চান্দের চর
চতুর্দশ কিস্তি
অলোকপর্ণা হসপিটালে ঝরের মতো ঢুকে আসেন তীর্থঙ্কর। রিসেপশনে কাউকে কিছু না বলেই তিনি পিকুর ঘরের দিকে ছুটে যান। বেড ফাঁকা দেখে তীর্থঙ্কর নার্সকে ধরেন। “পেশেন্ট কোথায়!” চিৎকার করেন তিনি। “এই তো বেরিয়ে গেলেন...” ভয়ে ভয়ে নার্স জবাব দেয়।
তীর্থঙ্কর আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে আসতে থাকেন হসপিটাল থেকে। তার এক কানে ফোন ধরা। “আপনি এখনই মবড হওয়ার ছবিগুলো মেসেজে পাঠান আমাকে, এই মুহূর্তেই...” এডিটরকে হুকুম দেন তিনি। বাইরে এসে চারদিকে চোখ বোলাতে থাকেন... কোথায় পিকু! আবার ফোন বের করেন তিনি, ডায়াল করেন ডঃ ঘোষকে।
“ওটা পিকুই ছিল”
ডঃ ঘোষ গলায় বিস্ময় আনার চেষ্টা করেন। “সে কি? তুমি নিশ্চিত!”
“হ্যাঁ, দীপা একটু আগে আমায় জানিয়েছে যে পিকুর ভিটিলিগো হয়েছিল”
“দীপা জানলো কি করে!”
“লং স্টোরি, আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি, পিকু হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে, কোথায় আছে জানিনা”
“পুলিশকে বলবে?” ডঃ ঘোষ দ্বিধান্বিত।
“অবশ্যই, আমি রাখছি তাহলে।” ফোন কেটে দিয়ে তীর্থঙ্কর পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদের জানিয়ে ফোন রাখতেই দেখেন ছটা পিকচার মেসেজ এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ছবিটা বের করেন তিনি। ফোন হাতে বড় বাজার এলাকার ভীড় রাস্তায় নামেন তীর্থঙ্কর। তার গায়ে তখন আর কোনো ঐশ্বরিক পালক লেগে নেই। প্রতিটা মানুষের কাছে তাদের মত সাধারণ হয়ে তিনি ফোন হাতে এগিয়ে যান। এক এক করে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন সবাইকে, কেউ ছবির চেহারার কাউকে একটু আগে দেখেছে কি না। কয়েকজন এক নির্দিষ্ট দিকে আঙুল দেখায়। তীর্থঙ্কর ছুটে চলেন সেই দিকে। পিকুর খোঁজে।
হাওড়া ব্রীজের দিকে হেঁটে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার একটু পিছনেই রেজ্জাক। আরো একটু দূরে সমস্ত ব্যথা অগ্রাহ্য করে হেঁটে আসছে দ্বৈপায়ন। কোলকাতার চিরকালীন ট্রাফিক জ্যাম রবীন্দ্র সেতু জুড়ে। দ্বৈপায়ন গাড়ির ভীর ঠেলতে ঠেলতে রবি বাউলের পিছু এগিয়ে চলে। রবিবাউল ব্রীজের শুরুতে এসেই রেজ্জাককে ছেড়ে ব্রীজের ধাতব পাত বেয়ে উপরে উঠতে থাকেন। দ্বৈপায়ন মোহান্বিতের মত তখনও তাঁর পিছু ছাড়ে না। একসময় যেন নীচের কোলাহল বাড়িয়ে দিয়ে সে ব্রীজের আনুভূমিক এক ধাতব পাতে উঠে দাঁড়ায়। দুপাশে দুটো যমজ শহরকে ধরে রেখেছে পায়ের তলার ব্রীজটা। অক্টোবরের ধারালো শান্ত রোদ আগলে রেখেছে বাঙালী কোলকাতাকে। শহরের হৃৎস্পন্দনে ব্রীজের গাড়ির আর্তনাদ চাপা পড়ে গেল। আলতো হাওয়ায় চুল উড়ছে তার। সিঁথিটা উড়ে গিয়ে নদীর পাড়ের জং ধরা নোঙ্গরে গিয়ে বসলো যেন।
তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী এসে পড়েছেন হাওড়া ব্রীজে। এখানে কাউকে জিজ্ঞেস করার নেই। জ্যামে সমস্ত গাড়ি আর বাস আটকে পড়েছে। অদ্ভুত ভাবে আজই ব্রীজের ধারের ফুটপাথে কেউ নেই। মুখ ফেরাতেই এক কোণে তিনি একটা রুক্ষ চুলের ছোটো ছেলেকে দেখতে পেলেন, একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে কিছু দেখছে। তীর্থঙ্কর তার দিকে এগিয়ে গেলেন।
“এই শোন...” ছেলেটা শূন্য দৃষ্টিতে তীর্থঙ্করের দিকে তাকায়। রেজ্জাক! “তুই এখানে কি করছিস!” ছেলেটা নিস্পলক তাকিয়ে থাকে। কোনো সাড়া না পেয়ে তীর্থঙ্কর তার সামনে ফোনটা তুলে ধরেন, ছবিতে পিকুর মুখ দেখিয়ে বলেন, “একে দেখেছিস তুই?” রেজ্জাক আঙুল তুলে তাঁকে ব্রীজের উপরের একটা অংশ দেখায়।
“হবি গঞ্জের জালালি কইতর
সুনাম গঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাঙচিল আমি
শূন্যে, শূন্যে দিলাম উড়া”
সুনাম গঞ্জের কুড়া
সুরমা নদীর গাঙচিল আমি
শূন্যে, শূন্যে দিলাম উড়া”
এক পা।
এক পা এগিয়ে এসে দ্রুত নীচের দিকে নেমে যায় দ্বৈপায়ন। তীর্থঙ্কর ছুটে আসেন রেলিঙের ধারে। একটু দূরে ফুটপাথে আছড়ে পরে পিকুর দেহটা। দূর থেকেই তীর্থঙ্কর বুঝতে পারেন ওতে আর প্রাণ নেই। আশেপাশের গাড়ি থেকে অনেকে বেরিয়ে আসেন। ভীড় জমে যায় দ্বৈপায়নের দেহ ঘিরে। তফাতে গিয়ে দাঁড়ান তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী, মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করেন তিনি। তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জীকে এখন কাঁদতে দেখলে শহরের সবচেয়ে বড় শিরোনাম তৈরী হতে পারে। রেলিঙে হেলান দিয়ে তিনি বসে পড়েন।
“ডঃ ঘোষ...”
“পেলে?”
“নাহ্।”
ফোন কেটে দেন তীর্থঙ্কর। তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় রেজ্জাক। তীর্থ দেখতে পাননা, রেজ্জাকের আগে আগে কোলকাতা শহর ছেড়ে হেঁটে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, বাউলের বেশে, হাতে একতারা নিয়ে।
“শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই,
যাইতে চান্দের চর।
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি
কোলকাতার উপর”
যাইতে চান্দের চর।
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি
কোলকাতার উপর”
শহরের আরো অনেক দিন কেটে গিয়েছে। অনেক দিন পর একসময় তীর্থঙ্কর চ্যাটার্জী রাইটার্স ব্লক থেকে উঠে এসেছেন। তিনি জানেন যে দীপান্বিতা চ্যাটার্জী এখনো পিকুর খোঁজ করে চলেছে। সে আর ফার্স্ট ইয়ারের কম্পালসারী ইংলিশ ক্লাস নিচ্ছে না। সুলগ্নাকে ধরে রুটিন চেঞ্জ করিয়ে নিয়েছে দীপা। ডঃ ঘোষ আজকাল সরাসরি পেশেন্টদের সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করেন না। তিনি অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন। আর কঙ্কাবতী আজও কলেজ স্ট্রীটে এলে কিছুক্ষণ বিনা কারণেই বিখ্যাত শাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর দোপাটি? গান, আঁকা ছেড়ে সে এখন বাঁশি নিয়ে পড়েছে।
-উপন্যাস শেষ করে উঠে দাঁড়ান তীর্থঙ্কর। গোটা খাতা জুড়ে পড়ে আছে অসংখ্য মৃত অক্ষর। একটু পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি- সন্ধানে, কে বলতে পারে, কলকাতা শহরের কোন মোড়ে বৃষ্টি ভিজে একা একটা মেয়ে হয়তো তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকে তাঁর নতুন উপন্যাস, যার প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা নাম- ‘চান্দের চর’।
(শেষ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন