কবিতা ও গানে বাঙালির ভাষা আন্দোলন
একটি জাতির স্বকীয়তা প্রমাণ করে তার ভাষা। ভাষিক সংস্কৃতির সমৃদ্ধিই ভাষাগোষ্ঠীর একমাত্র পরিচয়বাহী। রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা ক্ষমতালোভীদের কূটচক্রান্তে এই ভাষা কিংবা ভাষিক জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ ও আন্দোলনই হয়ে থাকে সচেতন ভাষাগোষ্ঠীর স্বাধীন সত্তাকে জাগ্রত রাখার একমাত্র পথ। ভারত উপমহাদেশ জুড়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং তৎপরবর্তী সময় ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হলে তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে জুড়ে যায়। একমাত্র ধর্মের মিল ছাড়া একদেশভুক্ত দু’দেশের তেমন কোন মিল ছিলো না। না ভাষিক, না সাংস্কৃতিক। এমনই সন্ধিক্ষণে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর বিভিন্ন গণবিরোধী নীতি চাপিয়ে দেয় ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তান। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু করার নীলনকশা। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এক ভাষণে আবারো রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু করার ঘোষণা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথমে ওই নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেন। বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, সচেতন জনগণ ওই নীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্রদের হাতকে শক্তিশালী করতে তাদের সমর্থন দেন। রুখে দেয়ার ঘোষণা দেন বাংলা ভাষা নস্যাতের সকল ষড়যন্ত্র। ফলে অমানুষিক নিপীড়নের খড়গহস্ত নেমে আসে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর। শুরু হয় বাঙালি দমন ও নিধন প্রক্রিয়া। ভাষা রক্ষার দাবিতে সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া ভাষিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে আসে ঢাকার রাজপথে। তারা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। পুলিশ গুলি চালায় মিছিলে। নিহত হন তিনজন। পরদিন আবারো মিছিল। ২১ ফেব্র“য়ারির ওই মিছিলে গিয়ে পাকবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান রফিক, শফিক. বরকত, জব্বার, সালামসহ অনেক ছাত্র। ২৬ ফেব্র“য়ারি রাতে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। শাসকরা সঙ্গে সঙ্গেই ওই স্তম্ভ গুড়িয়ে দেয়। ক্রমে ক্রমে এ আগুন সম্প্রসারিত হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান দেশের প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিকগণ। লিখিত হতে থাকে একের পর এক প্রতিবাদী, স্মৃতিবাহী কবিতা। রচিত হতে থাকে অসংখ্য গান।
তবে ভাষা আন্দোলন শুরুর আগেও অবরুদ্ধ ভাষা নিয়ে কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ মাতৃভাষা আগ্রাসনের ওপর লিখিত একটি সার্থক কবিতা। আন্দোলন চলাকালে ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বসে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে কলম ধরলেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তিনি লিখলেনÑ ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি।’ মাহবুবুল আলম চৌধুরী লিখিত এই দীর্ঘ কবিতাটি একুশে ফেব্র“য়ারিতে ভাষার জন্য আত্মত্যাগকারী শহীদদের স্মরণে প্রথম এবং ভাষিক আগ্রাসনের ওপর লিখিত দ্বিতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।
‘যে শিশু আর কোনোদিন তার পিতার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না
যে গৃহবধূ আর কোনোদিন তার স্বামীর প্রতীক্ষায় আঁচলে প্রদীপ ঢেকে দুয়ারে আর দাঁড়িয়ে থাকবে না
যে জননী খোকা এেেসছে বলে উদ্দাম আনন্দে সন্তানকে আর জড়িয়ে ধরতে পারবে না
যে তরুণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে বার বার একটি প্রিয়তমার ছবি চোখে আনতে চেষ্টা করেছিল
তাদের সবার নামে আমি শাস্তি দাবী করতে এসেছি।’
(কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি/ মাহবুবুল আলম চৌধুরী)
এরপর আন্দোলনকালীন সময়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ রচিত ‘ইটের মিনার ভেঙেছে, ভাঙুক/ একটি মিনার গড়েছি আমরা টারকোটি কারিগর/ বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণলেখায়।’ কবিতাটিকে দ্বিতীয় এবং ২৬ ফেব্র“য়ারি শহীদ মিনার ভাঙার দিনে লুতফুর রহমান জুলফিকার রচিত ৬৩ পঙ্ক্তির দীর্ঘ কবিতাকে তৃতীয় কবিতা হিসেবে ধরা হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন আর্য সভ্যতায় বসবাস করেও আর্য ভাষার বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তিনি অহিংসনীতি অনুসরণ করে স্থানীয় মুখের ভাষা ‘পালি’তে ‘ত্রিপিটক’ রচনা করে বিদ্রোহের জবাব দেন। ভাষিক বিদ্রোহের এ ধারা আমাদের বাংলা ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে বলেও অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। তবে সত্য এই যে, সংস্কৃতিগত মিল না থাকায় হাজার মাইলেরও বেশি ব্যবধানের একই রাষ্ট্রভুক্ত দু’বঙ্গের মানুষের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিলো। কারণ দু’বঙ্গে ছিলো দু’টি পৃথক জাতির বাস, পৃথক ভাষা। পূর্ববঙ্গে বসবাসকারীরা স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। আর এ ভাষা ছিলো বাংলা ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই বাংলা ভাষা, যার রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। প্রায় দু’শ বছর শাসনের পর ইংরেজরা যখন এ উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হন তখন অলীক এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা পূর্ববঙ্গের ওপর যে ভাষিক নিপীড়ন শুরু করেছিলেন তা থেকে মুক্তি পাওয়া ছিলো বাংলা ভাষাভাষীদের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। পরবর্তীতে বাংলাভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যে মৌল ভিত্তির ওপর আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে তা আমাদের প্রাণের ভাষা, বাংলা ভাষা। দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে কাব্যযোদ্ধারাও লিখতে থাকেন তাদের অমর পঙ্ক্তিমালাÑ
‘ফাগুন এলেই পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আশা
নাম দিয়েছি ভাষা, কতো নামেই ‘তাকে’ ডাকি
মেটে না পিপাসা।
(আসাদ চৌধুরী)
বস্তুত ইংরেজ শাসনামল থেকেই বাঙালি জাতি পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি হয়ে পড়ে। বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা পরনির্ভরশীলতার ফাঁদে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলন তীব্রতর হয়। এদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়নের পর বলতে গেলে মানচিত্রে পেন্সিলের রেখা টেনে ভারত ভাগ হয়। তখন সে অলীক রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গ নামের বাংলাদেশকে একটি পরমুখাপেক্ষী অঞ্চলে পরিণত করা হয়। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয় গণতন্ত্রের মূলভিত্তিকে। উপরন্তু বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতি। ফলে ঐতিহাসিক ২১ ফেব্র“য়ারি বাঙালির মানসলোকে সবল, স্বতঃস্ফূর্ততা ও সত্য নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। আর এই ভাষিক আন্দোলনে গণমানুষকে উজ্জীবিত করাÑ সাহসী করার শুদ্ধ উচ্চারণ এভাবেই উঠে আসে কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতেÑ
‘ওরা আমার মুখের কথা
কাইরা নিতে চায়।
ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায় ॥’
(আবদুল লতিফ)
দেশব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক-জনতাকে ভাষিক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে লিখিত হতে থাকে গান। গান একটি শ্র“তি মাধ্যম। গান দিয়ে অতি সহজে মানুষের মননের কোষে ঝংকার তোলা যায়Ñ চেতনা জাগানো সম্ভব হয়। যে কারণে বাঙালির ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন নিয়েও রচিত হয়েছে অনেক গান। গানের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা। যশোরের কবি শামসুদ্দিন আহমদ রচিত ‘ভুলব না ভুলব না, ভুলব না আর একুশে ফেব্র“য়ারি ভুলব না’ গানটি ভাষার জন্য আত্মদানকারী শহীদদের ওপর প্রথম রচিত গান। তবে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত গানটিই বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্র“-গড়া এ ফেব্র“য়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্র“য়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি ॥’
(আবদুল গাফফার চৌধুরী)
মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। অঞ্চলভেদে মাতৃভাষার পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু রাষ্ট্রভাষার পরিবর্তন হয় না। আর্ন্তজাতিক ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব থাকলেও আমাদের দেশে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয়েছে সেটুকুুই আজ আমাদের বাঙালি জাতির সামনে এসে হাজির হয়েছে।
পরিশেষে এটুকু বলা বাহুল্য হবে না যে, বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের পরিচয়ের সার-সত্য অনিবার্যভাবেই একুশে নিহিত। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষার্থে অকাতরে জীবন বিসর্জন দেয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল, যার একমাত্র দাবিদার বাঙালি জাতি। যে কারণে বাংলা ভাষা আজ সর্বজনীন ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৯ সাল থেকে ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্র“য়ারি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে। বাংলাদেশ আমাদের জন্মের অহঙ্কার। বাংলাভাষা আমাদের বেঁচে থাকার অলঙ্কার। জাতির ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় রচিত কবিতা ও গানে আত্মমুক্তির যে ঋদ্ধ উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছিলো, বুদ্ধিবৃত্তিক যে ধারা সম্প্রসারিত হয়েছিলো কাব্যচেতনার তা এখনো বহমান। বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের নাম যেমন স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে তেমনি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাও জাগরুক থাকবে চিরকাল।
বীরেন মুখার্জী
কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও সাংবাদিক
সম্পাদক : দৃষ্টি (শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ)
সহ-সম্পাদক,সম্পাদকীয় বিভাগ
দৈনিক যায়যায়দিন, তেজগাঁও, ঢাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন