বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর – তিন
সৌমিত্র চক্রবর্তী
একটানা দশ বছর কোথাও থাকেনি সে। সেই মায়ের পেটে থাকতেই চরকিপাক শুরু হয়েছিল। আজও সে পাকচক্রের গন্ডীর বাইরে যেতেই পারলো না। কিম্বা হয়তো জন্ম থেকেই মনটা এভাবেই তৈরী হয়ে গেছিল। জন্মাবধি দেখে এসেছে এক জায়গায় থিতু হতে না হতেই নতুনের ডাক এসে পড়ে। পুরনোর ক্লেদ ধোঁয়ার মত ঘুরপাক খাওয়ার শুরু করে যেই, ওমনি তাকে টা টা করে উঠে পড়তে হয় বাক্স প্যাঁটরা সমেত আরেক গাড়ীতে।
অঘ্রাণ পেরিয়ে পৌষালি শীত সকালে অলস সমকামিতায় ইতিউতি রোদ পোয়ায় অলস গরুবাছুর,কুকুর কিম্বা বাতিল মানুষ। বভ্রুবাহণের দেশের সৌন্দর্যের খোঁজ পায়ওনি কোনোদিন আর সে খোঁজের টুকিটাকি জানার ইচ্ছেও হারিয়ে ফেলেছে তারা কবেই। প্রথম দেখার লাজুক হাসি মুখে নিয়ে চোখ মেলছে গাছপালার দল। গুনগুন গান গেয়ে স্ফূর্তির পূর্ণ ভান্ডার থেকে খরচ করছে সদ্য ঠান্ডা থেকে উষ্ণতায় পা দেওয়া সকাল।
কুয়াশা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। অনিচ্ছুক প্রেমিকের মত যেতে যেতেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বারবার। জটীল সম্পর্কের কবচ গুলো এঁকেবেঁকে খুলে ছড়িয়ে পড়েই বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। লোকটা হেঁটে যাচ্ছে একমনে বরাবরের মতই পেছনে একেবারেই না তাকিয়ে। দূরে গ্রামের প্রান্তিক রাস্তায় মাথায় মরচে ধরা টিন বয়ে চোরাবাজারের কেরোসিন তেল বিক্রীর জন্যে হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে তার মতই আরেক কোনো অপদার্থ মানুষ।
ভূতত্বের নেশায় বেরিয়ে পড়া বাবার ঔতসুক্যতা তার মধ্যেও আপাদমস্তক। পশ্চিমের কিম্বা উত্তরের রুক্ষ অঞ্চল তাকে আজও সমান টানে, বারবার ঘুরেফিরে আসে স্বপ্নের ঝিলিকমহলে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টিলা, পলাশ আর বেটেখাটো কুলের জঙ্গল, হঠাৎ একঝাঁক রঙবেরঙ মাটির আদিবাসী কুঁড়েঘর। কি যে অদ্ভুত কায়দায় কিছু লতাপাতা পুড়িয়ে জলে গুলে নানান রঙ তৈরী করে তাই দিয়ে আদিম নক্সায় ভরে তোলে নিজেদের মাটির ঘরগুলো! অনেকবার দেখেও আয়ত্ব করতে পারেনি সে। প্রায় অভুক্ত শরীরগুলো থেকেই বাঃ ওরকম জেল্লা কিভাবে বেরোয়, তাও তার অজানাই রয়ে গেল আদিবাসী রমনীর শরীর চেটে খাওয়ার স্বপ্নের মতই।
লাল কাঁকুরে প্রান্তর, মোরাম বিছানো রাস্তা, ফলসার ,মগডালে ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে টুকটুক ফলসা ছিঁড়ে পকেটে পোরা হয়তো এ জীবনে আর ফিরে আসবে না। আসবে না বহু ফেলে আসা সুপ্তির অতলে হারানো দিলখুশ আনন্দসময়। আদিবাসী মেয়ের স্তনের মত ডাঁটো শৈশব কখন উধাও হয়ে উলুঝুলু মধ্যবয়সীনির প্রত্যঙ্গে স্থিতু হল কে ই বা তার খবর রাখে?
একটা কাঠবিড়ালী ফাজলামোর হাসি চোখের কোনায় ধরে একবার নমস্কার করেই পেরিয়ে গেল মাঠের আল। সম্ভবত বড় অর্জুন গাছটা তার আস্তানা। একা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে গাছটা অহংকারী চোখে চারপাশকে অবজ্ঞা করেই যেন কিছুই দেখছে না অথচ সবই তার অনুমতি নিয়েই ঘটছে। আজীবন যাযাবর লোকটাকে করুনা করে সে। এক জায়গায় কিছুদিন থাকার পরে সম্পূর্ণ অজানা জায়গার খোঁজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাবার কথা সে চিন্তাই করতে পারেনা। উদ্বাস্তু দের জন্যে মনে ঘৃণা আর করুণা ছাড়া আর কিছুই রাখেনি শেষ সামন্ত প্রতিভূ অর্জুন গাছ।
থমকে একটা বিড়ি বার করে পকেট হাতড়ে, ফুঁ দেয়, ধরায় লোকটা। পরম আদরে বিড়িটার দিকে তাকিয়ে আশ্লেষে চুমু খায় প্রান্তফাঁকে। ভুস ভুস করে সকাল হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় সমস্ত অবরুদ্ধ কাম। দূরে বড় রাস্তায় লোক চলাচল শুরু হয়েছে। চিড়িক মেরে উঁকি দেওয়া নদীর বুক বেয়ে ফিরছে সারারাত জাগা নিশাচর মেছুয়ারা। নৌকা তাদের রসদে বোঝাই। মাঠের পেট চিরে চলে যাওয়া একাকী রেললাইন গুমগুম শব্দে কাঁপছে অদূরবর্তী জান্তব ধর্ষণভয়ে। আর কিছু পরেই পালে পালে আসবে পোষ্যরা কচি ঘাসের লোভে।
আনমনে লোকটা হাঁটে, হেঁটে যায় দূরগামী কোনো স্বপ্নের উদ্দেশ্যে। আজীবন পায়ের নিচে তার সরষেবলয়। এতদিন পরে এই প্রথম প্রেমে পড়েছে সে। হয়তো কোনো শান্ত ঘরের ততোধিক শান্ত ছায়ার আশা, সারাজীবন বেঁধে রাখবে এই অগোছালো উচাটন যাযাবরকে। কিম্বা কাজল চোখ হয়তো বা আবার ভাসবে জলে।
লোকটা হাঁটে স্থির কিছু না ভেবেই। পা চালায় কখনো দ্রুত। কখনো বা আনমনে।
বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর – চার
সকাল বসে থাকেনা। দুপুর বসে থাকেনা। সন্ধে-রাত্রি; আসলে কেউই কারো জন্যেই বসে থাকেনা। তোমাকে ছাড়া বাঁচব না কিম্বা আমি ছাড়া দুনিয়া অচল জাতীয় হাক্লিষ্ট কূপমন্ডুক ভাবনার গন্ডীতে কোনোদিনই বাঁধা পড়েনি সে। খুব ভালো করেই জানে তার জন্যে এই ডিম্বাকৃতি গ্রহের কোনো মেরুতেই কেউই অপেক্ষায় নেই, থাকার কথাও ছিলোনা কোনো। কখনো কাউকে কোনো কথা দেয়নি সে। দেয়না এখনো।
ছায়া ছায়া ঘোর কাটিয়ে সকাল এখন তরুন। উত্তপ্ত সঙ্গমেচ্ছায় নিজেও তাতছে, তাতাচ্ছে অন্যদেরও। পটুয়ার টানে পটের একের পর এক মিলিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর জলসংগ্রহের জায়গায় কলমোচ্ছব বেঁধেছে। আগে পিছের ঝগড়া, মৃত্যুকামনা পরস্পরের, রসালো কেচ্ছা, পরনিন্দা-পরচর্চা। অনিচ্ছুক কৈশোরের ভারী ব্যাগ কাঁধে গতের অনুগত হওয়ার পথে এক-দুই-তিন পা এগোনো। কাকের দলের আর কুকুরের দলের বিকট কর্কশ চিৎকার, যেন শব্দপ্রতিযোগিতায় নেমেছে ওরা।
শব্দ! বাটখারার মাপে অতিরিক্ত হয়ে গেলে কোনোদিনই সহ্য করতে পারেনা সে। ছোট থেকেই বড় লাজুক সে। সব অভিমান-ক্রোধ-ভালোবাসার উচ্চকিত মুখ ঘুরিয়ে দেয় নিজেরই অন্দরমানুষের দিকে। আবছায়া মন নিয়ে তৈরী করে দ্বৈতসত্তা। নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে। সে সময় চোখ কিছুই দেখেনা। কর্নিয়ার উল্টোদিকে অভিনীত হয়ে চলে আরেক নারণিয়ার রূপকথা। কাল রাতের অতিরিক্ত কথা বলা চাষীর বউয়ের ঠোঁট দুটো কিছু না ভেবেই চেপে ধরেছিল। অথচ তারপরেই চর ও অচর উত্তাল, তারও পরে সব শান্ত। অখন্ড মনোযোগে কুলকুল বয়ে চলা নীরবতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল সে।
মাথার জমাট বাঁধা উস্কোখুস্কো চুলে অন্যমনস্কতায় উঠে আসে হাত। মনবাউলের গান ভেসে আসছে কোথা থেকে যেন। “সাধন ভজন চাইনা আমি, চাই শুধু তোর ঠিকানা মন। গ্রাম জানিনা পোস্টাপিসও, পথের খোঁজেই এ দিগজ্বলন”।। এ সুর তো তার চেনা, কথাগুলোও তারই কথা। ওই গেরুয়া বাউল তার ভেতরে ঢুকে হাঁটকে পাটকে কখন তার ভাবনাই চুরি করে ছড়িয়ে দিচ্ছে তরুন দিনের রোদ্দুরে। মাঘের শীত জড়িয়ে থাকে সর্বত্র।
সারাটা জীবন গেলেই চুল পাকে, বলিরেখা আঁচড় কাটে ত্বকে। কিন্তু নিজেকে চিনতে পারে কেউ? পর্ণমোচী নিমের পাতায় প্রেমের স্থায়ী বসত গড়ে উঠতে পারেনা। মানুষ বড় পলকা জীব। নিজের দেহেরই তল পায়না সে, তো অনন্ত মহাকাশে একের পর এক গ্যালাক্সি পেরিয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে যাওয়া মন কি করে ছোঁবে সে? তবুও বিভ্রান্ত দোপেয়ে জীব চালাকির হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে- ‘চিনি, আমি চিনি তোমাকে’। কিন্তু সত্যিই কেউ কাউকেই চেনেনা, বুঝতে পারেনা। মনের ঠিকানা খোজা বাউলের মতোই দিগজ্বলনে জ্বলছে সবাই।
কখন রাস্তা ফুরিয়ে যায়। সামনে ভেসে ওঠে আঁকাবাঁকা লক্ষ জাতিসত্তার আলে বিভক্ত জরাজীর্ণ মাঠ। সেখানে গহীনে একা দাঁড়িয়ে থাকা অকুলীন গাছ ডাল নেড়ে, পাতা নেড়ে ডাকে – ‘আয় আয়! ও জন্মফকির, একটু দাঁড়িয়ে যা। হাত বুলিয়ে দিয়ে যা আমার একাকী ক্ষতে। ছায়া দেব-ফল দেব-দুদন্ড জিরান দেব, আর দেব জন্মকাহিনী সুখ দুঃখের অলীক মায়ায় ভরা’।
থমকে যায় লোকটা। দাঁড়িয়ে দেখে মাথার ওপরে একঘেয়ে একরঙা আকাশ। পায়ের নিচে কেটে নেওয়া ধানের গোড়া মচমচ শব্দে কৌতুক করে। চন্দ্রবোড়া, আলকেউটেরা নির্বীজ ঘুমে মগ্ন কোন অতলে। টুইটুই ডেকে উড়ে যায় ডাহুক। মুহূর্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে আবার সামনে পা বাড়ায় নিয়ম না জানা শৃঙ্খলাহীন লোকটা।
একটানা দশ বছর কোথাও থাকেনি সে। সেই মায়ের পেটে থাকতেই চরকিপাক শুরু হয়েছিল। আজও সে পাকচক্রের গন্ডীর বাইরে যেতেই পারলো না। কিম্বা হয়তো জন্ম থেকেই মনটা এভাবেই তৈরী হয়ে গেছিল। জন্মাবধি দেখে এসেছে এক জায়গায় থিতু হতে না হতেই নতুনের ডাক এসে পড়ে। পুরনোর ক্লেদ ধোঁয়ার মত ঘুরপাক খাওয়ার শুরু করে যেই, ওমনি তাকে টা টা করে উঠে পড়তে হয় বাক্স প্যাঁটরা সমেত আরেক গাড়ীতে।
অঘ্রাণ পেরিয়ে পৌষালি শীত সকালে অলস সমকামিতায় ইতিউতি রোদ পোয়ায় অলস গরুবাছুর,কুকুর কিম্বা বাতিল মানুষ। বভ্রুবাহণের দেশের সৌন্দর্যের খোঁজ পায়ওনি কোনোদিন আর সে খোঁজের টুকিটাকি জানার ইচ্ছেও হারিয়ে ফেলেছে তারা কবেই। প্রথম দেখার লাজুক হাসি মুখে নিয়ে চোখ মেলছে গাছপালার দল। গুনগুন গান গেয়ে স্ফূর্তির পূর্ণ ভান্ডার থেকে খরচ করছে সদ্য ঠান্ডা থেকে উষ্ণতায় পা দেওয়া সকাল।
কুয়াশা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। অনিচ্ছুক প্রেমিকের মত যেতে যেতেও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে বারবার। জটীল সম্পর্কের কবচ গুলো এঁকেবেঁকে খুলে ছড়িয়ে পড়েই বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। লোকটা হেঁটে যাচ্ছে একমনে বরাবরের মতই পেছনে একেবারেই না তাকিয়ে। দূরে গ্রামের প্রান্তিক রাস্তায় মাথায় মরচে ধরা টিন বয়ে চোরাবাজারের কেরোসিন তেল বিক্রীর জন্যে হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে তার মতই আরেক কোনো অপদার্থ মানুষ।
ভূতত্বের নেশায় বেরিয়ে পড়া বাবার ঔতসুক্যতা তার মধ্যেও আপাদমস্তক। পশ্চিমের কিম্বা উত্তরের রুক্ষ অঞ্চল তাকে আজও সমান টানে, বারবার ঘুরেফিরে আসে স্বপ্নের ঝিলিকমহলে। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টিলা, পলাশ আর বেটেখাটো কুলের জঙ্গল, হঠাৎ একঝাঁক রঙবেরঙ মাটির আদিবাসী কুঁড়েঘর। কি যে অদ্ভুত কায়দায় কিছু লতাপাতা পুড়িয়ে জলে গুলে নানান রঙ তৈরী করে তাই দিয়ে আদিম নক্সায় ভরে তোলে নিজেদের মাটির ঘরগুলো! অনেকবার দেখেও আয়ত্ব করতে পারেনি সে। প্রায় অভুক্ত শরীরগুলো থেকেই বাঃ ওরকম জেল্লা কিভাবে বেরোয়, তাও তার অজানাই রয়ে গেল আদিবাসী রমনীর শরীর চেটে খাওয়ার স্বপ্নের মতই।
লাল কাঁকুরে প্রান্তর, মোরাম বিছানো রাস্তা, ফলসার ,মগডালে ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে টুকটুক ফলসা ছিঁড়ে পকেটে পোরা হয়তো এ জীবনে আর ফিরে আসবে না। আসবে না বহু ফেলে আসা সুপ্তির অতলে হারানো দিলখুশ আনন্দসময়। আদিবাসী মেয়ের স্তনের মত ডাঁটো শৈশব কখন উধাও হয়ে উলুঝুলু মধ্যবয়সীনির প্রত্যঙ্গে স্থিতু হল কে ই বা তার খবর রাখে?
একটা কাঠবিড়ালী ফাজলামোর হাসি চোখের কোনায় ধরে একবার নমস্কার করেই পেরিয়ে গেল মাঠের আল। সম্ভবত বড় অর্জুন গাছটা তার আস্তানা। একা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে গাছটা অহংকারী চোখে চারপাশকে অবজ্ঞা করেই যেন কিছুই দেখছে না অথচ সবই তার অনুমতি নিয়েই ঘটছে। আজীবন যাযাবর লোকটাকে করুনা করে সে। এক জায়গায় কিছুদিন থাকার পরে সম্পূর্ণ অজানা জায়গার খোঁজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাবার কথা সে চিন্তাই করতে পারেনা। উদ্বাস্তু দের জন্যে মনে ঘৃণা আর করুণা ছাড়া আর কিছুই রাখেনি শেষ সামন্ত প্রতিভূ অর্জুন গাছ।
থমকে একটা বিড়ি বার করে পকেট হাতড়ে, ফুঁ দেয়, ধরায় লোকটা। পরম আদরে বিড়িটার দিকে তাকিয়ে আশ্লেষে চুমু খায় প্রান্তফাঁকে। ভুস ভুস করে সকাল হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় সমস্ত অবরুদ্ধ কাম। দূরে বড় রাস্তায় লোক চলাচল শুরু হয়েছে। চিড়িক মেরে উঁকি দেওয়া নদীর বুক বেয়ে ফিরছে সারারাত জাগা নিশাচর মেছুয়ারা। নৌকা তাদের রসদে বোঝাই। মাঠের পেট চিরে চলে যাওয়া একাকী রেললাইন গুমগুম শব্দে কাঁপছে অদূরবর্তী জান্তব ধর্ষণভয়ে। আর কিছু পরেই পালে পালে আসবে পোষ্যরা কচি ঘাসের লোভে।
আনমনে লোকটা হাঁটে, হেঁটে যায় দূরগামী কোনো স্বপ্নের উদ্দেশ্যে। আজীবন পায়ের নিচে তার সরষেবলয়। এতদিন পরে এই প্রথম প্রেমে পড়েছে সে। হয়তো কোনো শান্ত ঘরের ততোধিক শান্ত ছায়ার আশা, সারাজীবন বেঁধে রাখবে এই অগোছালো উচাটন যাযাবরকে। কিম্বা কাজল চোখ হয়তো বা আবার ভাসবে জলে।
লোকটা হাঁটে স্থির কিছু না ভেবেই। পা চালায় কখনো দ্রুত। কখনো বা আনমনে।
বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর – চার
সকাল বসে থাকেনা। দুপুর বসে থাকেনা। সন্ধে-রাত্রি; আসলে কেউই কারো জন্যেই বসে থাকেনা। তোমাকে ছাড়া বাঁচব না কিম্বা আমি ছাড়া দুনিয়া অচল জাতীয় হাক্লিষ্ট কূপমন্ডুক ভাবনার গন্ডীতে কোনোদিনই বাঁধা পড়েনি সে। খুব ভালো করেই জানে তার জন্যে এই ডিম্বাকৃতি গ্রহের কোনো মেরুতেই কেউই অপেক্ষায় নেই, থাকার কথাও ছিলোনা কোনো। কখনো কাউকে কোনো কথা দেয়নি সে। দেয়না এখনো।
ছায়া ছায়া ঘোর কাটিয়ে সকাল এখন তরুন। উত্তপ্ত সঙ্গমেচ্ছায় নিজেও তাতছে, তাতাচ্ছে অন্যদেরও। পটুয়ার টানে পটের একের পর এক মিলিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর জলসংগ্রহের জায়গায় কলমোচ্ছব বেঁধেছে। আগে পিছের ঝগড়া, মৃত্যুকামনা পরস্পরের, রসালো কেচ্ছা, পরনিন্দা-পরচর্চা। অনিচ্ছুক কৈশোরের ভারী ব্যাগ কাঁধে গতের অনুগত হওয়ার পথে এক-দুই-তিন পা এগোনো। কাকের দলের আর কুকুরের দলের বিকট কর্কশ চিৎকার, যেন শব্দপ্রতিযোগিতায় নেমেছে ওরা।
শব্দ! বাটখারার মাপে অতিরিক্ত হয়ে গেলে কোনোদিনই সহ্য করতে পারেনা সে। ছোট থেকেই বড় লাজুক সে। সব অভিমান-ক্রোধ-ভালোবাসার উচ্চকিত মুখ ঘুরিয়ে দেয় নিজেরই অন্দরমানুষের দিকে। আবছায়া মন নিয়ে তৈরী করে দ্বৈতসত্তা। নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলে। সে সময় চোখ কিছুই দেখেনা। কর্নিয়ার উল্টোদিকে অভিনীত হয়ে চলে আরেক নারণিয়ার রূপকথা। কাল রাতের অতিরিক্ত কথা বলা চাষীর বউয়ের ঠোঁট দুটো কিছু না ভেবেই চেপে ধরেছিল। অথচ তারপরেই চর ও অচর উত্তাল, তারও পরে সব শান্ত। অখন্ড মনোযোগে কুলকুল বয়ে চলা নীরবতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছিল সে।
মাথার জমাট বাঁধা উস্কোখুস্কো চুলে অন্যমনস্কতায় উঠে আসে হাত। মনবাউলের গান ভেসে আসছে কোথা থেকে যেন। “সাধন ভজন চাইনা আমি, চাই শুধু তোর ঠিকানা মন। গ্রাম জানিনা পোস্টাপিসও, পথের খোঁজেই এ দিগজ্বলন”।। এ সুর তো তার চেনা, কথাগুলোও তারই কথা। ওই গেরুয়া বাউল তার ভেতরে ঢুকে হাঁটকে পাটকে কখন তার ভাবনাই চুরি করে ছড়িয়ে দিচ্ছে তরুন দিনের রোদ্দুরে। মাঘের শীত জড়িয়ে থাকে সর্বত্র।
সারাটা জীবন গেলেই চুল পাকে, বলিরেখা আঁচড় কাটে ত্বকে। কিন্তু নিজেকে চিনতে পারে কেউ? পর্ণমোচী নিমের পাতায় প্রেমের স্থায়ী বসত গড়ে উঠতে পারেনা। মানুষ বড় পলকা জীব। নিজের দেহেরই তল পায়না সে, তো অনন্ত মহাকাশে একের পর এক গ্যালাক্সি পেরিয়ে যাওয়া, ছড়িয়ে যাওয়া মন কি করে ছোঁবে সে? তবুও বিভ্রান্ত দোপেয়ে জীব চালাকির হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে- ‘চিনি, আমি চিনি তোমাকে’। কিন্তু সত্যিই কেউ কাউকেই চেনেনা, বুঝতে পারেনা। মনের ঠিকানা খোজা বাউলের মতোই দিগজ্বলনে জ্বলছে সবাই।
কখন রাস্তা ফুরিয়ে যায়। সামনে ভেসে ওঠে আঁকাবাঁকা লক্ষ জাতিসত্তার আলে বিভক্ত জরাজীর্ণ মাঠ। সেখানে গহীনে একা দাঁড়িয়ে থাকা অকুলীন গাছ ডাল নেড়ে, পাতা নেড়ে ডাকে – ‘আয় আয়! ও জন্মফকির, একটু দাঁড়িয়ে যা। হাত বুলিয়ে দিয়ে যা আমার একাকী ক্ষতে। ছায়া দেব-ফল দেব-দুদন্ড জিরান দেব, আর দেব জন্মকাহিনী সুখ দুঃখের অলীক মায়ায় ভরা’।
থমকে যায় লোকটা। দাঁড়িয়ে দেখে মাথার ওপরে একঘেয়ে একরঙা আকাশ। পায়ের নিচে কেটে নেওয়া ধানের গোড়া মচমচ শব্দে কৌতুক করে। চন্দ্রবোড়া, আলকেউটেরা নির্বীজ ঘুমে মগ্ন কোন অতলে। টুইটুই ডেকে উড়ে যায় ডাহুক। মুহূর্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে আবার সামনে পা বাড়ায় নিয়ম না জানা শৃঙ্খলাহীন লোকটা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন