শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

শৌনক দত্ত তনু




শৌ ন ক দ ত্ত ত নু

'পাহাড় তোমাকে কিছু বলতে ইচ্ছে করে
বিশেষত মনমরা বিকেলে
কী করো তুমি-কার কথা ভাবো
কে তোমার কান্নাকে প্রথম ঝরণা বলেছিলো?আমি?'
(
কথা,পাহাড়ের সঙ্গে)
এখন সকাল আমার রিংটোন বেজে উঠেছে..'আমার প্রানের পরে চলে গেল কে'..ঘুম ভেঙে কলটি নিলাম।
শুনেছো,কবি আপন মাহমুদ নেই!
চোখে তখনও ঘুম,নেই মানে?
আজ ভোরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে তিনি চলে গেছেন।
কেঁপে উঠলাম। কি যা তা কথাবার্তা। ফেসবুকে ঢুকে দেখলাম দুপুর মিত্রের লেখা। বিশ্বাস হলো না, কবি টোকন ঠাকুর কে কল দিলাম। টোকনদার গলায় জমাটকান্না, আমার তবু বিশ্বাস হচ্ছে না।

কবি আপন মাহমুদ কে আমি তার লেখায় চিনি।তিনি কবিতায় আমার যত আপন ব্যক্তিগতভাবে ততটাই অজানা,অচেনা! আমার তবে এত কষ্ট হচ্ছে কেন? আমি কেন কাঁদচ্ছি? কবির মৃত্যু বলে? নাকি একটি মানুষের মৃত্যুতে একটি মানুষের মানবিকশোক? আসলে উত্তরটা আমার জানা উত্তরটা জানতে পিছিয়ে যেতে হবে একটি রাত কিংবা মাসখানেক পিছনে।

আমি কবি রুক রুখসানা কে মেসেজ পাঠাই। কেন পাঠাই?কেন আমার বন্ধুটিকে আমারসাথে কাঁদতে বলি? মাস খানেক আগে আপন মাহমুদ ফেসবুকে বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতিনিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন যেখানে তিনি প্রকৃতিকে ধর্ষিতার সাথে এমনভাবে তুলনা করেছিলেন তুলনাটা ও দুটো বানান নিয়ে আমার আর রুকের দ্বিমত ছিল আপন মাহমুদ তার উত্তরে যা বলেছিলেন তাতে আমাদের একটু কষ্টই লেগেছিল তাই কি আমরা দুজন আজ কাঁদছি? নাকি অচেনা কবি গত বিকেলে ল্যান্ডফোন থেকে আমাকে অবাক করে দিয়ে কথা বলে গেলেন সেইজন্য এই কান্না?

কবি ও সাংবাদিক আপন মাহমুদ যথন তার প্রসঙ্গ বর্ষামঙ্গলে লেখেন 'ভাসতে না জানলে জাহাজ তো দূরের কথা একটা কাগজের নৌকাও হওয়া যায় না।' তখন আমার মনেপড়ে আপন মাহমুদের কবি আপন মাহমুদ হয়ে ওঠার পেছনের সেই ফ্লাইং কিস বা কবির ভাষায় হাওয়াইচুমুর কথা।এই হাওয়াই চুমুটা তাড়িয়ে না বেরালে কি আপন কবি হতেন না? হয়তো হতেন হয়তো হতেন না! কিন্তু বিজ্ঞানকে যদি ডেকে আনি নিউটনের সুত্রে যদি বলি তবে বলতেই হবে ঐ হাওয়াই চুমুটাই আপন কে করেছিল কবি।

হাওয়াই চুমুর কবি কি তাই চুমুর টানেই হাত বাড়িয়ে উড়ে গেলেন হাওয়ায়? জীবনের এত বড়ো অংকের সমাধান কবির লেখাতেই পেয়ে যাই' কোনো কোনো গান অংক পরীক্ষার চেয়েও ছোট ছিল-কোনো গান ছিল কচুপাতার পানি-'কবি আপন মাহমুদ তো তাইই আজ কচুপাতার পানির মতো গান,কিংবা পরীবাগ বস্তিতে পাঁচশত টাকায় একরুমেথাকা পাঁচজনের একজন যিনি কাঠের মেঝেতে শুয়ে কোনো এক ফেব্রুয়ারির রাতে ১৯৯৫এর হাওয়াই চুমুর প্রজাপতি ২০০৫এ উড়িয়ে লিখে ফেললেন
'মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে
শুনেছি,সেই হাওয়াইচুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো
পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি...'
১৯৯৫ থেকে ২০০৫ কবি আপন মাহমুদ কি লিখতে চাননি? চেয়েছেন তার ভাষ্যতেই পাই'১৯৯৫সালের পর প্রায় নয় বছর ওই চুমুটাকে নিয়ে কতবার কত কি লিখতে চেয়েছি, হয়নি!কতভাবে যে চুমুটাকে আমি ধরতে  চেয়েছি,পারিনি।ওই সময় যে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখিনি তা নয়।'কথাটিতেই কেমন একটা আকুলতা এত লিখছেন তবু যেন কিছুই লিখছেন না তিনি। কি বিস্ময়!কি ছিলো সেই হাওয়াই চুমুতে?সেই গল্পে যাবার আগে আপন মাহমুদের আরেকটি ভাষ্য মনে পড়ে।' সেই প্রভাবশালী বিকাল থেকেই আমাকে পাহারা দিয়ে আসচ্ছে একটি হাওয়াইচুমু।'

'
হাওয়াইচুমু' গল্পটা সরমা নদীর ছাতকে।সময়কাল সেই১৯৯৫এর মার্চ অথবা এপ্রিল।কবি আপন মাহমুদ ছাতকের অধুনালুপ্ত পাল্প এন্ড পেপার মিলসের আবাসিক এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছেন।একজন নারী চোখের জল মুছতে মুছতে যে কবিকে বলেছিলেনঃকেন যে আমি মুসলমান হলাম না, কেন যে তুমি হিন্দু হলে না। তাহলেই তো..
কবি আপন সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন তার ভাষায় শুনি'থাক সে,আমি ছেড়ে আসছিলাম সরমাকে(নদী),সুরের মাকে।আসতেই হয়েছে,যদিও পেছনে আলতারাঙা-পা,নুপুর..সব।আলতারাঙা-পা,নুপূর মানে নবম শ্রেণী।নবম শ্রেণী মানে ক্ল্যাসিকনৃত্য।ক্ল্যাসিকনৃত্য মানে বুকের ওপর পা,এবং পা।আসতেই হয়েছে আমাকে,মামাদের সিঁড়ি ভেঙে সামনের খেলার মাঠসংলগ্ন রাস্তায় চলে এসেছি আমি,পেছনে একটা জানালার রক্ষণশীল পর্দা তুলে দাঁড়ানো একজোড়া ভেজা চোখ,কাঁপা ঠোঁট।পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একজোড়া ক্রন্দনকাঁপা ঠোঁট গলিয়ে জন্ম নেওয়া একটা চুমু(হাওয়াইচুমু)যার ঠিকানা আপন মাহমুদ।আর তখনই,ঠিক তখনই মহাজাগতিক হাহাকারের সঙ্গে যুক্ত হলো একটি দীর্ঘশ্বাস।'

'কী হবে রঙের কথা বলে-রঙের যাদুকর প্রজাপতি-সেও জানে না কতটা বিভ্রান্তি নিয়ে তার ওড়াউড়ি!'(লালবাতির বায়োগ্রাফি)আপন মাহমুদের বিভ্রান্তি,বেঁচে থাকা,হয়ত নিজেও জানতেন না কিংবা জানলেও কবিতাতেই তা বলেছেন।বিভিন্ন দৈনিক ওলিটিল ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া একশত সাতটি কবিতা নিয়ে কবি আপন মাহমুদ কে বই আকারে পাওয়া যায় ২০১১তে তার প্রথমকাব্যগ্রন্থ সকালের দাঁড়ি কমা বইয়ে।

মা ও প্রজাপতি সিরিজের ১০টি কবিতা এবং বাকী কবিতা থেকে নেন ৩৪টি কবিতা মোট ৪৪টা কবিতা নিয়ে প্রকাশিত কবি আপন মাহমুদের সকালের দাঁড়ি কমা। যদিও কবির আক্ষেপ তার লেখালেখির শুরুর প্রথম নয় বছর যা লিখেছেন তা থেকে একটা কবিতাও তার প্রথম বইয়ে জায়গা করে দিতে পারেননি তিনি। আর তাই তার নিজেকে খুবই নিষ্ঠুর মনে হয়।

কি লিখেছেন কবি সকালের দাঁড়ি কমা বইটিতে?
বাংলা কবিতায় মায়ের উপস্থিতি প্রবল এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই মাতৃত্ববোধের মধ্যে স্বদেশ কে খোঁজার ছায়াপাত দেখা যায়।আপন মাহমুদ এখানে ভিন্ন 'মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া' শিরোনামের দশটি কবিতায় একই মায়ের অনুভব ও অবয়ব কে আলাদা আলাদা রূপকল্পে বিনির্মাণ করেছেন। সংসারজীবনের সঙ সেজে একজন মা কে যেসব বিচিত্র প্রতিকুল সময় কাটায় সেইসব বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি মা কে একেঁছেন এতে পৃথিবীর সব মায়েরই ছায়াপাত ঘটেছে। কবি মা’র আনন্দ বেদনার ছবি একেঁছেন। তাই কবি তার মা কে বলেন 'জীবনের যত কফ-থুথু আর উড়াল হারানোর বেদনা আমি জমা রেখেছি এই ঘাসফুলের কাছে,এমন কি প্রসব বেদনাও।'এই কবিই আবার অমোঘ উচ্চারণ করেন' যারা হারতে হারতে হারতে ভুলে গেছে-তাদের  সবার উচ্চতাই সমান।'কিংবা'মায়ের মুখ মনে এলে নিজেকে রক্ষকশূন্য গোলবার মনে হয়।'

বারবার শৈশবের মাঠে ঘাটে ঘুরে বেরানো কবি,অনেক নারীর সঙ্গে তার সম্পর্কের স্মৃতিচারণে কিংবা ছাত্রজীবনের পাঠ এবং প্রেমের অপূর্ণতার ছবি একেঁছেন সকালের দাঁড়ি কমায়। নারী ও নদীর তুলনা ঘুরে ফিরে এসেছে তার কবিতায় তাই হয়ত তিনি লিখে ফেলেন'এক একজন নারীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া মানে এক একটা অচেনা নদীরদেখা পাওয়া-এক একটা নারীর চলে যাওয়া মানে এক একটি নদীর মরে যাওয়া..'

আপন মাহমুদের বেশ কিছু কবিতায় বেহালাবাদকের কথা বলতে শুনি যা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় তার অন্তর্গত গুঞ্জরণকেই যা তিনি নিজ ভাষ্যে বর্ণনা করেন এভাবে 'ফ্লাইং কিস।হ্যাঁ,সেই হাওয়াইচুমুটার কথাই বলতে হচ্ছে।যে আমাকে তাড়িয়েবেড়িয়েছে শীত থেকে বসন্ত-বসন্ত থেকে বেহালার বয়স্ক ক্রন্দন-আর ক্রন্দন থেকে মাঘের কুয়াশা পর্যন্ত।যে আমার পিছু নিয়েছে অতিপ্রাকৃতিক গোপন বিড়ালের মতো।একসময় মনে হতো পৃথিবীর বয়সী বিড়ালটার ঘোলাটে চোখেই বুঝি লেখা আছে যাবতীয় ঠিকানা,মোহমুক্তি। আজো কি আমাকেই খুঁজছে না সেই অপ্রাপ্তবয়স্কচুমুটা! অথবা সেই আদি বিড়াল?'

সাইমা,অপাদি,লোপা,শিরিন-নারী চরিত্ররা কবিকে যতটা তৃষ্ণার্ত করেছে তার ঢের বেশি করেছে অতৃপ্ত আর তাই হয়ত কবি ঈশ্বরের বাণীর চেয়ে সাকুরা কিংবা অন্য কোনো পানশালার চিয়ার্সের শব্দ তার কাছে বেশি গুরুত্ব রাখে।অতৃপ্ততা থেকেই কি কখনো কখনো কবি তার জীবনকে দেখেছেন কারাগার কিংবা চিড়িয়াখানাররূপকল্পে?আমার জানা হয়না,আমাদের জানা হবে না আর কোনোদিন!

ক্ষুধার কষ্ট যখন তার কবিতায় চমক দিয়ে বলে ওঠে 'সমূহ-গোলাপের উদ্দেশে বলি,সবজির কাতারে আসুন' কিংবা 'পাহাড় তুমি কি জানো,রজনীগন্ধা সবজি নয় কেন!' তখন আঁতকে উঠি এই যে একটু আগে বললাম আপন মাহমুদ আমার অচেনা,অজানা কেন বললাম এ তো আমার কথা বলছে।আমাদের কথা শোনাচ্ছে। সমুনের চায়ের দোকানে এই লেখাটা লিখতে লিখতে একটা প্রজাপতি উড়ে এলো।কিছু ছায়া পড়েছে আশেপাশে আমার মনে হলো আপন মাহমুদ ছায়ার ভিড়ে আমার পাশে বসে তাকে নিয়ে লেখা আমার লেখা পড়ছে।আপন কি হাসলো?চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে।আপন যেন বলে উঠলো কান্দেন ক্যান?আপনে জানেন না শব্দ অমর মানুষ না।আমিও বলে ওঠি তাই তো হৃদয়ে যার কবিতা তার আবার হৃদক্রিয়া বন্ধ হয় কী করে। সবাই আমার স্বগোক্তি শুনে তাকাচ্ছে।তারা জানেসকাল থেকে আমি আজ আমি নেই।আপন মাহমুদ হেসে ওঠে।আমার জীবননান্দ মনে পড়ে 'আমার পায়ের শব্দ শোনো,নতুন এ,আর সব হারানো-পুরনো'পাশের সিডি দোকানে কেন যেন বেজে ওঠে লালন' সে আমি অচিন একজন এক জাগতে থাকি দুজন ফাঁকে থাকি লক্ষ যোজন না পাই দেখিতে।'

খারাপ-ভালো ভাবনাকে বাইরে রেখে শিল্পের সত্যকে সহজে গ্রহণ করার সাহস যাদের আছে, যারা প্রজাপতির রঙ দেখে রঙিন হয়ে ওঠে,যারা মা কে ভালোবাসে, তাদের কবি আপন মাহমুদ।

আমার পকেটে রিংটোন বেজে ওঠে 'আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো'..
আমার অবচেতন মন ডেকে ওঠে আপন মাহমুদ নয়তো? কাল তো এমন সময়েই তিনি কল দিয়েছিলেন। না আপন আর কল দেবে না। আপন তো এখন প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়ায় মরা নদীতে মৃত রাজহাঁসের পাশে বসে হয় চির্য়াস বলছে কিংবা ঈশ্বরের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্ঠা করছেন বারবার!

আমার বুক পকেটে সেলফোনের রিংটোন বেজে যায় বারবার একাকীত্বের চেয়ে একা হয়ে আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো..

তথ্যকৃতজ্ঞতাঃ কালের কন্ঠের সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপি,সকালের দাঁড়ি কমা এবং রিপন আর্য।

২টি মন্তব্য: