বাংলা গান ছড়িয়ে গেল দিকে দিকে , প্রথম বাংলা ব্যান্ডের পথিকৃৎ ‘মহীনের ঘোড়া গুলি’ ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১, ৬ বছর কলকাতায় এদের বিচরণ । ‘মহীনের ঘোড়া গুলি’ যেভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৮১-৮২ তে তা সম্ভব ছিলনা। গুটি কতক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন সমালোচনা ভাল মন্দ মিলিত । গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর দলবল ধূল উড়িয়ে হঠাৎ হারিয়ে গেল। অথচ এই ‘মহীনের ঘোড়া গুলি’, টগবগে অশ্বারোহীরা বরাবর সময়ের আগেই ছুটে চলেছে ।
আমার ভাললাগা গানের ‘মহীনের ঘোড়া গুলি’ থেকে কিছু গানের কথা ভীষণ ইচ্ছে করছে বলতে, অদম্য সেই ইচ্ছা। ভালবাসার কথা না বললেই নয়-“ আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি/ দেখা যায় তোমাদের বাড়ি” ............অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গলায় । ভালবাসার কল্পনায় মায়াজাল বুনতে বুনতে সম্মোহিত হলাম—“সেই বাড়ির নেই ঠিকানা শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি”।
মহীনের অশ্বারোহীরা নিজেদের পদচিহ্ন রেখে দেয় নবীন ব্যান্ড গায়কদের জন্য, তাদের চলার পথে দর্পিত পদক্ষ্যেপ । প্রথম দিকে মহীনের গান কোথায় বাজেনি?-রবীন্দ্রসদন, একাডেমী অফ ফাইন আর্টস, যোগেশ মাইম, স্টার থিয়েটার, মাক্সমুলার ভবন , সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল প্রাঙ্গন , ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিক –এই সব জায়গায় গৌতম চট্টোপাধ্যায় রেখেছেন অভিনবত্বর চিহ্ন। অভিনবত্বর কিছু থাকতই। পুরনো কাগজে ছাপা টিকিট, সদস্যদের টিপছাপ দেওয়া আমন্ত্রনী ।
১৯৯৫ সালে “আবার বছর কুড়ি পরে’’- র প্রত্যাবর্তন, অনেকবার শুনেছি , বার বার শুনি তাও মনে হয় নতুন শুনছি – “ভালবাসি জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে / ছায়া ঘেরা মেঠো পথে ভালবাসি হাঁটতে / দূর পাহাড়ের গায়ে গোধূলির আলো মেখে কাছে ডাকে ধানক্ষেত সুদূর দিগন্তে’’...গানটা শুনতে শুনতে বিষণ্ণ লাগে নিজের, ভীষণ একা লাগে । মন উদাস হয়ে যায় -----“ তবুও কিছুই যেন কিছুই যে ভাল লাগেনা কেন / উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন/ কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও’’/............... “সুদিন কাছে এস ভালবাসি একসাথে সবকিছুই ...’’ আমাদের ভাল লাগা মন্দ লাগা সব কিছুই খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে ভাগ করে নেবার আহ্বান, একসাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার গান ।
মহীনের গান ২০ বছর ধরে সঞ্চারিত হচ্ছিল এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজম্নের মুখে মুখে। পেসিডেন্সি কলেজ ক্যানটিনে ক্লাস পালান সহপাঠীর কণ্ঠ্যে এই গান শুনে চমকে উঠেছিলো সবাই , নিজেদের বিষণ্ণ নিঃসঙ্গতার সুর অন্য কোন গানে তারা বাজতে শোনেনি। ২০ বছর ব্যবধানে বোঝা গেল শ্রোতাদের মহীনের গান শোনার আগ্রহ, কারণ লিরিসিস্ট গৌতম চট্টপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ । এরপর-ই এল “ ঝরা সময়ের গান’’ , “মায়া” , “ক্ষ্যাপার গান” ।।
আর একটা আমার পছন্দের গান, “ পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে , স্যাটেলাইট আর কেবলে-র সাথে ড্রইং রুম-এ রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী” ......অত্যাধুনিক নাগরিক জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত এই গান। গৌতম চট্টপাধ্যায়ের নিজের গলায় টেলিফোন – “ আশায় আশায় বসে আছি ওরে আমার মন , কখন তোমার আসবে টেলিফোন”... বাউল ঢং –এ গানটি গাওয়া হয়েছে , কোথায় পৌঁছে গেছে আগেবতারিত বাংলা গান । জীবনানন্দের কবিতার জ্যোৎস্নায় কার্তিকের রাতে ঘরে না-ফেরা ঘোড়াদের প্রত্যাবর্তন , ‘ঝরা সময়ের গান’, –এ –‘রাবেয়া কি রুক্সানা’ গানটি মনের গভীরে প্রবেশ করে, যখন শুনি । বেদনা বিধুর গানটি অসম্ভব ভাল গেয়েছেন অন্তরা চৌধুরী- রিত্বিকা সাহানী-“নিমেষে বানিয়ে দেয় বাগানের ফুল ,ঠিক নির্ভুল , এভাবে মেয়েরা সব ফুল হয়ে যায়” । আমি বরাবর-ই অন্তরা চৌধুরী –র ভক্ত । কুড়ি বছর কিংবা তিরিশ পরেও কিন্তু কোন কিছু-ই পালটায়নি , সীমান্ত পেরিয়ে মেয়ের দল আর-ও আসে এ শহরে , রূপসা , মধুমতী , কীর্তনখোলা , হিজলা পার হয়ে , আসে এ শহরে , লক্ষ্মী , রাবেয়া, রুক্সানা , এসে ‘নিমেষে –ই ফুল হয়ে যায়’ । ফুলের জাত নেই , সুন্দরী গোলাপ , চম্পা , শেফালি, চামেলি , কিম্বা টগর, শহরের প্রান্তবাসিনী বাগানের ফুল হতে মানা নেই এদের , “ পোড়ার মুখীরা তোরা ফুল হয়ে রয়ে গেলি হায়” । ধূসর এ শহরের নির্লিপ্ত ল্যান্ডস্কেপ – মেয়েরা হারিয়ে যায় , এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই । মহীনের গান এভাবে অস্রুসজল নয়নে বার বার শুনতে ইচ্ছা করে
‘সংবিঙ্গ পাখিকুল’, আর একটা গান ‘Runway’- পথহারা , বিষাদগ্রস্ত , নিসঙ্গতার প্রকাশ । ‘রানওয়ে জুড়ে পড়ে আছে শুধু , কেউ নেই শূন্যতা / আকাশে তখন থমকিয়ে আছে মেঘ’ – পাগল করা গান ! এই গান গুলই এক সময় কেউ শুনতে চায়নি । অথচ অবস্থান এত টুকু বদলায়নি । আবার সেই দিনের কথা মনে হয় , ঝরা সময়কে মহীনের ঘোড়ারা উস্কে দিয়েছে ।
‘আমার প্রিয়া কাফে’ – এই গান তরুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলে। সত্যি শিহরিত হই , মন অন্য খানে চলে যায় বলতে বাধ্য , ... ‘ কাঁপে কাঁপে, আমার হিয়া কাঁপে, একি যে কাণ্ড , এ কি কাণ্ড , এ কি কাণ্ড সব পণ্ড , এ ব্রহ্মাণ্ড , সুন্য লাগে , তুমি ছাড়া শূন্য লাগে......... কাঁপে কাঁপে’, এই গান আমি আমার তরুণ , নবীন বন্ধুদের সাথে শোনার সৌভাগ্য রাখি । আবেগ ভালবাসা তাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই, ‘ মণি ছাড়া শূন্য লাগে’ !!
মহীনের সমস্ত গানের কথা বলতে গেলে লেখা শেষ হবে না । তখনকার কুড়ি বছরের পুরনো পৃথিবী আমাকে মন্ত্র মুগ্ধ করে দিয়েছে । কৃতজ্ঞতা জানাই গৌতম চট্টোপাধ্যায় , রঞ্জন ঘোষাল , আব্রাহাম মজুমদার – এঁদের । মহীনের অশ্বারোহীরা পৃথিবীর গান শুনিয়েছে , দেখিয়েছে অন্ধকারের দিশা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন