সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

অনাবিল স্মৃতির - অমর মিত্র


আমার কথা
অমর মিত্র


আমি ক্লাস ওয়ান-টু পড়ি নিকেন পড়ি নি  বলতে পারব নাআমাদের যাতায়াত ছিল কলকাতা দন্ডীরহাট আর পাকিস্তানের ধূলিহরেওতাই হয় তো পড়া হয় নিপ্রথম আমাকে বাবা এক সন্ধ্যায় এনে দেন, হাসি খুশি, সুখলতা রাওসেই আমার প্রথম নিজের বইএকান্ত নিজেরসেই বই আমাদের ফ্ল্যাটের ভিতর কোথায় লুকোবআলমারির তলায়, না আলনার তলায়আমার তো নিজস্ব কোনো জায়গা নেই যে সেখানে আমার নিজের বই নিজের মতো করে রাখবহা হা হাএত বয়সেও তা আমার হয় নিআমাদের সেই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের পুরোন ফ্ল্যাটেই আমি থাকিআমার নিজের ঘরখানিতে বই আর বইসেলফ ভর্তি হয়ে মাটিতে, খাটের নিচে, কোথায় নাযে বই যখন দরকার হয় খুঁজে পাই নাতবে আমার সহধর্মিণী শ্রীমতী মিতালি তা অনেক সময় খুঁজে বেরও করে দেনঅনেক সময়ই হারানো বই আবার সংগ্রহ করতে হয়চেয়ে নিয়ে কাজ মিটিয়ে ফেরত দিতে হয়থাক এখনকার কথা, তখনকার কথা বলিহাসিখুশি আমার প্রথম বইআমাকে পড়াতে এলেন রাখাল স্যারতিনি বেলগাছিয়া বাজারের পিছনে বস্তিবাসি ছিলেনশান্ত প্রকৃতিরইংরেজি পড়তে গিয়ে হোয়াট মানে ‘’কী’’ ? খুব মজা পেয়েছিলামতাঁর কাছে আমার অক্ষরজ্ঞান হয় নাকি আগেই হয়েছিল তা মনে নেইতবে আমার বছর পাঁচে ধূলিহর গ্রামে হাতে খড়ি হয়েছিল তা স্পষ্ট মনে আছেযাই হোক রাখাল স্যারের কাছে পড়ে এই এলাকার সবচেয়ে ভাল স্কুল মনোহর একাডেমিতে আমি ভর্তি হই পরীক্ষা দিয়েআর স্কুলে ভর্তি হয়েই আমি বন্ধু পেলামরাখাল স্যার আমাকে একবছর পড়িয়েছিলেনতাঁর ভাই আলু বেচতেন বাজারেএই তো বহু বছর বাদে সেই শীতলদাকে জিজ্ঞেস করেছি, রাখালবাবু কেমন আছেন?  খবর পেয়েছি, তিনি বেঁচে নেইকলকাতার স্কুলে থ্রি আর ফোরবন্ধু ছিল কজনতাদের সঙ্গে টালা পার্কে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে বড় হতে লাগলামবাড়িতে লোক বেশি, তাই খেলার মাঠেই বেশির ভাগ সময়পড়াশুনোয় সুবিধে হচ্ছিল নাথ্রি থেকে ফোরে কোনো রকমেঅঙ্কে খুব কাঁচাফোর থেকে ফাইবেও দুকুড়ি পাঁচআমার মা বলতেন ওই কথাএর মানে কোনো রকমে পাশআমি অঙ্কে তাও পেতাম নাকেউ তো দেখাবার ছিল নাপেতাম এক কুড়ি পাঁচ-দশভাল লাগত কিশলয়, ভূগোল, ইতিহাসগল্প থাকত তাতেবাবা বোধ হয় এক জন্মদিনে একটি বই এনে দিয়েছিলেন, দেব সাহিত্য কুটিরের বুক অফ নলেজসেই বই মাসখানেকের ভিতর শেষকী ভাল যে ছিল সেই বইকোন বইয়ে পড়েছিলাম মেরু অভিযাত্রীদের কাহিনিক্যাপ্টেন কুক, আমুন্ডসেনের কষ্টকর অভিযানকলম্বাসের কাহিনি, ভাস্কো দ্য গামার কথা  
                                             
কোন একটা বছর আমাকে কলকাতার ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে দন্ডীরহাট ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলমা গেল সঙ্গেকলকাতার বাসায় বাবা থাকলেন আর অনেকজনআমার দুই দাদা থাকল কলকাতায়মা আমি আর আমার পরের বোন অপর্ণা চললাম ৭৯ সি বাসে চেপে দন্ডীরহাটলাগত পাকা তিন ঘন্টাখুব ছোটবেলায় দেখেছি দন্ডীরহাটের পাশ দিয়ে মারটিন কোম্পানির ছোট রেলগাড়ি চলতেতা  আমাদের বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে সেই গাড়ি দেখেছি আমিগাড়ি বেলগাছিয়া থেকে ছেড়ে হাসনাবাদ অবধি যেতসেই গাড়ি তখন ঊঠে গেছেনতুন শিয়ালদা হাসনাবাদ রেলগাড়ি চালু হয়েছে, কিন্তু তা অনেক দূর দিয়ে ধানের মাঠের ভিতর দিয়ে যায়সেই গাড়ি দন্ডীরহাটের লোকের খুব সুবিধে করে নিএখন অবশ্য লোকজন সাইকেলে বসিরহাট গিয়ে ( আসলে স্টেশনের জায়গাটির নাম ময়লাখোলাশহরের সমস্ত ময়লা ওখানে ডাঁই করা হতো  যাকগে সেই কথা৭৯ নম্বর বাস ও অন্য সব বাসের মালিকানা তখন ছিল শিখদেরতাদের হাতেই ছিল কলকাতা ও মফস্বলের পরিবহন ব্যবস্থাবাস কন্ডাক্টর শিখ যুবক, বাসের গা পিটোতে পিটোতে----এই ডিগা ডিগা ডিগা বলতে বলতে চালককে উৎসাহিত করত গতি বাড়াতেকী মধুর ছিল তাদের মুখের সেই ডাকপরে একটি গান বিখ্যাত হয়েছিল দমদম ডিগা ডিগা, মৌসম ভিগা ভিগা......এখনো পুরোন কথা মনে পড়লে সেই ডিগা ডিগা ডাক শুনতে পাই যেনদন্ডীরহাট ইস্কুলে আমি পড়েছিলাম দু বছরসেই দুটি বছর আমার কাছে ছিল অমূল্য এক সময়ইস্কুল আর নতুন বন্ধু, রক্তিম, কাশিনাথ, অজয়, কমলেশ, তপন, মতিয়ার আর গোলপুকুর রেল স্টেশনের মাস্টার বাবুর ছেলে নির্মল----আমরা হুড়িয়ে বড় হয়েছিদন্ডীরহাটের পশ্চিমে একটি বিলেন জমি, বিস্তৃত আর্দ্র ভূমি, তা পেরিয়ে যে গ্রাম তার নাম ধলতিথাধলতিথায় নাট্যকার অমৃতলাল বসুর জন্মআমি পথের পাঁচালিতে ধলতিথার নাম পেয়েছিপাঠ্য পুস্তক সাহিত্য চয়নে পথের পাঁচালির একটি পরিচ্ছেদ পাঠ্য ছিল, তার ভিতরে পড়ে বিস্ময়ে অভিভূতধলচিতের মাঠে আমরা ক্রিকেট ম্য্যাচ খেলতে গেছিহেরে ফিরেছি, কিন্তু আমি তো আগে কখনো অমন বিল জমি পার হই নিকী নতুন না লাগছিল সবরাতে কলকাতার জন্য মন খারাপ হয় সত্যি, কিন্তু দিনের আলো ফুটতে না ফুটতে সব মন খারাপ মুছে যায়একদিন চার বন্ধু মিলে গেলাম ইছামতী নদী দেখতেআমাদের গ্রাম পেরিয়ে, নলকোড়া গ্রাম পেরিয়ে ধান জমি, ইট ভাটার পাশ দিয়ে চলেছি তো চলেছিআমি তখনই গোপনে লিখতে শুরু করেছি কবিতা গল্পসে যাই হোক, বন্ধুদের ভিতর আমাকে সব চিনিয়ে দেওয়ার প্রবণতা ছিল অসীম  ইছামতীর ওই ওপারে পাকিস্তানআমায় দেখাচ্ছে কাশিনাথসীমান্ত রক্ষী বাহিনীর লঞ্চ ঘুরছে জলে ইন্ডিয়ার ফ্ল্যাগ লাগিয়েইছামতী তখন বেগবতী ছিলসেই যে সেই নদী দর্শন, নদীর ওপারে আমাদের সেই ধূলিহর আছে, যত ভাবি তত যেন ভার হয়ে যেতে থাকি মনে মনেওপার থেকেই আমার ছোটকাকা এলেন কদিন আগে সাইকেলে পার হয়েদুদিন থেকে ফিরেও গেছেন
দন্ডীরহাট গ্রামটি তখন খেলাধুলো আর থিয়েটারে সব সময় মেতে থাকতআমাদের চেয়ে বয়সে বড় তরুণদা ছিল পোস্টাপিসের ডাক পিয়নতার সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ( তখন প্রাক্তন, জমিদারি অধিগ্রহন আইন চালু হয়ে গেছে ১৯৫৫-৫৬-য়ে, মধ্যস্বত্ব হয়েছে বিলুপ্ত। ) বাড়ির বিপুল পুস্তক সংগ্রহের দায়িত্বেলাইব্রেরির গ্রন্থাগারিকতিনি গরমের ছুটির সময়টাতে দুপুরে আমাদের দিয়ে সুনির্মল বসুর কিপ্টে ঠাকুরদা নাটকের রিহারসাল আরম্ভ করলেন  মনে আছে বালকদের সেই গান, ঠাকুরদাদা কিপ্টে বেজায় জল গলে না হাত দিয়ে......নিজেরা মঞ্চ বেঁধে হ্যাজাক জ্বালিয়ে সেই নাটক দেখতে গ্রাম ভেঙে পড়েছিল আর আরম্ভেই ঠাকুরদা তরুণদার শাদা দাড়ি খুলে বৈশাখের বাতাসে উড়ে গিয়েছিলকিন্তু তাতে অভিনয় থেমে থাকে নিতরুণ বয়সের তরুণই ঠাকুরদা হয়ে উঠেছিল অভিনয় গুনে  বড় হয়েছি এইভাবে, দু বছর বাদে কলকাতা ফিরেছিলামআর তারপর থেকে আমার ছেলেবেলার সেই শান্ত কলকাতা অশান্ত হয়ে উঠতে লাগলখাদ্য আন্দোলননকশাল আন্দোলনের ভিতর আমি বড় হয়েছি ভয়ে ভয়েআতঙ্কের ভিতরকলেজজীবন, লিটল ম্যাগাজিন করা, করতে করতে চাকরি নিয়ে গ্রামে চলে যাওয়া, ভারতবর্ষকে দেখতে পাওয়া, জীবনের অন্য এক সঞ্চয়লেখার ভিতরে ডুবে থেকে কখন যে এই বয়সে পৌঁছে গেছি জানি নাকিন্তু এখনো জীবন যে আরো কিছু দেবে তা আমি জানিচার অধ্যায়, শৈশব কৈশোর যৌবন আর প্রবীনতা---এর বাইরে কত যে অধ্যায়, তার ঠিকানা নেই

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন