‘I can never decide whether Paris is more beautiful by day or by night’… মাথার ভেতর কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল তার। বলতে নেই বেশ তীব্র আফসোস হচ্ছিল একরকম। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল টাইম অনুসারে, ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত সাড়ে এগারোটা। তার নিজের দেশের সময়ের হিসেবে অবশ্য সেখানে রাত এখন গভীর। এই ক্রমবর্ধমান রাতের মধ্যে প্যারিসের শার্ল দে গ্যল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটা টার্মিনালে বসে রয়েছে সে। অপেক্ষা করছে। পরবর্তী বিমানের জন্য, যা তাকে নিয়ে যাবে ইতালিতে। মার্কো পোলো এয়ারপোর্ট, ভেনিস। সেখান থেকে ট্রেন ধরে কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে উদিনে। কিন্তু সেসব তো এখনো দেরী আছে। কাল সকালের আগে তার ফ্লাইট নয়। টিকিট কাটার সময় যখন নীল দেখেছিল প্যারিসে তার প্রায় দশ ঘণ্টা লে’ওভার রয়েছে, যুগপৎ আনন্দ ও উত্তেজনা তার দুই’ই হয়েছিল। রাতের প্যারিসকে সে দেখতে পাবে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও কাছ থেকে। এই শহর নিয়ে কত পড়েছে, তাকে কত’কতবার সিনেমায় দেখেছে সে। পছন্দের সিনেমার দৃশ্যগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার, আর একটা অদ্ভুত অস্থিরতা পেয়ে বসছিল তাকে। অত কীই বা করার আছে তার, রাত দশটার সময় যখন ইস্তানবুল হয়ে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের লালচে বিমান তাকে প্যারিসের মাটিতে নামিয়ে দিলে, সে বেশ উৎসুক চোখে চারপাশে তাকাচ্ছিলে। পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার সাথে ধাতস্থ হতে খানিক সময় লাগল তার।
ইতিমধ্যে তার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে কখন। ফোনটার বয়েস হয়েছে ভালোই, প্রায় বছর চারেক হল, মাঝে একবার ব্যাটারি পালটেও যে খুব লাভ হয়েছে তা না। বাড়ি থেকে একবার বলেওছিল ফোনটা পাল্টানোর কথা, কিন্তু নীল ভাবলে এতদিন যখন ফোনটা সময়ে অসময়ে তাকে সঙ্গ দিলে, প্রথম বিদেশ ভ্রমণটুকুর সঙ্গীও না হয় সেই হোক। দৈনন্দিন জীবনের এই ছোটখাটো আপাত জড়বস্তুর প্রতি তার কেমন একটা টান কাজ করে ছোট থেকেই। যে কারণে আপাত কথাটা ব্যবহার করা। নীলের মনে হয় তার এই অকিঞ্চিৎ জীবনের বেশ কয়েক টুকরো যেন জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত তার জীর্ণ ওয়ালেট, ব্যাকপ্যাক কিংবা প্রায়শই চার্জ ফুরিয়ে আসা মোবাইলের ভেতর। এই নিয়ে রাই অবশ্য মাঝে মাঝেই পেছনে লাগে তার। তুই বুঝবি’না বলে, একটা আপাত গম্ভীর মুখভঙ্গি করে সে সেইসব প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। বলা ভালো চেষ্টা করে। কিন্তু এই মুহূর্তে শার্ল দে গ্যল থেকে বেরিয়ে, বিমানবন্দর সংলগ্ন টিউবরেল ধরে যদি সত্যি সত্যিই প্যারিসের মাটিতে তাকে পা রাখতে হয় সবার আগে যেটা দরকার সেটা হল ফোনটা সচল রাখা। সে ম্যাপ দেখতেই হোক বা সময়। অথচ দরকারের সময় দেখো, ফোনটা বন্ধ এখন ! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ব্যাগ থেকে অ্যাডাপ্টারটা বার করে সে চার্জিং পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেলে।
দেশ হতে বিদেশে যে সেখানের ব্যবহৃত মুদ্রা, ঘড়ির কাঁটায় সময়, অন্যান্য সাংস্কৃতিক রীতিনীতির মত বৈদ্যুতিন চার্জারের জ্যামিতিও পাল্টে যায় সেটা তার জানা ছিল না। ভাগ্যিস অঙ্কুর বলেছিল। বহু হাতবদল হয়ে পাওয়া একটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডাপ্টার জোগাড় করে দিয়েওছিল তাকে যাওয়ার আগে। একটা পিন যে আলগা হয়ে গেছে তার, তখন যদি নীল খেয়াল করত! বেশ কয়েকবারের চেষ্টাতেও কিছুতেই ঠিকঠাক জোড়া লাগলোনা সেটা। অতএব নিশ্চল হয়ে রইল তার ফোন। প্যারিসে অবতরণ করার সাময়িক উত্তেজনা এইবার ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে এলে তার খেয়াল পড়ল, তাড়াহুড়োয় টিকিটের প্রিন্টআউট ও নেওয়া হয়েনি তার। সেটা ফোনেই রয়েছে। অতএব কালকের ইতালিগামী ফ্লাইতে তাকে উঠতে হলে আর কিছু না হোক আগে ফোনটা অন্তত সচল করতে হবে তাকে। একদিকে মধ্যরাতের প্যারিসের হাতছানি অন্যদিকে নিজের ঠিকানা হতে কয়েক হাজার মাইল দূরের এক ভিন্ন মহাদেশের বিমানবন্দরে সংযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কার মধ্যে খুব দ্রুত সময় পিছলে যাচ্ছিল তার হাত থেকে। দূর থেকে সম্ভবত কেউ লক্ষ্য করছিল তাকে।
এয়ারপোর্টের জনৈক সহৃদয় কর্মীর সহায়তায় সে যাত্রা রক্ষা হল নীলের। বেশ খানিকক্ষণ তার কার্যকলাপ দূর থেকে দেখে, কেজানে সম্ভবত মনে মনে হাসছিলেন কিনা, সেই দীর্ঘদেহী কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক তার দিকে এগিয়ে, খুব ভারী ফরাসি টানের ইংরেজিতে নীলকে জিজ্ঞেস করলেন তার কোন সাহায্য লাগবে কিনা।এর পরের কয়েক মিনিট ধরে, বেশ খানিকটা হাত’পা নেড়ে ভদ্রলোককে তার বর্তমান প্রতিবন্ধকতা, এই আশ্চর্য নগরীতে তার ক্রমহ্রাসমান সময় এবং তার মধ্যেই বিমানবন্দর হতে রাতের প্যারিসে ঝটিকা সফরে একবার ঘুরে আসার মনোবাসনা সবকিছুই সে তাকে জানালে। ধৈর্য ধরে পুরোটা শুনে ভদ্রলোক তাকে এক জায়গায় বসার ইঙ্গিত করে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। খানিক পরে আবার যখন তাঁকে সে দেখতে পেল, ভদ্রলোকের হাতে একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক। সেটা নীল কে দিয়ে বললেন, ফোন চার্জ করে নাও যতটা লাগে। আর এত রাতে একা একা প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর আশা বিসর্জন দাও , রাতের প্যারিস আর তত নিরাপদ নয়। এও বললেন, যে তার ভোরের ফ্লাইট খুব সম্ভবত পাশের টার্মিনাল থেকে ছাড়বে, এখান থেকে আধঘন্টা দূরত্ব, কাজেই সময় থাকতে থাকতে নীল যেন সেখানে চলে যায়। ভদ্রলোকের কথাগুলোর মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম দৃঢ়তা ও যুক্তি রয়েছে নীল টের পেল, এবং তার মনের একটা অংশ এতে খানিক ক্ষুণ্ণ হলেও কথাগুলোকে সদুপদেশ বলেই মনে হল তার। রাতের নরম নীলচে আলোয় ঘেরা এই প্রায় জনমানবশূন্য ফাঁকা টার্মিনালে বসে ফোন চার্জ দিতে দিতে সহসা নিজের প্রতি খানিক আত্মকরুণা বোধ হল তার। ‘Paris is a woman but London is an independent man puffing his pipe in a pub’ , কেরুয়াকের সেই বিখ্যাত উক্তি বারবার মনে পড়ছিল তার। অথচ আমি তার কাছেই ছিলাম, সেই আশ্চর্য নারীর এত এত কাছেই গোটা একটা রাত, তবু সে অধরা রয়ে গেল, এক পলকের জন্যও যদি দেখতে পেতাম তাকে। এতসব মনখারাপের মধ্যেও নীলের মনে হল এই গোটা ব্যাপারটা কোথাও যেন বেশ কাব্যিক, হয়তো কোনোদিন এই নিয়ে কখনো কিছু লিখবে সে, যেমন সে লেখে মাঝে মাঝে ডায়েরির পেছনের পাতায়। তবে তার আগে হয়তো খানিক দূরত্বের প্রয়োজন তার।
পরদিন প্যারিসকে পেছনে ফেলে ভেনিস হয়ে ট্রেন মারফত যখন সে অবশেষে সে উদিনের ট্রেন স্টেশনে এসে পৌঁছলে, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। পৃথিবীর এই অংশে বছরের এই সময় উত্তরায়ণের খুব কাছাকাছি, কাজেই দিন খুব বড় এখন, সূর্য অস্ত যেতে যেতে প্রায় রাত সাড়ে নটা। কাজেই সময় আছে বেশ, কনফারেন্সের উদ্যোক্তারা যেখানে তার থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন সেখানে পোঁছেও চারপাশটা একটু হেঁটে দেখার অবসর থাকবে তার। ফ্রিউলির রাজধানী উদিনে, তার ইতিহাস বড়ই পুরাতন, ট্রেনে আসতে আসতে সে খানিক ঘেঁটে দেখছিল এদিকওদিক। কেউ বলেন আনুমানিক নবম শতাব্দীর গোড়ার দিকে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এই শহরের গোড়াপত্তন , আবার কেউ বলেন তার আঞ্চলিক ইতিহাস আরও আরও পূর্বেকার, মধ্যযুগ পেরিয়ে সেই আদি নিওলিথ সময়কার। কিন্তু উইকি ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভারী চিত্তাকর্ষক একটা খবরে চোখ আটকে গেল তার। পঞ্চম শতাব্দীতে বিখ্যাত, অথবা হয়তো কুখ্যাত, ইতিহাসের যেদিক হতেই বিবেচনা করা হোক না কেন, হুনরাজ আতিলা রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করার সময় নাকি এই উদিনেতে এসে মনে হয়েছিল, চারপাশ বড় বেশি সমতল, তাই তাঁর মনে ইচ্ছে হয় একটা উঁচু কিছু বানাতে, পাহাড় কিংবা টিলা গোছের যেখান থেকে চারপাশ দেখা যাবে বেশ। কথিত আছে এরপর তাঁর নির্দেশে সৈন্যরা তাদের শিরস্ত্রাণে মাটি ভরে পর পর গেঁথে তৈরি করে এক মানবনির্মিত পাহাড় যাকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত বর্তমান এই উদিনে শহর। উদিনের বহু শতাব্দী প্রাচীন কেল্লাও নাকি অবস্থিত এই পাহাড়ের কাছেই, নীল পড়ে দেখল। জায়গাটা খুঁজে দেখার বেশ আগ্রহ হল তার। সত্যি বলতে গতরাতের তুলনায় আজ অনেকখানি মন ভালো আছে তার। এখানে থাকবে সে দিন সাতেক, সম্ভব হলে ফেরার পথে একটু সময় করে ভেনিসটাও তার দেখা হয়ে যাবে, জলমগ্ন সেই আশ্চর্য শহর, যার সাথে এমনকি জড়িয়ে আছে গ্যালিলিওর ও একটুকরো ইতিহাস, তার এক ঝলক সে আজ পেয়েছে আসার পথে। এই বহু পুরাতন শহরে নতুন, অপ্রত্যাশিত কোন অভিজ্ঞতা লাভের সম্ভাবনায় তার সামান্য উত্তেজনা হয়। সে তাড়াতাড়ি হাঁটে।
যে কাজে সে এখানে এসেছে এযাবৎ সেটা বেশ ভালোই চলছে। নিজের গবেষণার বিষয় সম্পর্কিত অন্যান্য রিসার্চারদের সাথে তাদের কাজ নিয়ে টুকটাক আলাপচারিতা, সামারস্কুলের লেকচারগুলো সবই বেশ কাজে লাগছে তার। যারা পড়াচ্ছেন তাঁদের নাম এতদিন সে বইতে দেখেছে, সামনে থেকে এই প্রথম। সাহস করে তাঁদের কয়েকজনের সাথে গিয়ে কথাও বলল সে। অক্সফোর্ডের বিখ্যাত গণিতবিদ প্রফেসর গোরিয়েলি, তাকে নিজের কাজের সম্বন্ধে অল্প বলতেই তিনি তাঁর এক ছাত্রের একটা কাজের কথা বলে বললেন, পেপারটা হয়ত কাজে লাগতে পারে নীলের। সেদিন রাতে ঘরে ফিরে এসে নীল দেখলে, সে যা খুঁজছিলে এই কাজটায় প্রায় তার সবটাই আছে। এত অল্পে ভদ্রলোক তার চাহিদা বুঝে গেলেন কী করে কে জানে। এছাড়া, সে খেয়াল করে দেখেছে , জনৈক আইআইটির অধ্যাপক, যার সাথে এখনো তার আলাপ হয়নি, তিনি বাদে সে-ই একমাত্র ভারতীয় এইখানে। এটা ভেবে সে খুশি হবে না খানিক দুঃখিত এবিষয়ে অবশ্য খানিক ধন্দ রয়ে গেল তার।
এতদসত্বেও বলা যেতে পারে, উদিনে শহরে তার এই সপ্তাহব্যাপী অনতিদীর্ঘ বসবাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাখানি ঘটেছিল চতুর্থদিনের মাথায়, এক বৃহস্পতিবারের রাতে। দুপুরে লাঞ্চের সময় সেই ভারতীয় অধ্যাপকের সাথে আলাপ হতে নীল আবিষ্কার করলে ভদ্রলোক শুধু বাঙালি নয়, তার সেই গঙ্গাপাড়ের শতাব্দীপ্রাচীন কলেজের প্রাক্তনীও বটে ! ব্যাপারটা সতিই আশ্চর্যের, গানিতিক হিসেবে কতটুকুই বা এর সম্ভাবনা সে ভাবছিল! কথার ফাঁকে ভদ্রলোক বললেন, তিনি কাছেই একটা হোটেলে উঠেছেন, বিকেলের পর নীল যদি সেদিকে চলে আসে, তাহলে একসাথে ডিনার করা যেতে পারে। বেশ গল্পও করা যাবে খানিক।
কলেজ ও অন্যান্য বিভিন্ন সময়ের অনেক গল্প, পানাহার ইত্যাদি সেরে সেই অধ্যাপক, যিনি ইতিমধ্যে প্রায় তার একরকম কলেজতুতো দাদা সম্পর্কীয় হয়ে গিয়েছেন, তার সাথে আরেকদফা করমর্দন করে নীল যখন অ্যাম্বাসাডর প্যালেস হোটেল থেকে বেরোচ্ছে প্রায় সাড়ে নটা বাজে। সূর্য ডুবতে শুরু করবে আর কিছুক্ষণ পরেই। বেরোতে গিয়ে নীলের হঠাৎ মনে হল, ভদ্রলোকের সাথে এই একই মোলাকাত দেশের মাটিতে হলে হয়তো গোটা ব্যাপারটা এত সহজ হত না। ছাত্র ও অধ্যাপকের অবস্থানগত দূরত্বে চাপা পড়ে যেত বিগত কয়েক ঘণ্টার আলোচনার উষ্ণতা। সম্ভবত ওই সিস্টেম থেকে তারা দূরে আছে বলেই তা এত সহজে ভাঙা সম্ভব হল, তার ভেতরে ফিরে গেলে আবার যে কে সেই। এইসব ভাবতে ভাবতে ফেরবার রাস্তার ম্যাপ ফোনে দেখতে গিয়ে নীল খেয়াল করল তার ফোনের চার্জ ইতিমধ্যে আবার শেষ। নাহ্ , এবার ফিরেই মনে হচ্ছে অন্য একটা ব্যবস্থা দেখতে হবে, এত ডোবাচ্ছে এইবার ফোনটা। মনের আনাচে কানাচে জমে ওঠা এই কদিনের সদ্য সঞ্চিত স্মৃতির ওপর ভর করে ফিরতিপথের রাস্তা ধরল সে।
যেখানে যেতে হবে তাকে, সেই জায়গাটার নাম পিয়াজ্জা গ্যারিবল্ডি। তার হাউজিং-এর উল্টোদিকেই গ্যারিবল্ডির বিরাটকায় সবুজাভ ধাতবমূর্তি চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যে পথ দিয়ে সে এসেছিল তার অনতিদূরের একটি রাস্তার নাম দান্তে আলিঘিয়েরির নামে। ভাবলে বেশ গায়ে কাঁটা দেয় অবশ্য। এতদিন যা ছিল দূরে, কল্পনায়, তাকে হঠাৎ খুব কাছে, তার বাস্তবতা অনুভব করতে পারার মত একটা উত্তেজনা। দান্তে আলিঘিয়েরির পাশের রাস্তা ধরে বেশ খানিকটা সোজা হেঁটে তারপর বাঁদিক নিলেই পৌঁছে যাওয়ার কথা। যতদূর মনে আছে তার। কথায় কথায় ডিনারে কমপ্লিমেন্টারি ওয়াইনের পরিমাণটা আজ একটু বেশিই হয়ে গেছে রাস্তায় এসে বুঝতে পারল নীল। গোধূলির পড়ন্ত আলোয় শতাব্দীপ্রাচীন উদিনেকে আজ একটু বেশিই রঙিন লাগছে যেন।
আস্তে আস্তে নেমে আসছে শাটারগুলো। দোকানগুলো বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। এই কদিনে সে বুঝেছে, দিন পেরিয়ে রাত নামলেই ঘুমিয়ে পড়ার তোড়জোড় করে এই ছোট্ট শহরটা। আলো নিভতে না নিভতেই ফাঁকা হয়ে যায় রাস্তাঘাট। রাত্রের গ্যাসবাতির হলদে আলোয় শূন্য শহরটা যেন পাল্টে যায় কেমন। রাস্তা পেরোনোর আগে নীল খেয়াল করছিল তার বাঁহাতে একটা বেশ পুরনো অ্যান্টিকের দোকান। মালিক ও বেশ বয়স্ক, যেন বিগত এক সময়ের, ধীরে ধীরে অনেকক্ষণ সময় ধরে দোকানখানি বন্ধ করছিলেন। সিগন্যালের রঙ পাল্টানোর অপেক্ষা করতে করতে ভারী কাচের পাল্লার ওপারে দেখল বিভিন্ন রকমের স্টাফড জন্তু জানোয়ারের প্রতিকৃতি, তবে তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে জীবন্ত লাগছে কালচে খয়েরি, আর পাঁশুটে রঙের ডোরাকাটা কয়েকটা বেড়ালের মূর্তিকে। সদ্য জ্বলে ওঠা স্ট্রীটলাইটের আলোয় বেড়ালগুলোর চোখগুলো ঝকমক করে উঠল একবার। সে কি ঠিক দেখছে আদৌ? রাস্তার ওপার থেকে শাটার টেনে নামানোর আগে বেড়ালগুলোকে দেখতে দেখতে নীলের মনে হল, ওরা যেন উদগ্র অপেক্ষা করে আছে মালিকের প্রস্থানের। জনমানবের উৎসুক চোখগুলোর থেকে আড়াল পেলেই যেন প্রাণ ফিরে পাবে, লাফিয়ে উঠবে আবার। হাতে গোনাগুনতি আর যে’কটা দিন আছে তার মধ্যে আরেকবার সময় নিয়ে এসে দোকানটায় ঢুকতে হবে। মাথার ভেতর একটা অজানা রহস্যের গন্ধ পেয়ে সে বেশ উত্তেজিত বোধ করে।
সন্ধ্যার হলুদ আলো ছায়াময় রাস্তায় বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর নীলের খেয়াল হল চারপাশ খানিক অচেনা ঠেকছে। ম্যাপটা দেখতে পেলে বেশ হত, ফোনটার অভাব আরেকবার বোধ হল তার। তবে রক্তের মিশ্রনে আজ সামান্য অন্য কিছুর সংযোগ হয়েছে বলেই হোক বা নেমে আসা রাতের আবছায়ায় এই অচেনা শহরের অলিগলি নিজের মত আবিষ্কার করতে পারার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে বলেই হোক, দুশ্চিন্তার বদলে বেশ একটা ঔৎসুক্য বোধ তাকে পেয়ে বসে। আর তাছাড়া নেটে সে পড়েছে, গোটা উদিনে শহরটা খুব বড় নয়, হেঁটে বড়োজোর ঘণ্টা তিনেক, কাজেই দিগভ্রান্তের মত এলোমেলো ঘুরলেও রাত বারোটা, একটার মধ্যে নিশ্চয়ই সে খুঁজে পেয়ে যাবে তার ইপ্সিত গন্তব্যস্থল। এই ভেবে সে নিজেকে প্রবোধ দেয়। আর তাছাড়া কাউকে রাস্তায় পেলে একবার জিজ্ঞেস করেও নেওয়া যাবে না হয়। নীল ভাবে রাস্তা যখন একবার ভুল হয়েই গেছে, অলিগলিতে না ঢুকে বরং বড় রাস্তা বরাবর সোজা এগিয়ে গিয়ে বরং দেখা যাক। আর কিছু না হোক টাউনস্কোয়ারে গিয়ে পৌঁছলেও ওখান থেকে শহরের ম্যাপ দেখে অন্তত ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। তার আবছা মনে পড়ল কোন একটা বুলেটিনে সে দেখেছিল ওখান থেকে দূরত্ব দেড় কিলোমিটার। অর্থাৎ মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ।
ভারতবর্ষ থেকে যে অনেক দূরে চলে এসেছে তা হয়তো চারপাশের নীরবতা দিয়ে বোঝা যায় সবচেয়ে ভালো। কত আর লোক হবে এইখানে, মেরে কেটে কয়েক লাখ। সংখ্যাটা তাদের দেশের নিক্তিতে এত নগণ্য ভেবে তার হাসি পায়। রাস্তার ধারের ছোট ছোট রেস্তোরাঁ, ফুড জয়েন্ট যেগুলো তে দিনভর লোকে ভিড় করে থাকে, সকালের কনফারেন্সে যেতে যেতে নীল দেখে যে লোকগুলো বসে আছে সিগারেট কিংবা ওয়াইনের গ্লাস হাতে, বিকেলের ফিরতিপথে আবার তাদেরকেই দেখে আবার, অবিকল সেই লোকগুলোই বসে আছে ঠিক ওই একই জায়গায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে তার আশেপাশে যেন। দেখে তার ভালো ও লাগে আবার একটু হিংসে হয় এই ভেবে, যে এদের রয়েছে সেই অখণ্ড অবসর। কলকাতার কথা মনে পড়ে যায়। চায়ের দোকানে খবরের কাগজের হাতে সারা বেলা বসে থাকা লোকগুলোকে এখন দূর থেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগে তার। মনে হয়, যাক অন্তত কোথাও তো খানিক ধীরে বইছে সময়। এদিকে কলকাতার ছাড়ার পর থেকেই তার জীবন যেন হয়ে গেছে বহুগুন দ্রুত, প্রয়োজনের থেকেও অনেকখানি বেশি। অনিশ্চয়তার ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে কখন চলে যায় আরেকটি সপ্তাহ, চলে যাওয়ার আগে তাকে মনে করিয়ে দিয়ে যায় যে আরও সাতদিন চলে গেল, কাজ হলনা তেমন। অন্তত এই অপরাধবোধ থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে এই শহরে সে আছে যে কদিন। মহাদেশ পেরিয়ে এসে তাই বা কম কী পাওয়া।
চিন্তার সুতো ছিঁড়ে নীল খেয়াল করল রাস্তার অন্যপ্রান্ত থেকে কেউ হেঁটে আসছে। হাতে একটা ব্যাগ। এই আলো আঁধারির মধ্যেও অবশ্য যেটা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে সেটা হল খেটে খাওয়া লোকটার গায়ের রঙ অনেকটা তারই মতন। একে কি একবার সে জিজ্ঞেস করে দেখবে? খানিকক্ষণ ইতস্তত বোধ করে নীল লোকটার উদ্দেশ্যে একবার হাত নাড়ল, যদি তাকে খেয়াল করে। করল ও। তারপর তার দিকে খানিক এগিয়ে এসে তাকিয়ে থাকল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। তারপর নীলের কাছে জানতে চাইল, সে কি পাকিস্তান থেকে এখানে এসেছে?
পাকিস্তানের কথা শুনেই কি না জানিনা নীলের খেয়াল হল যে শার্টটা সে পরে আছে এখন, তার রঙ গাঢ় সবুজ। খুব বেশি সাহায্য অবশ্য পাওয়া গেল না, কিন্তু লোকটা যে তাকে দেখে একথা জানতে চাইল এই ভেবে তার বেশ মজা লাগলো। লোকটার আদি বাড়ি লাহোরে, এখানে একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করে। তার সাথে কথায় কথায় নীল বুঝতে পারল এখানের বিভিন্ন মধ্য প্রাচ্য খাবারের দোকানগুলো আসলে চালায় উপমহাদেশের লোকেরাই, মূলত তাদের দুই প্রতিবেশী দেশের, পূবে আর পশ্চিমে। প্রথমদিন এরকম একটা দোকানে ঢুকে শাহরুখ খানের কোন একটা সিনেমার গান বাজছে শুনে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল, এখন তা বুঝতে পারল কেন। সে যে ভারতীয় তা শুনে লোকটার মুখে খুব একটা বিরূপ ভাব কিছু দেখা গেলনা, সেটা দেখে একরকম স্বস্তিই হল তার। তবে খুব যে সাহায্য করতে পারল সে তা নয়। পিয়াজ্জা গ্যারিবল্ডির নাম শোনেনি লোকটা। তাহলে কি নীল অনেকটা দূরে এসে পড়েছে? ফোন অচল হওয়ার দরুন এলোমেলো রাস্তায় কতক্ষন ধরে সে হাঁটছে তার ঠিক হিসেব নেই। চলে যাওয়ার আগে লোকটা বলে গেল, যদি নেহাতই ফেরার রাস্তা খুঁজে না পাও, দুটো বাঁক পরে ডান হাতে একটা মসজিদ পাবে। রাতটুকু সেখানে আশ্রয় চাইলে না করবেনা কেউ।
তার দূরতর প্রতিবেশীর অপস্রিয়মাণ ছায়াখানি দেখতে দেখতে অবশ্য তার মনে হল, আরেকটু খুঁজে সে দেখতেই পারে। আর তাছাড়া আজকের রাতটাও যেন এখনো অবধি বেশ অন্যরকম। কে জানে যদি আরও নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হয়ে যায় তার। পকেটে পাসপোর্ট বা তেমন কোন পয়সা কড়ি নেই, আর তার পরনের জামাকাপড় ও খুব সাধারণ, তো আশা করা যায় চোর বাটপাড় আদৌ কেউ থাকলে দয়াপরবশ তাকে উপেক্ষা করে যাবে নিশ্চয়ই। মাথার ভেতর এইসব অদ্ভুত যুক্তি সাজাতে সাজাতে, মসজিদখানি পেছনে ফেলে সে এগিয়ে গেল। সামনের স্কোয়ারটার দিকে একটা ছোট জটলা মতন দেখা যাচ্ছে। অল্পবয়েসি কয়েকটা ছেলে, খুব সম্ভবত এখনো স্কুল পেরিয়ে কলেজে ওঠেনি। তিন চারজন একে অপরকে ঘিরে নাচের ভঙ্গিমায় প্রদক্ষিন করছে। আরেকটু কাছে যেতে নীল বুঝতে পারল, ছেলেগুলোর অবস্থাও অবশ্য তারই মতন, কিংবা তুলনামূলক ভাবে আরেকটু তূরীয় হয়ে আছে। তার গন্তব্যের দিকনির্দেশ তাদের কাছে জানতে চাওয়ায় জড়ানো ইতালিয়ানে তারা যা বললে সেটা আর যাইহোক কোন রাস্তার ঠিকানা যে নয়, তা সে দিব্যি বুঝতে পারল। সে চলে আসতে যাবে এমন সময় দেখল, সাপের ছোবলের ভঙ্গিমায় শাদাটে বাহুগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে তিনজন তিনদিকে দিক নির্দেশ করছে তাকে। তাদের চোখ আধবোজা, মুখে মৃদু আমুদে হাসি। যেন হঠাৎ দেখলে কোন আঞ্চলিক উপদেবতার চটুল মূর্তি বলে ভুল হতে পারে। রাতের বাকিটুকু তাদের ভালো কাটুক, এই বলে পাশ কাটিয়ে সে অন্য পথ ধরল।
কতক্ষণ হাঁটছে সে? ঘণ্টা দেড়েক সম্ভবত হবে। গ্যাসবাতির আলোয় শহরটার নিত্যনতুন চেহারা ক্রমাগত আবিষ্কার করার নেশায় এতক্ষন তার সময়ের হুঁশ ছিলনা। তার আবারও মনে পড়ল গোধূলির পড়ন্ত আলোয় সেই প্রাচীন অ্যান্টিকশপে নিষ্প্রাণ বেড়ালগুলোর আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখ। সম্ভবত সূর্যাস্ত হয়েছিল সেই সময়। সেই হিসেবে বেশ অনেকক্ষণ হাঁটছে সে। লোভারিয়া, জিউসেপ্পে ভের্দি ইত্যাদি অপরিচিত রাস্তার নামগুলো ইতস্তত চোখে পড়েছে আসার পথে। কিন্তু সম্ভবত সে অন্য কোথাও একটা চলে এসেছে এইবার, যেখান থেকে সে শুরু করেছিল সেখান থেকে অন্য কোথাও। অন্য কোনোখানে। পায়ের নিচের রাস্তাটা আর ঠিক আগের মত চওড়া, কিংবা মসৃণ সমতল নয়, ক্রমশ সরু হয়ে সামনে এখন বেশ খানিকটা চড়াই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, আবছা অন্ধকারে একটা বহু প্রাচীন উন্মুক্ত প্রবেশদ্বার, যেন তাকে ইশারায় ফিসফিস করে বলছে, উঠে আয়, উঠে আয়। একটা ঘোরের ভেতর সে এগিয়ে গেল। তার পায়ের নিচে বহু পুরাতন টুকরো পাথর, খোয়া বেছানো পথ এরকম রাস্তার ওপর ঘোড়া চলে গেলে সম্ভবত শোনা যাবে বহুদূর থেকে । যেত ও কি তাই? আরও কয়েক শতাব্দী আগে। উন্মুক্ত তোরণখানির ইঙ্গিত স্বীকার করে নীল এইবার তার ভেতরে প্রবেশ করলে। জনমানবশূন্য এই রাতে তা এখনও কেন খোলা, এরকম কোন প্রশ্ন তার মাথায় এল না।
‘রক্তিম চন্দ্রালোকে তাহাদের মুখ’। রচয়িতা কাজী আল মাজনুন শেখের এই বইটি ১৯৬১ সালে প্রকাশ পাওয়ার পর পরই নাকি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রকাশ্যে উপলব্ধ প্রায় সবকটি কপি তৎক্ষণাৎ বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। এবং পুড়িয়ে ফেলে তারপর। কী লেখা ছিল সেই বইয়ে যা পড়ে অত বিচলিত হয়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার তা আজ আর জানার কোন উপায় নেই। শুধু তার নামটুকু আছে । রয়ে গেছে স্মৃতি হিসেবে। ‘রক্তিম চন্দ্রালোকে তাহাদের মুখ’ । শতকরা আটানব্বই ভাগ নিশ্চিত করে বলা যায়, এই নামে আসলে কোন বই নেই। অথবা ওই নামে আদতে কখনো কোন লেখক ছিলেননা কেউ। তবু গতবছর একটি উপন্যাসে* বইটির নাম খুঁজে পেয়ে নীলের মনে হয়েছিল বাস্তবে সত্যি থাকলে মন্দ হতনা এরকম একটা বই। কল্পিত বইটার সম্ভাব্য বিষয়বস্তু নিয়ে ভেবেছিল বেশ কয়েকদিন। বেশ কয়েকবার। এবং ঠিক এই মুহূর্তে সেইসব কথা মাথার ভেতর ভিড় করে এল তার। আবার।
|
হুন রাজ আতিলা, তাঁর সৈন্যদের মাটি ও ধাতুসর্বস্ব এই শৃঙ্গ নির্মাণ করতে আদেশ করেছিলেন যাতে রোমান সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট শহর আক্যুলিয়ার পতন তিনি দেখতে পারেন এইখানে বসে। শতাব্দী প্রাচীন একটা গোটা শহর পুড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, এই মানবনির্মিত উচ্চতায় বসে সেই জ্বলন্ত দৃশ্য একমনে উপভোগ করছেন বিবিক্ত আতিলা। টিলা ও তাঁর সংলগ্ন কেল্লার মাথা থেকে নেমে আসার পূর্বে, সেই চাঁদনি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে এই চিত্র খানিক কল্পনা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করলে সে। তার অভিবাসী রক্তে সেই সর্বগ্রাসী খিদের যে কণামাত্র নেই এই ভেবে হয়তো সে নিশ্চিন্ত হয় নেমে আসার আগে। তারপর শিরস্ত্রাণ গাঁথা ওই উঁচুনিচু পাথুরে পথ, পাণ্ডুর চন্দ্রালোকে কেল্লার আকাশে নির্জন সোনালি পরী, তার অন্তরালের সারি সারি দেওয়াল, অপেক্ষারত ধাতব প্রহরী ও রণক্লান্ত হারকইউলিসের প্রচ্ছায়াকে সে আরেকবার ঝুঁকে পড়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। উদিনের রূপ সে দেখিয়াছে।
এতদূর বলতে যতক্ষণ লাগলো, তার ফিরে যাওয়ার গল্প প্রত্যাশিত ভাবেই এর চেয়ে বহুগুণে সংক্ষিপ্ত। আন্দাজমতন রাস্তা দিয়ে ফিরে যেতে যেতে নীল দেখেছিল এই মধ্যরাতে নিঃসঙ্গ এক বৃদ্ধা রাস্তা পার করার চেষ্টা করছেন। কোথায় যাবেন তিনি, এত রাতে কেনই বা বেরিয়েছেন রাস্তায় তার উত্তর মেলেনা। পারাপারটুকু নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে যেটুকু সামান্য সাহায্য, বয়সের ভারে বহুকুঞ্চিত তাঁর বাহু ধরে নীল তা করে দিলে ইতালিয়ান ও ভাঙা ইংলিশের মিশ্র বাচনভঙ্গিমায় তিনি অনেকবার ধন্যবাদ জানান। হাত তুলে বলেন ওইদিকে হাঁটলেই পিয়াজ্জা গ্যারিবল্ডি, সামনের জেলাটোর দোকান থেকে ডানদিকে। সদ্যজ্ঞাত জেলাটোর শীতল ও পিচ্ছিল স্বাদ মুখের ভেতর রোমন্থন করতে করতে সে অবশেষে পৌঁছে যায় ইপ্সিত লক্ষ্যে। নিঃশব্দে ঘরে ফিরে দেখে ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় একটা। মিডনাইট ইন উদিনে! এই রাতের লব্ধ শব্দ ও চিত্রকল্পগুলো আনাগোনা করে আধোঘুমের ভেতর।
এই নশ্বর জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনার উপযুক্ত উপসংহার লাভের সৌভাগ্য সবসময় আমাদের জোটে না। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের মত মনে হয়েছিল তার। দিনের জোরালো আলোয় গতরাতের সেই জাদুবাস্তবতার জেরটুকু ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে আনন্দের চেয়ে তার আফসোস হয়েছিল বেশি। ইশ, যদি অন্তত একটাও ছবি তুলে সে রাখতে পারতে। কেউ বিশ্বাস করবে তাকে আদৌ? কনফারেন্সের শেষদিনে তার সদ্য হয়ে ওঠা বন্ধু, ক্রোয়েশিয়ার মেয়ে লানা বলল উইকেন্ডে শুনেছি এখানে একটা হাট বসে। আমরা যাব ভাবছি। তুমি যাবে? উদগ্রীব চাহনিতে চারপাশে তাকাতে তাকাতে সে তাদের সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল। টাউনস্কোয়ারের সেই সপ্তাহান্তের হাটে অনেক কিছু বসেছিল, চোখ বুজলে এখনো নিশ্চয়ই তার অনেকখানি মনে থাকবে তার। তবু মনে আছে, এক বৃদ্ধ কাফ্রির তাঁবুর ভেতর এগিয়ে গিয়েছিল সে। দূরতর প্রেমিকার কথা ভেবে কিনেছিল, কালো পাথরের ওপর বসান একটুকরো আইভরির পাতের একটা আংটি। ‘এসব কিন্তু তুমি ভেনিসে আরও ভালো পাবে’, লানা বলছিল তাকে। কিন্তু তবু সে কিনল। হয়তো যাতে ওই হাট এবং ঢিলে জোব্বা পরিহিত ওই কাফ্রি বিক্রেতার মুখাবয়ব তার স্মরণে থাকে আরও অনেকদিন। হাট থেকে বেরিয়ে আসার পথে লানা, তাদের পথের সঙ্গী নিক, ড্যানিয়েলরা আঙুল তুলে বলল ‘ওই দেখো উদিনে ক্যাসল। সামনে হারকিউলিসের মূর্তি ! নীল তুমি নিশ্চয়ই হারকিউলিসের গল্প জানো’ … এগিয়ে যাওয়া ভিড়টার থেকে এইবার ধীরে ধীরে নিজেকে আলাদা করে নেয় সে। রোমানরা মূর্তির চোখের মণি খোদাই করতো না, বরং তা রঙতুলি দিয়ে আঁকতো তার ওপর। কালের নিয়মে তা ক্রমে ক্রমে বিবর্ণ হলে আজ মনে হয় যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আজ মূর্তিগুলো নিষ্পলক। দিনের আলোয় মণিহীন চোখের হারকিউলিস ও কেকাস, কেল্লার চূড়ায় সোনালী ধাতব পরীটির দিকে তাকিয়ে নীল একমনে যেন কিছু খোঁজে। কিছুই ঘটেনা কোথাও, তবু দূরগামী বাতাস এই অতীতচারী কেল্লার অলিগলির ভেতর বয়ে যেতে যেতে যেন কোথাও আবার সেই পরিচিত, পাথরের ওপর ভারী পোশাকের ঘসটানির খসখস শব্দ হয়। দৃষ্টিকোণের আড়ালে কেউ আবারও হারিয়ে যেতে যেতে যেন শেষবারের মতো জানতে চায়, মনে আছে? মনে থাকবে তো?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন