নো-এণ্ট্রি
বাণীব্রত কুন্ডু
মোহরকুঞ্জ থেকে বেরিয়ে এলো আবির। হালকা সবুজ রঙের খাদির পাঞ্জাবি গায়ে, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। ডান হাতে একটা আর্ট-পেপার গোল করে পাকানো। রাস্তার ডানদিকের ফুটপাত ধরে এলোমেলো পায়ে হেঁটে চলেছে। কোথায় যাবে! আকাশেও ছাড়া ছাড়া মেঘ ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টিও হয়েছে দু-এক পশলা। একটু ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে শহরের বুক জুড়ে। অন্যদিনের থেকে একটু আগেই যেন আজ সন্ধে নেমেছে। বড়ো বড়ো রাস্তাগুলোকে ঘিরে যত আলোর উন্মাদনা। দামি দামি পণ্যদ্রব্যের সমস্ত হোর্ডিং জ্বলে উঠেছে অলৌকিক মায়ামন্ত্র নিয়ে। মিষ্টি এক সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে আবহময়। অযুত গাড়ি তাদের সতর্ক-চোখ জ্বালিয়ে আলোমিছিলের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার মোড়মাথায় দাঁড়ীয়ে থাকা কালো কালো সিগ্নাল পোষ্টের লাল আলো জ্বলে ওঠার মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল সমস্ত গতি...
#
ফ্লাইওভারের নিচে জেব্রায় রাস্তা পার হয় আবির। রেলিং বরাবর হাঁটতে থাকে। বৃষ্টির ঝাপটায় চশমার কাঁচটা বারবারই ঝাপসা হয়ে উঠছে আর আবিরও পাঞ্জাবির কোণায় তা মুছে নিচ্ছে। নন্দনের সামনে গেট দিয়ে ঢুকে বাংলা আকাদেমির দিকে যেতেযেতে আবির খেয়াল করল যে আজ তার কিছুটা পাগলামোয় পেয়েছে। আকাদেমি চত্বরে আসার কোনো কারণ নেই তবুও যেন কীসের তাড়নায় কিংবা অভ্যাসেই এই পথে চলে এসেছে আজ। যাইহোক, এসে যখন পড়েইছে তখন তো একটু কফি খাওয়া যেতেই পারে...
#
বৃষ্টির সন্ধ্যায় গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবির দেখতে পেল দু-জোড়া পা যেন তারই দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতেই আবির তো থ! প্রায় আটবছর হয়ে গেল কলেজ ছাড়ার। এতদিন পরেও কলেজের সেই সব থেকে নামজাদা ছেলেটা যে তাকে দেখে চিনতে পারবে – তা তো আশ্চর্য়েরই কথা। রাজদীপ স্মার্টলি এসে আবিরের কাঁধে এক চাপ্পড় দিয়ে বলল,
- হাই! অর্চি, আই মিন আবির। কেমন আছিস ? কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হল বল তো!
- হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু তুই এখানে ?
- আরে বলিস না! ও হ্যাঁ তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই – আমার মিসেস্, পৌলমি।
বাঙালির রক্ষণশীলতাকে অক্ষুন্ন রাখতে চেয়ে অপরিচিতের ভঙ্গিতে দু-হাত জোড় করে নমস্কার করতে গেলেও পৌলমী হ্যান্ডসেক্ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে আবির হাত মেলালো। আর সেই সুযোগে সদন চত্বরের কোনো এক অবুঝ ঝুঁকে পড়া আলোতে পৌলমীর ঈষৎ হাস্যমাখা মুখটা দেখে নিল আর এক ঝলক।
#
কফির কাপটা হাতে ধরেই আবির বলল,- কফি খাবি তো! চল। নন্দনমেলায় গিয়ে আরো দুটো কফির অর্ডার দিল। অস্ত যাওয়া সূর্য়ের মোহ আলোয় দাঁড়িয়ে জমে উঠেছিল কথারা। রাজদীপ বলল,
- হ্যাঁরে অর্চি! তুই আমাদের সঙ্গেই চল না! গড়িয়াহাটে ড্রপ করে দেব। আছিস তো ওখানেই ?
- হ্যাঁ আছি। কিন্তু আজ ওখানে ফিরব না, একটু শ্যামবাজার যাব।
অস্ফুটে পৌলমিও উচ্চারণ করল- শ্যামবাজার!
পাঁচবছর আগে এইসব অঞ্চলই তো ছিল পৌলমির জীবনযাপন। কত অলিগলি নিশ্চিন্তে আবিরের হাত ধরে ঘুরে বেড়িয়েছে, কত বায়ানাক্কা করেছে, ফুচকা খেয়েছে, ঝালমুড়ি খেয়েছে। ইউনিভার্সিটির ক্লাস কেটেও দুজনে সময় কাটিয়েছে কত। আজ পৌলমি একজন সুখিগৃহিণী হলেও জীবনের প্রথম প্রেম কী ভুলতে পারে! তাই সারাক্ষণ হয়তো উৎকন্ঠায় ভরে আছে পৌলমির মন, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। শুধু চাহনি দিয়েই যেন আজও আবিরকে আকর্ষণ করতে চাইছে, মনে করাতে চাইছে, সেই পাঁচবছর আগেকার কথা। যা আজ রূপকথা!
#
তিনজনে গল্প করতে করতে গেটের দিকে এগিয়ে এল। পার্কিং জোনে দাঁড় করানো কালো রঙের স্করপিওটায় উঠে পাশের জানালার কাচদুটো নামিয়ে রাজ বলল,- ঠিক আছে! পরে দেখা হবে বস্। গুডনাইট! পৌলমীও শুভরাত্রির শুভেচ্ছা জানিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে গাড়ির আয়নায় নজরবন্দী করল ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া আবিরকে। এখনও আয়নায় তার চেয়ে থাকার ছবি স্পষ্ট। রাজ পৌলমীকে নিয়ে মিশে গেল শহরের ভিড়ে। আবিরও পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল মেট্রোর দিকে...
#
যখন শ্যামবাজার মেট্রো থেকে বেরিয়ে এলো মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। রাক্ষুসে হ্যালোজেনগুলো যেন জলের আদরে জ্যোৎস্না হয়ে উঠেছে। কখনো তির্যক কখনো বা এলোমেলো ফিচেল হাওয়ার পাল্লায় পড়ে দূরপাল্লার বৃষ্টিরেখাগুলো গন্তব্যে এসেও যেন পথ হারাচ্ছে। রাস্তার ধারে ধারে জল জমতে শুরু করেছে। ফেরারি মানুষগুলোকে নিয়ে বাস ট্যাক্সি বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে চলেছে নির্ভরযোগ্য আস্তানার উদ্দেশে...
#
বৃষ্টি অনেকটাই কমে এসেছে। আবির রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে চলল মণীন্দ্রকলেজের দিকটায়। অন্যান্যদিন এরকম সময়ে ফুটপাতের ধারে ধারে দিনান্তের পরিশ্রান্ত মানুষগুলোর আড্ডা জমে যেত হ্যালোজেনের হলুদে। পাখিরাও আজ বেসামাল। কোনোরকমে নিজেদের বাঁচিয়ে নিচ্ছে বড়ো বড়ো বাড়ির ঘুলঘুলিতে, কার্ণিশে কিংবা এ.সি মেশিনের নীচে। হাঁটতে হাঁটতে রাজবল্লভপাড়ার মোড়টায় এসে যেন থমকে দাঁড়াল আবির! কি দেখছে! পাঁচবছর আগেরই তো সেই দৃশ্য- একটি ছেলে, একটি মেয়ে, একটা ছাতা, কিছু খুনসুটি, কিছু দুষ্টুমি আর একটা নির্ভরযোগ্য আস্তানা! মানে...! মানে, একটু শিউলি ঝরা ভোর, একটু ধূ ধূ করা দুপুর, একটু মন খারাপ করা বিকেল, তারপর একটু মেঘের ঝিলিক, আর অনেকখানি আদরমাখা রাত! এইতো চেয়েছিল পমি। কিন্তু এমনি বেগতিক জীবন কেটেছে তখন যে...! তিন তিনটে বছর ধরেও আবির খুঁজে দিতে পারেনি এমন এক আস্তানা। অথচ দিনের পর দিন পমির হাত ধরে আবির খুঁজে গেছে একটা ঘর। দিনের শেষে যেখানে ফিরে সে খুঁজে নেবে তার বনলতাকে, অনুভবে থাকবে এক আশ্চর্য প্রশান্তি...
#
মাস্টার্সের পর চাকরি খুঁজে বেরাচ্ছে আবির। আর পমিও এম.এ-তে ভর্তি হয়ে গেল। তবু-তো ইউনিভার্সিটির ক্লাস কেটে আবিরের সঙ্গে দেখা করা যাবে! মাস কয়েকের মধ্যে আবির একটা কাজ পেয়েও গেল। পার্কস্ট্রিটের কাছে একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কে। কোনোদিন পমি চলে আসে এস্প্ল্যানেডে কোনোদিন আবার আবির অফিসে একটু ম্যানেজ করে সটান কলেজস্টিট। এইভাবে কলকাতার ছোটো বড়ো রেস্টুরেন্টে পরিযায়ী পাখির মতো প্রেম খুঁটে বেড়িয়েছে দুজনে। দেখতে দেখতে পমির ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা এগিয়ে এল। ইদানীং পমির সঙ্গে দেখা হচ্ছে না আবিরের। যদিও এই সিদ্ধান্ত দুজনের। তাই এই সময়টা আবিরও কাজে লাগিয়ে নিতে চায় পুরোদমে।
#
পমির পরীক্ষা আজ হলেই শেষ। সকাল থেকেই আবির অপেক্ষায় আছে কখন বিকেল আসবে! নিশ্চই পমিই আগে ফোন করবে... কিন্তু নাহ্! সন্ধে হয়ে গেল, এখনো তো কই ও ফোন করল না! অফিসের নম্বর তো ও জানে, তাহলে! আর অপেক্ষা করতে পারছে না আবির। ওই রিসিভার ওঠালো। নম্বর ডায়াল করল। পমির বাড়ি...
- ট্রিং... ট্রিং... ট্রিং... ট্রিং... ট্রিং...
- হ্যালো? হ্যালো?
- হ্যাঁ! কে মাসিমা বলছেন? আমি আবির বলছি। আপনি ভালো আছেন তো?
- হ্যাঁ বাবা ভালো আছি। তুমি ভালো তো?
- হ্যাঁ মাসিমা। পমি কি বাড়িতে আছে?
- না তো বাবা। ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে। এই তো অষ্টমঙ্গলার পরই ওরা অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। ওখানে এক কোম্পানিতে...
- ও আচ্ছা, আচ্ছা... হ্যাঁ... ঠিক আছে...
কোনো কথাই আর কানে ঢুকছে না আবিরের। রিসিভার নামিয়ে রাখে।
#
তারপর প্রায় স্বপ্নাবিষ্টের মতোই স্বপ্নভঙ্গের মুহূর্তকে আঁকড়ে ধরে পথে নামে। হাঁটতে হাঁটতে কলেজস্ট্রিট, শ্যামবাজার, রাজবল্লভপাড়া, রাস্তার মাঝে দঁড়িয়ে থাকা গিরীশ ঘোষের বাড়ি ছাড়িয়ে সোজা গিয়ে উদ্বোধন, বাঁ-দিকে মায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে বাগবাজার ঘাট। যেখানে আবিরের সব অশান্তির শান্তি মেলে। চিত্কার করে কান্নায় ভেঙে পড়তে চাইলেও পারছে না। দুহাতে মুখ চেপে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে, অঝোরে! আবিরের কান্নার জল মিশে বিষন্নতায় ঢেকেছে রাত্রির গঙ্গা। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে দুচোখের পাতা এক হয়েছে খেয়াল নেই। ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে আবির দেখে মন্দির চত্বরেই শুয়ে আছে সে! দু একজন স্নানার্থীর যাতায়াত শুরু হয়েছে। বুক অবধি জলে দাঁড়িয়ে মোহমুদ্গর আওড়াচ্ছেন কোনো এক সন্মার্গচারী – ‘...কস্য ত্বং বা কুত আয়াতস্তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভ্রাত।’ আর তখনি জোয়ার এসে এক লহমায় তার ফেরারি মনটাকে পারঘাটে ফিরিয়ে এনেছিল, ভাসিয়ে নিয়েছিল বাকি সব...!
#
নিস্তব্ধতা ভাঙার শব্দে সম্বিতে ফিরি। দেখি, বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ! রাস্তায় এখন কেউ নেই। দুজন কনস্টবল গল্প করছে তাদের ডেরায়। কিছু কুকুর দলবেঁধে প্রহর ঘোষণায় ব্যস্ত। নগরবাসীকে সজাগ করছে। হয়তো আবিরকেও...! ব্যাগে রাখা আর্ট পেপারটা ভিজে গেছে। ভিজেছে খাদির পাঞ্জাবিটাও। ঝড়বৃষ্টিতে ভেঙে যাওয়া ঝুপড়ি সমেত পড়ে গিয়ে মারা গেছে গোটাকতক পক্ষীশাবক। তাদের মায়েরা কেঁদে যাচ্ছে মরমি সুরে। বৃষ্টি থামলেও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে বেশ! রাস্তার ওপরে উলটে পড়া নো-এণ্ট্রি স্টপারের খাঁজে আটকে আছে ছাতাটা! আর পতপত করে শব্দ করছে তার একদিকের ছিঁড়ে যাওয়া কাপড়...
(সমাপ্ত)
গল্পের রেশ বেশ সুন্দর। বাঁধন বেশ পোক্ত ভাবে গড়িয়েছে শেষ পর্যন্ত।সব মিলিয়ে ভাললাগা আর একটু মন্দ আবেশ ছুঁয়ে রয়ে গেল সুন্দর গল্প টি। সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর লাগল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ প্রলয়দা। আপনার মূল্যবান মন্তব্য আমার পাথেয়অস্বরূপ। ভালো থাকবেন।
মুছুনআমার অনবধানতাবশত একটি ভুল সংশোধন করছি -
উত্তরমুছুনপ্রিয় পাঠকবন্ধুগণ,-
উল্লিখিত এই - "নিস্তব্ধতা ভাঙার শব্দে সম্বিতে ফিরি। দেখি, বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ!"- অংশটি নিম্নোক্তরূপে পড়তে হবে...
"নিস্তব্ধতা ভাঙার শব্দে সম্বিতে ফেরে আবির। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ!"
ধন্যবাদান্তে- বাণীব্রত কুন্ডু।
ঠিক আছে। :)
মুছুনবেশ।
উত্তরমুছুনতবে প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি ছিল...... :) শুভেচ্ছা।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ অপরাজিতাদি!
মুছুনমায়াময় - ওই বৃষ্টিভেজা হ্যালোজেনের আলোর মতই। একটি মিষ্টি সংবেদনের কাহিনী।
উত্তরমুছুন