'দুখিনী বাংলা বানান' ও সুখী/সুখি বানানবিদ (!)
ঢাকার একটি দৈনিকের সাহিত্য-সাময়িকীতে গোলাম মুরশিদের বানান-বিষয়ক একটি লেখা 'দুখিনী বাংলা বানান' পাঠ করে প্রথমে দুটি বিষয়ের কথা মনে হলো/হল। কিছুদিন আগে ঢাকা শহরে একটি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় কিছু বিলবোর্ড দেখা গিয়েছিল, যেখানে 'গাড়ী ভরে বাড়ী যান' এমন একটি বাক্য ছিল। এটি বিজ্ঞাপন আকারেও অর্ধপৃষ্ঠা-সিকিপৃষ্ঠা জুড়ে কিছু দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু 'গাড়ী-বাড়ী'র বিকল্প বানানের বিধান সেই ১৯৩৬ সালে দেওয়া! তার হীরক-জয়ন্তী পার করেও মানুষ (পণ্ডিত নন) আজও ওখানেই রয়ে গেল কেমন করে? আরেকটি হচ্ছে, গত ১০ বছর ধরে কিছু সরকারী/সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর/শ্রেণির প্রথম দিকের রোলনম্বরধারী শিক্ষার্থীদের, অর্থাৎ ভালো ছাত্রদের, বর্ণমালা লিখতে দিয়ে আমি কিছু তথ্য পেয়েছি। তার একটি হচ্ছে অনেকেই বর্ণ হিসাবে 'ক্ষ' লিখেছে যা তাদের বাবাদের পাঠ্যপুস্তকেও, অন্তত সরকারী/সরকারি পাঠ্যপুস্তকে, ছিল না। অন্যদিকে ২০০২ সালে অন্তঃস্থ-ব বর্ণমালায় সংযুক্ত হলেও দেখা গেছে প্রায় কোনো শিক্ষার্থীই বর্ণটি লেখেনি।
এগুলোর সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে নিশ্চয়। এই তাৎপর্য অনুসন্ধান করা বানানবিদদের (!) কাজ নয়। লেখাটি যিনি লিখেছেন তিনি বানানবিদ (!) নন, সত্যনিষ্ঠ গবেষক বলে তাঁর পরিচিতি। বাংলা বানান নিয়ে সাম্প্রতিক নিরীক্ষার কিছু প্রকৃতি তিনি উপলব্ধি করেছেন। লেখাটিতে তিনি বাংলা বানান নির্ধারণের ইতিহাসের আদিকাল হয়ে ইংরেজী/ইংরেজি বানান সংস্কারের বিভিন্ন প্রচেষ্টা উল্লেখ করেছেন, এবং পরিশেষে 'শ্রেণী'কে 'শ্রেণি'করণ ও 'চীন'কে 'চিন'করণ করার দৃষ্টান্ত্ তুলে ধরে একরকম হাহাকারই করেছেন।
লেখক ১৯৩৬ সালের বানান-বিষয়ক সুপারিশকে 'গোঁজামিল' বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তৎপরবর্তী পর্যায়ের বানান-সংস্কার প্রক্রিয়াগুলোর ইতিহাস জেনে, রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্লাবী প্রভাবের কথা স্বীকার করে নিয়েও, নিশ্চিতভাবে বলা যায় - এগুলোর মধ্যে ১৯৩৬ সালের সুপারিশমালাই সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাই বাংলাদেশের শিক্ষিত সাধারণ মানুষ, পাঠক ও শিক্ষার্থীরা ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত্ মোটামুটি এটা অনুসরণ করেই পড়ে-লিখে-বুঝে আসছিল। এরপর এখানে যা হয়েছে তা 'সরকারি হস্তক্ষেপ', এবং যেটা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, 'সরকারি আদেশের ফলে যা হতে পারে, তা হলো : বানানবিভ্রাট।' এবং সেটাই ঘটেছে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এটা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সামরিক-শাসক প্রবর্তিত সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচী/কর্মসূচি বাস্তবায়ন কৌশলের সাথে বাংলা লিপি-স্পষ্টীকরণ ও বানান-সহজকরণের ফর্মুলা জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে। তখন বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যায়ন গ্রহণের জন্য পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ৩ দিনের একটি কর্মশিবিরের আয়োজন করে। এর কৌশলী শিরোনাম ছিল 'সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার পটভূমিতে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা বানানের সমতাবিধান-বিষয়ক জাতীয় কর্মশিবির'। ৩ দিনের সেই কর্মশিবিরে গৃহীত সিদ্ধান্ত্ ছিল বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা-উত্তরকালে গৃহীত সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত্।
প্রকৃতপক্ষে 'সমতাবিধান'-এর নামে যা করা হয়েছিল তা হচ্ছে 'পাঠ্যপুস্তক' এবং 'পাঠ্যপুস্তক নয়' এমন বিভাজন টেনে ব্যাপক লিপি-সংস্কার এবং কিছু বানান-সংস্কার। কারচিহ্ন ও যুক্তবর্ণ মিলিয়ে ৪২টির মতো টাইপ তাঁরা পরিবর্তন করেছিল। সেই ৪২টি টাইপ ব্যবহৃত হয় এমন শব্দসংখ্যা বাংলায় কয়েক হাজার। সুতরাং তখন থেকে এই সহস্রাধিক শব্দের পাঠ্যবইয়ে ব্যবহৃত রূপ আর পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতে ব্যবহৃত রূপ আলাদা। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত্ বোর্ডের সিদ্ধান্ত্ ছিল উক্ত টাইপগুলোর আদি রূপ - যেটা শিক্ষার্থীরা পথে-ঘাটে, পত্র-পত্রিকায়, অপাঠ্য বইয়ে, টেলিভিশনে পড়ে-দেখে সেটা - তাঁরা শেখাবেন না। কিন্তু ২০০৫ সালে এসে তাঁরা স্পষ্ট রূপটাকে চালু রেখেই আদি রূপটিও শিক্ষার্থীদের শেখানোর বিধান দিলেন। তাই আগে শিক্ষার্থীরা যুক্তবর্ণের অস্পষ্ট একটা রূপ শিখত, এখন তারা স্পষ্ট-অস্পষ্ট দুটোই শিখছে। স্পষ্ট শিখছে পাঠ্যবই পড়ার জন্য, আর অস্পষ্ট শিখছে 'অপাঠ্য' বই পড়ার জন্য।
লিপির পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বিকল্প বর্জন করে যেসব বানান গ্রহণ করেছিলেন তার কিছু দৃষ্টান্ত্ এরকম : খ্রিস্টান, পোস্টঅফিস, পেশি, শেফালি, আমদানি, গ্রিক, জানুয়ারি, লাইব্রেরি, নানি, বাঙালি, সোনালি ইত্যাদি। কিন্তু 'বহুলপ্রচলিত' বলে তাঁরা হাত দেননি শ্রেণী, পল্লী, রানী, একাডেমী, নবী, বীমা, লীগ, স্পীকার, শহীদ ইত্যাদি বানানে। তবে ২০০৫ সালে এসে তাঁরা বললেন, খিস্ট ও খ্রিস্টান শেখানো ভুল হয়েছে, কারণ খিষ্ট ও খ্রিষ্টান বাংলায় 'আত্তীকৃত' হয়ে গেছে!
অন্যদিকে বাংলা একাডেমী/একাডেমি ১৯৯২ সালে তাঁদের প্রণীত বানানবিধিতে বহুল প্রচলনের ছাড় দিলেন না। তাঁরা করলেন শ্রেণি, পল্লি, রানি, নবি, বিমা, লিগ, স্পিকার, শহিদ ইত্যাদি; একাডেমী-কে বাইরে রাখলেন। ২০০৫ সালেও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বহুল প্রচলনের বিধি অপরিবর্তিত রাখলেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের শিক্ষাবিভাগ একাডেমী/একাডেমির বানানকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করায় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পিছিয়ে গেছে। তাই তাঁরা 'বহুল প্রচলনের' বিধি বাতিল করে একাডেমীর/একাডেমির 'শ্রেণি' ইত্যাদি বানান চালু করেছে পাঠ্যপুস্তকে।
এই যে ডামাডোল তাতে বানানবিদদের কারো পক্ষেই এখন বলা সম্ভব নয় তাঁরা কখন, কোনটা, কার জন্য, কেন করেছিলেন। বোর্ড ও একাডেমী দুটোরই বানানবিধি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছিলেন এমন একজন অধ্যাপকের সাথে কথা বলে এটা নিশ্চিত হয়েছিলাম। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এর থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে দুবছর গবেষক হিসাবে কাজ করেছিলেন; লিখে, চিঠি লিখে, বক্তৃতা দিয়ে নিজের মত ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু এখন বানানবিদেরা অনেকটা শীত-গ্রীষ্ম বুঝে কাজ করেন। তাঁরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে গিয়ে বোর্ডের চাহিদামতো করেন, বাংলা একাডেমী/একাডেমিতে গিয়ে একাডেমী/একাডেমির মতো করেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনে গিয়ে ফাউন্ডেশনের মতো করেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে মাদ্রাসা বোর্ডের মতো করেন, পত্র-পত্রিকা বা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাদের মতো করেন, এবং নিজের বইয়ে নিজের মতো করেন!
তারই সর্বশেষ ধারাবাহিকতায় এসেছে প্রথম আলো ভাষারীতি। এটা শুধুই 'হাউজ স্টাইল' নয়, তার চেয়ে 'একটু বেশি/বেশী'। কারণ তাঁরাও বানান বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত্ গ্রহণ করেছে যা বাংলা একাডেমী/একাডেমি থেকে পৃথক। যেমন একাডেমীর বানান ঈগল, একাডেমী, ক্ষেত, ঘণ্ট, চাষী, ঠাণ্ডা, দেশী, নিশ্বাস, বন্দি (আটক অর্থে), মূলা, ইত্যাদি ভাষারীতির বানানে হয়েছে ইগল, একাডেমি, খেত, ঘন্ট, চাষি, ঠান্ডা, দেশি, নিঃশ্বাস, বন্দী (আটক অর্থে), মুলা, ইত্যাদি।
বাংলা বানান ও লিপি-সংস্কারের এই যে প্রক্রিয়া এর প্রভাব বিষয়ে গোলাম মুরশিদ এক প্রজন্মের সাহিত্য থেকে আরেক প্রজন্মের পাঠকের বিচ্ছিন্ন হওয়াসহ কিছু ক্ষতিকর দিক চিহ্নিত করেছেন। ভয়ঙ্কর/ভয়ংকর সত্য হচ্ছে - এখন অধিকাংশ মানুষ ভাবে, একটা কিছু লিখলেই হয়। কিন্তু তারও চেয়ে ভয়ঙ্কর/ভয়ংকর ক্ষতি যেটা হয়েছে আমাদের জাতীয়তার দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতা ঘোষণার দ্বন্দ্ব, সমতল-পাহাড়ের দ্বন্দ্ব, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর দ্বন্দ্ব, সামরিক-বেসামরিক দ্বন্দ্ব, এনজিও-জিও দ্বন্দ্ব ইত্যাদির পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের মধ্যেই প্রবেশ করেছে ই-কার ঈ-কার, উ-কার ঊ-কার, বর্গীয় জ অন্তঃস্থ য, দন্ত্য ন মূর্ধন্য ণ, দন্ত্য স মূর্ধন্য ষ, ২১-২১শে ইত্যাদির দ্বন্দ্ব। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যেন মনে হয় ই-কার, উ-কার, বর্গীয় জ, দন্ত্য ন, দন্ত্য স, ২১, ১৬, ২৬ এগুলো প্রগতিশীল - অনেকখানি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের; আর ঈ-কার, ঊ-কার, অন্তঃস্থ য, মূর্ধন্য ণ, মূর্ধন্য ষ, ২১শে, ১৬ই, ২৬শে এগুলো প্রতিক্রিয়াশীল - রাজাকার-টাজাকার হবে! কি/কী বিশাল সামাজিক সময় ও শক্তি আমরা ব্যয় করে চলেছি কিছুই না করার কাজে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন