অনুজ দৃষ্টিতে শঙ্খ-কাব্য
মিলন চট্টোপাধ্যায়
শঙ্খ ঘোষ -- এক অবিসংবাদী প্রতিবাদের নাম । যার লেখা নিয়ে বলার মত যোগ্যতাই আমার নেই । তবুও লিখছি ! কেন ?
কারণ কিছু ব্যাতিক্রমী কবি আছেন যাঁদের কবিতা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না । সমাজে যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার আগ্রাসী থাবা বাড়ায়,মদমত্ত শক্তির অহংকারী পদচারণ পিষ্ট করে প্রকৃত গণতন্ত্র - তখনই পরশুরামের কুঠারের মত নেমে আসে তাঁর কবিতার অমোঘ লাইন ।
শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ভালো কবিতার শর্ত মেনেও সাম্প্রতিক সময় যতটা প্রতিভাত হয় ততটা খুব কম জনের লেখাতেই আসে । বিপন্নতায় , অস্থিরতায় যখন তাঁর কবিতার লাইন পড়ি তখন ভিতরের বারুদটা ছাপোষা মানসিকতাকে ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চায় ।
১৯৫২ সালে সদ্য তরুণ এক কবির লেখা একটা কবিতা নড়িয়ে দিয়েছিল আপামর কাব্যপ্রেমীকে । সম্ভবত দেশে প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল সেটা কবির । কবির নাম - 'শঙ্খ ঘোষ ' আর কবিতার নাম ' যমুনাবতী ' । কিছু লাইন দেখা যাক --
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে,
আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে!
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী-
দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দিই!
হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়
হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাত দিই হায় "
এবং
"যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে!
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ-পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ গিয়ে !
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে ! "
কি অসামান্য কবিতা । এক কিশোরীর মৃত্যু এখানে উপজীব্য । সেই কিশোরী যে মারা যায় পুলিশের গুলিতে এক ভুখা মিছিলে গিয়ে । ভাতের জন্য মৃত্যু , যার ভাতের সন্ধান তাকে এনে দেয় গরম বস্তু তবে ভাতের বদলে সেটা সীসার বুলেট । সব সুখ-স্বপ্ন বারুদের কাছে , মৃত্যু এসে হাত ধরে ।এখানে নিভন্ত চুল্লিকে করে তুলেছেন এক কিশোরীর দহনে দাউদাউ চিতা ।
আবার সেই কবিই পরিণত বয়সে যমুনাবতীর চল্লিশ বছর পর লিখলেন আরেক অমোঘ কবিতা 'ন্যায় অন্যায় জানিনে' ।
"ন্যায় অন্যায় জানিনে"
তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে !
স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধ্বসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল
সমাজবিরোধী।
ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসিপাতা
উল্টেও পারেনা খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছু জানেনা বুলেটরা।
দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দ্যাখে মাঝে মাঝে।
পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।"
কি দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায় প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে এখানে । আক্রমণ এখানে শাণিত কিরীচের মত চিরে ফেলে , সরাসরি ।
তিন রাউন্ড গুলিতে তেইশ জনের মৃত্যু ! কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয় সেই অভিঘাতে শঙ্খ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।
'পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ' --- একেবারে নগ্ন করে দেওয়া রাজনীতির মুখোশ খুলে । কারণ '৪৭' এর আগে এবং অব্যবহিত পরেও স্বাধীন পুলিশের, স্বাধীন বুলেট, স্বাধীন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনি ,করেও না , করবেও না ।
লিখলেন --
"ভয়াবহ শব্দধূমে ভরে গেছে পৌষের বাতাস
আর সেই অবসরে কোনও কোনও পিশাচ স্বাধীন
রাজপথ থেকে নারী তুলে নিয়ে চলে যায় ট্রাকে ।"
এই ভাষ্যও সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় নারীত্বের অসম্মান ।আজও যা সমান প্রসঙ্গিক । নারী আজও ধর্ষিতা হয় ব্রিজের আড়ালে , প্রকাশ্য রাজপথে,ভাড়ার গাড়িতে । পরদিন সংবাদপত্রে সেটা পড়ে আহ-উহ করা ছাড়া আমরা কিছুই করিনা ।
কি অসহায় লাগে যখন পড়ি --
" আজকাল কবিমাত্রে অনায়াসে জঙ্ঘা বলে যাকে
শব্দের প্রকৃত বোধ কুয়াশায় একা পড়ে থাকে "
অনায়াসে বলে দেন ---
" মত কাকে বলে, শোনো । মত তা-ই যা আমার মত
সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ "
গণতন্ত্রের আসল রূপ ফুটে উঠেছে এই লাইন দুটিতে । মোসাহেবি কর, বাঁচো । এ যেন - আমিই সব । আমি এখানে যে কেউ হতে পারে । কোনো দল, মাফিয়া, সংস্থা-কর্ণধার অথবা বাড়ির গার্জেন ।আমাদের নিজের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য । আমরা যা ভাবি তাই যথার্থ আর বাকিরা ভুল ! মতে না মিললেই সে শত্রু , আমরা হয়ে যাই পরমত অসহিষ্ণু । সে যদি সহমত হয় তাহলে তাকেই করে নিই সর্বক্ষণের সঙ্গী আর সেটা সে নির্গুণ হলেও ।
বর্তমান সময়ে ঠিক এই মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাই চারদিকে ।
'ধূম লেগেছে হৃদ্ কমলে ' বই থেকে দুটি লাইন এইরকম ---
"তোমার স্বাচ্ছন্দ্য দেখি, দূর থেকে
রঞ্জনেরা খুন হলে তুমি বলো, 'মরেনি ও ,
আমার ভিতরে বেঁচে আছে' ... "
কেমন এই স্বাচ্ছন্দ্য যেটা দূর থেকে দেখি ? আসলে এই স্বাচ্ছন্দ্য মধ্যবিত্ত মানসিকতার, ছাপোষা মনোভাবের । তাই কোনো প্রতিবাদে গর্জে না উঠেই --'মরেনি সে ,আমার ভিতরে বেঁচে আছে ' বলে দায় সারা যায় ।
কত বলবো, বলতে গেলে দিনের পর দিন চলে যাবে ।তাও হয়তো বলা হবে না ঠিক করে।
" যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা
সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা "
আরওয়াল গণহত্যার পর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে লিখেছেন --
" ওদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, ওদের চক্রের ব্যূহ ঘেরা
ওদের রাইফেলে গুলি ওদের পুলিশ সুপারেরা "
ইদানীং ' সালোয়াজুড়ুম ' শব্দটি শুনতে শুনতে আমার আরওয়ালের কথাই মনে পড়ে যায় । এই ভাবেই বোধহয় ভারতবর্ষের ' প্রাইভেট আর্মি ' মান্যতা পেয়ে যায় ।
এ প্রসঙ্গে গুজরাট দাঙ্গার পরে লেখা সেই লাইনগুলি মনে পড়ছে ---
" নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা ।
যতদূর যেতে বলি যায় এরা,কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে,
ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায় । যদি বলি দিন বলে দেয় দিন
যদি বলি রাত,বলে রাত "
নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিলেন সব ছলচাতুরী একমুহূর্তে । নারায়ণী সেনা কারা ? এটা রূপক । এরা এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্ধ কর্মী । যাদের না আছে বিবেক,না মনুষ্যত্ব । ধ্বংসের জন্য , এমনকি এদের কোনো অজুহাতও লাগে না । এখানে নারায়ণী সেনা শব্দের কি সুচতুর প্রয়োগ !
নারায়ণের নিজস্ব সেনাই নারায়ণী সেনা আর নারায়ণ শব্দটা নির্দেশ করে ধর্মের ধ্বজাধারী এক কূট শক্তিকে যে নিজে বসে থাকে রাজাসনে আর তার তল্পিবাহকরা মেতে ওঠে ধ্বংসলীলায় ।
আবার ,
" ধরো কেউ নিজে থেকে দিতে চায় সব তা বলে কি
বসে থাকা সাজে ? তার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়ে এসো কাছে "
এই কবিতাতেই আছে
' চরিত্রই নেই যার তার আবার ধর্ষণ কোথায় '
ভাবা যায় ! কি নির্মম কষাঘাত । চারপাশে যখন শুনি আইনবিরুদ্ধ ভাষা- 'বেশ্যার আবার চরিত্র কিসের ? ' তখন এই কষাঘাত বিবেকী মানুষদেরও চাবকাতে বাধ্য। হায় নারীত্ব !
'কালযমুনা 'কবিতায় কলম বলছে সেই অসহায় মেয়েটির কথা যে একটা ভোগ্য বস্তু , বিক্রয়যোগ্য পণ্য । যার শরীরের বিনিময়ে কেনা হবে পরিবারের সুখ।
"বেচিস না মা বেচিস না
বেচিসনা আমায়
ওরাও ছিঁড়ে খাবে না হয়
তুই আমাকে খা "
কবি এখানেই সার্থক । সচেতন করানোর জন্য কবি লেখেন না । তিনি লেখেন বিবেকের তাগিদে, আর শঙ্খ ঘোষের বিবেক তাঁর অসম্ভব শক্তিশালী কলম ।
বাস্তু কবিতায় কবি লেখেন -
' আজকাল বনে কোন মানুষ থাকেনা
কোলকাতায় থাকে '
নাগরিক সুখের আড়ালে লেখা হয় বন্যতার গন্ধ ।শ্লেষ এখানে তীব্র ।
'পাগল' কবিতায় -------
'হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান '
বুদ্ধির কি দীপ্তি , কি শাণিত বাস্তবতাবোধ । মুহূর্তে হয়ে গেল আসল সম্প্রদায় বিভাজন ।
নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরেই লিখলেন এমন এক কবিতা যা আগুন জ্বেলে দিল মননে ।
কবিতার নাম 'সবিনয় নিবেদন' -------------
"আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে ।"
শপথ কে রেখেছেন ? কি শপথ ?
শপথ রেখেছেন মাননীয় রাষ্ট্রপ্রধানগন । সে শপথে মাটির কথা থাকেনা , মানুষ থাকে উপেক্ষিত । শুধু থাকে ঈশ্বরের নামে শপথ । শপথ রেখেছি কথাটা ব্যাজস্তুতি । প্রতিবাদীদের রক্তে , তাঁদের নরকে পাঠিয়ে স্বস্তি পায় মহান রাজনীতি !
'মার্চিং সং ' কবিতায় --
"নেই কোনো সন্ত্রাস
ত্রাস যদি কেউ বলিস তাদের
ঘটবে সর্বনাশ --
ঘাস বিচালি ঘাস
ঘাস বিচালি ঘাস !"
চারদিকে অরাজকতা , সন্ত্রাস , অত্যাচার চলছে আর রাজনীতিকরা বসে আছেন ঠাণ্ডা ঘরে । তাঁদের গায়ে নেই ঘামের এতটুকু দাগ । সব ঠিক আছে , রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে । যারা প্রতিবাদ করবেন তাঁদের জন্য উপহার - 'সর্বনাশ '। গৃহপালিত চতুষ্পদের মত চুপ থাকো , ভালো থাকো এটাই গণতন্ত্রের দান ।
'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা 'বিকল্প' । যেখানে লেখা হয়েছে --
"নিশান বদল হলো হঠাৎ সকালে
ধ্বনি শুধু থেকে গেল ,থেকে গেল বাণী
আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি আজও
একই মত থেকে যায় গ্রাম রাজধানী "
নির্বাক হয়ে যাই পড়লে । সাম্প্রতিকের থেকেও সাম্প্রতিক হয়ে থাকে এই অমর লাইন ।সত্যিই তো কিছুই পাল্টায় না । আলো আছে যার ,থাকে তার। যে তিমিরে থাকে,সে তো আরও অন্ধকারেই ডুবে যায় । রাজা আসে , রাজা যায় ; আমরা জাবর কেটেই দিনগত পাপক্ষয় করি ।
এরই ভেতর হাতে এলো কবির নতুন কাব্যগ্রন্থ - - ' প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে '। ২০১২ -র মধ্যে লেখা এই বইতে মোট ৫৫ টি কবিতা ।
'ছেলের তর্পণ করছে বাবা' নামক কবিতার কিছু লাইন এরকম -
" প্রশ্ন করে যায় নচিকেতা । প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে ।
নচিকেতা প্রশ্ন করে, অন্যমনে থেকে তার উত্তর পারিনি কিছু দিতে
হৃদয়ে নিইনি কোনো দায়
বলেছি বরং অনাদরে
' চল্ তোকে দিয়ে আসি একাকীর দোরে'... "
মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েই যাই শুধু । সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কবি অপরাধবোধের এই ক্ষয় , পুরাণের অনুষঙ্গে ।
'হাসি' কবিতায় একটি মেয়ের যন্ত্রণা তুলে আনেন কলমে অনাসায় কুশলতায় ।
'... নিজেরই জীবনকথা সাতকাহন করে বলতে বলতে
মেয়েটা হেসেই খুন ।
' সবরকম অভিজ্ঞতা হওয়াই তো ভালো এ জীবনে -
ঠিক কি না ? বলো ?
হীনতম অপমানে হতে থাকে দিনগত পাপক্ষয় -
গায়ে না মাখলেই হলো ।
যা- খুশি করুক-না সে, সয়ে যাই সব,
যে যার আপনমতো থাকি।
শেষাবধি জেনে যাবো নরকের যতটুকু বাকি ।'
আবারও খিলখিল করে
বাতাসে বাতাসে তার গড়িয়ে পড়ে হাসি ।"
কিভাবে বিবেকের মত হয়ে উঠেছে কলম । জীবনের নাক্কারজনক কথাও আজ অনায়াসে বলতে হচ্ছে সমাজের কাছে । দোষীকে শাস্তি দিতে চাওয়া এই সমাজ - আবারও কি দেগে দিচ্ছে না মেয়েটিকে । নিরুপায় মন উত্তর খুঁজে নিচ্ছে ' গায়ে না মাখলেই হলো ' ।
লেখনী এখানে চাবুক ।
আর একটি অনবদ্য কবিতা - 'মাওবাদী'
" এখনও কি তুমি প্রতিবাদ করো ?
-- মাওবাদী !
প্রশ্ন করার সাহস করেছ ?
-- মাওবাদী !
চোখে চোখ রেখে কথা বলো যদি
ঘড়ি-ঘড়ি সাজো মানবদরদি
আদরের ঠাঁই দেবে এই গারদই
মাওবাদী --
সহজ চলার ছন্দটা আজ
একটু না-হয় দাও বাদই !
দুচোখে দেখি সর্ষেফুলের মতো থোকা থোকা
মাওবাদী
এখানে-ওখানে দোকানে-বাজারে হাজারে হাজারে
মাওবাদী
বাঁকা হাসি দেখে ঠিকই চিনে যাই
মাওবাদী, তুমি মাওবাদী !"
এই কবিতা পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাম্প্রতিক সময় ।চারপাশে যা ঘটছে তাই উঠে আসে কালির আঁচড়ে । আজ কোনো প্রতিবাদ করলেই তাকে এক বিশেষ অভিধায় অভিষিক্ত করে ফেলা হচ্ছে । গণতন্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্য প্রকাশে কবি এখানে নির্ভয় । মানুষের জন্য স্বার্থহীন হয়ে কিছু করলেও রাজনীতির ধ্বজাধারী'দের আশঙ্কা হচ্ছে । চারদিকে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে, হাসিরও মানে পাল্টে যাচ্ছে । চারদিকে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করলেই হচ্ছে - রজ্জুতে সর্পভ্রম ' ।
'গলাগলি'- কবিতায় ব্যবহৃত হওয়ার কথা । যার ভালোর জন্য একদিন বোঝা তুলে নিতে হয়, নামতে হয় পথে তারাই একদিন বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যায়। গলাগলি থেকে নেমে আসে গালাগালিতে । বিশেষ কোন যূথবদ্ধ শক্তি তার হিতাকাঙ্ক্ষীকে পরিয়ে দেয় - স্বৈরতন্ত্রী'র চাদর ।
"যে- কেউ তাদের মোট বইয়ে নিতে পারে তোমাকে দিয়ে
গলাগলি করতে করতে
যে- কেউ তোমার ওপর বইয়ে দিতে পারে গালাগালির তুফান
আর তাই
যে- কোনো তন্ত্র এসে হতভম্ব তোমার কপালে
দেগে দিয়ে যেতে পারে দগদগে দাগে :
স্বৈরতন্ত্রী, স্বৈরতন্ত্রী তুমি ।"
আবার লিখছেন --
"দিনদুপুরে ঘরের মধ্যে এসে আমাকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ ।
টেনে নিয়ে যাচ্ছে পথে ।
কী করেছি ? আমি জানতে চাই।
তাদের মুখে ঢাকনা দেওয়া, কথা বলছে না কেউ ,
কাউকে যদিও দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বুঝতে পারছি পথে পথে উৎসুক জনতা ।
... "
( বিচার )
পুলিশ এখানে রাষ্ট্রযন্ত্র । অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ পালনকারী । মুখ ঢাকা , অবয়ব আছে , আর সেই অবয়ব কেবলমাত্র নির্দেশ পালন করে । সবাই দেখছে শাসন ও শোষণের উপহার ( ! ), কিন্তু তাদের নির্বাক ও অদৃশ্য থাকা ছাড়া উপায় নেই ।
মনুষ্যত্বের নিরুপায় আত্মসমর্পণ, বিকিয়ে গেছে বিবেক, মেরুদণ্ডহীন হয়ে বেঁচে আছি আমরা । সমাজের এই নিয়ত মৃত্যু লেখা হয় আখরবিন্যাসে । কবি এখানে কষাঘাত করেন । বিদ্যুৎঝলক হয়ে ওঠে তাঁর লেখনী,অসহায়তা ফুটে ওঠে যখন লেখেন --
"......'কী খুঁজছেন ?'
মিহি স্বরে বললেন তিনি : ' মেরুদণ্ডখানা ।'
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের । চমকে উঠে দেখি :
একা নয়, বহু বহু জন
একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ- কোণে ও- কোণে ঘর জুড়ে ।"
( হামাগুড়ি )
অসংখ্য কবিতা , তার অসংখ্য লাইন । কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি নিজেই জানিনা । একদম কালানুক্রমিক নয় এই লেখা । হঠাৎ হঠাৎ আসা কিছু কবিতা, কিছু স্তবক,লাইন যেভাবে আমাকে ভাবিয়েছে সেভাবেই লেখা।
আজ যখন চারদিকে সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে তখনও একই থেকে যাচ্ছে নষ্টামি, অস্থিরতা ।
অত্যাচার, শোষণ আসলে ধ্রুবক । এগুলো একই থাকে শুধু জামার বদল হয়। কবিও তাই কখনো কখনো অস্থিরতায় , দোলাচলে ভুগতে থাকেন । দিনের শেষে কবিও হয়তো আদ্যন্ত এক পরাজিত মানুষ ! তাই অসহায় উচ্চারণে লেখেন ----
" এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !"
শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবিদের একজন যিনি তাঁর লেখনীকে ব্যবহার করেন এক অনিবার্যতায় ।আপাত শান্ত , আদ্যন্ত ভদ্রলোক এই কবির কলমে ভরা থাকে প্রতিবাদের বারুদ ।
শঙ্খ ঘোষ -- এক অবিসংবাদী প্রতিবাদের নাম । যার লেখা নিয়ে বলার মত যোগ্যতাই আমার নেই । তবুও লিখছি ! কেন ?
কারণ কিছু ব্যাতিক্রমী কবি আছেন যাঁদের কবিতা আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয় না । সমাজে যখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি তার আগ্রাসী থাবা বাড়ায়,মদমত্ত শক্তির অহংকারী পদচারণ পিষ্ট করে প্রকৃত গণতন্ত্র - তখনই পরশুরামের কুঠারের মত নেমে আসে তাঁর কবিতার অমোঘ লাইন ।
শঙ্খ ঘোষের কবিতায় ভালো কবিতার শর্ত মেনেও সাম্প্রতিক সময় যতটা প্রতিভাত হয় ততটা খুব কম জনের লেখাতেই আসে । বিপন্নতায় , অস্থিরতায় যখন তাঁর কবিতার লাইন পড়ি তখন ভিতরের বারুদটা ছাপোষা মানসিকতাকে ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চায় ।
১৯৫২ সালে সদ্য তরুণ এক কবির লেখা একটা কবিতা নড়িয়ে দিয়েছিল আপামর কাব্যপ্রেমীকে । সম্ভবত দেশে প্রকাশিত প্রথম কবিতা ছিল সেটা কবির । কবির নাম - 'শঙ্খ ঘোষ ' আর কবিতার নাম ' যমুনাবতী ' । কিছু লাইন দেখা যাক --
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে,
আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে!
নোটন নোটন পায়রাগুলি
খাঁচাতে বন্দী-
দুয়েক মুঠো ভাত পেলে তা
ওড়াতে মন দিই!
হায় তোকে ভাত দেবো কী করে যে ভাত দেবো হায়
হায় তোকে ভাত দিই কী দিয়ে যে ভাত দিই হায় "
এবং
"যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে
বিষের টোপর নিয়ে!
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ-পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ গিয়ে !
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে ! "
কি অসামান্য কবিতা । এক কিশোরীর মৃত্যু এখানে উপজীব্য । সেই কিশোরী যে মারা যায় পুলিশের গুলিতে এক ভুখা মিছিলে গিয়ে । ভাতের জন্য মৃত্যু , যার ভাতের সন্ধান তাকে এনে দেয় গরম বস্তু তবে ভাতের বদলে সেটা সীসার বুলেট । সব সুখ-স্বপ্ন বারুদের কাছে , মৃত্যু এসে হাত ধরে ।এখানে নিভন্ত চুল্লিকে করে তুলেছেন এক কিশোরীর দহনে দাউদাউ চিতা ।
আবার সেই কবিই পরিণত বয়সে যমুনাবতীর চল্লিশ বছর পর লিখলেন আরেক অমোঘ কবিতা 'ন্যায় অন্যায় জানিনে' ।
"ন্যায় অন্যায় জানিনে"
তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে এত বজ্জাত হয়েছে !
স্কুলের যে ছেলেগুলো চৌকাটেই ধ্বসে গেলো, অবশ্যই তারা ছিল
সমাজবিরোধী।
ও দিকে তাকিয়ে দ্যাখো ধোয়া তুলসিপাতা
উল্টেও পারেনা খেতে ভাজা মাছটি আহা অসহায়
আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছু জানেনা বুলেটরা।
দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দ্যাখে মাঝে মাঝে।
পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।"
কি দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায় প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে এখানে । আক্রমণ এখানে শাণিত কিরীচের মত চিরে ফেলে , সরাসরি ।
তিন রাউন্ড গুলিতে তেইশ জনের মৃত্যু ! কিভাবে প্রতিবাদ করতে হয় সেই অভিঘাতে শঙ্খ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ।
'পুলিশ কখনও কোনও অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ' --- একেবারে নগ্ন করে দেওয়া রাজনীতির মুখোশ খুলে । কারণ '৪৭' এর আগে এবং অব্যবহিত পরেও স্বাধীন পুলিশের, স্বাধীন বুলেট, স্বাধীন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে দ্বিধা করেনি ,করেও না , করবেও না ।
লিখলেন --
"ভয়াবহ শব্দধূমে ভরে গেছে পৌষের বাতাস
আর সেই অবসরে কোনও কোনও পিশাচ স্বাধীন
রাজপথ থেকে নারী তুলে নিয়ে চলে যায় ট্রাকে ।"
এই ভাষ্যও সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় নারীত্বের অসম্মান ।আজও যা সমান প্রসঙ্গিক । নারী আজও ধর্ষিতা হয় ব্রিজের আড়ালে , প্রকাশ্য রাজপথে,ভাড়ার গাড়িতে । পরদিন সংবাদপত্রে সেটা পড়ে আহ-উহ করা ছাড়া আমরা কিছুই করিনা ।
কি অসহায় লাগে যখন পড়ি --
" আজকাল কবিমাত্রে অনায়াসে জঙ্ঘা বলে যাকে
শব্দের প্রকৃত বোধ কুয়াশায় একা পড়ে থাকে "
অনায়াসে বলে দেন ---
" মত কাকে বলে, শোনো । মত তা-ই যা আমার মত
সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ "
গণতন্ত্রের আসল রূপ ফুটে উঠেছে এই লাইন দুটিতে । মোসাহেবি কর, বাঁচো । এ যেন - আমিই সব । আমি এখানে যে কেউ হতে পারে । কোনো দল, মাফিয়া, সংস্থা-কর্ণধার অথবা বাড়ির গার্জেন ।আমাদের নিজের ক্ষেত্রেও এটাই সত্য । আমরা যা ভাবি তাই যথার্থ আর বাকিরা ভুল ! মতে না মিললেই সে শত্রু , আমরা হয়ে যাই পরমত অসহিষ্ণু । সে যদি সহমত হয় তাহলে তাকেই করে নিই সর্বক্ষণের সঙ্গী আর সেটা সে নির্গুণ হলেও ।
বর্তমান সময়ে ঠিক এই মানসিকতার প্রতিফলন দেখতে পাই চারদিকে ।
'ধূম লেগেছে হৃদ্ কমলে ' বই থেকে দুটি লাইন এইরকম ---
"তোমার স্বাচ্ছন্দ্য দেখি, দূর থেকে
রঞ্জনেরা খুন হলে তুমি বলো, 'মরেনি ও ,
আমার ভিতরে বেঁচে আছে' ... "
কেমন এই স্বাচ্ছন্দ্য যেটা দূর থেকে দেখি ? আসলে এই স্বাচ্ছন্দ্য মধ্যবিত্ত মানসিকতার, ছাপোষা মনোভাবের । তাই কোনো প্রতিবাদে গর্জে না উঠেই --'মরেনি সে ,আমার ভিতরে বেঁচে আছে ' বলে দায় সারা যায় ।
কত বলবো, বলতে গেলে দিনের পর দিন চলে যাবে ।তাও হয়তো বলা হবে না ঠিক করে।
" যদিও বধির, তবু ধ্বনিরও তো ছিল কিছু দেনা
সবই কি মিটিয়ে দিয়ে গেল তবে রণবীর সেনা "
আরওয়াল গণহত্যার পর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে লিখেছেন --
" ওদের ব্রহ্মর্ষি সেনা, ওদের চক্রের ব্যূহ ঘেরা
ওদের রাইফেলে গুলি ওদের পুলিশ সুপারেরা "
ইদানীং ' সালোয়াজুড়ুম ' শব্দটি শুনতে শুনতে আমার আরওয়ালের কথাই মনে পড়ে যায় । এই ভাবেই বোধহয় ভারতবর্ষের ' প্রাইভেট আর্মি ' মান্যতা পেয়ে যায় ।
এ প্রসঙ্গে গুজরাট দাঙ্গার পরে লেখা সেই লাইনগুলি মনে পড়ছে ---
" নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা ।
যতদূর যেতে বলি যায় এরা,কখনো আসেনা কোন কূটতর্ক নিয়ে,
ভাবলেশহীন ধ্বংস হাতে ছুটে যায় । যদি বলি দিন বলে দেয় দিন
যদি বলি রাত,বলে রাত "
নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিলেন সব ছলচাতুরী একমুহূর্তে । নারায়ণী সেনা কারা ? এটা রূপক । এরা এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের অন্ধ কর্মী । যাদের না আছে বিবেক,না মনুষ্যত্ব । ধ্বংসের জন্য , এমনকি এদের কোনো অজুহাতও লাগে না । এখানে নারায়ণী সেনা শব্দের কি সুচতুর প্রয়োগ !
নারায়ণের নিজস্ব সেনাই নারায়ণী সেনা আর নারায়ণ শব্দটা নির্দেশ করে ধর্মের ধ্বজাধারী এক কূট শক্তিকে যে নিজে বসে থাকে রাজাসনে আর তার তল্পিবাহকরা মেতে ওঠে ধ্বংসলীলায় ।
আবার ,
" ধরো কেউ নিজে থেকে দিতে চায় সব তা বলে কি
বসে থাকা সাজে ? তার টুঁটি ছিঁড়ে নিয়ে এসো কাছে "
এই কবিতাতেই আছে
' চরিত্রই নেই যার তার আবার ধর্ষণ কোথায় '
ভাবা যায় ! কি নির্মম কষাঘাত । চারপাশে যখন শুনি আইনবিরুদ্ধ ভাষা- 'বেশ্যার আবার চরিত্র কিসের ? ' তখন এই কষাঘাত বিবেকী মানুষদেরও চাবকাতে বাধ্য। হায় নারীত্ব !
'কালযমুনা 'কবিতায় কলম বলছে সেই অসহায় মেয়েটির কথা যে একটা ভোগ্য বস্তু , বিক্রয়যোগ্য পণ্য । যার শরীরের বিনিময়ে কেনা হবে পরিবারের সুখ।
"বেচিস না মা বেচিস না
বেচিসনা আমায়
ওরাও ছিঁড়ে খাবে না হয়
তুই আমাকে খা "
কবি এখানেই সার্থক । সচেতন করানোর জন্য কবি লেখেন না । তিনি লেখেন বিবেকের তাগিদে, আর শঙ্খ ঘোষের বিবেক তাঁর অসম্ভব শক্তিশালী কলম ।
বাস্তু কবিতায় কবি লেখেন -
' আজকাল বনে কোন মানুষ থাকেনা
কোলকাতায় থাকে '
নাগরিক সুখের আড়ালে লেখা হয় বন্যতার গন্ধ ।শ্লেষ এখানে তীব্র ।
'পাগল' কবিতায় -------
'হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান '
বুদ্ধির কি দীপ্তি , কি শাণিত বাস্তবতাবোধ । মুহূর্তে হয়ে গেল আসল সম্প্রদায় বিভাজন ।
নন্দীগ্রাম গণহত্যার পরেই লিখলেন এমন এক কবিতা যা আগুন জ্বেলে দিল মননে ।
কবিতার নাম 'সবিনয় নিবেদন' -------------
"আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে ।"
শপথ কে রেখেছেন ? কি শপথ ?
শপথ রেখেছেন মাননীয় রাষ্ট্রপ্রধানগন । সে শপথে মাটির কথা থাকেনা , মানুষ থাকে উপেক্ষিত । শুধু থাকে ঈশ্বরের নামে শপথ । শপথ রেখেছি কথাটা ব্যাজস্তুতি । প্রতিবাদীদের রক্তে , তাঁদের নরকে পাঠিয়ে স্বস্তি পায় মহান রাজনীতি !
'মার্চিং সং ' কবিতায় --
"নেই কোনো সন্ত্রাস
ত্রাস যদি কেউ বলিস তাদের
ঘটবে সর্বনাশ --
ঘাস বিচালি ঘাস
ঘাস বিচালি ঘাস !"
চারদিকে অরাজকতা , সন্ত্রাস , অত্যাচার চলছে আর রাজনীতিকরা বসে আছেন ঠাণ্ডা ঘরে । তাঁদের গায়ে নেই ঘামের এতটুকু দাগ । সব ঠিক আছে , রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে । যারা প্রতিবাদ করবেন তাঁদের জন্য উপহার - 'সর্বনাশ '। গৃহপালিত চতুষ্পদের মত চুপ থাকো , ভালো থাকো এটাই গণতন্ত্রের দান ।
'বাবরের প্রার্থনা' কাব্যগ্রন্থের আরেকটি কবিতা 'বিকল্প' । যেখানে লেখা হয়েছে --
"নিশান বদল হলো হঠাৎ সকালে
ধ্বনি শুধু থেকে গেল ,থেকে গেল বাণী
আমি যা ছিলাম তাই থেকে গেছি আজও
একই মত থেকে যায় গ্রাম রাজধানী "
নির্বাক হয়ে যাই পড়লে । সাম্প্রতিকের থেকেও সাম্প্রতিক হয়ে থাকে এই অমর লাইন ।সত্যিই তো কিছুই পাল্টায় না । আলো আছে যার ,থাকে তার। যে তিমিরে থাকে,সে তো আরও অন্ধকারেই ডুবে যায় । রাজা আসে , রাজা যায় ; আমরা জাবর কেটেই দিনগত পাপক্ষয় করি ।
এরই ভেতর হাতে এলো কবির নতুন কাব্যগ্রন্থ - - ' প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে '। ২০১২ -র মধ্যে লেখা এই বইতে মোট ৫৫ টি কবিতা ।
'ছেলের তর্পণ করছে বাবা' নামক কবিতার কিছু লাইন এরকম -
" প্রশ্ন করে যায় নচিকেতা । প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে ।
নচিকেতা প্রশ্ন করে, অন্যমনে থেকে তার উত্তর পারিনি কিছু দিতে
হৃদয়ে নিইনি কোনো দায়
বলেছি বরং অনাদরে
' চল্ তোকে দিয়ে আসি একাকীর দোরে'... "
মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েই যাই শুধু । সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন কবি অপরাধবোধের এই ক্ষয় , পুরাণের অনুষঙ্গে ।
'হাসি' কবিতায় একটি মেয়ের যন্ত্রণা তুলে আনেন কলমে অনাসায় কুশলতায় ।
'... নিজেরই জীবনকথা সাতকাহন করে বলতে বলতে
মেয়েটা হেসেই খুন ।
' সবরকম অভিজ্ঞতা হওয়াই তো ভালো এ জীবনে -
ঠিক কি না ? বলো ?
হীনতম অপমানে হতে থাকে দিনগত পাপক্ষয় -
গায়ে না মাখলেই হলো ।
যা- খুশি করুক-না সে, সয়ে যাই সব,
যে যার আপনমতো থাকি।
শেষাবধি জেনে যাবো নরকের যতটুকু বাকি ।'
আবারও খিলখিল করে
বাতাসে বাতাসে তার গড়িয়ে পড়ে হাসি ।"
কিভাবে বিবেকের মত হয়ে উঠেছে কলম । জীবনের নাক্কারজনক কথাও আজ অনায়াসে বলতে হচ্ছে সমাজের কাছে । দোষীকে শাস্তি দিতে চাওয়া এই সমাজ - আবারও কি দেগে দিচ্ছে না মেয়েটিকে । নিরুপায় মন উত্তর খুঁজে নিচ্ছে ' গায়ে না মাখলেই হলো ' ।
লেখনী এখানে চাবুক ।
আর একটি অনবদ্য কবিতা - 'মাওবাদী'
" এখনও কি তুমি প্রতিবাদ করো ?
-- মাওবাদী !
প্রশ্ন করার সাহস করেছ ?
-- মাওবাদী !
চোখে চোখ রেখে কথা বলো যদি
ঘড়ি-ঘড়ি সাজো মানবদরদি
আদরের ঠাঁই দেবে এই গারদই
মাওবাদী --
সহজ চলার ছন্দটা আজ
একটু না-হয় দাও বাদই !
দুচোখে দেখি সর্ষেফুলের মতো থোকা থোকা
মাওবাদী
এখানে-ওখানে দোকানে-বাজারে হাজারে হাজারে
মাওবাদী
বাঁকা হাসি দেখে ঠিকই চিনে যাই
মাওবাদী, তুমি মাওবাদী !"
এই কবিতা পড়তে পড়তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সাম্প্রতিক সময় ।চারপাশে যা ঘটছে তাই উঠে আসে কালির আঁচড়ে । আজ কোনো প্রতিবাদ করলেই তাকে এক বিশেষ অভিধায় অভিষিক্ত করে ফেলা হচ্ছে । গণতন্ত্রের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্য প্রকাশে কবি এখানে নির্ভয় । মানুষের জন্য স্বার্থহীন হয়ে কিছু করলেও রাজনীতির ধ্বজাধারী'দের আশঙ্কা হচ্ছে । চারদিকে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে, হাসিরও মানে পাল্টে যাচ্ছে । চারদিকে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করলেই হচ্ছে - রজ্জুতে সর্পভ্রম ' ।
'গলাগলি'- কবিতায় ব্যবহৃত হওয়ার কথা । যার ভালোর জন্য একদিন বোঝা তুলে নিতে হয়, নামতে হয় পথে তারাই একদিন বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে যায়। গলাগলি থেকে নেমে আসে গালাগালিতে । বিশেষ কোন যূথবদ্ধ শক্তি তার হিতাকাঙ্ক্ষীকে পরিয়ে দেয় - স্বৈরতন্ত্রী'র চাদর ।
"যে- কেউ তাদের মোট বইয়ে নিতে পারে তোমাকে দিয়ে
গলাগলি করতে করতে
যে- কেউ তোমার ওপর বইয়ে দিতে পারে গালাগালির তুফান
আর তাই
যে- কোনো তন্ত্র এসে হতভম্ব তোমার কপালে
দেগে দিয়ে যেতে পারে দগদগে দাগে :
স্বৈরতন্ত্রী, স্বৈরতন্ত্রী তুমি ।"
আবার লিখছেন --
"দিনদুপুরে ঘরের মধ্যে এসে আমাকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ ।
টেনে নিয়ে যাচ্ছে পথে ।
কী করেছি ? আমি জানতে চাই।
তাদের মুখে ঢাকনা দেওয়া, কথা বলছে না কেউ ,
কাউকে যদিও দেখা যাচ্ছে না কিন্তু বুঝতে পারছি পথে পথে উৎসুক জনতা ।
... "
( বিচার )
পুলিশ এখানে রাষ্ট্রযন্ত্র । অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ পালনকারী । মুখ ঢাকা , অবয়ব আছে , আর সেই অবয়ব কেবলমাত্র নির্দেশ পালন করে । সবাই দেখছে শাসন ও শোষণের উপহার ( ! ), কিন্তু তাদের নির্বাক ও অদৃশ্য থাকা ছাড়া উপায় নেই ।
মনুষ্যত্বের নিরুপায় আত্মসমর্পণ, বিকিয়ে গেছে বিবেক, মেরুদণ্ডহীন হয়ে বেঁচে আছি আমরা । সমাজের এই নিয়ত মৃত্যু লেখা হয় আখরবিন্যাসে । কবি এখানে কষাঘাত করেন । বিদ্যুৎঝলক হয়ে ওঠে তাঁর লেখনী,অসহায়তা ফুটে ওঠে যখন লেখেন --
"......'কী খুঁজছেন ?'
মিহি স্বরে বললেন তিনি : ' মেরুদণ্ডখানা ।'
সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকালো ফের । চমকে উঠে দেখি :
একা নয়, বহু বহু জন
একই খোঁজে হামা দিচ্ছে এ- কোণে ও- কোণে ঘর জুড়ে ।"
( হামাগুড়ি )
অসংখ্য কবিতা , তার অসংখ্য লাইন । কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি নিজেই জানিনা । একদম কালানুক্রমিক নয় এই লেখা । হঠাৎ হঠাৎ আসা কিছু কবিতা, কিছু স্তবক,লাইন যেভাবে আমাকে ভাবিয়েছে সেভাবেই লেখা।
আজ যখন চারদিকে সময়ের সাথে সাথে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে তখনও একই থেকে যাচ্ছে নষ্টামি, অস্থিরতা ।
অত্যাচার, শোষণ আসলে ধ্রুবক । এগুলো একই থাকে শুধু জামার বদল হয়। কবিও তাই কখনো কখনো অস্থিরতায় , দোলাচলে ভুগতে থাকেন । দিনের শেষে কবিও হয়তো আদ্যন্ত এক পরাজিত মানুষ ! তাই অসহায় উচ্চারণে লেখেন ----
" এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !"
শঙ্খ ঘোষ সেই বিরল কবিদের একজন যিনি তাঁর লেখনীকে ব্যবহার করেন এক অনিবার্যতায় ।আপাত শান্ত , আদ্যন্ত ভদ্রলোক এই কবির কলমে ভরা থাকে প্রতিবাদের বারুদ ।
অপূর্ব ভাবনার প্রকাশ।
উত্তরমুছুনosamanyo likhechhis re.
উত্তরমুছুনদুর্দান্ত প্রকাশ
উত্তরমুছুনদুর্দান্ত প্রকাশ
উত্তরমুছুন