বাংলার প্রথম সার্থক নারী
উপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী
একটি নদীর খোঁজে...
শৌনক দত্ত তনু
নদী,সভ্যতার বাহক।নদীর বুকে ইতিহাস রাখা আছে আর সেই নদী হারিয়ে গেলে রেখা পড়ে থাকে, একা।বাংলাসাহিত্যের হাজার নদীর একটি স্বর্ণকুমারী!কে এই স্বর্ণকুমারী?রেখা খুঁজে সময় হেঁটে যায় পেছনে।বিস্মৃতির অতল থেকে উড়ে আসে বাতাস।কার্তিক মাসের কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আসে সময়।দিন আর রাতের সন্ধিক্ষণে বেঁচে থাকা স্বর্ণকুমারী এমন এক নদীর নাম,এমন এক নারীর নাম যার হারিয়ে যাওয়া বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে বাংলাসাহিত্যকে,কিন্তু কেন?
মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার ইতিহাস পালাবদলে যখন পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার প্রবাহে পথ চলতে শুরু করে তখন পুরুষদের ছায়ার নীচে একটু একটু করে নারীরা হারিয়ে যেতে থাকে।বাংলাসাহিত্যেও তার ব্যতিক্রম নয়।স্বর্ণকুমারী তেমন একটি হারিয়ে যাওয়া নাম।
ছোটগল্পের প্রথম সার্থক শিল্পী যদি রবীন্দ্রনাথ হয় তবে তার আগে ছোটগল্পের প্রস্তুতিপর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার স্বর্ণকুমারী দেবী!আবার স্বর্ণকুমারীই প্রথম বাংলাসাহিত্যের নারী উপন্যাসিক।সাহিত্যের সব বিভাগে-গান,গল্প,উপন্যাস,নাটক,কৌতুকনাট্য,প্রহসন,কবিতা এমনকী প্রবন্ধেও যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় রেখে গেছেন এই লেখিকা। স্বর্ণকুমারী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ কন্যা,রবীন্দ্রনাথের ন'দি।রবীন্দ্রনাথের ছয়বছরের বড়ো স্বর্ণকুমারীর বিয়ে হয় নদীয়ার জমিদার পরিবারের জানকীনাথ ঘোষালের সাথে।তখন তার বয়স তেরো।জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সাহিত্য সাধনায় মগ্ন থেকেছেন।দীর্ঘ বার বছর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন সে সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা 'ভারতী'তে।কিশোর পত্রিকা 'বালক'ও তার সম্পাদনায় সমকালে অত্যন্ত খ্যাতি কুড়িয়েছে।
১৮৭৬খ্রীঃ বাংলা নারী উপন্যাসিকদের জন্য একটি মাইলফলক বছর।কেননা এ বছরই জাতীয়তা ভাবের প্রচারের বিষয়বস্তু নিয়ে মুখ দেখে একুশ বর্ষীয় স্বর্ণকুমারীর প্রথম উপন্যাস 'দীপনির্বাণ'।'স্নেহলোতা'(১৮৭৯)উপন্যাসটিও সেকালে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিল।স্বর্ণকুমারীর'ফুলের মালা'(১৮৯৮)ও'কাহাকে'(১৮৯৮)উপন্যাস দুটি ইংরেজীতে এবং তার'দিব্যকমল'(১৯৩০)নাটকটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়। সে সময় একজন লেখিকার দুটি উপন্যাস ইংরেজীতে ও একটি নাটক জার্মান ভাষায় অনূদিত হওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।'রাজকন্যা'তার লেখা আর একটি উল্লেখযোগ্য নাটক।স্বর্ণকুমারীর বহুমাত্রিক প্রতিভার একটি অন্যতম দিক ছিল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা।বৈজ্ঞানিক পরিভাষা রচনাতেও তার বিচরণ ছিল বিস্ময়কর।
কবি স্বর্ণকুমারীও সে যুগে বিস্তর খ্যাতি পেয়েছিলেন।তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো'গাঁথা'(১৯২৭)'বসন্ত উত্সব'(১৮৯৭)'গীতিগুচ্ছ'(১৯২৩)।দীর্ঘকাল ধরে তার নিরলস সাহিত্যসাধনার স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণকুমারী দেবীকে'জগত্তারিণী স্মৃতিপদক'সন্মানে সন্মানিত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে।মজার বিষয় হলো তিনি এই স্বর্ণপদকের প্রথম প্রাপিকা!
কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবী যৌথভাবে রচনা করেন একটি শিশুপাঠ্য গল্পগ্রন্থ।বইটির নাম ছিল'গল্পসল্প'(১৮৮৮)।তাতে তার পাঁচটি গল্পের দেখা মেলে।১৮৮৩সালে 'সখা'পত্রিকায় প্রকাশিত 'বীরেন্দ্র সিংহের রত্নলাভ'গল্পটি সহ 'সঙ্গদোষ','সত্য','ক্ষমা' এবং 'শুভকাজের সুযোগ হারাইও না'।
স্বর্ণকুমারী দেবীর 'সন্ন্যাসিনী'এবং'কেন'গল্পদুটি সেকালে পাঠকদের মন জয় করেছিল।
'কেন' গল্পে গল্পকার স্বর্ণকুমারী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তার মরমি ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন স্বামী পরিত্যক্তা এক ভাগ্যবিড়ম্বিতা নারীর করুণ জীবনকাহিনি।আখ্যানটি মিলনান্তক হলেও,আর এক বেদনাবিধুর নারীর সর্বস্ব ত্যাগ করে মহীয়সী হয়ে ওঠার কারুণ্য গল্পটিকে পৌঁছে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রায়।
এ কাহিনি বঙ্কিমচন্দ্রের 'কৃষ্ণকান্তের উইল'ও'বিষবৃক্ষ'উপন্যাস দুটিকে অবশ্যই মনে পড়ায়।ভ্রমরকে ত্যাগ করে গোবিন্দলালের রোহিনী অভিমুখী হওয়া এবং সূর্যমুখীকে উপেক্ষা করে নগেন্দ্রর কুন্দননন্দিনীতে আকর্ষণ ইত্যাদি ঘটনার ছায়াপাত এখানে চোখে পড়ে।বিশেষ করে সূর্যমুখীকে অবহেলা করে নগেন্দ্রর চলে যাওয়া ও পুনরায় সূর্যমুখীতেই ফিরে আসা ব্যাপারটি স্বর্ণকুমারীর গল্পে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।
স্বর্ণকুমারীর অধিকাংশ গল্পেই অত্যন্ত স্পষ্ট একটি গুণ হলো,তার সুরুচি আর আভিজাত্য।তার রচনার সর্বত্র একটি নিভৃত বেদনার সমাগম।শরতকালের আকাশে হঠাৎ যেমন এক খণ্ড মেঘ কালো ছায়া বিস্তার করে,কিন্তু বর্ষণ হয় না,ভেসে যায় কোথাও-স্বর্ণকুমারীর রচনায় সেইরকম একটি কারুণ্য মেঘের মতো ধীরে প্রসারিত হয়।তবে তা গভীর বেদনা-বিহ্বলতায় পাঠকের মনকে আর্দ্র করে তোলে না।
স্বর্ণকুমারীর গল্প বলার ক্ষমতাটি ছিল মনোরম,তবে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস তার মনকে কিছুটা প্রবাহিত করেছে।ফলে বঙ্কিমী রচনার বর্ণনাভঙ্গি ও চরিত্রায়ণ অনেকক্ষেত্রে তার রচনায় প্রভাব ফেলেছে।
স্বর্ণকুমারী সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক সমালোচক প্রাবন্ধিক অধ্যাপক ড.শিশিরকুমার দাশ চমত্কার বলেছেন"বাংলা ছোটগল্পের আবির্ভাব লগ্নে যে সমস্ত শিল্পী এই নবীন শিল্পরীতিকে অভিবাদন জানিয়েছিলেন স্বর্ণকুমারী তাঁদের অন্যতম।আজ ইতিহাসের নেপথ্যলোকে তার অধিষ্ঠান।তার গল্পের পরিচয় আজ অতি ক্ষুদ্র মহলে সীমিত।এ যুগের সমস্যাব্যথিত,জীবনযুদ্ধক্লিষ্ট মানুষের কাছে তার কোনো আবেদন নেই।কিন্তু যে ক্ষুদ্র জলবিম্বে আজ আমরা বিশ্বের প্রতিবিম্ব দেখতে পারি-স্বর্ণকুমারী তারই উত্সদেশে একদা ছিলেন-এই কৃতজ্ঞতাবোধ আমাদের অন্তর থেকে উত্সারিত হোক।"
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য সংকলিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত বাংলা ছোটগল্প।
স্বর্ণকুমারীর গল্প
বিজিত ঘোষ , এবং রত্নদীপা দে ঘোষ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন