হৃত বিস্মৃত হৃৎবিধৃত
স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যায় স্মরণ করছি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। লাল চেতনায় ফুটিফাটা এই কবির নাম মানুষের লড়াইএর শেষদিন পর্যন্ত সংগ্রামের অক্ষরে লেখা থেকে যাবে। দগদগে কলমকুশল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছন্দচর্চা থেকে অ-ছন্দের অস্ত্রসজ্জা – সবেতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’ (১৯৬৪) থেকে বইএ বইএ ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ (১৯৮৫)-তে চলে এলেন তিনি, অথচ তার জীবনের থেকে বৃহৎ জীবনোৎসব রঙ ছড়িয়ে গেল নিভল না, এখনোও অক্লান্তরূপ অম্লান। তার পাঁচটি কবিতায় আমরা মনে করি এই রক্তকবির পাঞ্জায় কাটাকুটির দাগগুলিকে।
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে ব’লে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমনীকে বুকে টানে ; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
জন্মভূমি আজ
একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।
এখনো রাত শেষ হয় নি ;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিন পাথরের মতো, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।
মাথার ওপর একটা ভয়ংকর কালো আকাশ
এখনো বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।
তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও
আর আকাশের ভয়ংকরকে শান্ত গলায় এই কথাটা জানিয়ে দাও
তুমি ভয় পাও নি।
মাটি তো আগুনের মতো হবেই
তুমি যদি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।
১৯৭০
নিরাপদ মাননীয় মানব সমাজ
‘I smell dark police in the trees’
দীর্ঘ দেবদারু বীথি আজ কোন আকাশ দেখে না
এখন আকাশ জুড়ে নষ্ট চাঁদ, শুরু হবে পিশাচের নাচ ;
এখন বাতাস দগ্ধ দুধকলা দিয়ে পোষা সাপের নিঃশ্বাসে...
ভাল আছ—নিরাপদ—আমাদের মাননীয় মানব সমাজ ।।
আগস্ট ১৯৬৫
স্থিরচিত্র
শ্রীগোপাল মৈত্র, সুহৃদ্বরেষু
সবই তো এক রকম
আমাদের চোর পুলিশ স্কুল কলেজ হাসপাতাল,
এই দেশে মানুষের পা রাখার জায়গা কোথায় ?
এখানে শিশুরা আসে জন্মনিয়ন্ত্রণের হুকুম মেনে ;
এখানে বেকার যুবকরা মাইলের পর মাইল
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লম্বা কিউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে
এক প্রাগৈতিহাসিক ক্ষুধার স্পর্ধাকে
তাদের বুকের হাড় আর পিঠের চামড়া খুলে দেয়
যা তাদের বেঁচে থাকার মাশুল !
কিছুই বদলায় না। আমাদের স্বপ্নগুলি
বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের মতো
সমস্ত দিন, সমস্ত রাত যাকেই সামনে পায়
তারই পা-জড়িয়ে ভিক্ষা চায় ;
যে দৃশ্য আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছি।
তবু আমরা অপেক্ষা করি ; এক মন্ত্রী যায়,
অন্য মন্ত্রী আসে
আমরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ।
২৮ জুন ১৯৭৭
অথচ ভারতবর্ষ তাদের
কোথায় তাদের ঘর ? ত্রিপুরায়, আসামে, বাংলায়
সাঁওতাল পরগণায়, দাক্ষিণাত্যে, মেঘালয়ে
ঘর কোথায় ? পাহাড়ে, জঙ্গলে, চা-বাগানে, কয়লা-খনিতে,
তারা হাঁটে, কুঁজো হয়ে কাজ করে, আধপেটা খায়, বিনা চিকিৎসায় মরে ।
কিংবা কপালের জোরে বেঁচে থাকে
কোথায় তাদের মান ? দেশ থাকতে দেশ নেই,
পথের ঠিকানা নেই
অথচ ভারতবর্ষ তাদের রক্ত ও হাড়—তারাই গড়েছে
এই মহাদেশ
শত শতাব্দির শ্রমে, পরিচ্ছন্ন সততায়, মানবিক
শুভেচ্ছায়-বোধে !
২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৪
[এই বিভাগটি বর্তমান সংখ্যা থেকে সূচনা হল। বাংলা ভাষাকে ওরা গান বলে, কিন্তু বাংলা ভাষা তো কবিতা ! আমরা যারা বাংলা কবিতাকে নিয়ে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে রয়েছি, তাদের পালকগুলি এক-এক বিন্দু শব্দের শিশির নিয়ে ভোরবেলা স্বপ্নে যায়। এত দীর্ঘ ইতিহাসের এক এক টুকরো এই আশ্লেষেশিশিরে মাখামাখি করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব স্থির হল, ক্ষেপুব্লগের আগামী সংখ্যাগুলিতে। সুখ্যাত-অখ্যাত-পঠিত-বিস্মৃত বাংলা ভাষার কবিদের স্মরণের আলোয় আমন্ত্রণের দায়িত্বে রইলেন অত্রি ভট্টাচার্য্য।]
স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যায় স্মরণ করছি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে। লাল চেতনায় ফুটিফাটা এই কবির নাম মানুষের লড়াইএর শেষদিন পর্যন্ত সংগ্রামের অক্ষরে লেখা থেকে যাবে। দগদগে কলমকুশল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছন্দচর্চা থেকে অ-ছন্দের অস্ত্রসজ্জা – সবেতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। ‘তিন পাহাড়ের স্বপ্ন’ (১৯৬৪) থেকে বইএ বইএ ‘অফুরন্ত জীবনের মিছিল’ (১৯৮৫)-তে চলে এলেন তিনি, অথচ তার জীবনের থেকে বৃহৎ জীবনোৎসব রঙ ছড়িয়ে গেল নিভল না, এখনোও অক্লান্তরূপ অম্লান। তার পাঁচটি কবিতায় আমরা মনে করি এই রক্তকবির পাঞ্জায় কাটাকুটির দাগগুলিকে।
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে
কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে ব’লে
আজও তার নিঃশ্বাসের বাতাস নির্মল ;
যদিও উজীর, কাজী, শহর-কোটাল
ছড়ায় বিষাক্ত ধুলো, ঘোলা করে জল
তথাপি মানুষ আজো শিশুকে দেখলে
নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে,
উপোসেও রমনীকে বুকে টানে ; কারও
সাধ্য নেই একেবারে নষ্ট করে তাকে।
জন্মভূমি আজ
একবার মাটির দিকে তাকাও
একবার মানুষের দিকে।
এখনো রাত শেষ হয় নি ;
অন্ধকার এখনো তোমার বুকের ওপর
কঠিন পাথরের মতো, তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছো না।
মাথার ওপর একটা ভয়ংকর কালো আকাশ
এখনো বাঘের মতো থাবা উঁচিয়ে বসে আছে।
তুমি যেভাবে পারো এই পাথরটাকে সরিয়ে দাও
আর আকাশের ভয়ংকরকে শান্ত গলায় এই কথাটা জানিয়ে দাও
তুমি ভয় পাও নি।
মাটি তো আগুনের মতো হবেই
তুমি যদি ফসল ফলাতে না জানো
যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও
তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।
যে মানুষ গান গাইতে জানে না
যখন প্রলয় আসে, সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়।
তুমি মাটির দিকে তাকাও, সে প্রতীক্ষা করছে,
তুমি মানুষের হাত ধরো, সে কিছু বলতে চায়।
১৯৭০
নিরাপদ মাননীয় মানব সমাজ
‘I smell dark police in the trees’
দীর্ঘ দেবদারু বীথি আজ কোন আকাশ দেখে না
এখন আকাশ জুড়ে নষ্ট চাঁদ, শুরু হবে পিশাচের নাচ ;
এখন বাতাস দগ্ধ দুধকলা দিয়ে পোষা সাপের নিঃশ্বাসে...
ভাল আছ—নিরাপদ—আমাদের মাননীয় মানব সমাজ ।।
আগস্ট ১৯৬৫
স্থিরচিত্র
শ্রীগোপাল মৈত্র, সুহৃদ্বরেষু
সবই তো এক রকম
আমাদের চোর পুলিশ স্কুল কলেজ হাসপাতাল,
এই দেশে মানুষের পা রাখার জায়গা কোথায় ?
এখানে শিশুরা আসে জন্মনিয়ন্ত্রণের হুকুম মেনে ;
এখানে বেকার যুবকরা মাইলের পর মাইল
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের লম্বা কিউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে
এক প্রাগৈতিহাসিক ক্ষুধার স্পর্ধাকে
তাদের বুকের হাড় আর পিঠের চামড়া খুলে দেয়
যা তাদের বেঁচে থাকার মাশুল !
কিছুই বদলায় না। আমাদের স্বপ্নগুলি
বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকের মতো
সমস্ত দিন, সমস্ত রাত যাকেই সামনে পায়
তারই পা-জড়িয়ে ভিক্ষা চায় ;
যে দৃশ্য আমরা জন্ম থেকে দেখে আসছি।
তবু আমরা অপেক্ষা করি ; এক মন্ত্রী যায়,
অন্য মন্ত্রী আসে
আমরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি ।
২৮ জুন ১৯৭৭
অথচ ভারতবর্ষ তাদের
কোথায় তাদের ঘর ? ত্রিপুরায়, আসামে, বাংলায়
সাঁওতাল পরগণায়, দাক্ষিণাত্যে, মেঘালয়ে
ঘর কোথায় ? পাহাড়ে, জঙ্গলে, চা-বাগানে, কয়লা-খনিতে,
তারা হাঁটে, কুঁজো হয়ে কাজ করে, আধপেটা খায়, বিনা চিকিৎসায় মরে ।
কিংবা কপালের জোরে বেঁচে থাকে
কোথায় তাদের মান ? দেশ থাকতে দেশ নেই,
পথের ঠিকানা নেই
অথচ ভারতবর্ষ তাদের রক্ত ও হাড়—তারাই গড়েছে
এই মহাদেশ
শত শতাব্দির শ্রমে, পরিচ্ছন্ন সততায়, মানবিক
শুভেচ্ছায়-বোধে !
২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন