আমার কথা
অমর মিত্র
আমি ক্লাস ওয়ান-টু পড়ি
নি। কেন পড়ি নি
বলতে পারব না। আমাদের যাতায়াত ছিল কলকাতা দন্ডীরহাট আর পাকিস্তানের
ধূলিহরেও। তাই হয় তো পড়া হয় নি। প্রথম
আমাকে বাবা এক সন্ধ্যায় এনে দেন, হাসি খুশি, সুখলতা রাও। সেই
আমার প্রথম নিজের বই। একান্ত নিজের। সেই
বই আমাদের ফ্ল্যাটের ভিতর কোথায় লুকোব। আলমারির তলায়, না আলনার তলায়। আমার
তো নিজস্ব কোনো জায়গা নেই যে সেখানে আমার নিজের বই নিজের মতো করে রাখব। হা হা হা। এত বয়সেও তা আমার হয় নি। আমাদের সেই পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের পুরোন ফ্ল্যাটেই আমি থাকি। আমার নিজের ঘরখানিতে বই আর বই। সেলফ
ভর্তি হয়ে মাটিতে, খাটের
নিচে, কোথায়
না। যে বই যখন দরকার হয় খুঁজে পাই না। তবে আমার সহধর্মিণী শ্রীমতী মিতালি তা অনেক সময় খুঁজে বেরও
করে দেন। অনেক সময়ই হারানো বই আবার সংগ্রহ করতে হয়। চেয়ে নিয়ে কাজ মিটিয়ে ফেরত দিতে হয়। থাক
এখনকার কথা, তখনকার
কথা বলি। হাসিখুশি আমার প্রথম বই। আমাকে পড়াতে এলেন রাখাল স্যার। তিনি
বেলগাছিয়া বাজারের পিছনে বস্তিবাসি ছিলেন। শান্ত
প্রকৃতির। ইংরেজি পড়তে গিয়ে হোয়াট মানে ‘’কী’’ ? খুব মজা পেয়েছিলাম। তাঁর
কাছে আমার অক্ষরজ্ঞান হয় নাকি আগেই হয়েছিল তা মনে নেই। তবে
আমার বছর পাঁচে ধূলিহর গ্রামে হাতে খড়ি হয়েছিল তা স্পষ্ট মনে আছে। যাই হোক রাখাল স্যারের কাছে পড়ে এই এলাকার সবচেয়ে ভাল স্কুল
মনোহর একাডেমিতে আমি ভর্তি হই পরীক্ষা দিয়ে। আর স্কুলে
ভর্তি হয়েই আমি বন্ধু পেলাম। রাখাল স্যার আমাকে একবছর পড়িয়েছিলেন। তাঁর ভাই আলু বেচতেন বাজারে। এই তো
বহু বছর বাদে সেই শীতলদাকে জিজ্ঞেস করেছি, রাখালবাবু কেমন আছেন? খবর পেয়েছি, তিনি বেঁচে নেই। কলকাতার
স্কুলে থ্রি আর ফোর। বন্ধু ছিল কজন। তাদের
সঙ্গে টালা পার্কে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে বড় হতে লাগলাম। বাড়িতে
লোক বেশি, তাই
খেলার মাঠেই বেশির ভাগ সময়। পড়াশুনোয় সুবিধে হচ্ছিল না। থ্রি থেকে ফোরে কোনো রকমে। অঙ্কে
খুব কাঁচা। ফোর থেকে ফাইবেও দু’কুড়ি
পাঁচ। আমার মা বলতেন ওই কথা। এর মানে
কোনো রকমে পাশ। আমি অঙ্কে তাও পেতাম না। কেউ তো দেখাবার ছিল না। পেতাম
এক কুড়ি পাঁচ-দশ। ভাল লাগত কিশলয়, ভূগোল, ইতিহাস। গল্প থাকত তাতে। বাবা
বোধ হয় এক জন্মদিনে একটি বই এনে দিয়েছিলেন, দেব সাহিত্য কুটিরের বুক অফ নলেজ। সেই বই মাসখানেকের ভিতর শেষ। কী ভাল
যে ছিল সেই বই। কোন বইয়ে পড়েছিলাম মেরু অভিযাত্রীদের কাহিনি। ক্যাপ্টেন কুক, আমুন্ডসেনের কষ্টকর অভিযান। কলম্বাসের কাহিনি, ভাস্কো দ্য গামার কথা।
২
কোন একটা বছর আমাকে কলকাতার
ইস্কুল থেকে ছাড়িয়ে দন্ডীরহাট ইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল। মা গেল
সঙ্গে। কলকাতার বাসায় বাবা থাকলেন আর অনেকজন। আমার দুই দাদা থাকল কলকাতায়। মা আমি
আর আমার পরের বোন অপর্ণা চললাম ৭৯ সি বাসে চেপে দন্ডীরহাট। লাগত
পাকা তিন ঘন্টা। খুব ছোটবেলায় দেখেছি দন্ডীরহাটের পাশ দিয়ে মারটিন
কোম্পানির ছোট রেলগাড়ি চলতে। তা আমাদের
বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে সেই গাড়ি দেখেছি আমি। গাড়ি
বেলগাছিয়া থেকে ছেড়ে হাসনাবাদ অবধি যেত। সেই
গাড়ি তখন ঊঠে গেছে। নতুন শিয়ালদা হাসনাবাদ রেলগাড়ি চালু হয়েছে, কিন্তু তা অনেক দূর দিয়ে
ধানের মাঠের ভিতর দিয়ে যায়। সেই গাড়ি দন্ডীরহাটের লোকের খুব সুবিধে করে নি। এখন অবশ্য লোকজন সাইকেলে বসিরহাট গিয়ে ( আসলে স্টেশনের জায়গাটির
নাম ময়লাখোলা। শহরের সমস্ত ময়লা ওখানে ডাঁই করা হতো। যাকগে সেই কথা। ৭৯ নম্বর
বাস ও অন্য সব বাসের মালিকানা তখন ছিল শিখদের। তাদের
হাতেই ছিল কলকাতা ও মফস্বলের পরিবহন ব্যবস্থা। বাস
কন্ডাক্টর শিখ যুবক, বাসের গা পিটোতে পিটোতে----এই ডিগা ডিগা ডিগা বলতে বলতে চালককে
উৎসাহিত করত গতি বাড়াতে। কী মধুর ছিল তাদের মুখের সেই ডাক। পরে একটি গান বিখ্যাত হয়েছিল দমদম ডিগা ডিগা, মৌসম ভিগা ভিগা......। এখনো পুরোন কথা মনে পড়লে সেই ডিগা ডিগা ডাক শুনতে পাই যেন। দন্ডীরহাট ইস্কুলে আমি পড়েছিলাম দু বছর। সেই দুটি বছর আমার কাছে ছিল অমূল্য এক সময়। ইস্কুল আর নতুন বন্ধু, রক্তিম, কাশিনাথ, অজয়, কমলেশ, তপন, মতিয়ার আর গোলপুকুর রেল স্টেশনের মাস্টার বাবুর
ছেলে নির্মল----আমরা হুড়িয়ে বড় হয়েছি। দন্ডীরহাটের পশ্চিমে একটি বিলেন জমি, বিস্তৃত আর্দ্র ভূমি, তা পেরিয়ে যে গ্রাম তার
নাম ধলতিথা। ধলতিথায় নাট্যকার অমৃতলাল বসুর জন্ম। আমি পথের পাঁচালিতে ধলতিথার নাম পেয়েছি। পাঠ্য পুস্তক সাহিত্য চয়নে পথের পাঁচালির একটি পরিচ্ছেদ পাঠ্য
ছিল, তার
ভিতরে পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত। ধলচিতের মাঠে আমরা ক্রিকেট ম্য্যাচ খেলতে গেছি। হেরে ফিরেছি, কিন্তু আমি তো আগে কখনো অমন বিল জমি পার হই নি। কী নতুন না লাগছিল সব। রাতে
কলকাতার জন্য মন খারাপ হয় সত্যি, কিন্তু দিনের আলো ফুটতে না ফুটতে সব মন খারাপ মুছে যায়। একদিন চার বন্ধু মিলে গেলাম ইছামতী নদী দেখতে। আমাদের গ্রাম পেরিয়ে, নলকোড়া গ্রাম পেরিয়ে ধান জমি, ইট ভাটার পাশ দিয়ে চলেছি
তো চলেছি। আমি তখনই গোপনে লিখতে শুরু করেছি কবিতা গল্প। সে যাই হোক, বন্ধুদের ভিতর আমাকে সব চিনিয়ে দেওয়ার প্রবণতা
ছিল অসীম। ইছামতীর ওই ওপারে পাকিস্তান। আমায়
দেখাচ্ছে কাশিনাথ। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর লঞ্চ ঘুরছে জলে ইন্ডিয়ার
ফ্ল্যাগ লাগিয়ে। ইছামতী তখন বেগবতী ছিল। সেই
যে সেই নদী দর্শন, নদীর
ওপারে আমাদের সেই ধূলিহর আছে, যত ভাবি তত যেন ভার হয়ে যেতে থাকি মনে মনে। ওপার থেকেই আমার ছোটকাকা এলেন কদিন আগে সাইকেলে পার হয়ে। দুদিন থেকে ফিরেও গেছেন।
দন্ডীরহাট গ্রামটি তখন
খেলাধুলো আর থিয়েটারে সব সময় মেতে থাকত। আমাদের
চেয়ে বয়সে বড় তরুণদা ছিল পোস্টাপিসের ডাক পিয়ন। তার
সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ( তখন প্রাক্তন, জমিদারি অধিগ্রহন আইন চালু হয়ে গেছে ১৯৫৫-৫৬-য়ে, মধ্যস্বত্ব হয়েছে বিলুপ্ত। ) বাড়ির বিপুল পুস্তক সংগ্রহের দায়িত্বে। লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক। তিনি
গরমের ছুটির সময়টাতে দুপুরে আমাদের দিয়ে সুনির্মল বসুর কিপ্টে ঠাকুরদা নাটকের রিহারসাল
আরম্ভ করলেন। মনে আছে বালকদের সেই গান, ঠাকুরদাদা কিপ্টে বেজায় জল গলে না হাত দিয়ে......। নিজেরা মঞ্চ বেঁধে হ্যাজাক জ্বালিয়ে সেই নাটক দেখতে গ্রাম
ভেঙে পড়েছিল আর আরম্ভেই ঠাকুরদা তরুণদার শাদা দাড়ি খুলে বৈশাখের বাতাসে উড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে অভিনয় থেমে থাকে নি। তরুণ
বয়সের তরুণই ঠাকুরদা হয়ে উঠেছিল অভিনয় গুনে। বড় হয়েছি এইভাবে, দু বছর বাদে কলকাতা ফিরেছিলাম। আর তারপর থেকে আমার ছেলেবেলার সেই শান্ত কলকাতা অশান্ত হয়ে
উঠতে লাগল। খাদ্য আন্দোলন। নকশাল
আন্দোলনের ভিতর আমি বড় হয়েছি ভয়ে ভয়ে। আতঙ্কের ভিতর। কলেজজীবন, লিটল ম্যাগাজিন করা, করতে করতে চাকরি নিয়ে গ্রামে
চলে যাওয়া, ভারতবর্ষকে
দেখতে পাওয়া, জীবনের
অন্য এক সঞ্চয়। লেখার ভিতরে ডুবে থেকে কখন যে এই বয়সে পৌঁছে
গেছি জানি না। কিন্তু এখনো জীবন যে আরো কিছু দেবে তা আমি জানি। চার অধ্যায়, শৈশব কৈশোর যৌবন আর প্রবীনতা---এর বাইরে কত যে
অধ্যায়, তার
ঠিকানা নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন