। রমাকান্তর খুব খারাপ লাগছিল। বেচারা একটু পক্ষপাত পাবেন বলে এখানে এসে ছিলেন--ভেবে ছিলেন, হয় তো আপন থেকে পর ভালো, এখন হয় তো ভাবছেন, এর চে জঙ্গলই বোধ হয় ভাল ছিল !
আরও কিছু মুখ ফসকাবে ভেবে শৈলবালা বোধ হয় হঠাৎ স্তব্ধতা
নিয়ে চলে গেলেন। তাঁর চোখের সামনে হয় তো রমাকান্তর মতই আর একটি পুরুষ মানুষের ছবি মূর্তিমান হয়ে উঠছিল !
উদ্ধব বাবু এখন মাথা নিচু করে বসে আছেন। রমাকান্ত তাঁর পাশটায় গিয়ে বসলেন, আস্তে করে নিজের হাতটা উদ্ধবের পিঠে রাখলেন, সহানুভূতির স্পর্শ পেয়ে উদ্ধব বাবু মুখ তুললেন, ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, জানেন, আমার কেউ সাপোর্টর নেই--আমি তো ঘরে একা--আর ওরা স্ত্রী আর শাশুড়ি আমায় সব সময় চাপে রাখে !
রমাকান্ত বুঝলেন, হ্যাঁ, এক দিক বেশ ভারী বটে ! উদ্ধব বাবুর পেরে না উঠাটাই স্বাভাবিক।
রমাকান্তর ভাবনাগুলি এগিয়ে চলছিল। এমনিতে স্ত্রী জাতি মাত্রেই সন্দেহ বাতিকী, আবার পরক্ষণেই তাঁর মনে হল--আর পুরুষ জাতি ? তার কি কোন দোষ নেই ? রমাকান্ত নিজের মধ্যে ঝেঁকে দেখেছেন, হ্যাঁ আছে বৈ কি--ভাল লাগা স্বভাব বোধ হয় তার মজ্জাগত। তাদের ভাল লাগে প্রকৃতি, রং ফুলের সৌন্দর্যের প্রতি পক্ষপাত তাদের জাত ধর্ম। সত্যি কথা বলতে কি মেয়ে ছেলে দেখলে ছুঁক ছুঁক ভাবটা পুরুষ জাতির রক্তে মাখামাখি থাকে—হ্যাঁ, তার প্রকাশ পুরুষদের স্বভাবের ওপর নির্ভর করে—কারও আবার বাইরে দৃশ্য-গম্ভীর গুমোট চেহারা হলেও অন্তরে প্রেম উচ্ছলতা ছলাৎ ছলাৎ চলতেই থাকে !
নারীর প্রকৃতি অনেক আলাদা—ভগবানও নাকি তার ধরণ বুঝে উঠতে অক্ষম। সৃষ্টির মাঝে গাঁট বন্ধনের প্যাঁচ এমন ভাবে তৈরি যে সেখানে আলাদা কোন গিঁটের প্রয়োজন নেই !
তবে অনেক গভীরে গিয়ে নারী প্রকৃতি নাড়া খায়--বেশ কিছুটা ত্যক্ত বিরক্তির পরই বোধ হয় এমনটা
হয়। আর সে বোধোদয় অনেকটা
সময় স্থায়ী হয়। মুদ্দা কথা, আমাদের পূর্বপুরুষদের মাথা মোটা ছল না--অনেক অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে যেতে যে নিয়ম, সংসারধর্মের ধারণা তাঁরা পুঁতে গেছেন তার মূল্যও অপরিসীম। তা না হলে ঘর ভাঙাই হত পুরুষদের প্রধান কাজ হত। আর নারীদের সর্ব ভোগ্যা হয়ে থাকতে হত। অরাজকতার রাজ হত। তাই তো এই ঘর, সংসার, চার দেওয়াল, স্ত্রী জাতির সংরক্ষণ গুণগুলি সমাজ বন্ধনকে বাঁচিয়ে রাখতে
পেরেছে।
সে দিন উদ্ধব বাবু উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রমাকান্ত আরও একটু সময় তাঁকে বসতে বলেছিলেন।
কিন্তু তিনি রুদ্ধ গলায় বলে উঠেছিলেন, জানেন রমাকান্ত বাবু, আমি নিশ্চয় একদিন ঘর ছেড়ে পালাব।
--কোথায় ? সহমর্মী হয়ে রমাকান্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন।
--সাধু হয়ে, ঘর ছেড়ে কোন আশ্রমে চলে যাব।
তারপর বহু বছর কেটে গেছে। আজও উদ্ধব বাবু সাধু হয়ে ঘর ছাড়তে পারেন নি।
- সমাপ্ত -
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন