মুক্ত গদ্য
সোহম দাশগুপ্ত
বনে যদি ফুটলো কুসুম
-দাদা, আপনাদের অঞ্চলে পাখিটাখি চোখে পরেনা কেন?
-পরবো কি কৈরা? পাখি থাকলেতো...
-সে কি, এ তল্লাটেও পাখি নেই?
-আমিতো জম্মে দেখি নাই। শুনছি এককালে নাকি ছিল। আওনের পথে চাইরদিকে রাবার বাগান দ্যাখসেন?
-হ্যাঁ, তা তো দেখলাম, ছবিও তো তুললাম।
-পাখির ডাক শোনছেন?
-মনে পরেনা।
-হেইটাই তো কাল হইসে। ঐ রাবার গাছ লাগানের ঠ্যালায় সব পাখি দ্যাশ ছাড়সে।
-তাই নাকি! এ তথ্যটাতো জানা ছিলোনা!
-হ, তাই সরকার নাকি অখন রাবার গাছ লাগানের কাম বন্ধ রাখসে।
-এই গানটা রবীন্দ্রনাথ কোথায় লিখেছিলেন জানেন কি?
-না তো!
-এই ত্রিপুরাতেই, ১৯২৬ সালে।
সোহম দাশগুপ্ত
বনে যদি ফুটলো কুসুম
গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ত্রিপুরা পৌঁছলাম। সারা রাজ্যটাই প্রায় নিশ্ছিদ্র সবুজ। আকাশ ছোঁয়া সেগুনের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে আমাদের বাস ছুটছে। ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ, মন্দির, পাহাড়ের গায়ে পাথরে খোদাই করা উনোকোটি দেবতা মূর্তি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জম্পুই পাহাড়ে। প্ল্যান ছিল, ঘন জঙ্গলে ঢাকা নির্জন জম্পুইএর দৃশ্য দেখার সাথে সাথে সেখানকার পাখিদের ছবি তুলবো। কিন্তু হায় কপাল, দুদিন বহু খোঁজাখুজি করে দুচারটে চড়াই আর ফিঙে ছাড়া আর কোনো পাখি, এমনকি কাকেরও টিকি পেলাম না! স্থানীয় এক দোকানদারকে শুধোতে জানালেন, "আর কইয়েন না। আদিবাসীরা সব পাখি-পুখি মাইরা খাইয়া ফ্যালাইসে"; মনে পড়ে গেলো আমাদের কলেজ হস্টেলে যে ক'জন মিজো ছেলে ছিলো তারা, প্রায় রোববার, গুলতি দিয়ে কাক মেরে রান্না করে খেতো। জম্পুইয়ের পূবদিকে হাত বাড়ালেই মিজোরাম, তাই এপারেও সেই রসনার ছোঁয়া লাগতেই পারে। এমনই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল, পরের গন্তব্য ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কুমিল্লা বর্ডারে। আমার আত্মীয়দের অনেকেই কুমিল্লার, তারা কখনো কাক খেতো বলে তো শুনিনি। আশায় বুক বাঁধলাম, বাকি সফরে নিশ্চয় পাখির দেখা পাবো।
আবার বাসযাত্রা। আবার সেই সবুজের সমারোহ। এদিকটায় সেগুনের চেয়ে রাবার প্লান্টেশনই বেশী। মাইলের পড় মাইল রাবার বাগান, মাঝেমধ্যে লোকালয়ের উঠোন পেরিয়ে পৌঁছলাম ত্রিপুরার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে। পথে ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরে আমার একান্ত আবেদন জানিয়ে গন্তব্যে পৌঁছলাম। কিন্তু ভবি ভোলাবার নয়- নীরমহলের লেক, সিপাহীজলার স্যাঙ্কচুয়ারি চষে ফেলেও তেমন কোনো পাখির দেখা মিললোনা! এবার চায়ের দোকানে এক স্থানীয় মানুষের দ্বারস্থ হলাম।
-দাদা, আপনাদের অঞ্চলে পাখিটাখি চোখে পরেনা কেন?
-পরবো কি কৈরা? পাখি থাকলেতো...
-সে কি, এ তল্লাটেও পাখি নেই?
-আমিতো জম্মে দেখি নাই। শুনছি এককালে নাকি ছিল। আওনের পথে চাইরদিকে রাবার বাগান দ্যাখসেন?
-হ্যাঁ, তা তো দেখলাম, ছবিও তো তুললাম।
-পাখির ডাক শোনছেন?
-মনে পরেনা।
-হেইটাই তো কাল হইসে। ঐ রাবার গাছ লাগানের ঠ্যালায় সব পাখি দ্যাশ ছাড়সে।
-তাই নাকি! এ তথ্যটাতো জানা ছিলোনা!
-হ, তাই সরকার নাকি অখন রাবার গাছ লাগানের কাম বন্ধ রাখসে।
বাকি বেড়ানোটা জমজমাট চলছিলো। পরদিন আগরতলা ফিরে, চললাম উজ্জয়ন্ত প্যালাস দেখতে। এখন ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ ঝকঝকে স্টেট মিউজিয়াম। বিভিন্ন ঘরে ঘুড়তে ঘুড়তে পৌঁছলাম রবীন্দ্র কক্ষে। রবিঠাকুরের ছোঁয়া পেলেই বাঙ্গালীর মন উদাস হয়ে যায়। মনের কোনে পাখির দেখা না পাওয়ার আক্ষেপটা ছিলো বলেই হয়তো অজান্তেই গুনগুনিয়ে উঠলাম "বনে যদি ফুটল কুসুম, নেই কেন সেই পাখি নেই কেন..."; হঠাৎই মিউজিয়ামের এক কর্মী মিষ্টি হেঁসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি বেজায় অপ্রস্তুত, এযাবৎ আমার গান শুনে কাউকে কখনো উৎসাহী হতে দেখিনি। ভদ্রলোক বললেন,
-এই গানটা রবীন্দ্রনাথ কোথায় লিখেছিলেন জানেন কি?
-না তো!
-এই ত্রিপুরাতেই, ১৯২৬ সালে।
জম্পুই পাহাড় |
"বিসর্জন" এর সেই মন্দির। |
উজ্জয়ন্ত প্যালেস |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন