একজন কবি যখন গদ্য লেখেন তখনও কি তিনি কবি থাকেন? আমার মনে হয়, থাকেন না, কারণ তখন তো তিনি গদ্যকার। গদ্য লেখার জন্যে যে চিন্তাভাবনা বা অনুশীলন দরকার, কবিতার বেলায় সেটা দরকার নাও হতে পারে। অনেকেই বিনা অনুশীলন বা সে রকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই এক্সটেম্পর কবিতা লেখা শুরু করে দেন। যার কাছে যেটা অনায়াস মনে হয়, তিনি সেভাবেই লেখেন। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করেন।
একটা গদ্য লিখতে গেলে সেটা হয় না। গদ্য লেখার প্রস্তুতিটা অন্য রকম। একজন কবি কবিতা লেখাতে যতটা স্বচ্ছন্দ, গদ্য লেখাতে ততটা দড় নাও হতে পারেন। তবু কবিদেরও গদ্য লিখতে হয় বেতনের বিনিময়ে ক্লাসে লেকচার দেবার জন্যে নয়, নেহাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে। তবে গদ্য লেখার সময়ে কবি যদি কবি হয়েই থাকেন, তাতেই বা অসুবিধে কী?
একটা গদ্য লেখার জন্যে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করতে হয়, পড়াশোনা করতে হয়, কিছু কিছু তত্ত্ব ও তথ্যের খোঁজ খবর রাখতে হয়। পরিশ্রম করতে হয়। আবার শুধুই তত্ত্ব ও তথ্যের কচকচানি থাকলে সেখানে একটা একঘেয়েমি চলে আসে, ক্লিশে লেখা পড়তে পড়তে পাঠক বিরক্ত হন। লেখা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন। সুতরাং গদ্যের ভিতর কিছু নতুন এবং নিজস্ব চিন্তাভাবনা ও উপলব্ধির প্রকাশ ঘটানো যেমন দরকার, তেমনই পাঠককে নিজের ভাবনার অংশীদার করাটাও জরুরি। জানি না, বর্তমান গদ্যে এই অর্বাচীনের পক্ষে সেটা কতটা সম্ভব হবে। তার মাথা তো শুধুই বদবুদ্ধির আখড়া। তবু নিজের সেই নষ্ট বুদ্ধি দিয়ে নিজের মতো করে কিছু লেখার চেষ্টা তো করা যাক, জানি না, তা পাঠকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে।
লেখালিখির ব্যাপারে অনেকেই বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার কথা বলেন। পবিত্রতা একটা শাস্ত্রীয় ব্যাপার, সেই পরিপেক্ষিতে এই খচ্চরের মতো একজন শাস্ত্রবিরোধী ছোটোলোকের কলমে সাহিত্যের বিশুদ্ধরস আশা না করাই ভালো। তবে কথা দিচ্ছি, এই লেখাতে প্রচুর অপবিত্রতার ছোঁয়া থাকবে, কালিঝুলি থাকবে, বালি-কাঁকড়ের জোগান থাকবে। কিছু ঢ্যামনামি থাকবে। তাতে কিছু মনে করবেন না প্লিজ, ধরে নিন সেটা পাঠকের ধৈর্য এবং দাঁতের জোর পরীক্ষা করার জন্যে।
আরও একটা কথা জানিয়ে দিই, এই একুশ শতকের বহুমাত্রিক ও বহুদিশাময় সময়ে এসে, চারপাশে ছড়ানো এত বহু-বিচিত্র দ্বন্দ্বমূলক-ধান্দাবাজি এবং যুদ্ববাজ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের সশস্ত্র উলঙ্গ নৃত্যের মাঝে এখনও যাঁরা শুদ্ধতা ও পবিত্রতার কথা বলছেন, আমার মনে হয়, তাঁরা আসলে বাংলা-কবিতাকে একটা বদ্ধ-জলার মধ্যে আটকে রাখতে চাইছেন। অথবা ভদ্রলোকেদের নরকে ঠেলে দিতে চাইছেন। আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা চরম রক্ষণশীল ও গোঁড়া। কবিতা তো কবিতাই হবে তার আবার শুদ্ধ-অশুদ্ধ বাছবিচার কেন। ও-সব তো টিকি-দোলানো পণ্ডিতদের ব্যাপার।
লেখাটা কিছু ট্যারা-ব্যাঁকা ইথাবার্তা দিয়ে শুরু করলাম বটে, কিন্তু লিখতে বসে মনে হচ্ছে, এমন একটা সময়ে এই গদ্য লেখা শুরু করলাম যখন মানুষকে ভাবতে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ অতি নীরবে এবং খুব পরিকল্পিতভাবে মানুষের চিন্তা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সৃজনশীল কল্পনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, সুস্থ স্বপ্ন দেখার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
হ্যাঁ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
কে কেড়ে নিচ্ছে?
ভেবে দেখুন, চারপাশে এখন কীসের দাপট। দেখুন, বহুজাতিক পুঁজি লালিত কর্পোরেট সংস্কৃতির কী রমরমা। যেন ভোগ এবং উপভোগের মোচ্ছব চলছে। উৎসব-খেলা-মেলা-সংবাদ থেকে শুরু করে অহরহ গান-বাজনা-রিয়েলিটি শোা-সিনেমা-সিরিয়াল-ওটিটি- ডিজে কালচার এই রকম হাজার কিসিমের উন্মাদ বিনোদনের জালে মানুষের চিন্তাশক্তিকে পাকে পাকে বেঁধে ফেলে তাকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। নানাভাবে যুবসমাজের মগজ নামক অস্ত্রটিকে ভোঁতা করে দেওয়া হচ্ছে। মানুষকে ভাসিয়ে দিতে চাইছে নির্বোধ আমোদের স্রোতে।
উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে বৃটিশের মুৎসুদ্দি এবং সেই সঙ্গে “দি গ্রেট বেঙ্গল অপেরা” থিয়েটার দলের মালিক বীরকৃষ্ণ দাঁ-র সেই বিখ্যাত সংলাপটার কথা মনে পড়ছে- “দুহাতে দশটা হিরের আঙটি। যে কোনও একটা দিয়ে সাহিত্য-ফাহিত্য কিনে রাখতে পারি।” এই ধরনের স্বার্থপর, অর্থলোভী এবং ক্ষমতালোভী মানুষেরা কোনওদিনই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন, বরং তারা শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য সবকিছুকে নিজের স্বার্থ হাসিলের একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। সত্যিই আজকের মুৎসুদ্দি তথা বানিয়া সমাজ এবং সরকারের পক্ষ থেকে দু-একটা পদ-পদক অথবা কবিতা-পাঠের মঞ্চে ডাক পাবার সামান্য একটা আমন্ত্রণের বিনিময়ে বাঙালি কবিদের বোধ-বুদ্ধি সব কিনে নেওয়া হচ্ছে। তাদের আনুগত্য কিনে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে ভয়-ভীতি-আতঙ্কের একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, মুখ খুললেই পুলিশ-কেস, হয়রানি, নানা রকম নিগ্রহ। একুশ শতকে এসেও এই সব মধ্যযুগীয় কৌশল দিয়েই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে সমূলে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্তাবাবুরা মনে করেন সিস্টেমের বিরোধী কিছু বলা মানেই অরাজকতা তৈরির চেষ্টা। তারা এটাও প্রচার করে থাকেন এ-সব আদতে দেশবিরোধিতারই নামান্তর।
এইসব ক্ষমতালোভীরা স্বীকার করেন না গণতন্ত্রে বিরোধী কণ্ঠস্বরের ভূমিকা গুরুত্ব অপরিসীম।
এখন তো আবার প্রযুক্তিবিদেরা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করে ফেলেছে। ভাবনার জন্য আর মানুষের দরকার হবে না, প্রযুক্তিই তা করে দেবে। কত যে চাকরি-বাকরি নাই হয়ে যাবে, দিকে দিকে সেই আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে। মানুষ বড়ো অসহায়। সে প্রলোভিত হচ্ছে। প্রতারিত হচ্ছে। না হয়ে উপায় নেই। সে বুঝতে পারছে না, তার সহজাত ও স্বাভাবিক বুদ্ধি, দিয়ে তার সমস্যা ও সংকট এবং চারপাশে ঘটে চলা এত অন্যায়-অবিচার নিয়ে তাকে চিন্তা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
মধ্যযুগের ইউরোপের কথা মনে পড়ছে, তখন রাজা আর চার্চ বুঝিয়েছিল জনগণের হয়ে তারাই সব চিন্তা-ভাবনা করে দেবে, মানুষকে চিন্তা করার দরকার নেই। সেই অচলায়তনের বিরুদ্ধেই তো আলোক-প্রাপ্তির তত্ত্বের উদ্ভব। সেই সময়ের বুদ্ধি-বিপ্লবের শুরু।
আজ সেই এনলাইটেনমেন্ট-তত্ত্বের গায়ে পুরু মরচে। মানুষের লোভ-লালসা-ক্ষমতা ও আধিপত্যের বাসনা মানুষের সমস্ত শুভবুদ্ধিকে ধ্বংস করে মানব-সভ্যতাকে এক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এআই যদি সব করে দেবে তাহলে আগামী দিনের মানুষ কি কলের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকবে? এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের সামনে প্রকট হয়ে উঠছে আর এক অস্তিত্বের সংকট।
এ-সবের পাশাপাশি আছে ভাষা-সন্ত্রাস। বাংলা-ভাষার শব্দ-ভাণ্ডারে এমনিতেই তৎসম শব্দের বাহুল্য। তার উপর যাঁরা কবিতায় বিশুদ্ধ রসের সন্ধান করেন তাঁরা কবিতাকে ভাবগম্ভীর করার জন্যে বেশি করে সাধু-ভাষার শব্দ ব্যবহার করেন। হাতের কাছে বিকল্প তদ্ভব বা দেশি শব্দ থাকলেও তাঁরা এটা করে থাকেন, তাঁরা মনে করেন তা না করলে কবিতার জাত নষ্ট হবে। আবার যাঁরা ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠছেন তাঁরা নিজেদের লেখায় আরবি ও ফারসি-শব্দের ব্যবহার বাড়িয়ে বাংলা ভাষাকে ইসলামি বাংলা করে তুলতে চাইছেন। নতুন প্রজন্মের কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার বেশি। তাঁদের লেখালিখিতেও তার প্রতিফলন ঘটছে। তার সঙ্গে আছে হিন্দি-সাম্রাজ্যবাদের দাপট। সিনেমা-সিরিয়াল সব জায়গাতেই হিন্দি-ভাষার আধিপত্য। যাঁরা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান তত্ত্বের প্রবক্তা তাঁরা তাঁদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছন উত্তর-ভারত তথা আর্যাবর্তের সাংস্কৃতিক মানসিকতাকে বাঙালির উপর চাপিয়ে দিতে। বাঙালিকে নিরিমাশাষী বানাতে।
এক্ষেত্রে কবিদের নিজের নিজের অবস্থান খুব স্পষ্ট করতে হবে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ভাষা-স্রোতে যে-সব বিদেশি শব্দ অবায়াসে বাংলা শব্দভাণ্ডারে মিশে গেছে, তাদের নিয়েকোনও প্রশ্ন নেই, কিন্তুযা অনায়াস নয়, জোর করে কিছু চাপানোর চেষ্টা হলে তাকে প্রতিহত করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে যাতে বেশি করে দেশি শব্দের ব্যবহার বাড়ানো যায়। সুতরাং আরও একটা বুদ্ধি-বিপ্লব যে অবশ্যম্ভাবী সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
এই রে, আবার ক-টা ক্লিশে শব্দ উচ্চারন করে ফেললাম, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিপ্লব। আবারও অনেকেই প্রশ্ন করবেন, আজকের দিনে এইসব প্রতিবাদ প্রতিরোধ বা বিপ্লবের কথা বলে কী হবে? পুঁজিপতিরা কবিতা পড়ে না এবং মেট্রোপলিটন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মার্জিত রুচির পাঠক যারা তারাও তো বেশিরভাগই ভোক্তা হয়ে গেছে। তারা নিজের নিজের কমফোর্ট জোন আগলে খেলা চালিয়ে যেতে পছন্দ করে। তাদের মনোভাব, এই তো বেশ চলছে, খাও দাও মজা করো। ব্যাস, সারাটা জীবন নাহয় ক্ষমতা ও আধিপত্যবাদের দাসত্ব করেইে কাটিয়ে দাও।
সঝখ থাকলে সাহিত্য-চর্চাও করতে পার, তবে তার জন্যে ওই যে সব বাজারি বাণিজ্যিক পত্রিকা আছে, বিগ-হাউজ আছে। ওরাই তো এখন বাংলা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির হর্তাকর্তাবিধাতা। ওরা যা পরিবেশন করছে সেটা খুব উপাদেয়। তাই নিয়েই তূষ্ট থাকো। ওদের মতে মত দিয়ে এবং ওদের দেখানো পথে কিছু সৎ ও মহৎ লেখালিখিও করতে পারো। তোমার মধ্যে মশলা আছে টের পেলে ওরাই তোমাকে মহর্ষি বানিয়ে দেবে। তার বেশি কিছু ভাবতে বা করতে যেয়ো না।
এই রকম করতে পারলে তো ভালোই হত। কিন্তু এই যে খেপচুরিয়াসের মতো কিছু পাগল ছেলেমেয়ে আছে। তারা জেদ ধরে বসে আছে, তারা অন্যকিছু ভাববে। অন্যকিছু করবে। তাই এই পশ্চিমে হেলে পরা বয়সেও কলম ধরতে হচ্ছে।
কলম ধরেই যে প্রশ্নটা ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করছে, সেটা হল, ওই যে বাঙালি গায়ে আত্মঘাতী বা আত্মবিস্মৃত এই সব তকমা সেঁটে দেওয়া হয়, সেটা কতটা গ্রহণযোগ্য। এক এক সময় মনে হয়, এটা একশোভাগ সত্যি। বাঙালি সাহিত্যের পাতায় প্রতিবাদ তুলে আনতে ভুলে যাচ্ছে, বড্ড বেশি সৎ ও বিশুদ্ধ কবিতার পিছনে ছূটছে। তারা বুঝতে পারছে না একটা প্রতিবাদকে হত্যা করা মানে নিজেকেও হত্যা করা। নিজের ‘বিবেক’ নামক বস্তুটিকে খুন করা। (অবশ্য যদি বিবেক বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে)।
আবার এক এক সময় মনে হয়, বিবেকের দায় নেই বলে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে যতই গালাগালি করি না কেন, বাঙালির মন থেকে বিবেক নামক বস্তুটি যে একেবারে উবে গেছে সে-কথা বলাটাও আহম্মকের কাজ। সাম্প্রতিক সময়েই তো শাসকের রক্তচক্ষুকে কাঁচকলা দেখিয়ে নানা অন্যায় ও অত্যাচােরর বিরুদ্ধে বহু মানুষ পথে নেমেছিল। প্রতিবাদ করেছিল। ফলাফল যাই হোক, একটা ব্যাপার পরিষ্কার বাঙালি নিজের সত্তাকে এখনও পুরোপুরি ভুলে যায়নি। সেই ঘাড়-ব্যাঁকা ভাবটা তার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে। সেভাবে একটা জোরদার খোঁচা খেলে সে জেগে উঠতে জানে। তখন অবশ্য প্রতিক্রিয়াশীল শিবির দশগুণ উৎসাহ নিয়ে সেই প্রতিবাদকে নিকেশ করতে নেমে পড়ে।
একটু আগে বুদ্ধি-বিপ্লবের কথা লিখেছিলাম। বিশ শতকের কবিতায় চৈতন্যের জাগরণটা কেমন ছিল? বুদ্ধি-বিপ্লব মানে চৈতন্যের জাগরণ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে…”। আবার রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক কবি বিষ্ণু দে লিখলেন- “চৈতন্যে মড়ক।” মড়কই বটে, সেই সময়কালের ছবিটা কেমন ছিল ভাবুন, যুদ্ধ, মন্বন্তর, মহামারী। গ্রাম থেকে দলে দলে কলকাতায় ভিড় করা বুভুক্ষু মানুষের ‘ফ্যান দাও’, ‘ফ্যান দাও’ চিৎকারে মহানগরীর আকাশ বাতাস মুখরিত। দলে দলে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেল। কত মানুষ। তিরি- চল্লিশ লাখ। হিরোসিমা-নাগাসাকিতে মারা গেছিল দেড় থেকে দু-লাখ মানুষ, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ মারা গেল দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার গ্রামগুলোতে। বাজারে চাল-ডালের অভাব ছিল না। সব খাবার-দাবার চলে যাচ্ছিল সৈন্যদের রসদ জোগাতে। বিদেশি শাসকদের তৈরি করা দুর্ভিক্ষ। তারপর ডাইরেক্ট অ্যাকশন-ডে, দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু-স্রোত। ভারবর্ষের স্বাধীনতা দিবসে বাঙালির কাছে হয়ে উঠল শোক-দিবস। ইউরোপীয় চেতনায় দীক্ষিত বিষ্ণু দে কেনই বা লিখবেন না ‘চৈতন্যে মড়ক’। তারই আগে-পরে আধুনিক কবিরা দেশ-কালের বাস্তবতাকে ছুঁতেই চাইলেন না। তাতে নাকি সাহিত্য আর সৎ থাকবে না। তার মহত্ব নষ্ট হবে। বুদ্ধদেব-বসু রিপুর তাড়নায় জর্জরিত নিজের ব্যক্তিসত্তায় বন্দি হয়ে বলেই ফেললেন- ‘রমণী-রমণ-রণে পরাজয় ভিক্ষা মাগি নিতি’। জীবনানন্দ লিখলেন, “ হাইড্র্যাণ্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল; / অথবা সে-হাইড্র্যাণ্ট হয়তো বা গিয়েছিলো ফেঁসে / এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে। / একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে।” সুধীন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন – “তোমার নিবিদে বাজাব না ঝুমঝুমি...”, আর সমর সেন লিখলেন –“ হে শহর হে ধুসর শহর ! কালীঘাট ব্রিজের উপরে কখনও কি শুনতে পাও লম্পটের পদধ্বনি”। অবশ্য অমিয় চক্রবর্তী একটা আধ্যাত্মিক ভাব এনে জানালেন- “মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর/ পোড়ো বাড়িটার/ ওই ভাঙা দরজাটা ।/ মেলাবেন ।” তার বিপরীত ছবিটাও দেখুন, স্ব্যং রবীন্দ্রনাথ লিখলেন “বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও...”, নজরুল লিখেছিলেন ‘ বাঁচতে বাঁচতে প্রায় মরিয়াছি এবার সব্যসাচী / যা হোক একটা দাও কিছু হাতে / একবার মরে বাঁচি”। সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখলেন – “হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো”, সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখলেন – “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য / ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, / চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য / কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া। / চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ, / গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে, / তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য/ জীবনকে চায় ভালবাসতে।”
বেশ কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়ে গেল। পঙ্ক্তিগুলো অনেকেরই মুখস্থ ও বহুচর্চিৎ। তবু তাদের আর একবার স্মরণ করলাম এবং জায়গায় আনলাম, অন্য কিছু নয়, এই-সব কথার মধ্যে দিয়েই আংশিকভাবে তুলে ধরতে চাইলাম একটা নির্দিষ্ট সময়কালে বাঙালি কবিদের অস্তিত্ব-সংবাদ। একটা সংকটময় সময়ে তাঁদের চৈতন্যের জাগরণ। তাঁদের জীবন-দর্শন।
আমি শুধু মানুষের নিজস্ব চিন্তাকে পিষে ফেলার জন্যে তৈরি করা একটা সিস্টেমের বিকাশকে তুলে ধরলাম। ব্যক্তিগতভাবে কারও কোনও কোনও বিরোধিতা বা সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা বলা যায় কবিদের শিবির ভাগ ছিল, কবিদের কবিতা-দর্শনে ফারাক ছিল, নানা কবির দৃষ্টিভঙ্গিও অভিন্ন ছিল না।
এক পক্ষ, যাঁরা কলাকৈবল্যবাদী, তাঁরা বিশ্বাস করতেন “শুধু শিল্পের জন্যই শিল্প, তাঁদের হুঁশিয়ারি শিল্পের উপর যেন দেশ-কালের ছায়া না পড়ে।। সমসাময়িক কোলাহল থেকে দূরে না থাকলে কোনও শিল্পই কালোত্তীর্ন হবে না। শিল্পে চিরায়ত বা শাশ্বত উচ্চারণই প্রধান। কোনওকালেই তার মহিমা ম্লান হয় না। অন্যদিকে যাঁরা প্রতিবাদের পক্ষে তাঁদের বক্তব্য, শিল্পকে মহৎ এবং চিরায়ত হতেই হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি নেই। মহৎ বলে যদি কিছু থেকেও থাকেও তাহলে যে কোনও মানবিক সংকট থেকে উঠে আসা শিল্পও সব যুগে সব কালে সত্য। এই যুক্তিতে বিচার করলে তারাও শাশ্বত ও চিরন্তন। এই বিরোধের আজও মীমাংসা হয়নি। শিবিরভাগও রয়ে গেছে।
এই বিরোধের কোনও মীমাংসা হয় না। আসলে কলাকৈবল্যবাদীরা বরাবরই, যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তাঁদের পক্ষে। তাঁরাই আবার ইতিহাস লেখেন। বিজিতদের অবদমিত করে বিজয়ীদের ইতিহাস। যে কোনও মূল্যেই তাঁরা বিরোধী ও বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করতে তৎপর। তাকে দাবিয়ে রাখতে উদ্যোগী। নিজেদের স্বার্থেই একটা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধি-ব্যবস্থার সপক্ষে নানা শাসন-অনুশাসন জারি করে আধিপত্যবাদের অনুকূলে একটা ন্যারেটিভ তৈরি করে বাকিদের উপর তা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায়। নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’ কবি বলে তাঁর প্রতিভাকে অসম্মান করতে চায়, সুকান্তের গায়ে ‘কিশোর কবি’-র তকমা এঁটে তাঁর গুরুত্বকে খাটো করতে চায়। অথচ কী মজার ঘটনা দেখুন, আপনি শহর কলকাতার ফুটপাতের যে-সব দোকানে না ছবি ও পোস্ট বিক্রি হয়, সেখানে খোঁজ নিলে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও নজরুল ও সুকান্তর ছবি পেয়ে যেতে পারেন কিন্তু অন্যান্য প্রথইতযশা কবিদের টিকিটিও খুঁজে পারেন না। এর দ্বারা অন্তর এটা বোঝা যায় কারা মহাকালের শাসন অতিক্রম করে জনগণের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্তাবাবুরা অবশ্য জানিয়ে দিতে ভুলবেন না, এতে কিছুই প্রমাণ হয় না। ও-সব উঁচু দরের কাব্যরস সকলের জন্য নয়। সকলেই উচ্চাঙ্গ-সংগীতের সমঝদার হতে পারে না। তার জন্যে উপযুক্ত শিক্ষা ও দীক্ষা দরকার। অর্থাৎ এখানেও সেই ‘ক্লাস’ এবং ‘মাস’-এর বিভাজন।
এই ‘ক্লাস’-কে খুঁজতে গেলে আপনাকে পৌঁছে যেতে হবে কলেজ-ইউনিভার্সিটীর সিলেবাস নামক জাদুঘরে, যেখানে সেই সব কবিদের লেখালিখি সযত্নে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের কোমলপ্রান মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করার জন্য। সে-সব না গিললে, রাতের পর রাত জেগে স্যারের দেওয়া নোট মুখস্থ না করলে পরীক্ষা নামক বৈতরণীটা পার হওয়া যাবে না, ডিগ্রির সার্টিফিকেটও মিলবে না। সুতরাং এভাবেই চলবে সিলেবাসকেন্দ্রিক আকাদেমির আগ্রাসন, কবিতার সঙ্গে জীবনের দূরত্ব আরও বাড়বে।
অথচ একটু লক্ষ করলে বোঝা যাবে ‘ক্লাস’ এবং ‘মাস’ এসব ভদ্রলোকেদের তৈরি করা বিভাজনরেখা। একটা সাংস্কৃতিক হায়ারার্কি বজায় রাখার জন্যে। একটা বায়োনারি তৈরি করার জন্যে। তার মাধ্যমে এটাই বোঝাতে চাওয়া যে দেখো আমরা ‘ক্লাস’ মানে আমরা ভালো ও উঁচুদরের মানুষ আর তোমরা ‘মাস’ মানে তোমরা মন্দ ও নীচু দরের জীব। এটা ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসিরই গর্ভজাত। এই ধরনের বিভাজন যাঁরা তৈরি করেছিলেন তাঁরা বাঙালির সঠিক চরিত্র বুঝতে চাননি বা পারেননি। ঔপনিবেশিক চিন্তায় সম্পৃক্ত হয়ে শুধু নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চেয়েছিলেন।
বাঙালির সত্তাকে সঠিক বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালি রুচি অনুযায়ী নিজের গানগুলিকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করেছিলেন। প্রেম পূজা প্রকৃতি এবং দেশাত্মবোধক। বাঙালি প্রেম ভালোবাসে, প্রকৃতি ভালোবাসে, পূজা ভালোবাসে এবং ভালোবাসে বিদ্রোহ। তার সঙ্গে আরও একটা যোগ করা যায়, হাসি ও রঙ্গরস।
পূজা মানেই ভক্তি, এই ভক্তি ও প্রেমকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণব পদাবলি। পদাবলি সাহিত্য বাঙালির রোম্যান্টিক হবার প্রবণতাকে এত বাড়িয়ে দিয়েছে, সেই রোম্যান্টিকতা থেকে বাঙালি আজও বেরোতে পারেনি। আবার দেখুন বাঙালির ভক্তি ও বিশ্বাসকে মূলধন করে উঠে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কোথাকার এক অখ্যাত গাঁয়ের প্রায় নিরক্ষর এক বামুন নিজের সহজ সরল বিশ্বাসা এবং অকপট আধ্যাত্মিক উপলব্ধি দিয়ে ব্রাহ্ম-অধ্যষিত কলকাতার নাগরিক সমাজকে শুধু তাক লাগিয়ে দেননি, তাদের বশ করে ফেলেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ সেই বিশ্বাস ও ভক্তির সঙ্গে যোগ করলেন বৈদান্তিক জ্ঞান জীবপ্রেম এবং লোকসেবা। তাই দিয়ে তিনি বিশ্বজয় করলেন। তারপর রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কথা আগেই বলেছি। এরপর নজরুল। তাঁর কবিতা ও গানে বিশেষ জায়গা করে নিল বিদ্রোহ। তার সঙ্গে ভক্তি ও প্রেমও রইল। তারপর সুকান্ত, তাঁর কবিতায় শুধুই বিদ্রোহের কথা।
এখনও গ্রাম-মফসলের বিভিন্ন ক্লাব বা সাংস্কৃতিক সংগঠন যাঁদের জন্মদিন পালন করে তাঁরা হলেন রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত। উন্নাসিকেরা বলেন ব্যঙ্গ করে বলেন রসুন। কিন্তু তাঁরা যতই উপেক্ষা করতে চান তাতে করে কিন্তু বাঙালির এই ভালোবাসাকে নস্যাৎ করা যায় না।
ক্ষুদিরাম থেকে নেতাজি এইসব দেশপ্রেমিকদের পাশাপাশি বাঙালি আরও দুজন মনীষীর জন্মদিন বিশেষভাবে পালন করে থাকে তাঁরা হলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। বাঙালি-সত্তা বিকাশের সেই পর্বে তাঁদের মধ্যে আবার ভক্তি-প্রেম এ-সব সুপ্ত থাকলেও প্রকট হয়ে উঠেছিল বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞান। এবং ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারের প্রতি তীব্র আগ্রহ। এই আগ্রহ তাঁদের মনের বিদ্রোহী-সত্তারই বহিঃপ্রকাশ। সেই সব কাজের জন্য তাঁদের ভিতরে ও বাইরে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ তো রামমোহনকে ভারতপথিক আখ্যা দিলেন আর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেই ফেললেন- ‘“বাঙালি গড়তে গড়তে, বিধাতা যে কী করে একটা ঈশ্বরচন্দ্র বানিয়ে ফেললেন, সেটা অতীব আশ্চর্যের”।
এই বিশ্লেষণ থেকে একটা দেখা গেল রামমোহন থেকে সুকান্ত একটা ব্যাপার খুব কমন, সেটা হল তাঁদের বিদ্রোহঈ-সত্তা। এখানে আরও উল্লেখ করা যায়, এই বিদ্রোহের সঙ্গে রোম্যান্টিকতা মিশে গিয়ে তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিযুগ। তারও পরে স্বাধীন ভারতের সেই নকশাল পিরিয়ড। কেরিয়ারের তোয়াক্কা না করে সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে একটা গোটা প্রজন্মের উজ্জ্বল মুখেদের সশস্ত্র-বিপ্লবে জড়িয়ে পড়। বাড়িঘর ছেড়ে সুখস্বাচ্ছন্দ ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়ে এক নতুন দেশ গড়ারর লক্ষ্যে আত্নত্যাগের দীক্ষা নেওয়া। যতই ভুল হোক সেই পথ, শাসক শ্রেণির বুক কেঁপে উঠেছিল, হাজার-হাজার সাধারণ মানুষ তাদের সমর্থন করেছিল।
এবার পিছন ফিরে বাঙালি-সত্তা গড়ে ওঠার একেবারে সৃষ্টি-লগ্নের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যাবে চর্যাপদ লেখার দিনগুলোতে একটা সোচ্চার সামজিক বিপ্লব প্রকট হয়েছিল। প্রথমত সাহিত্য-রচনার প্রচলিত ভাষাকে নাকচ করে একটা জায়মান ভাষাকে সাহিত্যের পাতায় তুলে আনা হল, সেই সঙ্গে ধর্ম সম্পর্কে সমস্ত প্রচলিত মেটা-ন্যারেটিভকেও ভেঙে ফেলা লহ, ব্রাহ্মণ্যবাদের ফেটিশগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হল; দ্বিতীয়ত, ব্রাহ্মণ-গুরুর সঙ্গে চণ্ডালির মিলন ঘটিয়ে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ এই সামাজিক হায়ারার্কির ভিত্তিমূলেও তুমুল আঘাত করেছিল, বৈধী-প্রেমের ধারণাকেও নস্যাৎ করা হল। তৃতীয়ত, উপরমহলে প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যধর্মকে বাতিল করে সিদ্ধাই-যোগীরা সহজিয়া বৌদ্ধধর্মে প্রচার করলেন। চতুর্থত, নিজেদের সাধন-পদ্ধতিকে গোপন করার জন্যে চর্যাপদকর্তাদের রচিত পদের মধ্যে প্রচুর চিহ্ন-প্রতীক-চিত্রকল্প ব্যবহার করা হল যা শুধু ভারতীয় সাহিত্য কেন, বিশ্বসাহিত্যেও তার আগে দেখা যায়নি। অনেক পরে আধুনিক সময়ের শুরুতে ফরাসি কবিতায় চিহ্ন-প্রতীকের প্রচুর ব্যবহার দেখা গেল। প্রতীকবাদী আন্দোলন হল, বাঙালির আধুনিক কবিরা প্রতীকের ব্যবহার বুঝতে ইউরোপীয় কবিদের দ্বারস্থ হলেন। কিন্তু কেন, কারণ তাঁরা বাঙালির নিজস্ব-প্রতীককে উপেক্ষা করেছিলেন।
চর্যাপদের পরে বৈষ্ণব-পদাবলি, সেখানেও স্বকীয়া ছেড়ে পরকীয়া প্রেমের জয়জয়াকার। অর্থাৎ প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে আর এক বিদ্রোহ। মনে রাখতে হবে বিবাহ একটা প্রতিষ্ঠান কিন্তু বিবাহ-বিহির্ভূত প্রেম প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ তো আমার দেখানো হল বিয়ের আগেই কুমারী রাজকন্যার গর্ভবতী হবার ঘটনা।
তার সঙ্গে শিবকে গেঁয়ো ভিখিরি বানানো বা শিবকে লিঙ্গরূপে উপাসনা করা, মা-কালীর উলঙ্গ মূর্তির পূজা করা, এ-সবকিছুই বাঙালির বিপ্লবী-চেতনার নমুনা।
সবচেয়ে আশ্চর্য প্রতীক দশমহাবিদ্যার ছিন্নমস্তা রূপ। এ-কথাটা নিশ্চিত করে বলা যায় পুরুষতান্ত্রিক-সমাজের তৈরি করা বিষ্ণুর দশাবতারের তত্ত্বকে কাউন্টার করে মাতৃতান্ত্রিক-সমাজ দেবীর দশমহাবিদ্যার রূপকে সামনে এনেছিল। এটা যে পুরোপুরি বাঙালি মনন-জাত তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।
আহা কী ভয়ানক-সুন্দর সে সে রূপ। দেবীর বাঁ-হাতে নিজেরই কাঁটা মুণ্ড, ডান-হাতে রক্তেরাঙা খাঁড়া। কণ্ঠনালী থেকে ফিনকি দিয়ে রক্তের তিনিটি ধারা বেরিয়ে আসছে। মাঝেরটি দেবীর মুখে, দেবী নিজের হাতে নিজের মুণ্ডু কেটে নিজেই নিজের রক্তপান করছেন, অন্য দুটি ধারা গিয়ে পড়েছে ডাকিনী ও বর্ণিনী নামে তাঁরি দুই সহচরীর মুখে। দেবীর পায়ের তলায় রতি ও কামের মিথুনু-মূর্তি। (মতান্তরে রাধা-কৃষ্ণ)।
এই একটা মাত্র মূর্তির প্রতীকের মধ্যে দিয়ে কতদিকে কত রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। যাঁরা ব্রহ্মবাদী পূর্ণতার উপাসক তাঁরা “পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং...”-এর বার্তা পাচ্ছেন, যাঁরা বৌদ্ধ শূন্যতায় বিশ্বাসী তাঁরা ‘চতুষ্কোকোটি বিনুর্মুক্তি’-র সন্ধান পাচ্ছেন, আবার যাঁরা তন্ত্রধর্মে বিশ্বাসী তাঁরা কামকে দলন করে কুলকুণ্ডলী জাাগরণের বার্তা পাচ্ছেন। নিজের মাথা কেটে ফেলা মানে মিথ্যা ভাব, অজ্ঞতা ও আমিত্ব অপসারণের প্রতীক। আবার ছিন্ন-মস্তক মানে তুরীয় চৈতন্যের প্রতীক।
এমনকি এই সময়ের পাশ্চাত্য আলওচকরাও স্বীকার করছেন এমন প্রতীক-মূর্তির কথা পশ্চিমা বিশ্বও কখনও ভাবতে পারেনি। এই প্রসঙ্গে একটা বইয়ের উল্লেখ অবশ্যই করতে হয়--“Dancing in the Flames: The Dark Goddess in the Transformation of Consciousness”। বইটি এমিলি ডিকসনকে সঙ্গী করে মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ুংপন্থী বিশ্লেষক মারিয়ন উডম্যানের লেখা। এখানে কানাডিয়ান লেখিকা উডম্যান মা-কালীকে দেখেছেন আমাদের মতো দেবী হিসেবে নয় বরং এক অসীম এবং অনন্ত শক্তির অনিঃশেষ প্রবাহ হিসেবে। অবদমিত নারীশক্তির জাগরণ হিসেবে। তবে এই জাগরণ শুধুমাত্র নারীদের জন্যে নয়, পুরুষদের জন্যেও সমান কার্যকর। বইটির সমালোচকরা লিখেছেন - Dark, earthy, and immensely powerful, the Black Goddess has been a key force in world history, manifesting in images as diverse as the Indian goddess Kali …. She embodies the energy of chaos and creativity, creation and destruction, death and rebirth. Images of Her, however, have been conspicuously missing in the Western world for centuries – until now, when awareness of the Goddess is re-arising in many spheres, from the women’s movement to traditional religion, from the new discoveries of quantum physics to the dreams of ordinary men and women. Why now particularly? The answer provided by Marion Woodman and Elinor Dickson is bold and thrilling: the reemergence of the Divine Feminine in our time indicates our readiness to move to an entirely new level of consciousness. The reemerging Goddess calls for a shattering of rigid categories, a willingness to hold opposition. She calls us to marry reason and order to creativity, and to embrace the chaos that can ultimately lead to wisdom and transformation on personal and global levels.
উডম্যানের সিদ্ধান্ত হল যে প্রকৃত রূপান্তরের জন্য দরকার হয় অহং-এর মৃত্যু, সেই সঙ্গে অহং-এর গায়ে যে-সব ভীতিজনিত মিথ্যা মূল্যবোধ লেপটে থাকে তাদের থেকে মুক্তি। মা-কালীর মূর্তি কল্পনায় সেটাই প্রকাশিত। মারিয়ন তাঁর পাঠকদের জানিয়ে দিয়েছেন কালীর রূপকে ব্যাখ্যা করার যে প্রচলিত প্রথা তা আমাদেরে বলে কালীর কালো বরণ একটা বিদ্যুৎ চমকের মতো যা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে জগতের সবকিছু, এবং যার মধ্যেই তারা আবার ফিরে লীন হয়ে যাচ্ছে। একটানা ঘটে চলা মহাজাগিক এই ঘূর্ণির ভিতর বিরামহীনভাবে মৃত্যুকে পান করে বেঁচে আছে জীবন, জীবনকে পান করে বেঁচে আছে মৃত্যু – এই ভ্রমাত্মক মদে মাতাল হয়ে, মা কালী হাসতে হাসতে এবং লোফালুফি ক্রতে করতে একই সং সবকিছি স্ততিষ্ট করছেন ও ধ্বংস করছেন। এই সামগ্রিক ভাবটিকে গ্রহণ করার অর্থ হল ভয় ও দুর্বলতা থেকে মুক্ত হওয়া। ব্যক্তগত ও মহাজাগতিক জ্ঞানের দরজা খুলে যাওয়া। উডম্যান মনে করেন প্রতি নিয়ত চেতনার গভীরে এই জন্ম ও মৃত্যু আসলে এক জটিল মনস্তাত্বিক ঘটনা। আমাদের প্রকৃত সত্তাকে আমরা বরাবরি উপর থেকে দেখি এবং বিচার বিশ্লেষণ করি। তার ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করি না। উডম্যানের মতে সেখানে প্রতি নিয়ত এক ভয়ংকর গণ্ডগোল ঘটে চলেছে। যা একই সঙ্গে বিভ্রান্তিকর আবার স্বতঃস্ফূর্ত। সে এক উন্মাদের পাঠশালা। সেখানে প্রবেশ করলে আমাদের জানা-চেনা জগৎ ও অচল-ওটল সংস্কার লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে; আরাম, নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তার সব বেড়া কর্পূরের মতো উবে যাবে। তখন মা-কালীর আমাদেরও আগল না হয়ে উপায় থাকবে না। সেখানে সবকিছু মুর্মুহু বদলে যাচ্ছে। বন্যার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ক্ষণে ক্ষণে পুরাতন মুছে যাচ্ছে, জন্ম হচ্ছে নতুনের। নারী-শক্তির সমর্থক উডম্যান সেই ঢেঊয়ের ছন্দে খুঁজে পেলেন নারীত্বের আদল। পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে যে ঘটনাকে বিনির্মাণ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ দেবী ছিল্লমস্তার এই রূপ-কল্পনা।
বাঙালির বিপ্লব-চিন্তা আজ বিশ্বচিন্তাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে।
বিপ্লবের সঙ্গে রোম্যান্টিকতাকে মিশিয়ে কাজ করেছিলেন আরও এক জন্ম-বিপ্লবী, তিনি আর্নেস্টো চে গেভারা, এখনও বহু বাঙালি ছেলেমেয়ের টিশার্টের ও গেঞ্জির বুকে চে-র ছবি দেখা যায়। এই যুবক-যুবতিরা আবার হাতে গিটার তুলে নিয়ে গাইতে থাকা জন লেনন, বব ডিলান, পিট সিগার। অর্থাৎ তাদের বুকে বিপ্লবের বারুদ আছে রোম্যান্টিকতাও আছে। দরকার শুধু একটা ফুলকি।
বাঙালির এই বিপ্লবী সত্তার কারণ তার শরীরে যে রক্ত বইছে সেখানে শূদ্র-রক্তের প্রাধান্য। ব্রাহ্মণরা এসেশের ভূমিপুত্র নয়, তাদের এদেশে ডেকে আনা হয়েছিল বাইরের থেকে। বাঙালির জাতিসত্তার উসৎমূলে যে কৌমগোষ্ঠিগুলি ছিল তারা হল বাউড়ি-বাগদি-মুচি-ডোম-হাড়ি-ক্যায়ট-চণ্ডাল এই সব তথাকথিত নিম্ন-শ্রেণির মানুষজন বা ছোটোলোকেরা।
আর কে না জানে, শূদ্র-সমাজ মানেই প্রতিষ্ঠানের চক্ষুশূল।
অথচ মজার কথা, ভারতের মহাকাব্যগুলিতে প্রত্যক্ষভাবে ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রচার করা হলেও পরোক্ষ ভাবে সেখানে শূদ্রদের উত্থান চোখের পড়ার মতো। গীতায় দেখুন, প্রথম অধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে, এত আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করতে হবে জেনে যখন অর্জুনের মন বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই সেই বিষাদ কাটাবার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে উপদেশ দিচ্ছেন তার প্রথমেই তিনি অর্জুনকে বলছেন তাঁর এই আচরণ শূদ্রের মতো। শূদ্ররা যুদ্ধ চায় না। ক্ষত্রিয়দের ধর্ম যুদ্ধ করা।
অথচ গীতা শুরু হচ্ছে কী ভাবে, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাঁর সারথি সঞ্জয় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সরাসরি ধারাবিবরণী দিচ্ছেন। কে এই সঞ্জয়? তিনি তো একজন সূত, ্রাজার রথ চালান, জাতে ছোটোলোক।
একজন শূদ্রের মুখ দিয়ে চোস্ত সংস্কৃতে ভগবানের উক্তি উচ্চারণ করানো হচ্ছে, এবং শূদ্রের উচ্ছিষ্ট সেই শ্লোকগুলিই হল পরম পবিত্র শ্রীমদ্ভাগতবত গীতা।
আবার মহাভারত, তার রচনাকার যেই হোন, নৈমিষারণ্য বনে সমবেত ঋষিদের সামনে সেই কাহিনি যার মুখ দিয়ো বলানো হচ্ছে তিনি কিন্তু কণোনও মুনি-ঋষি নন, তিনিও আর এক সূত, নাম সৌতি উগ্রশ্রবা। তাঁকে শুধু মহাভার নয়, শিবপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, হরিবংশ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, পদ্মপুরাণ এই সব বেশ কয়েকটি পুরাণের কথক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সবকিছুই শূদ্রদের মুখ-নিঃসৃত।
রামায়ণ যাঁর লেখা সেই বাল্মীকিও তো জঙ্গল-দস্যু থেকে ঋষিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ধর্ষণবিদ্যা থেকে উত্তীর্ন হয়ে যখন কর্ষণ-বিদ্যায় দীক্ষিত হলেন, তাঁর মুখ দিয়ে প্রথমে রাম নাম উচ্চারণই হত না। তিনি ‘মরা’ ‘মরা’ বলতেন। এ-সব বহুল প্রচলিত গল্প। রামায়ণে যে সাতটি কাণ্ড, তার মধ্যে শেষেরটি অর্থাৎ উত্তরকাণ্ডকে বিশুদ্ধবাদীরা স্বীকার করেন না, কারণ সেখানে সীতার প্রতি রামের অন্যায় অবিচারের কথা আছে। সীতা রামকে ‘প্রাকৃত’ বা ছোটোলোক বলে গাল দিচ্ছে সে-কথা আছে। রাবণের মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে। সীতার বনবাসের অ পাতাল-প্রবেশের কথা আছে, যা রাম-চরিত্রের মহিমাকে খাওটো করে।
বিশুদ্ধবাদীরা আবার চারটি বেদ-এর অস্তিত্বও স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে চতুর্থটি অর্থাৎ অথর্ববেদ ছোটোলোকেদের লেখা। সেখানে তন্ত্র-মন্ত্র-মারণ-উচাটন-বশীকরণ-জাদুবিদ্যা এইসব হাবিজাবি ব্যাপার আছে, যা শূদ্রদের থেকে এসেছে এবং তা বেদ অনুমোদিত নয়।
ভারতীয় ধর্মের পরম্পরা লক্ষ করলে এই রকম প্রচুর মজার অসংগতি ধরা পড়বে, যেখানে রক্ষণশীলদের সঙ্গে উদারতাবাদীদের মতাদর্শগত সংঘাত ও সংঘর্ষ চলেছে। সেখানে বিদ্রোহ ও সমাজ-বিপ্লবের বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ মজুত আছে। এমন অভিজ্ঞতাও আছে, এই লড়াইয়ের ফলে ধর্ম ও সমাজে যে-সব সংস্কার সাধিত হয়েছে তাদের ফলাফলও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আত্মস্যাৎ করে তা নিজেদের কৃতিত্ব বলে চালাতে চেয়েছে। ইতিহাসের চাকাকে তারা সাময়িকভাবে পিছনের দিকে টেনে রাখতে চেয়েছে এবং এখনও চাইছে।
আশ্চর্যজনকভাবে পরবর্তীকালে এই বিদ্রোহের লক্ষণপগুলি বেশি প্রকাশ পেল বাঙালির জাতিসত্তায়। তার এই বিদ্রোহী সত্তার জন্যেই বাঙালি অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা। বাঙালির এই বিপ্লবী-সত্তার জন্যে আজও ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের মানুষেরা বাঙালির দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে এবং ভয় পায়। আধুনিক ধারার বাংলা-কবিরা বাঙালির এই চরিত্রগুণ বুঝতে পারেননি। অতএব লোকস্মৃতি থেকে তাঁরা মুছে গেছেন।
কথার পর কথা বসাতে গিয়ে কিছু কিছু অপ্রিয় কথা লেখা হয়ে গেল। কী করব বলুন, কলম ত্যাঁদড় হলে কলমচির আর কী করার থাকে। আমি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করিনি, কিছু প্রবণতার কথা তুলে ধরতে চেয়েছিমাত্র। তবু এ-সব কথাবার্তা কারও অনুভূতিতে আঘাত করে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
ফিরে আসি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে। এই হই-হুল্লোড়ের মধ্যে একটা কথা বলা যায়, কর্পোরেট-কালচারের নির্বোধ আমোদের স্রোতে গা ভাসালেও বাঙালির হৃদয়রেখায় এই দুর্দিনেও কোথাও যেন একটা আলাদা মনকেমন রয়ে গেছে। সেটা হয়তো বাংলার প্রকৃতি, বাংলার জল-মাটি-হাওয়ার অবদান। বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গা থেকে চুঁইয়ে পরা আলো। কোনও কিছুতেই পোষ মানা তার ধাতে নেই। বাঙালি তো শুরু থেকেই বড়ো খ্যাবড়া-খ্যাচাং, ঘাড়-ব্যাঁকা পাবলিক। এলোমেলো বাতাস লাগলে এখনও বাঙালি আপন মনে গুনগুন করে ওঠে – ‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো, দোলে মন দোলে অকারণ হরষে’, অথবা ‘দোলাও দোলাও দোলাও, আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে’।
বিষ্ণু দে বুদ্ধদেব বসু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জীবনানন্দ দাশ সমর সেন অমিয় চক্রবর্তী, সকলেই জানেন, তবু স্মরণ করিয়ে দিই, তাঁরা সকলেই ইউরোপীয় আধুনিক ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে কবিতা লিখেছিলেন, অথচ সেই বিদেশি তত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল আলোকপ্রাপ্তি। কিন্তু সিকি শতাব্দীর মধ্যে ঘটে যাওয়া দুটো বিশ্বযুদ্ধ, আমেরিকার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ, শুধু হিরোসিমা-নাগাসাকিকে ধ্বং্স করেনি, একই সঙ্গে আলোকপ্রাপ্তির তত্ত্বকে তামাশায় পরিণত করেছিল। আধুনিকতার কফিনেও অন্তিম পেরেক ঠুকে দিয়েছিল।
সমসাময়িক কবিরা তাঁদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের ভাব ও আদর্শ অন্যযায়ী কেউ হতাশাকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন, আাবার কেউ চেয়েছিলেন আলো জ্বালতে। । অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘“আজ মানুষের জয়ধ্বনি নয়, আজ সভ্যতার পরাজয়ের করুণ ধ্বনি চারিদিকে শুনতে পাচ্ছি।” তিনি মেঠো বাউলের একতারার সুরে গেয়ে উঠলেন, “ ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো। / একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো ॥”
কিন্তু এসব কথা আসছে কেন? আসছ, কারণ, আগে যেটা বলেছি সেটা আর একবার বলি, আজকের আধিপত্যবাদীরাও মানুষের চৈতন্যে মড়ক আনতে চাইছে, মানুষের চিন্তাশক্তিকে অলস করে দিতে চাইছে। সিস্টেমের অনুকূলে লেখাকে প্রশংসা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভরিয়ে দেওয়াটা একটা পুঁজিবাদী কৌশল। উচ্চাকাঙ্ক্ষী কবিরা একদিকে স্বীকৃতি ও নিরাপত্তার কাঙাল, অন্যদিকে তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজের লেখাটা কবিতা হল কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ ও সংশয়। তাদের এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে হুঁজুর-খেজুরদের পক্ষ থেকে কবিতাকে বৈধতা দেবার নামে কবি ও কবিতার সঙ্গে একটা ভয়ংকর প্রতারণা করা হচ্ছে। কবির ঘাড়ে নাম-যশের বোঝা চাপিয়ে তার ক্ষমতাকে হত্যা করার চক্রান্ত চলছে। কবিরা ব্যাপারটা ঠিকমতো না বুঝেই তাদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা চৈতন্যকে জাগিয়ে তোলাই এই সময়ের কবির অন্যতম কাজ। চৈতন্যের জাগরণ মানে কবির ভিতর ঘুমিয়ে থাকা সহজাত শক্তিকে জাগিয়ে তোলা, মনকে জড়তা-মুক্ত করা, পাঠককে নতুন কিছু ভাবতে উদ্দীপ্ত করা।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন ‘নতুন ভাবনা, সে কী বস্তু, সে কোথা থেকে আসে, তা কী কাজে লাগে’, আমি মনে করি, এ-প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় আমার নয়, সেটা কবিদের নিজের। তারাই ভাবুক তারা কী লিখছে, কেন লিখছে। তারা কি শুধুই শখ করে লিখছে, অথবা বিশেষ কোনও চাপ থেকে না লিখে থাকছে পারছে না, অথবা নিতান্ত অভ্যাস থেকে লিখছে। তারা নাম-যশ-অর্থের এক দুর্নিবার ঘূর্ণিপাকে ঘুরপাক খেতে খেতে হুঁজুরদের দলে ভিড় বাড়াচ্ছেন না তো? সম্মান ও স্বীকৃতির লোভে কারও তাঁবেদারি করছেন না তো। নিজের ভিতরের বিদ্রোহী সত্তকে জাগাতে গেলে কবিকে কিন্তু অনেক প্রলোভন জয় করতে হবে।
তাহলে নতুন কবিতার লক্ষণ কী ? আমি কারও উপর খবরদারি করছিনা বা কোনও ফরমান জারি করছি না, শুধু জানিয়ে দিচ্ছি এ-সব নিয়ে নিয়ে কবিদের নিজেদের মতো করে ভাবতে হবে। সেই ভাবনার অধিকার তাদের আছে। দেখতে হবে, তাদের কলম থেকে তেমন কোনও ভাবনা বেরিয়ে আসছে কিনা, যা এর আগে লেখা হয়নি। সেই সব দেখা আছে কিনা যা এর আগে কারও চোখে ধরা পড়েনি। সেই সব সংবাদ আছে কিনা, যা এর আগে পরিবেশিত হয়নি। যা গতানুগতিক অথবা প্রথাসিদ্ধ লেখা নয়, খুব সাধারণ হয়েও যা অসাধারণ, (প্রতিটা সাধারণের মধ্যেই এক ধরনের অসাধারণ লুকিয়ে আছে, কবিকে সেটা উপলব্ধি করতে হয়।) এবং যা সিস্টেমকে বিব্রত করে, অতিষ্ট করে, প্রতিষ্ঠিত ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করে কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারে। অথবা বিনা কারণে, অচেনা অজানা পথে হেঁটে, কবিতাকে এক অনির্দিষ্ট থেকে আরও এক অনির্দিষ্টের দিকে নিয়ে যেতে পারে, এক রহস্য থেকে আর এক রহস্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। পুরোনোকে অস্বীকার করে মরু-বিজয়ের নতুন কেতন ওড়াতে পারে। সেটাই নতুন লেখা।
কবি যা লিখল তা অন্যদের ভালো লাগতে পারে, নাও লাগতে পারে, অন্যদের কাছে তা কবিতা মনে হতে পারে, নাও হতে পারে। এ-সব কোনও ব্যাপার নয়, তাই নিয়ে কবিকে মাথা না ঘামালেও হবে। আসল ব্যাপার যেটা তা হল, কবি যে লেখাই লিখুক তার মধ্যে যেন কবির ছোটোখাটো অনুভূতি, নিজস্ব ঘামের গন্ধ, নিজের লালারস, চোঁয়া-ঢেঁকুর, নিজের চাউনি, ব্যক্তিগর যৌনতা, রাগ-অনুরাগ-প্রতিবাদ এই-সব মিশে থাকে, কারণ সেগুলোই কবির নিজস্ব বায়োমেট্রিক্স। তাই দিয়ে কবিকে আলাদা করে চেনা যাবে।
একুশ শতকের কবিতা নিয়ে কবি ও পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন দরকার। এ বিষয়ে আমার নিজের উপলব্ধির কথা বলি, নমো নমো করে কবিতার সাজানো বিগ্রহকে পুজো না করে আন্তরিকভাবে বিগ্রহকে ভাঙার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। অচলায়তনের জগদ্দল পাথরটাকে সরাতে হবে। (এমন হওয়াটা খুব সোজা কাজ নয়)। নিজেকে রি-ফর্ম্যাটিং করতে হবে। পুরোনো ল্যাঙ্গুয়েজ, পুরোনো প্রোগ্রামিং, পুরোনো অপারেটিং সিস্টেম এ-সবই বদলে ফেলতে হবে, অথবা প্রতিনিয়ত তাদের আপডেট করতেন হবে। তার সঙ্গে নতুন নতুন ফিচার যোগ করতে হবে। কবিতাকে বদলাতে গেলে আগে নিজের চিন্তা-ভাবনা, সংস্কার, বিশ্বাস এ-সবের খোল-নলচে পালটে ফেলতে হবে। ভদ্রতা নামক ঢ্যামনামি থেকে সরে আসতে হবে। আকাশ পানে তাকিয়ে চললে হবে না, মাটির দিকে চোখ রেখে হাঁটতে হবে। একুশ শতকের ছেলেমেয়েদের কবিতা লেখাটাকে শুধুমাত্র শখের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। নিজেকে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ। নিজস্ব চিন্তা-বীজকে রোপন করার চ্যালেঞ্জ। এই কনজিউমার সোসাইটিতে সারা বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের যে কোনও শাখায় যে ব্যাপারটা বেশি করে জায়গা করে নিচ্ছে তা হল অস্তিত্বের সংকট। ভোগবাদী সংস্কৃতির ঘূর্ণিস্রোতে সকলর লেখাতেই কম-বেশি উঠে আসছে শেকড়ের সন্ধান। নতুন সময়ের ছেলেমেয়েদের নিজের নিজের সমস্যা ও সংকট নিয়েও ভাবতে হবে। নিজের সেই চ্যালেঞ্জটাকে চিনতে হবে। নিজের লড়াইটাকে চিনতে হবে।
যাঁরা আমার এইসব কথার সঙ্গে সহমত হবেন, আমি বলব, সেই কবিদের নবারুণের ফ্যাতাড়ুদের মতো গেরিলা-যুদ্ধ শিখতে হবে। যে কোনও কবিতার যে কোনও লাইনে, যেখানে-সেখানে, যে কোনও শব্দে ল্যান্ডমাইন পুঁতে দিতে হবে, পড়তে গেলেই তার বিস্ফোরণ ঘটবে এবং সেই বিস্ফোরণ টিকিওয়ালা গুরুমশাইদের ঘেঁটি ধরে টান মারবে।
শব্দ দিয়ে তৈরি বোমা নীরব হতে পারে কিন্তু নিরীহ নয়।
ভবিষ্যতের দোয়াতে বর্তমানের কালি ডুবিয়ে লেখা আগামীর দিশা🙏🏼❤🙏🏼
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ও ভালোবাসা
মুছুন