শরৎসাহিত্যে নারী
শ্রীশুভ্র
শরৎসাহিত্যে বঙ্গ নারীর শাশ্বত রূপটি যেমন প্রাণবন্ত ফুটে ওঠে, বাংলা সাহিত্যে তাঁর পূর্বে তেমনটি আর দেখা যায় নি! গত শতকের প্রথমার্দ্ধেই তাঁর কলমে বাঙ্ময় হয়ে উঠল সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পুরুষ আধিপত্যবাদী পারিবারিক সংস্কৃতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারী জীবনের অকথিত ব্যাথা বেদনা! এবং তা প্রকাশ পেল নারী ব্যাক্তিত্বের অন্তর্নিহিত শক্তির ঐশ্বর্য্যের আলোতেই! এইখানেই শরৎসাহিত্যের অনন্যতা! তিনি নারীকে কখনোই অবলা রূপে দেখেননি! বরং নারী শক্তির অনন্ত সম্ভাবনা ও তার মানবিক ঐশ্বর্য্যের প্রত্যয়ী প্রতিভাস আভাষিত হলো তাঁর লেখনীর মননঋদ্ধ জাদুতে!
প্রচলিত সমাজ চিত্রণে- পারিবারিক সংস্কৃতির আলোতে তিনি ফুটিয়ে তুললেন তাঁর সংবেদনশীল মননের প্রতিবিম্বে বঙ্গ নারীর বাস্তব অবস্থান; তার আশা নিরাশার ক্যানভাসে সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকা পড়া নারীর মূল্য ও সমাজ আরোপিত নারীর মহিমার মধ্যে চলতে থাকা অবিচ্ছেদ্য দ্বন্দ্বের ঘূর্ণাবর্ত!
সেই ঘূর্ণীর আলোড়নে চিত্রিত করে তুললেন নারী পুরুষের শাশ্বত সম্পর্কের রেখাচিত্র! যে রেখাচিত্রে স্পষ্ট হতে থাকে বাংলার সমাজ বাস্তবতা! যে বাস্তবতার গুমোট আবহে দগ্ধ হয় নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা! নারীর মূল্য! শুধুই সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও আন্তরিক দরদের আলোতে মানবিক শ্রদ্ধার প্রত্যয়ে অনুভব করেছিলেন নারীর ঐশ্বর্য্য!
তাঁর "নারীর মূল্য"র প্রথমেই বললেন, "মণিমাণিক্য মহামূল্য বস্তু কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য! এই হিসেবে নারীর মূল্য বেশি নয়! কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন! জল জিনিসটা নিত্য প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই! কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজ বোধ করি এক ফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করে না! তেমনি ঈশ্বর না করুন, যদি কোনোদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইহার যথার্থ্য মূল্য কত, সে তর্কের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে- আজ নহে- আজ ইনি সুলভ!"
বলা যেতে পারে সমগ্র শরৎসাহিত্যের কেন্দ্রে এই বোধ সর্বদা ক্রিয়াশীল! এবং শরৎসাহিত্যের নারীরা এর মধ্যে থেকেই জায়মান!
শরৎচন্দ্রের সাহিত্য চর্চা যে যুগকে প্রতিফলিত করে সেযুগে শুধু বাংলাই নয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নারী স্বাধীনতা, নারীবাদ, নারী প্রগতির আন্দোলন: এসবের বিশেষ প্রচলন ছিল না! সেই যুগের প্রেক্ষিতে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যকামী সংস্কৃতির মধ্যে জন্মেও শরৎচন্দ্র যেন দৈত্যকুলে প্রল্হাদ! তিনি অন্তরের দরদে অনুভব করলেন নারী জীবনের অব্যক্ত অকথিত ব্যাথা বেদনা এবং নারী ব্যক্তিত্বের অনন্ত সম্ভাবনা! উপলব্ধি করলেন সমাজ সভ্যতায় নারীর ঐশ্বর্যের অতলান্ত মূল্য! তিনি অত্যন্ত কাছ থেকেই দেখেছিলেন বাঙালি হিন্দু সমাজ কি ভাবে ধর্মীয় অনুশাসনের শেকলে নারী জাতিকে অাষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে!
শরৎচন্দ্র তাঁর সুগভীর মননশীলতার প্রজ্ঞায় বুঝেছিলেন নারীকে সামাজিক বিধিনিষেধে, ধর্মীয় রীতিনীতিতে শৃঙ্খলিত করে রেখে; তার ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করে ; কোনো সমাজই বড়ো হতে পারে না! সুন্দর হতে পারে না! সমাজের অন্তরে অধিষ্ঠিত হয় না মঙ্গল! "স্বরাজ সাধনায় নারী!"- প্রবন্ধে তিনি তাই দ্ব্যর্থহীন ভাবে বললেন; "আমার মনে হয় মেয়েদের অধিকার যারা যে পরিমাণে খর্ব করেছে ঠিক সেই অনুপাতেই তারা কি সামাজিক; কি আর্থিক, কি নৈতিক সকল দিক দিয়েই ছোটো হয়ে গেছে!
নারীর অধিকার খর্ব করে সমাজের এই যে নৈতিক পদস্খলন; তার ফলে ব্যক্তি মানুষের জীবন কত ভাবেই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শরৎসাহিত্যের নিবিড় পাঠে তা হৃদয়ঙ্গম হয় পাঠকের!
নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও তাঁর সমানাধিকারকে খর্ব করে রাখার একটি বড়ো উপায় হলো সতীত্বের মহিমা প্রচার! শুধু বঙ্গ সমাজেই নয়, বিশ্বের বহূ জাতিতেই এর ব্যবহার বহূ পুরাতন!
শরৎসাহিত্যের নারীরা তাদের জীবন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করতে থাকে প্রচারিত এই "সতীত্বের মহিমা" ও তাদের অন্তরের "নারীর মূল্য"-র মধ্যে চলতে থাকা নিরন্তর এক নৈতিক দ্বন্দ্বের! সেই দ্বন্দ্বের ঘূর্ণাবর্তে আলোড়িত হতে হতেই আলোকিত হয়ে ওঠে নারী চরিত্রগুলির অন্তরের ঐকান্তিক ঐশ্বর্য্য,
তাদের প্রকৃতিগত দূর্বলতা ও শক্তির সমন্বয়ের মধ্যে দিয়েই! সেই সমন্বয়ের সংঘটনের মধ্যেই নিহিত তাদের জীবনের পূর্ণতা অপূর্ণতা! সমন্বয়ের সাফল্যেই নারী জীবনের সার্থকতা!
নারীর সতীত্বের মহিমা ও নারীর মূল্যের মধ্যে চলতে থাকা এই দ্বন্দ্বের তীব্র আলোড়নের দহনে আলোকিত হয়ে ওঠা চরিত্রগুলির মধ্যে "চরিত্রহীন" উপন্যাসের "কিরন্মণী" হয়ত শরৎসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি! আবার "শেষপ্রশ্ন" উপন্যাসের "কমল" ঠিক এর বিপরীতে সমাজের চরিত্রহীনতার উত্তরে এক প্রজ্জ্বলিত প্রতিবাদ! বিপ্লবাত্মক না হয়েও প্রত্যয়ী প্রতিরোধ! এই দুই অবিস্মরণীয় চরিত্রের মধ্যবর্তী বিস্তৃত পরিসরে অন্যান্য নারী চরিত্রগুলির উদ্ভাসন সাহিত্যিক মাত্রায়!
যেখানে "শ্রীকান্ত"র অন্নদা দিদির মতো সতী সাধ্বী থেকে কমললতা, পিয়ারী বাঈ থেকে রাজলক্ষী; "দত্তা"র বিজয়া থেকে "গৃহদাহ"র অচলা; আরও কত চরিত্রের উজ্জ্বল ব্যাপ্তী!
বস্তুত পুরুষের চেতনায় নারী বহূ ফসলী জমির মতো! জমির মালিকানার মতোই নারীর মালিকানা পুরুষের হাতে! স্বামী রূপে স্ত্রী রূপী নারীর উপর তাই তার প্রভূত প্রভূত্ব! পুরুষের বংশ রক্ষা করা ও স্বামীর সেবা করার মধ্যেই নারী জীবনের চরম সার্থকতা! এই তত্ত্বই প্রচার করে আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলি! আর এই অনুশাসনগুলিই নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে পথরোধ করে দাঁড়ায়!এই চিত্রই হিন্দু সমাজকে পদে পদে ছোট করে রেখেছে! শরৎসাহিত্য সেই খর্বতার বিরুদ্ধে; সেই ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে সহৃদয় সংবেদনশীল প্রত্যয়ী চেতনা উন্মেষকারী শক্তি!
নারী হৃদয়ের সংবর্তনের পটে এত বড়ো দরদী কথাশিল্পী খুব কমই এসেছে বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়!
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন; বাঙালির বেদনার কেন্দ্রে আপন বাণীর স্পর্শ দিয়ে গেছেন শরৎচন্দ্র! অত্যাচারের প্রতি ঘৃণা আর অত্যাচারিতের প্রতি সহানুভূতি উদ্রেকের অনন্ত শক্তি নিয়েই শরৎসাহিত্যের ঔজ্জ্বল্য! সমাজের সেই অত্যাচারিত নিপীড়িত শ্রেণীর মর্মকথার সাথে আপন অভিজ্ঞতার সংযোগের আলো তাঁর লেখনীর মর্মে ছিল বলেই তাঁর সাহিত্য আপামরের এত আপন হয়ে উঠেছিল!
সামাজিক পাপের বলি হওয়া কূলত্যাগী নারীর দুঃখের মূল যে দুঃসহ অত্যাচার ও অসহনীয় দারিদ্র; সে সত্য উপলব্ধি করেই শরৎচন্দ্র সতীত্ব ও একনিষ্ঠ প্রেমকে কখনোই এক বলে মেনে নিতে পারেননি কোনোদিন! সেই সত্যমূল্যেই শরৎসাহিত্যের নারী চরিত্ররা আলোকিত ও এত জনপ্রিয়!
এক ভাষণে খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন শরৎচন্দ্র; "পাপের প্রতি মানুষকে প্রলুব্ধ করতে চাইনা আমি! আমি বলি তাদের মধ্যেও তো ভগবানের দেওয়া মানুষের আত্মা আছে! তাকে অপমান করবার আমাদের কোনো অধিকার নেই!" মানবাত্মার প্রতি এই অম্লান শ্রদ্ধাই শরৎসাহিত্যের নারীদের-কে পাঠক চিত্তে ভাস্বর করে তুলেছে হৃদয় সংরাগে! এখানেই তাঁর সাহিত্যিক কুশলতার শৈল্পিক স্বীকৃতি!নারীর বাৎসল্য প্রেম তার স্নেহ মায়া মমতা তার ত্যাগ তার সেবা এ সকল গুণের সহৃদয় চিত্রণের মধ্যেই কিন্তু তিনি নারীত্বের সীমানা টেনে দেননি! "শেষপ্রশ্ন"-এ কমল তাই বলেছিল, "যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বই নারীর চরম সার্থকতা, সমস্ত নারী জাতিকেই তারা বঞ্চনা করেছিল!"
শরৎসাহিত্য তাই নারীত্বের পূর্ণ বিকাশের চেতনা উন্মেষে আলো দিয়ে যায় নির্মল প্রত্যয়ে! যদিও শরৎসাহিত্য আধুনিক নারীবাদী সাহিত্য নয়! নয় প্রতিবাদী প্রতিরোধী বিপ্লবী সাহিত্যের নিদর্শন! শরৎসাহিত্য প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার দিকনির্দেশিকা নয়! আবহমান সমাজ জীবনে প্রলয় আনেননি তিনি! বস্তুত সাহিত্যের কাজ সমাজ সংস্কার নয়! সৎ সাহিত্যের কাজ সাহিত্যের দর্পণে সমাজ ব্যবস্থার দূর্বলতাগুলিকে ব্যক্তি মানবের চেতনায় স্পষ্ট প্রতিবিম্বিত করা! মানব জীবনের অন্তর্নিহিত মর্মবেদনাকে সহানুভূতির স্বরে বাজিয়ে তোলাই সাহিত্য! তার কাজ মানুষের মনুষ্যত্বকে নিরন্তর জাগিয়ে রাখা! শরৎসাহিত্য বঙ্গজীবনে সেই কাজটিই করে গেছে বরাবর!
শরৎসাহিত্যে বঙ্গ নারীর শাশ্বত রূপটি যেমন প্রাণবন্ত ফুটে ওঠে, বাংলা সাহিত্যে তাঁর পূর্বে তেমনটি আর দেখা যায় নি! গত শতকের প্রথমার্দ্ধেই তাঁর কলমে বাঙ্ময় হয়ে উঠল সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পুরুষ আধিপত্যবাদী পারিবারিক সংস্কৃতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারী জীবনের অকথিত ব্যাথা বেদনা! এবং তা প্রকাশ পেল নারী ব্যাক্তিত্বের অন্তর্নিহিত শক্তির ঐশ্বর্য্যের আলোতেই! এইখানেই শরৎসাহিত্যের অনন্যতা! তিনি নারীকে কখনোই অবলা রূপে দেখেননি! বরং নারী শক্তির অনন্ত সম্ভাবনা ও তার মানবিক ঐশ্বর্য্যের প্রত্যয়ী প্রতিভাস আভাষিত হলো তাঁর লেখনীর মননঋদ্ধ জাদুতে!
প্রচলিত সমাজ চিত্রণে- পারিবারিক সংস্কৃতির আলোতে তিনি ফুটিয়ে তুললেন তাঁর সংবেদনশীল মননের প্রতিবিম্বে বঙ্গ নারীর বাস্তব অবস্থান; তার আশা নিরাশার ক্যানভাসে সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকা পড়া নারীর মূল্য ও সমাজ আরোপিত নারীর মহিমার মধ্যে চলতে থাকা অবিচ্ছেদ্য দ্বন্দ্বের ঘূর্ণাবর্ত!
সেই ঘূর্ণীর আলোড়নে চিত্রিত করে তুললেন নারী পুরুষের শাশ্বত সম্পর্কের রেখাচিত্র! যে রেখাচিত্রে স্পষ্ট হতে থাকে বাংলার সমাজ বাস্তবতা! যে বাস্তবতার গুমোট আবহে দগ্ধ হয় নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা! নারীর মূল্য! শুধুই সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও আন্তরিক দরদের আলোতে মানবিক শ্রদ্ধার প্রত্যয়ে অনুভব করেছিলেন নারীর ঐশ্বর্য্য!
তাঁর "নারীর মূল্য"র প্রথমেই বললেন, "মণিমাণিক্য মহামূল্য বস্তু কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য! এই হিসেবে নারীর মূল্য বেশি নয়! কারণ, সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন! জল জিনিসটা নিত্য প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই! কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজ বোধ করি এক ফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করে না! তেমনি ঈশ্বর না করুন, যদি কোনোদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইহার যথার্থ্য মূল্য কত, সে তর্কের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে- আজ নহে- আজ ইনি সুলভ!"
বলা যেতে পারে সমগ্র শরৎসাহিত্যের কেন্দ্রে এই বোধ সর্বদা ক্রিয়াশীল! এবং শরৎসাহিত্যের নারীরা এর মধ্যে থেকেই জায়মান!
শরৎচন্দ্রের সাহিত্য চর্চা যে যুগকে প্রতিফলিত করে সেযুগে শুধু বাংলাই নয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নারী স্বাধীনতা, নারীবাদ, নারী প্রগতির আন্দোলন: এসবের বিশেষ প্রচলন ছিল না! সেই যুগের প্রেক্ষিতে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যকামী সংস্কৃতির মধ্যে জন্মেও শরৎচন্দ্র যেন দৈত্যকুলে প্রল্হাদ! তিনি অন্তরের দরদে অনুভব করলেন নারী জীবনের অব্যক্ত অকথিত ব্যাথা বেদনা এবং নারী ব্যক্তিত্বের অনন্ত সম্ভাবনা! উপলব্ধি করলেন সমাজ সভ্যতায় নারীর ঐশ্বর্যের অতলান্ত মূল্য! তিনি অত্যন্ত কাছ থেকেই দেখেছিলেন বাঙালি হিন্দু সমাজ কি ভাবে ধর্মীয় অনুশাসনের শেকলে নারী জাতিকে অাষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে!
শরৎচন্দ্র তাঁর সুগভীর মননশীলতার প্রজ্ঞায় বুঝেছিলেন নারীকে সামাজিক বিধিনিষেধে, ধর্মীয় রীতিনীতিতে শৃঙ্খলিত করে রেখে; তার ব্যক্তি স্বাধীনতাকে খর্ব করে ; কোনো সমাজই বড়ো হতে পারে না! সুন্দর হতে পারে না! সমাজের অন্তরে অধিষ্ঠিত হয় না মঙ্গল! "স্বরাজ সাধনায় নারী!"- প্রবন্ধে তিনি তাই দ্ব্যর্থহীন ভাবে বললেন; "আমার মনে হয় মেয়েদের অধিকার যারা যে পরিমাণে খর্ব করেছে ঠিক সেই অনুপাতেই তারা কি সামাজিক; কি আর্থিক, কি নৈতিক সকল দিক দিয়েই ছোটো হয়ে গেছে!
নারীর অধিকার খর্ব করে সমাজের এই যে নৈতিক পদস্খলন; তার ফলে ব্যক্তি মানুষের জীবন কত ভাবেই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শরৎসাহিত্যের নিবিড় পাঠে তা হৃদয়ঙ্গম হয় পাঠকের!
নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও তাঁর সমানাধিকারকে খর্ব করে রাখার একটি বড়ো উপায় হলো সতীত্বের মহিমা প্রচার! শুধু বঙ্গ সমাজেই নয়, বিশ্বের বহূ জাতিতেই এর ব্যবহার বহূ পুরাতন!
শরৎসাহিত্যের নারীরা তাদের জীবন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করতে থাকে প্রচারিত এই "সতীত্বের মহিমা" ও তাদের অন্তরের "নারীর মূল্য"-র মধ্যে চলতে থাকা নিরন্তর এক নৈতিক দ্বন্দ্বের! সেই দ্বন্দ্বের ঘূর্ণাবর্তে আলোড়িত হতে হতেই আলোকিত হয়ে ওঠে নারী চরিত্রগুলির অন্তরের ঐকান্তিক ঐশ্বর্য্য,
তাদের প্রকৃতিগত দূর্বলতা ও শক্তির সমন্বয়ের মধ্যে দিয়েই! সেই সমন্বয়ের সংঘটনের মধ্যেই নিহিত তাদের জীবনের পূর্ণতা অপূর্ণতা! সমন্বয়ের সাফল্যেই নারী জীবনের সার্থকতা!
নারীর সতীত্বের মহিমা ও নারীর মূল্যের মধ্যে চলতে থাকা এই দ্বন্দ্বের তীব্র আলোড়নের দহনে আলোকিত হয়ে ওঠা চরিত্রগুলির মধ্যে "চরিত্রহীন" উপন্যাসের "কিরন্মণী" হয়ত শরৎসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি! আবার "শেষপ্রশ্ন" উপন্যাসের "কমল" ঠিক এর বিপরীতে সমাজের চরিত্রহীনতার উত্তরে এক প্রজ্জ্বলিত প্রতিবাদ! বিপ্লবাত্মক না হয়েও প্রত্যয়ী প্রতিরোধ! এই দুই অবিস্মরণীয় চরিত্রের মধ্যবর্তী বিস্তৃত পরিসরে অন্যান্য নারী চরিত্রগুলির উদ্ভাসন সাহিত্যিক মাত্রায়!
যেখানে "শ্রীকান্ত"র অন্নদা দিদির মতো সতী সাধ্বী থেকে কমললতা, পিয়ারী বাঈ থেকে রাজলক্ষী; "দত্তা"র বিজয়া থেকে "গৃহদাহ"র অচলা; আরও কত চরিত্রের উজ্জ্বল ব্যাপ্তী!
বস্তুত পুরুষের চেতনায় নারী বহূ ফসলী জমির মতো! জমির মালিকানার মতোই নারীর মালিকানা পুরুষের হাতে! স্বামী রূপে স্ত্রী রূপী নারীর উপর তাই তার প্রভূত প্রভূত্ব! পুরুষের বংশ রক্ষা করা ও স্বামীর সেবা করার মধ্যেই নারী জীবনের চরম সার্থকতা! এই তত্ত্বই প্রচার করে আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলি! আর এই অনুশাসনগুলিই নারীর স্বাধীন ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে পথরোধ করে দাঁড়ায়!এই চিত্রই হিন্দু সমাজকে পদে পদে ছোট করে রেখেছে! শরৎসাহিত্য সেই খর্বতার বিরুদ্ধে; সেই ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে সহৃদয় সংবেদনশীল প্রত্যয়ী চেতনা উন্মেষকারী শক্তি!
নারী হৃদয়ের সংবর্তনের পটে এত বড়ো দরদী কথাশিল্পী খুব কমই এসেছে বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়!
রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন; বাঙালির বেদনার কেন্দ্রে আপন বাণীর স্পর্শ দিয়ে গেছেন শরৎচন্দ্র! অত্যাচারের প্রতি ঘৃণা আর অত্যাচারিতের প্রতি সহানুভূতি উদ্রেকের অনন্ত শক্তি নিয়েই শরৎসাহিত্যের ঔজ্জ্বল্য! সমাজের সেই অত্যাচারিত নিপীড়িত শ্রেণীর মর্মকথার সাথে আপন অভিজ্ঞতার সংযোগের আলো তাঁর লেখনীর মর্মে ছিল বলেই তাঁর সাহিত্য আপামরের এত আপন হয়ে উঠেছিল!
সামাজিক পাপের বলি হওয়া কূলত্যাগী নারীর দুঃখের মূল যে দুঃসহ অত্যাচার ও অসহনীয় দারিদ্র; সে সত্য উপলব্ধি করেই শরৎচন্দ্র সতীত্ব ও একনিষ্ঠ প্রেমকে কখনোই এক বলে মেনে নিতে পারেননি কোনোদিন! সেই সত্যমূল্যেই শরৎসাহিত্যের নারী চরিত্ররা আলোকিত ও এত জনপ্রিয়!
এক ভাষণে খুব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন শরৎচন্দ্র; "পাপের প্রতি মানুষকে প্রলুব্ধ করতে চাইনা আমি! আমি বলি তাদের মধ্যেও তো ভগবানের দেওয়া মানুষের আত্মা আছে! তাকে অপমান করবার আমাদের কোনো অধিকার নেই!" মানবাত্মার প্রতি এই অম্লান শ্রদ্ধাই শরৎসাহিত্যের নারীদের-কে পাঠক চিত্তে ভাস্বর করে তুলেছে হৃদয় সংরাগে! এখানেই তাঁর সাহিত্যিক কুশলতার শৈল্পিক স্বীকৃতি!নারীর বাৎসল্য প্রেম তার স্নেহ মায়া মমতা তার ত্যাগ তার সেবা এ সকল গুণের সহৃদয় চিত্রণের মধ্যেই কিন্তু তিনি নারীত্বের সীমানা টেনে দেননি! "শেষপ্রশ্ন"-এ কমল তাই বলেছিল, "যারা প্রচার করেছিল মাতৃত্বই নারীর চরম সার্থকতা, সমস্ত নারী জাতিকেই তারা বঞ্চনা করেছিল!"
শরৎসাহিত্য তাই নারীত্বের পূর্ণ বিকাশের চেতনা উন্মেষে আলো দিয়ে যায় নির্মল প্রত্যয়ে! যদিও শরৎসাহিত্য আধুনিক নারীবাদী সাহিত্য নয়! নয় প্রতিবাদী প্রতিরোধী বিপ্লবী সাহিত্যের নিদর্শন! শরৎসাহিত্য প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার দিকনির্দেশিকা নয়! আবহমান সমাজ জীবনে প্রলয় আনেননি তিনি! বস্তুত সাহিত্যের কাজ সমাজ সংস্কার নয়! সৎ সাহিত্যের কাজ সাহিত্যের দর্পণে সমাজ ব্যবস্থার দূর্বলতাগুলিকে ব্যক্তি মানবের চেতনায় স্পষ্ট প্রতিবিম্বিত করা! মানব জীবনের অন্তর্নিহিত মর্মবেদনাকে সহানুভূতির স্বরে বাজিয়ে তোলাই সাহিত্য! তার কাজ মানুষের মনুষ্যত্বকে নিরন্তর জাগিয়ে রাখা! শরৎসাহিত্য বঙ্গজীবনে সেই কাজটিই করে গেছে বরাবর!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন