শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অমলেন্দু চন্দ



কত কিছু কথা থাকে
কত কিছু কথা আছে।
কবে শুরু হয়েছিল প্রথম কথা বলা ? ঝিনুকের বুকে থাকা মুক্তোর মতো সব কথা।
কবে প্রথম শুরু হয়েছিল কিছু বলবার তাগিদ? মানুষ কবে প্রথম জেনেছিল ভাষায় ঢেলে আনতে পারলে প্রাণের রং ছবি হয়ে যায়? সেই আলটা মিরা’র কেভ ম্যান যে প্রথম হাতে তুলে নিয়েছিল রঙের রসদ – সে কি রঙিন পাথর গুঁড়ো করেছিল? না কি শক্ত পাথরের রঙিন টুকরোটা জলে ভিজিয়ে সোজা শক্ত হাতের লম্বা লম্বা আঙ্গুলের টান দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিল এক দঙ্গল মানুষের বর্শা হাতে গর্তে পড়ে থাকা হাতিটার অসহায় আত্মসমর্পণকে ঘিরে ঊর্ধ্ববাহু উল্লাস। কিংবা সেই দারুণ বাইসনের তীর বেঁধা প্রাণের উৎসর্জন । সে কবেকার কথা । আজওঁ সে ছবি কথা বলে।

সেই কবেকার কথা – তখন থাকতাম বিহারের একটা জায়েগায় - নাম বোকারো সেটা উনিশশো ঊনআশি সাল। সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি ইউনিভারসিটি তে যাই – এম এ পড়ছি এমন সময়ে একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল, পাশ করেছি জানলাম, গেলাম ইনটারভিউ দিতে – চাকরিটা হয়ে গেছে জানতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল আর তার পর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে চলে গেলাম সেই বোকারোতে । তখন থাকি পাটনাতে, সেটা ছিল রাজধানি –  কি বিরাট শহর । মনে আছে বোকারো স্টেশনে প্রথম দিন নেমে খুব দমে গেছিলাম – মাত্র দুটো প্লাটফর্ম তাও একটা তে ছোটো শেড আরেকটা একেবারে ন্যাড়া কোনো শেড নেই । কোথায় এলাম রে বাবা মনে হয়েছিল । স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম – বেশ কিছু অটো রিক্সা আর ট্রেকার - লোক যেতে পারে দশটা কিন্তু তোলে পনেরোটা তো তাই সই চড়লাম একটাতে স্টেশন থেকে রাস্তা বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়েগার মধ্যে দিয়ে গেছে দূরে দেখা যায় চন্দ্রকোণা থারমাল পাওয়ার স্টেশনের প্ল্যান্ট । ওটা এসিয়ার সবচেয়ে পুরনো থারমাল পাওয়ার স্টেশন,  তখনও জানি না কিন্তু খুব ইম্পেসিং লেগেছিল স্ট্রাকচারটা - উঁচু উঁচু চিমনি কনভেয়ার বেল্ট এর ঢাকা স্টেয়ারস সব কারখানাতে যেমন থাকে পরে অনেক কিছু জেনেছিলাম যেমন ওটা একটা নদীর ধারে যার নাম কোণার নদী । কোল-বেল্ট পুরো জায়েগাটা তাই কালো কালো ধুলো ভর্তি ওই তারই মধ্যে চলল ট্রেকার - কাঁধে পিঠে লোক নিয়েপেটে আমার মতো জনা বারো।
আজ চন্দ্রপুরা অনেক বদলে গেছে। ডি ভি সি’ র অনেক বড়ো প্রোজেক্ট এর মধ্যে চন্দ্রপুরা একটা ২০১৩ বা ১৪ তে ৭৫০ মেগা ওয়াট প্রোজেক্ট শেষ হওয়ার কথা । যখন  শুরু হয়েছিল স্বাধিনতার পরে কোলাবোরেশনে ছিল জার্মানি আর সোভিয়েত রাশিয়া । ঊনআশি তে তখনও তারা আছে। মনে আছে বোকারওতেও স্টিল প্লান্টে ছিল মুলত রাশিয়ান কোলাবোরেশন সেক্টর ফোরে ওদের ছিল বিশেষ কলোনি। বিশেষ সিকিউরিটি ওদের – মনে আছে গেট পেরতে হলে পারমিশণ লাগত. ত তাতে অবশ্য কোনোদিন অসুবিধে হয়নি।  কি কথাতে কি কথা ।
আসলে পিছন ফিরে তাকানো কথাটা একটা মিসনমার কেন একটু বলিপেছনের দিনগুলো তো একটা সরল রাস্তা জুড়ে পড়ে নেই – যে ফিরে তাকাব আর দেখতে পাবো । আমাদের স্মৃতিচারণ তো একধরণের মনময় অবস্থা যেন একটা প্রান্তরের মাঝে ঘোরাঘুরি। কোথাও তার ঝকঝকে আলো কোথাও আলো আন্ধারি কোথাও মেঘের ছায়া কোথাও বা আন্ধার – কাছে না গেলে বোঝা যাবে না কি আছে হেথায়আর আমাদের সেই ঘোরা ফেরা’র স্মৃতিময়তার যতি এবং গতি অনেকটা সেই অ্যামিবার নড়াচড়ার মতো – যেদিকে ইম্পালস সেদিকে একটা নাড়া বাড়িয়ে দেওয়া, ছুঁয়ে দেখার জন্য কি আছে সেথায়। ফলে গল্প কখনও সোজা গড়গড় করে এগোয় না। ইদিক উদিক ইতি উতি তার নড়াচড়া ।
চন্দ্রপুরার আশেপাশের জায়েগা গুলোর নাম ছিল বেশ মিষ্টি – মুনিডিহ, ভোজুডিহ, রেতিডিহ, পিপড়াডিহ, ঝর্ণাডিহ শাঁওতালিতে ডিহি কথাটার মানে টাঁড় বা পাহাড়ি জায়েগা । সবকটাই ইস্টার্ন কোলফিল্ডের কোল মাইন্স আর মুনিডিহ তো ইস্টার্ন কোলফিল্ডের ওয়ান অফ দি বেস্ট ওয়াশারি – মানে ভালো কয়লার মাইন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি’র নিয়ম অনুযায়ী সাজান থাকবার সেক্টর গুলোর ছিল ভারি সুন্দর নাম – আদি পল্লী, পশ্চিম পল্লী, সিমলা কলোনি কিম্বা নিমিয়ার মোড়। সিমলা কলোনির  দুর্গা পুজা হত ভারি দারুন গেছিও দেখতে আর ভোগ খেতে যখন পুজোয় থেকেছি।
তো আমি তো ট্রেকারে চেপে পৌঁছলাম বোকারও’র নয়া মোড় বলে একটা জায়েগাতে – পরে  সে জায়েগার নাম বদলে হয়েছে বিরসা চৌক – একটা বিরাট বড়ো বিরসা মুণ্ডার স্ট্যাচু তৈরি হয়েছে সেখানে – আর  তাই নাম তার মোতিঝিল – মানে বিরসা চৌক । মনে পড়ছে সেই বিরসা চৌকে মুণ্ডা’র মূর্তির পায়ের তলায় ফরাস পেতে ফি বছরে বার তিনেক কবিতার আসর বসতো – তখন আমি সেখানে পুরাতন বাসিন্দা হয়ে গেছি আর কবিতা টবিতাও পড়ি – মানে লিখে পড়ি। সে কবিতার আসরের আয়োজনের কর্ণধার বা হোতা ছিলেন নভেন্দু সেন । সে এক দারুণ ব্যক্তিত্ব – পাঁচ ফুট তিন-টিন ছিল বোধহয় – ছিল বলছি কারণ তিনি বিগত – ক্যান্সারে, অনেক শিল্পী’র এরক’ম হয়েছে জীবনীশক্তির অপচয় আর তার মাসুল গোনা।  বিরসা চকের ওই বিরসার মূর্তিটা ওর হাতে তৈরি
তো সেই নভেন্দু আয়োজন করাতেন সেই কবিতা পাঠের মঞ্চ’র  মনে আছে সেটা বোধহয় বছর পাঁচেকের পরের কথা মানে আমার বোকারো যাওয়ার – স্থির হল একটা ম্যাগাজিন বার করা হবে – সবাই নবীন তাই নাম হলো “কিশলয়”তো আমি হলাম তার এক এডিটর আরও অন্যান্যদের মধ্যে, আর একজন তাঁদের মধ্যে - নাম অলক পাল চৌধুরী – আমরা ডাকতাম অপাচৌ বলে – প্রচুর অপাচ্য কবিতা লিখত বলে দিয়েছিলাম সে নাম আমরা মানে আমি অমিত সৌভিক শিবাজি অনন্ত – সেও সাড়া দিত আম্লানবদনে । এমনি ছিল সেই সব সময়।

নভেন্দু ছিলেন আর্ট এর টিচার স্টিল সিটি’র স্কুল’এ। কোলকাতা আর্ট কলেজের গোল্ড মেডালিস্ট পেশায় অঙ্কনশিল্পী – আর নেশায় কবি নাট্যকার স্কাল্পচার কি নয়। কলকাতা শিল্পী  মহলের অলিন্দে ছিল তার যাতায়াত, শম্ভু মিত্র’র প্রিয়পাত্র ছিলেন। 
নিলাদ্রি বলেছিল - যারা আজ নেই তাদের সাথে কথা বলতে হলে উজান বেয়ে সময়ের উল্টো রাস্তায় হাঁটা দেওয়া ছাড়া ... সত্যি, কি অমোঘ। মাঝে মাঝেই মনের তারে নাড়ির টান - তখন উচাটন মন - যদি হতো যদি এমন হতো আমি সময়ের উজান পেছন পানে নয়, যদি সময়ের উল্টো দিক থেকে হাঁটতে হাঁটতে আজকের দিকে ফিরতাম, তাহলে ওই সব সময়ের কাছাকাছি হলে হাতের গেলাসটা নামিয়ে রেখেই বলতাম - চল শিবাজি আবার হারাই।

হয় না, সে আর হয় না। সময় একার নয়, একাকী তো নয়ই
সময় বহতা থাকে - আমি শুধু নেশাতুর ফিরে যাই সেই বাঁকে 

আমাদের মেসের একটা দারুণ বারান্দা ছিল। মেরে কেটে দুটো চেয়ার আর একটা টুল পাতা যেত আর দুরের মানে বারান্দার দরজা থেকে দুরের চেয়ারটাতে বসতে হলে বা বসা থেকে উঠে আসতে হলে অন্য জনকে বেশ সন্ত্রস্ত হতে হত, কারন প্রায় কোল ডিঙ্গিয়ে আসতে হত, এতটাই ফালি ছিল সেই একফালি বারান্দা।

তো সেই বারান্দায় আমি আর অচিন গরমকালের এক সন্ধ্যেয় বিয়ার নিয়ে বসেছি, কতই বা পেতাম তখন, তারি মাঝে একটু আধটু ওই সব মানে লাক্সারি আর কি। হলোঘরের অন্যপ্রান্তে জ্বলা একটা বাল্বের আলোয় বিরাট লম্বা ছায়া ফেলে নভেন্দু'দা হাজির। অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরের আকাশ। বারান্দায় দরজাতে পা রেখেই সামনে টুলে রাখা বিয়ারের বোতলটা হাতে নিতেই অচিন বলল ঢাল না ঢেলে নাও। বলেই একটু খিক খিক করল। অচিনের ওই খিক খিক টা খুব গায়ে জ্বালা ধরানর মতো, দেখি নভেন্দু'দা খুব গম্ভীর গলায় বোতলটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলছে - "আমি ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না - খেয়াল করি নি অচিনের সাথে গল্প করতে করতে যে ও বার দুএক ঢেলে বোতল টা খালি করে দিয়েছে। আমি ব্যস্ত হলাম নভেন্দু'দা কে আমার বোতলটা এগিয়ে দিতে, আর ঠিক তখনি অচিনের আর একটা গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো মন্তব্য - "কিন্তু ছুঁচোটার তো স্বর্গলাভ হতে পারতো, ওই হাতে মরে।।" 

ঠা ঠা করে হেসে ওঠা নভেন্দু'দার দরাজ স্বর - ছাদের দু একটা পায়রা ঝট পট করে জায়গা বদল করল। "শুয়ার বোতল শেষ করে দিয়ে এখন রস ঢালছ..."  দু একটা আরও অশ্রাব্য অশ্লীল কথা, তারপর আমার বোতলে চুমুক।

নভেন্দু সেন। কলকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র ছিল। পাশ টাস করে বিয়ের পর প্রয়োজনের তাগিদে স্টিল সিটির স্কুলে আর্ট এর টিচার । আমাদের আর আমাদের মতো অনেকের জীবনে লোকটা ছিল এক ঐশ্বরিক উপস্থিতি। না প্রভার দ্যূতিতে নয়, প্রাণের। ছোটো খাট লোকটার ছিল অদম্য প্রাণশক্তি, আর সেটা খরচাও করত চার হাতে। ও ছিল আমাদের স্বপ্ন কারিগর, ও না হলে আমাদের আড্ডা খুব সহজেই মিইয়ে যেত। 

আমরা প্রায়ই মধ্যরাতের শেষ যামে বোতল খালি হলে চার পাঁচজন - শিবাজি আমি অচিন দেবাশিস অলক - আমরা যেতাম ওকে ওঁর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতে, অনেক সময় হয়েছে ওঁর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডার মায়া কাটাতে পারছি না, আর তখন দোতলার জানলার ফাঁক দিয়ে একটা আওয়াজ আস - আড্ডা টা শেষ করে আসলে হতো না এখানে, এ বাড়ির আর সবাই কেউ কি ঘুমতে দেবে না তোমরা। ভদ্রমহিলা আসলে কী এক অদ্ভুত জীবনের চলার ছন্দে নভেন্দু'দার সব কিছুকেই মনে নিয়েছিলেন, নিছক মেনে নয়, আর তাই এতো অনাচারে অত্যাচারের পরেও আমরা কোনোদিন তাঁর কাছে ব্রাত্য হইনি।

নভেন্দু'দা মারা যাওয়ার পর তাঁর কাছে যেতে পারিনি, সাদা কাপ পরা তাকে দেখতে পারব না বলে। সাদা হয়ত উনি পরেন নি, কিন্তু নভেন্দু'দা ছাড়া উনি - সামনে যেতে পারিনি। ওঁর বড়ো মেয়ে ফোন করেছিল - কাকু আসবে না? বলেছিলাম - না রে পারব না...মেয়েটাও নভেন্দু'দার আর তাই অল্প হেসেছিল ফোনের ওপার থেকে - আচ্ছা।

ভেতরের যে বিশ্ব আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে আছে, কখনও কখনও তা এতো গুরুভার।  মন আঙিনাবানভাসি তীব্র  জোয়ারের টা ডুবে থাকা অন্তরীপ হাহাকার  রক্তের লবণে তোলে  শব্দের কল্লোল   দিকচিহ্নহীন  সেই  মা ভুমের অনিমা লঘিমা জুড়ে স্মৃতির সাফিনায় ভেসে ভেসে  ভেড়ার সোনালি লোম,  লুব্ধক নক্ষত্রের আলো  খোঁজা বুকের আঘ্রাণে মন পাখীর তোতা কাহিনী

[ ধারাবাহিক চলবে...]

অলংকরণ – মেঘ অদিতি

৪টি মন্তব্য: