শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সুবীর ঘোষ




কবিতার মানসাঙ্ক

অনেকে জিজ্ঞেস করেন-কবিতা পড়ে কী হয় ? কবিতা কী কাজে লাগে ? এর উত্তরে একটি প্রতিপ্রশ্ন করা যায় - কবিতা কখনও কী কোনো কাজে লেগেছে ? মানুষ সাধারণত বোঝে যা ভোগ করা যায় তা-ই কাজে লাগে । কোনো চিত্তকলা তো ভোগের বস্তু নয় , তা উপভোগ করার জন্য , আর  উপভোগের বস্তু তখনই কাজে লাগে যখন ভোক্তা মনে করে এ থেকে সে আনন্দ পাচ্ছে । তার মানে ঐ আনন্দ পাওয়াটাই কাজ । সবার আনন্দ একই বস্তু থেকে আসবে এমন কথা নেই । কারওর আনন্দ চিত্রকলায় তো কারওর বা কবিতায় ।

কবিতা সেভাবে কোনো দিনই কারোর কাজে লাগেনি । আমরা নিজেদের দৈন্য ঢাকতে কবিতাকে আশ্রয় করেছি । যখন কাগজকলম ছিল না তখন ধর্মকথা বা মন্ত্র মনে রাখার জন্য ছন্দমিল ও সুরের সহায় নিতে হয়েছে । নইলে রামায়ণ মহাভারত তো নিছকই গল্পকথা । মুখের ভাষাতে বললেই তো হতোকবিতাকে অবলম্বন করা এ জন্য যে শ্রুতিসহজ হবে ব্যাপারটা এবং স্মরণযোগ্য হবে । তাও-তো অনেক মূলকথা পাল্টে গিয়ে প্রক্ষিপ্ত হয়ে গেছে । এমন কী এখনকার এত উন্নতির যুগেও মোবাইল কানে রেললাইন পেরুবেন না এই অনুশাসন মানুষকে বোঝাতে বলতে হয়একথাই শেষ কথা নয় তো ? অন্যভাবে যার মানে আমাদের প্রয়োজনে কবিতাকে কাজে লাগাচ্ছি । কবিতা কাউকে কিছু পাইয়ে দেবার জ্ন্য তৈরি হয় না ।

কালপ্রবাহের সাথে সাথে মানুষের ভাষা বদলাবে খাদ্যাভাস বদলাবে পোশাক বদলাবে আর কবিতার অবয়ব বদলাবে না এ কী হয় ! তখন বলা হত কবিতা এরকম হবে আর এখন বলা হয় কবিতা এরকম হবে না । কীরকম হবে না ?
--কবিতা ছন্দমিল অলঙ্কার এসব নিয়ে বেশি ভাববে না যেমন আজকের মেয়েরা উনিশ শতকের মেয়েদের মতো এক গা গয়না পরাটাকে জরুরি মনে করে না ।
--কবিতা স্কুলের রচনা নয় যে একটি বিশেষ বিষয়ের ওপর ঝাড়া লিখে যেতে হবে ।
-- কবিতা ফটোগ্রাফি নয় যে দৃশ্য দেখাতে হবে ।
-- কবিতা স্মৃতিকথা নয় যে জীবনের ঘটনা বলতে হবে ।
-- কবিতা গান নয় যে সুরেলা ভাবে শুনিয়ে সবার মন মাতাতে হবে ।
তাহলে কবিতার নিজের একটা স্বাধীন চারণভূমি থাকবে যেখানে সে ঘাসের মতো প্রসারণে বাড়বে যাকে বলে রাইজোমেটিক । ঘাসের সঙ্গে কিছু অঘাস বনফুল গুল্মও বাড়তে থাকে তাতে রাইজোমেটিক সংসারে কোনো বিরোধ হয় না এখনকার কবিতায় ওসেনোগ্রাফি মিশলেও তাতে কবিতার চরিত্রনাশ হয় না ।

কবিতা নিয়ে আমাদের মুসকিলের জায়গাটা হল আমরা কবিতায় যুক্তি খুঁজি কবিতার উচ্চারিত স্পন্দনের বৈধতা খুঁজি পরম্পরা খুঁজি   কবিতাকে আমরা ইতিহাস ভূগোলে মিলিয়ে দেখে নিতে চাই , ডিডাকটিভ লজিকের ছকে ফেলে যাচাই করে দেখতে যাই । এবং তখনই বৃহত্তম ভুলটি করে বসি । কোনো কবিতার নামনদীহলে  আমরা আশা করি নদীর বিবরণ পাবো । কিন্তু খেয়াল করি না যে প্রাকৃতিক কবিতা আর প্রাকৃত কবিতা আলাদা । প্রাকৃত কবিতা লোকসম্বন্ধিত । সংশ্লিষ্ট যুগের মানুষের যাপন ও মানসিকতা সে যুগের কবিতায় প্রতিফলন ও অতিফলন আনবে এটাই স্বাভাবিক । এখনকার নদীর কবিতা হতে পারে এমন
আমি নদীকে বলি
আমার ড্রইংরুমের ভেতর দিয়ে গিয়ে
জানলা দিয়ে বেরিয়ে যাও

কবিতা লেখার ইচ্ছে কী শুধুই কাগজের ওপর কালির আঁচড় ? নিরন্তন লিখনপ্রক্রিয়াই হলো জীবনের সবসেরা চলমান সজীবতা । সন্তানের আগে এক নারী থাকে ; ভাষাও তো নারীর শরীর, কে কাকে গমন করে ! খুলে যাওয়া অনর্থ গভীর আর একটু তোমায় পড়ি। রোমকূপে লিখে দাও মুগ্ধবোধ ।

কবিতা যেন  The Social Act Of A Solitary  Person তার কবিতাচারণ তাকে নিয়ে যায় তার সামাজিক সম্পাদনার পথে । নারীর ভালোবাসা  সাংকেতিকতায় কবিতার বিষয় ও বস্তুকে অতিক্রম করে ভাবমুখীনতায় উত্তরিত হয় ।

মানুষ কোথাও তার মানুষীকে ভালোবাসছে
এই কথা , নিঃশব্দ চেয়ারে বসে ভেবে নিতে পারি ।
কোথাও কীসের একটা যোগাযোগ আছে , নইলে এভাবে
আমরা কেঁপে উঠি কেন ?
                                  ( প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত )


অলংকরণ – মেঘ অদিতি

৩টি মন্তব্য: